spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধনজরুলের 'দারিদ্র‍্য' : শিল্পের সানাই

লিখেছেন : আমিনুল ইসলাম

নজরুলের ‘দারিদ্র‍্য’ : শিল্পের সানাই

আমিনুল ইসলাম

মহাবিশ্বের যা কিছু খালি চোখে দৃশ্যমান, সেসব সবাই কমবেশি দেখে থাকে। কিন্তু সকলের দেখা অভিন্ন হয় না। গভীরতা ও মাত্রার পার্থক্য থাকে। আর যেসকল বিষয় বিমূর্ত, যেসব দেখতে হয় অনুভবের দৃষ্টি দিয়ে,- তারসাথে বিনিয়োগ করে খানিক সৃজনমুখী কল্পনা, সেখানে দৃষ্টিসফলতা লাভ করে শুধুমাত্র অসাধারণ ও অনন্য দৃষ্টির অধিকারী সৃজনশীল মানুষেরা । সেধরনের সৃজনশীল মানুষদের মধ্যে কবিরা অগ্রগণ্য। অবশ্য যাপিত জীবনের উঠোন ও পরিবেশও একটা ভূমিকা পালন করে থাকে কোনো ঘোষণা না দিয়েই। সামাজিক ও পারিবারিক অঙ্গনে রাজত্ব করা অর্থনীতির খলনায়ক ‘দারিদ্র্য’ তেমনি একটি বিমূর্ত বিষয়। সেই দারিদ্র্যকে দেখেছেন অসাধারণ ও অনন্য ধরনের মেধাবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

জন্মগতভাবে সর্বোতমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম যাপিত জীবনে অর্জন করেছিলেন বৈচিত্র্যমুখী অভিজ্ঞান যার অনেকখানিই আনকমন ও অনন্য। তাঁর কবিতায় ও সংগীতে সেই অনন্যতার ছাপ ফলে উঠেছে সোনালি রঙের সচ্ছলতায়। তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি যাপতিজীবন ও ব্যতিক্রমী শৈল্পিক সক্ষমতার উজ্জ্বলতর শিল্প হয়ে আছে। কবিতাটি তার সুচারুতায় সমৃদ্ধ শিল্পের জমিনে ধারণ করেছে দারিদ্র্যের নিবিড়তম, গভীরতম ও সূক্ষ্ণতম ছাপ। অর্থনীতিবিদরা বহুদিন যাবৎ দারিদ্র্যের নানাবিধ সংজ্ঞা প্রদান এবং সীমা-পারসীমা নির্ধারণ করে আসছেন। সেসব সংজ্ঞায় মূলত দারিদ্র্যকে খাদ্যগ্রহণের ক্যালরি এবং কতিপয় মৌলিক চাহিদা পূরণের-অপূরণের মাপকাঠিতে চেনানোর চেষ্টা আছে। নজরুল সেটাকে হিসাবে রেখে তার সঙ্গে দারিদ্র্যের আরো কিছু ডাইমেনশন যোগ করেছেন। কবিতার শুরুতেই তিনি বলেছেন যে- দারিদ্র্য মানুষকে সত্য কথা বলার দুঃসাহস জোগায়, দান করে অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস । দারিদ্র্যের প্রভাবে তার মুখের কথা এবং লেখার বাণী ক্ষুরধার তরবারির ন্যায় শানিত হয়ে ওঠে। দরিদ্র মানুষেরা নির্ভীকভবে সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারেন, তারা ন্যায়ের সংগ্রমে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। তাঁদের কেনো পিছুটান থাকে না। কিন্তু যাদের ধনসম্পদ বেশি থাকে, তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংগ্রামে শরিক হতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জমিদার নন্দন-ধনবান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-জোতদাররা অংশগ্রহণ করেননি বলেই চলে। কারণ, তাদের ধনসম্পদ এবং আয়েশী জীবনের পিছুটান ছিল। কিন্তু ছাত্র-কৃষক-দিনমজুরদের সেই পিছুটান ছিল না। তাই সেসব সংগ্রামে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপকভাবে বেশি। এভাবে দারিদ্র মানুষকে ব্যক্তিগত পিছুটান ফেলে মহত্তর ও বৃহত্তর কাজে শরিক হওয়ার প্রণোদনা দান করে, প্রেরণা জোগায়। নজরুল তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতার শুরুতেই তাই বলেছেন,

হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা!-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার।

কিন্তু এই প্রশংসার ভেতরেই দারিদ্র্যের নেতিবাচক দিক স্পষ্ট। ‘কণ্টক-মুকুট ’ কিন্তু রাজার মুকুটের মতো পুষ্পশয্যার সুখ দেয় না, তার কাজ নিত্যযন্ত্রণাদান। আর বীণা যখন অভিশাপে তরবারি হয়ে যায়, তখন যুদ্ধ করাই হয়ে ওঠে নির্মম নিয়তি। যাকে সারাজীবন যুদ্ধ করতে হয়, তার জীবন আঘাতের ও রক্তপাতের, বিশ্রামহীনতার ও স্বস্তিহীনতার। সেজীবনে সুখ থাকে না। নজরুল এখানে দারিদ্র্যকে রোমান্টিক মন নিয়ে মহিমান্বিত করেননি।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’—ঈশ্বরী পাটনীর এই চাওয়া সকল জননীর প্রত্যাশা ও প্রার্থনার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি পিতামাতা চান তার সন্তান যেন দুধেভাতে থাকে কিন্তু দুধভাত সংগ্রহে রাখার সামর্থ্য গরীব মানুষের থাকে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একজন অনাহার ক্লিষ্ট অর্থাৎ দারিদ্র্যপীড়িত মা তার দুধের শিশুকে বুকের দুধ দিতেও ব্যর্থ হন। কারণ, খাদ্যের অভাবে শীর্ণ-জীর্ণ শরীরে বুকের স্তনে মাতৃদুগ্ধ সঞ্চিত হয় না। নজরুল দারিদ্রের এই সূক্ষ্ণ নিবিড় ভয়াবহ রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং কবিতায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন অপরিসীম বেদনাভরা ভাষায়। নজরুলের কবিতা পড়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে মধ্য-এশিয়া-আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত, যুদ্ধকবলিত দারিদ্য-পীড়িত অনাহার ক্লিষ্ট জননী এবং হাড্ডিসার শিশুর অগণিত ছবি।

চলে পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ-তনু,
কী দেখি বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি, রুদ্র হান অশ্রুবান
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান
প্রমোদ কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা
তোমার আইনে শুধু মৃত্যুদণ্ড-লিখা!

এই দুর্ভিক্ষকবলিত মহামারিগ্রস্ত বড়ো আকারের ছবি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় সহজেই। সংবাদপত্র টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং সাংবাদিকগণ তাঁদের পেশাগত স্বার্থে হলেও এসকল ছবি নিয়ে কাভার স্টোরি বানিয়ে প্রচার করে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগত দারিদ্র্য অংকুরে বিনষ্ট করে দেয় বহু জীবন-রাষ্ট্রের অগোচরে, সবার অলক্ষে। ঐসব ব্যক্তিগত দারিদ্র্যের ভয়াবহ রূপ এবং তার দংশনে মৃতপ্রায় মানুষের ছবি তোলে না কেউ, সেসব ছবি কাভারেজ পায় না মিডিয়ায়। নজরুল ছিলেন সর্বহারাদের কবি, শোষিত-বঞ্চিতদের কথাশিল্পী, সর্বশ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার। তিনি সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশেছেন গভীরভাবে নিবিড়ভাবে। তিনি বৃহত্তর দুর্ভিক্ষ যেমন দেখেছেন, ততোধিক গভীর দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন সমাজের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষদের। নজরুল তারও আগে দারিদ্র্যের আরও নিবিড় রূপ লক্ষ করেছেন- যেখানে দারিদ্র্যের কবলে পড়ে শুকিয়ে যায় মায়ের স্তন, সন্তান পায় না বেঁচে থাকার মাতৃদুগ্ধ।

কথায় বলে,- অভাব দুয়ারে দাঁড়ালে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। শূন্য হাতে কোনো কিছুই করা যায় না। সুখও আসে না শূন্য ঘরে । ঘরে থাকা সুখ ঘর শূন্য হওয়া মাত্র দৌড় দিয়ে পালায়। অভাব মানেই অতৃপ্তি, অ-সুখ, অশান্তি। দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহে অপরাধ সংঘটিত হয় বেশি। বিরাজ করে অস্থিরতা। দরিদ্র পরিবারেও অশান্তি ও ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে নিত্য। মানুষের সুখী হওয়ার জন্য প্রাচুর্যের দরকার হয় না। তবে সচ্ছলতার প্রয়োজন হয় অপরিহার্যভাবেই। পেটে ভাত না থাকলে মিষ্টি কথা শুনে ভালো লাগে না। ক্ষুধাক্লিষ্ট প্রাণে কোনো শান্তি দিতে পারে না মধুর সংগীতও । বলা হয় যে, বাসরঘর হচ্ছে সবচেয়ে সুখের স্থান, বাসররাত হচ্ছে সবচেয়ে মধুর সময়। কিন্তু দারিদ্র্য প্রবেশ করলে একটি দাম্পত্য জীবনে, বাসররাতে শুরু হওয়া মধুর জীবনের সহসায় ছেদ পড়ে। ক্ষুধাপীড়িত শরীরে মধুর মিলনের স্বাদ আস্বাদন করা অসম্ভব। মানুষের সংসারে দারিদ্রের ভয়ংকর ও সর্বনাশা প্রভাবের কথা উপস্থাপন করতে গিয়ে নজরুল তাঁর দারিদ্র ভাবনাকে নান্দনিকতার শিখর স্পর্শ করিয়েছেন । তিনি বলেছেন দারিদ্র্য হচ্ছে দুর্বাষা ঋষি, যে ক্ষমাহীন এবং যার চোখ যেখানেই পড়ে সেখানেই অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় সব শান্তি-সুখ-স্বপ্ন:‘—পড়ে হাহাকার/ নিমিষে সে স্বর্গসুখে, নিবে যায় বাতি, /কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি।’

দারিদ্র্যের দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়াগুলো সমাজবজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদগণ লক্ষ করেন এবং এসব নিয়ে তারা নানা গবেষণাকর্ম প্রকাশ করে থাকেন। এসব করে তারা খ্যাতি , যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি , পুরস্কার লাভ করে থাকেন। কিন্তু দারিদ্র্যের শারীরিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও একটি ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দারিদ্র্য মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথে মারাত্নক বাধা হিসেবে কাজ করে। প্রতিভা এবং উচ্চাশা থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাবে বহু প্রতিভাধর মানুষের প্রতিভার অকালমৃত্যু ঘটে। বেঁচে থাকার জন্য দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই যাকে ব্যয় করতে হয় সমস্ত সময় ও সামর্থ্য, তার পক্ষে তো নান্দনিক সৃষ্টির সাধনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না । সুন্দুরের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে পারেস না তিনি। অধিকন্তু দারিদ্র্য মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ঘটায় তাকে অন্নমুখী ভাবনায় তাড়িত করে। আর দারিদ্র মানুষের নান্দনিক চেতনাতেও পরিবর্তন ঘটায় । রোমান্টিক কবিশিল্পীরা যেভাবে আকাশচারী হন, দারিদ্র্য জর্জরিত একজন কবির পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি আকাশে উড়তে গিয়ে ফিরে আসেন মাটির কাছে,- জীবনের মাঝে। অধিকাংশ সময় মানুষের মেধার রস শুকিয়ে যায়, দারিদ্র্যের খরতাপে । কত যুবক-যুবতি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় দারিদ্র্যের চাপে পড়ে, তার হিসাব লিখে রাখে না কেউ। দারিদ্র্য মানুষের প্রতিভা বিকাশের পক্ষে বিরাট অন্তরায়। দারিদ্র্য মানুষের সুখের শত্রু। দারিদ্র্য মানুষের ভালো কাজের পথে অলঙ্ঘ্যনীয় অন্তরায়। মানুষের মেধা, মাননীলতা ও সৃজনশীলতার ওপর দারিদ্র্যের এই মারাত্নক প্রভাবের বিষয়টি কোনো অর্থনীতিবিদের গবেষণায় ধরা পড়ে না। অমত্য সেনদেরও চোখ পড়ে না এখানে । কিন্তু নজরুল তাঁর গভীর নিবিড় সূক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এ জায়গাগুলো দেখেছেন এবং নান্দনিক অলংকার সহযোগে উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়-

‘বেদনা-হলুদ-বৃত্ত কামনা আমার
শেফালির মতো শুভ্র-সুরভি-বিথার
বিকশি উঠতে চাহে, তুমি হে নির্মম
দল বৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মতো ছলছল
করে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল
টলটল ধরণীর মত করুণায়
তুমি রবি তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নিহার বিন্দু! ম্লান হয়ে উঠি
ধরণীর ছায়াতলে।’

কবি-শিল্পী-ভাস্কর প্রভৃতি সৃজনশীল মানুষের কাজ কোনোকিছুকে বহুকৌণিক সৌন্দর্যে উপস্থাপন এবং পুরাতন সুন্দরের শরীর নতুন আলো ফেলে তাকে নতুন সৌন্দর্যে পুনঃসৃষ্টি করা। আর এটা করতে হলে প্রয়োজন হয় নিরুপদ্রুব সময় । একাগ্রচিত্তে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়ে সৃজনশীল মানুষ তুলে আনেন সৌন্দর্যের আশ্চর্য কোটা। কিন্তু দারিদ্র্য মানুষকে নিত্য জ্বালাতনের মধ্যে রাখে বলে সেই একনিষ্ঠ গভীর মনোনিবেশ ঘটানোর সময় হয় না। তাই গরিব শিল্পীর পক্ষে অমরার অমৃত সাধনা করার সময় ও সুযোগ হয় না বললেই চলে। কপালে ‘বেদনার টীকা’ নিয়ে তাকে ‘কাঁটাকুঞ্জে বসে ’ মালিকা গেঁথে যেতে হয়। তাপস-সন্ন্যাসীর মতো দারিদ্র্যের রসবৈরী স্বভাব। সৃজনশীল মেধা এবং সৃজনশীল চর্চার ওপর দারিদ্র্যের এই অভিঘাতকে চিহ্নিত করে নজরুল তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় বলেছেন,

দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস
অম্লান স্বর্গেরে মোর করিলে বিরস
অকালে শুকালে মম রূপ-রস-প্রাণ
শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই–হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক, আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ।

‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি শিল্পের সুষমায় সমৃদ্ধ, নান্দনিক উপভোগ্যতায় অনিঃশেষ। কবিতায় অভিনব ধরনের উপমা, চিত্রকল্প, প্রতিতুলনা ও মিথ্যের ব্যবহার ঘটেছে। ‘কণ্টক-মুকুট শোভা’- কী সুন্দর একটি প্যারাডক্স! কবিতায় দারিদ্র্যকে খরার সূর্য, বিষধর ‘নাগ-নাগ বালা’, ক্ষমাহীন দুর্বাসা ঋষি, ধুতুরা-গেলাস প্রভৃতি উপমায় তুলিত করা শৈল্পিক অভিনবত্বের স্বাক্ষর। কবিতাটিতে অনেকগুলো অভিনব অথচ জুতসই ও শৈল্পিক সৌন্দর্যমাখা চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে। বলা চলে পুরো কবিতাটিই অভিনব চিত্রকল্পের কোলাজ। সিংহাসনে আসীন কণ্টক-মুকুট শোভিত যন্ত্রণাবিদ্ধ রাজা, বেদনার টিপ কপালে পরে কাঁটাকুঞ্জ বসে মালিকা গাঁথা, সারা অঙ্গে দারিদ্র্যরূপী বিষধর সাপকন্যার দংশন নিয়ে গান গাওয়া, খাদ্যের অভাবে স্তন শুকিয়ে ওঠা জননীর কাছে ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না, দারিদ্র্যের বিষশ্বাসে
মিলনরাতের স্বর্গসুখের বাতি নিভে গিয়ে তা কালরাত্রিতে পরিণত হওয়া প্রভৃতি চিত্রকল্প বাস্তব ও কল্পনা, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, আক্ষরিক অর্থ ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা এসবকিছুু নিয়ে শিল্পসৌন্দর্যে অভিনব ও অনন্য। কবিতায়দারিদ্র্যের অন্তরঙ্গ ভয়ংকর রূপ প্রকাশে দারিদ্র্যকে সম্বোধন করে ব্যবহৃত আরেকটি চিত্রকল্প বিস্ময়করভাবে সমৃদ্ধ, সুন্দর ও সার্থক:

লক্ষ্ণীর কিরীটি ধরে ফেলিতেছ টানি’
ধূলি-তলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যতসুর অর্তনাদ হয়ে ওঠে শুনি!

এ কবিতায় মুখস্থযোগ্য ম্যাজিক লাইনের ছড়াছড়ি। ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’, ‘তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দ- লিখা!’, ‘বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ’, ‘বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার।’, ‘ধরণী বিলাসকুঞ্জ নহে নহে কারো’, ‘তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান’, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’, ‘উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু’, ‘সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!’, ‘আমার নয়ন আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!’, ‘দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগ বালা!…’ প্রভৃতি চরণ অর্থব্যঞ্জনায় ও ঝংকৃত সৌন্দর্যে উপভোগ্য মধুরতায় অনিঃশেষ। ‘বিনয়ের ব্যভিচার’ শব্দের এমন নির্মাণ ও প্রকাশ নুতন এবং অনন্যসুন্দর। ‘বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ / তুমি চাহ নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।’— শব্দে শব্দে এ এক অভূতপূর্ব খেলা,– অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের এক অভিনবসুন্দর কাব্যিক প্রকাশ।

পঙক্তিতে পঙক্তিতে অন্ত্যানুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাস ইত্যাদি নানা রকমের অনুপ্রাসের ঝংকার ও অনুরণন পুরো কবিতাটিকে ছন্দময় ও সুরময় ব্যঞ্জনার মাধুর্যে ভরে তুলেছে।  ” জ্বালা নাই, নেশা নাই, নাই উন্মাদনা—/ রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা ” কিংবা ” গাহি গান, গাঁথি মালা, কণ্ঠ করে জ্বালা/ দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগ বালা!….”  — প্রভৃতি চরণ উচ্চারণের সাথে ঝরনার ছন্দ এবং বাদ্যযন্ত্রের সুর বেজে ওঠে।

দারিদ্র্য মানেই হাহাকার; দারিদ্র মানেই বেদনা; দারিদ্র্য মানেই বিড়ম্বিত সামাজিক অবস্থান; দারিদ্র্য মানেই নিরানন্দে কণ্টকিত পৃথিবী। দারিদ্র্যের মতো এমন একটি দাহনগর্ভ বিষয়,– দারদ্র্যিপীড়িত দিনরাত— এমন একটা যন্ত্রণাদায়ক যাপন নিয়ে কোনো রোমান্টিক কবিতা লেখা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য নিয়ে সুখভাবনার কবিতা লিখলেও তা হবে বাস্তবতাকে এড়িয়ে অলীক কল্পনার শিল্প। দারিদ্র্যকে নিয়ে গান রচনা করা হলে সেই গানের সুর হবে বেদনার ব্যঞ্জনায় ভরা। বেদনার ব্যঞ্জনার সুর সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে সানাই বাদনে। মহাসংগীতকার নজরুল বিষয়টি আর দশজন কবির চেয়ে ভালো জানতেন, বেশি জানতেন। কবিতা যেমন বিষয়ের জুতসই উপস্থাপনা তেমনি তা শৈল্পিক
সৌন্দর্যেরও শিল্প। নজরুল তাঁর ‘দারিদ্র্র্য’ কবিতায় জীবন ও শিল্প, বাস্তব ও কল্পনা, আলো ও ছায়া– এসবকিছুকে একাকার সংশ্লেষে ধারণ করেছেন। সুদক্ষ শিল্পীর সাফল্যে তিনি তিনি দারিদ্র্যকে ছন্দে, তালে ও সুরে বাঁধার জন্য সানাইকে বেছে নিয়েছেন। কবিতার পঙক্তিগুলো সানাই বাদকের অধর স্পর্শে হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জন্য বেদনার ব্যঞ্জনা, গতিময়তার ছন্দ আর পরিস্ফুটনের শিহরন নিয়ে সবধরনের ও সবখানি যোগ্যতা ধারণ করেছে।

শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।’

কাজী নজরুল ইসলাম দারিদ্র্যকে সকল সুপ্রাপ্তির ও সুপ্রত্যাশার পথে অলঙ্ঘনীয় বাধা হিসেবে দেখেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন। মানুষ পরিশ্রম করে এই আশায় যে আসবে সুফল। মানুষ স্বপ্ন দেখে এই আশায় রাঙা সকালে তা পরিণত হবে বাস্তবে। মানুষ পরিকল্পনার নদীতে নামে এই আশায় যে সাঁতার শেষে উঠবে বাস্তবায়নের কূলে। মানুষ প্রেম করে এই প্রত্যাশায় যে চাওয়ার পথ একদিন মিলবে মিলনের উঠোনে। মানুষ সংসার বাঁধে এই সুখ-কল্পনায় ভরা বুক নিয়ে যে সামনের সকালে উঠোন জুড়ে খেলা করবে সুখের শিশু। কিন্তু যেসকল ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিরাজ করে অথবা মাঝপথে এসে উপস্থিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে আশা-প্রত্যাশা-স্বপ্ন-সুখকল্পনা-পরিকল্পনা বার্লিন প্রাচীরের চেয়েও কঠিন বাধার সৃষ্টি করে। যার আসার কথা সে আসে না, যার ফোটার কথা সে ফোটে না, যার বাঁশি বাজানোর কথা তার ঠোঁট নিস্ক্রিয় থেকে যায়। তখন উঠোন ভরে বেজে ওঠে আশাভঙ্গের বেদনার সুর। সে সুর বাজায় স্বয়ং দারিদ্র্য হাতে নিয়ে অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র: সানাই। কাজী নজরুল ইসলাম ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় এমন একটি নিবিড় ব্যঞ্জনাময় চিত্রকল্পের উঠোন সাজিয়েছেন দক্ষ হাতে।

প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?’

‘দারিদ্র্য’ কবিতা দেখাচ্ছে: দারিদ্র্যগ্রস্ত জীবন দুর্বিষহ। অস্তিত্ব ঘিরে নানাবিধ যন্ত্রণা। জীবন হয়ে যায় শূন্য। এই শূন্য জীবন বড়ই দুর্বিসহ। এ ধরনের জীবন বয়ে চলা বড়ই কঠিন। উৎসব আসে পৃথিবীতে; দরিদ্রের ঘরে তা প্রবেশ করে না। ঋতু বদল হয় প্রকৃতিতে; দরিদ্রের মনে লাগে না বসন্তের রঙ। সিংহাসনে বসে নতুন রাজা; অভিষেক উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে রাজ-প্রসাদ; কিন্তু দরিদ্রের ঘরে শুধু নাই নাই কান্না। দারিদ্রকে নিজের চোখের জল নিজেই পান করতে হয়। তার জন্য থাকে না কোনো শরবত , কোনো উৎসবের মদ । তার জন্য গ্লাসভরতি ধুতুরা বিষের পানীয় আর চারপাশে ‘নাই নাই’ হাহাকার । দারিদ্র্যের অপর নামও ‘নাই নাই’ । ঘরে চাল নাই । পেটে ভাত নাই। পরনে কাপড় নাই। রোগে চিকিৎসা নাই। কর্মহীন সময়ে বিনোদন নাই । অনাহারী শিশুর মুখে হাসি নেই । প্রেয়সীর চোখে অনুরাগের কাজল নাই। ভালোবাসার সময় নাই । সৃজনশীল চর্চার সুযোগ নাই। অমরত্ব লাভের রাবীন্দ্রিক সাধনা নাই। যতক্ষণ দারিদ্র , ততক্ষণ সকল অবস্থায় শুধু ‘নাই নাই’ হাহাকার । সূর্য অস্ত যায়। নতুন সুর্য ওঠে। রাজা যায়।রাজা আসে। শীত যায় বসন্ত আসে। আর হরমৌসুম দরিদ্র ঘরে অপরিবর্তিত শোচনীয় শূন্যতাময় অবস্থা।
‘আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই/ ও যেন কাঁদিছে শুধু নাই কিছু নাই।’ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই রাধার কণ্ঠ হয়ে ‘মোহে পানঘাটপে নন্দলালা ছেড়ো গায়রে..’ বোলযুক্ত বেদনাকে ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর হাওয়ায় হাওয়ায়, সে বেদনার সুরতান মুগ্ধ করে দেয় সুরপিয়াসী শ্রবণ ও হৃদয়কে। নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি তেমনি করে দারিদ্র্যগ্রস্ত প্রাণের আকুলতাকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি মাখা অভূতপূর্ব নান্দনিকতায়।
—০০০—

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. “বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি মাখা অভূতপূর্ব নান্দনিক” লেখা হয়েছে, কবি নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতা নিয়ে। এমন করে কখনো ভাবিনি আসলে। এ কবিতা আবৃত্তির জন‍্য আমরা কতোভাবেই না পড়ি, মুখস্থ করি কিন্তু ভেতরের রহস্যলিপ্ত গভীর বেদনা ভারাক্রান্ত ইতিহাসের কথা কেউ চিন্তাও করি না। আমিনুল ইসলাম চিন্তার গন্ডির দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন, ধন্যবাদ।

    • আপনার পাঠোত্তর অভিমত আমাকে প্রাণিত করবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ গুণিজন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা