রেজা তানভীর
২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে শেখ হাসিনা কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেছিলো- আরেকটি প্রকৃত নির্বাচন শিগগিরই হবে। সে কথা তিনি রাখেননি। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, আমি জাতির পিতার কন্যা আমাকে বিশ্বাস করুন। তিনি দিনের ভোট রাতে করে সে বিশ্বাসের জবাব দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে স্ব-ঘোষিত ‘ডামি’ ভোট করে আত্মপ্রতারণার মহড়া প্রদর্শন করেছিলেন। এরপরের ইতিহাস আরো করুণ, আরো নির্মম।
হিটলার মুসোলিনিরা রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। শেখ হাসিনা রীতিমতো গণহত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। যে নির্মমতা ও পাশবিকতা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ জনগণের রুদ্ররোষে এমনিই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সাধারণভাবে স্বাভাবিকভাবে কেউ আওয়ামী লীগের কথা প্রকাশ্যে বলার স্পর্ধা রাখেনি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই গণঅভ্যুত্থান শক্তি বিভাজনের সুযোগে তারা কচ্ছপের মতো মুখ বের করার চেষ্টা করে। এতে বিরোধী শক্তির প্রাণহানিও ঘটে। ১৫ বছর ধরে যে দীর্ঘ রক্তপাত তারা করেছে, তার জন্য তাদের নেতানেত্রীদের কোনো অনুশোচনা নেই। বরং মাঝেমধ্যে উদ্ভট উচ্চারণ করে তারা জনগণের এতটাই ক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে যে, ৩২ নম্বরের একটি ইটও অক্ষত থাকেনি। অবশ্য সমাজে না থাকলেও রাষ্ট্রে তাদের যে লোকজন এখনো ঘাপটি মেরে আছে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ তার প্রমাণ। সেলিনা হায়াত আইভী আওয়ামী লীগ করেন- সেটি মনে রাখতে হবে। তিনিও নানাভাবে মানুষকে নিগ্রহ করেছেন।
লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়,
“১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ যেভাবে উৎখাত হয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগও ২০২৪ সালে দেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। মনে রাখতে হবে একটা দেশে কেন গণঅভ্যুত্থান হয়? সরকার পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়মিত থাকলে তো আর অভ্যুত্থান হয় না। আওয়ামী লীগ সেই ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে পিটিয়ে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। এর ফলে ফ্যাসিবাদ পরিবর্তনের তাগিদ জনগণ অনুধাবন করে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনটা ছিল স্ফুলিঙ্গের মতো। জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটার মধ্যে পড়ে দাবানল সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগের পতন হলো। আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারে এ সম্ভাবনা আর নেই। মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ উৎখাত হয়ে গেছে। ইতিহাস আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে।”
১৯৭৫-এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পতন হওয়া বাকশালরূপী আওয়ামী লীগ ২১ বছরে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছিল যেসব কারণে, সেগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক।
প্রথমত ‘৭৫-এ আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় এবং বাকশালে হারিয়ে গেলেও মুজিব পরিবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘ভিকটিম কার্ড’ খেলতে থাকেন হাসিনা এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি বিশাল মধ্যবয়সি এবং তরুণ প্রজন্ম মাঠে সক্রিয় ছিল। আজকে তিনি দীর্ঘ অত্যাচার, অবিচার, গুম-খুনের নেতৃত্ব দেওয়ার ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০২৪-এর গণহত্যার এক নিষ্ঠুর খলনায়িকা।
দ্বিতীয়ত ২০২৪-এ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল ‘ভোট ও ভাতের রাজনীতি’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মতো গালভরা বয়ান নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে। এ মুহূর্তে প্রতিশোধ ছাড়া অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই আওয়ামী রাজনীতির, যা হাসিনা নিজেই প্রমাণ করে গেছেন।
তৃতীয়ত, এবারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি এবং জনগণের সব ধরনের অধিকার পদদলিত করে আওয়ামী রাজত্ব বাংলাদেশের আপামর জণসাধারণকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করে দলটি থেকে। সেই মানুষই সে রকম দলকে রিব্র্যান্ডিং হলেও খুব সহজে বিশ্বাস করবে, এমন আশা দুরাশামাত্র।
চতুর্থত, আওয়ামী লীগ অস্বীকার করতে পারবে না যে, এর নেতৃত্ব ক্ষমতায় টিকে ছিল ভারতীয় আশীর্বাদে এবং তারা সেবাও করেছে ভারতকে। দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে পুরো একটি তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘দিল্লি-আওয়ামী লীগ মৈত্রী’ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হিসেবে চিহ্নিত। তাদের নতুন দল এই লিগ্যাসির বাইরে যাবে কী করে? দিল্লি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে সে প্রমাণই দিল।
আওয়ামী লীগ আর কখনো রাজনীতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না বলে মনে করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীরা। দেশের মানুষকে জিম্মি করে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে দলটি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। দলটি মনে করত, তাদেরই শুধু ক্ষমতায় থাকার অধিকার আছে। আর কারো নেই। দেশের মানুষকে যা ইচ্ছে তা করার স্বাধীনতা তাদের কে দিয়েছে? মানুষকে তারা মানুষ মনে করত না। যার ফলে তাদেরকে আজ সদলবলে পালাতে হয়েছে।
আওয়ামীলীগের শেষ পরিণতি মুসলীম লীগের পরিণতিই হবে।
চমৎকার একটি আর্টিকেল।
যথার্থ মূল্যায়ণ! আসলে আওয়ামীকে শেখ মুজিবর রহমানই কবর দিয়ে গেছেন। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সেটা পুনঃজন্ম হয় এবং শেখ হাসিনা সেটাকে ফ্রান্ককেস্টাইন তৈরি করে। সেটি আবার হাসিনাকে সহ পুরো দলটিকে খেয়ে দিলো। আগামি ২৫ কিংবা ৫০ বছরেও এটি আর ফিরতে পারে বলে মনে হয় না!