আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নগ্ন আকাংখার পরিণতি আমাদের একেবারে চোখের সামনে। ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনাও নয় এবং ভুলে যাওয়ার মতো সময়ও পার হয়নি। যারা নিজেদের রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি রাজনীতি সচেতন বলে দাবি করেন, তারাও যদি এরই মধ্যে মাত্র সাড়ে নয় মাস আগে দেশে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে, সেই ঘটনাগুলো বিস্মৃত হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে বলতেই হয় যে, জাতির ভাগ্যে আরও দু:খ-দুর্দশা অপেক্ষা করছে। দেশের ওপর বিশাল পাথরের মতো চেপে থাকা পূর্ববঙ্গ নামের ভূখণ্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে চরম, জঘন্যতম ঘৃণিত এক নিপীড়ক শাসকের হাতে অসংখ্য জীবনহানি ও চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণের বিনিময়ে জনগণের অর্জিত অভূতপূর্ব মুক্তির সাথে সাথে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রধান ও দায়িত্বশীল দল হিসেবে ভাবমূর্তি-সম্পন্ন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল — বিএনপি যে ধরণের আচরণ শুরু করে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। তারা প্রমাণ করছে. ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নে ‘যাহা আওয়ামী লীগ, উহাই বিএনপি’।
দলটির নেতাদের কাছ থেকে জনগণ আরও সংযম ও মিতাচার আশা করলেও তারা তাদের দায়িত্বহীন আচার-আচরণের মাধ্যমে দেশবাসীকে চরম হতাশ করেছেন। তারা ভুলেই গেছেন যে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাতে তাদের ভূমিকা প্রায় ছিলই না। তারা উলটো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং এ আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও একাধিক নেতা বলেছেন। কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর তারা এর কৃতিত্ব দাবি করতে ও সুবিধা নিতে কোনো বিলম্ব ও দ্বিধা করেননি।
বিএনপির মতো এত বড় একটি দল, যারা কয়েক মেয়াদে ক্ষমতার ছিল এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে হয়তো কিছু অভিজ্ঞতাও আছে, তাদের পক্ষে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দু:শাসনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আন্দোলন তো দূরের কথা, বলা চলে তারা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাশাসকে গায়ে আঁচ লাগতে পারে, এমন কিছুই করতে পারেননি। ফলে শেখ হাসিনা পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতায় গেড়ে বসেছিলেন এবং বিএনপি-জামায়াতসহ সকল বিরোধীদলের মুখ্য নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে। আওয়ামী লীগের দলীয় গুন্ডা-মাস্তানরা তো ছিলই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের পর্যন্ত দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহার করে শেখ হাসিনা তার রাজত্বের ভিত মজবুত করা, দলের নেতা ও সুবিধাভোগীদের রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনের সকল পথকে নিরাপদ করেছিলেন।
শেখ হাসিনার ক্ষমতার গনেশ পালটে যাওয়ার পর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করার আগে বিএনপির যখন উচিত ছিল ক্ষমতার মন্দির থেকে আওয়ামী লীগের পতনের পূর্বের সাড়ে ১৫ বছর পর্যন্ত সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যর্থতার কারণ মূল্যায়ন করে দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দেওয়া, তখন তারা চটজলতি ক্ষমতায় দখলের জন্য অন্তবর্তী সরকারের ওপর বালসুলভ চপলতায় চাপ সৃষ্টি করছেন। শুধুই কী চাপ সৃষ্টি? অন্তবর্তী সরকারের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে এই বলে প্রশ্নবিদ্ধ করছে যে, অনির্বাচিত অন্তবর্তী সরকারের এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো এখতিয়ার নেই, কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারই এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; ইত্যাদি। বিএনপিও যেহেতু অতীতে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে, অতএব আওয়ামী লীগের মতোই বিএনপির মাসলম্যানের কখনো অভাব ছিল না, এখনো নেই।
বিএনপির নেতাকর্মীরা অন্ধকার থেকে আলোতে বের হয়েই আওয়ামী লীগের অবৈধ অর্থ কামানোর ফেলে যাওয়া সকল উৎস — হাট-বাজার, বন্দর-টার্মিনালসহ, ঘাট-বালুমহল ইত্যাদিসহ জোরজবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, সেগুলো দখল করে ঢালাওভাবে চাঁদা আদায় করছে। যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এতদিন আওয়ামী লীগের প্রভাবের আওতায় ছিল অথবা আওয়ামী লীগকে চাঁদা দিয়ে তাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করতো, সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আগ বাড়িয়ে বিএনপির লোকজনকে তোয়াজ করছে। বিএনপির নেতা ও ক্যাডাররা যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, অপরের জমি, ব্যবসা ও ঘের দখল করছে। যেহেতু বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, অতএব তারা মাঠ ফাঁকা থাকলে অবৈধ সুযোগ-সুবিধার ভোগদখলে অভিন্ন আচরণ করে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শিক্ষা থেকে বিএনপি আদৌ কোনো শিক্ষা নেয়নি।
শেখ হাসিনার পলায়ন এবং আওয়ামী লীগের সামান্য কিছুসংখ্যক নেতা ও লুটেরা গ্রেফতার হয়েছে এবং অধিকাংশই দেশত্যাগসহ আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় বিএনপি সম্ভবত আওয়ামী লীগের ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাশূন্য একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তাদের ধারণা এবং ভয় হলো, অন্তবর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২০২৬ সালে জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা বলছে, ওই সময়ের মধ্যে ভিন্ন ধরনের দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে পারে, তাতে বিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে।
কী আছে এই ক্ষমতায়? বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর কোন নেতা অথবা কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে দেশ বা জনগণের জন্য কী করেছেন? তারা কী দেশে তাদের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র এসেছেন? তারা কী বিচার বিভাগকে স্বাধীন নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করেছেন? দেশে কী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? না, কোনোকিছুই হয়নি! দেশের সবকিছু স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তান আমলের গণতন্ত্রহীন অবস্থায় আছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশে কেউ কী শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনায় অন্য কাউকে বড় নেতা বলে মনে করে? তা না করা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের ব্যর্থতা এবং তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না বলে তার সমালোচনা করতে কেউ তাকে ছাড় দেয়না। তিনি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে বলেই নেতা হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সকল নিষিদ্ধ করে তার পছন্দের ‘সংসদীয় ব্যবস্থা’র কবর রচনা করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে বলে মুখে ফেনা তুলতেন, কিন্তু চারটি সংবাদপত্র রেখে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন। তিনি তার নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে প্রমাণ করেছেন যে তিনি যা বলতেন তা তিনি তার বিশ্বাস থেকে বলতেন না। তিনি মন ভুলানো কথা বলে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন তার পেছন পেছন গিয়ে অজ্ঞাত গহ্বরের অন্ধকারে আটকা পড়তে। সেই অন্ধকার থেকে জনগণ আজও মুক্তি পায়নি।
ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো ছিলই না। ছিটেফোটা উন্নয়ন যে হয়নি, তা নয়। নতুন কিছু শিল্পকারখানা হয়েছি, কিছু দালানাকোঠা নির্মিত হয়েছিল। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। এই তো। কিন্তু সেই স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণে অতীষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে শাসকগোষ্ঠী, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমে উঠতে শুরু করেছিল, তার ইতিবাচক দিক ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেতনা জাগ্রত হওয়া, যা পূর্ব বাংলা অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে থাকলে কখনো সম্ভব হতো কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই চেতনায় জাতি উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলে সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভে সফল হয়েছে।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের যা করা উচিত ছিল, তা তিনি করেননি তার ‘আমিত্ব’কে দেবতূল্য করে তোলার স্বার্থে। ১৯৭৪ সালে ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক খুশবন্ত সিং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তিনি শেখ মুজিব সম্পর্কে তার ‘অন ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ নামে গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে তার দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কথা বলেন। তার আশাবাদ সংক্রামক।” একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগের কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। তিনি ক্ষমতা অর্পণে অস্বীকৃতি জানান এবং এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক সমর্থকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি যখন-তখন সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেন।” অর্থমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদকে অপসারণ করার কারণ জানতে শেখ মুজিব যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, সে সম্পর্কে খুশবন্ত সিং বর্ণনা করেছেন, “তিনি রাগে জ্বলে উঠেন এবং টেবিল চাপড়ে উত্তর দেন, ‘গণতন্ত্রে মন্ত্রী নিয়োগ ও বরখাস্ত করা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এখতিয়ার। তিন বছরে আমি নয়জন বা দশজন মন্ত্রী পরিবর্তন করেছি। আপনার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন?’”
শেখ মুজিবুর রহমান তার দেবত্ব বজায় রাখতে দলে কোনো উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করা পছন্দ করেননি। তাজুদ্দিন আহমেদ সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হতে পারতেন। সে কারণেই হয়তো তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার দল বেছে নিয়েছিল তার নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনা। সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করে ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে দলকে দেশের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার তার ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হোক, অথবা পিতার জিনের প্রভাবেই হোক, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিতা শেখ মুজিবের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। তিনি তার নেতাকর্মীদের সন্তুষ্ট করতে তাদেরকে অবাধ ল্টুপাটের সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাদের সন্তুষ্ট করতে শেখ হাসিনা তার পিতার মতো যখন-তখন সিদ্ধান্ত পালটে ফেলতেন না। তবে তিনি তার পিতার ‘আমিত্ব’র উত্তরাধিকার পুরোপুরি নিজের মাঝে স্থাপন করেছিলেন। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অর্থহীনভাবে খড়গহস্ত না হয়ে এবং তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন ক্ষমতায় থাকার উগ্র মানসিকতা পরিহার করে দেশের উন্নয়নে মনোযোগ দিলে কাগজে কলমে উন্নয়ন খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা সঠিকভাবে ব্যয় করলে দেশ আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করার ফলে বাংলাদেশের পরে স্বাধীন হওয়া বেশ কটি দেশ উন্নয়নের সকল সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।
কিছু উঁচু অট্টালিকা, মেট্টোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল ইত্যাদি অবশ্যই উন্নয়ন, কিন্তু এগুলো প্রয়োজনের পাশাপাশি নান্দনিক উন্নয়ন। সময়ের সাথে এসব আসবেই। ‘আমি মোবাইল দিয়েছি,’ আমি টেলিভিশন দিয়েছি.’ আমি ইন্টারনেট দিয়েছি,’ এসব কথামালা কোনো সভ্য ভদ্র ও সুশাসকের দাবি হতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে বিশ্বের এমনকি অতি দরিদ্র দেশও এখন এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কিন্তু ওইসব দেশের শাসকরা এমন হাস্যকর বালখিল্য আচরণ করেন কিনা, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু তাই নয়, ‘অমুক’ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসতো না, পাকিস্তানের গোলাম হয়ে থাকতে হতো, এসব দাবির মধ্যেই বা কতটা যথার্থতা আছে!
বিশ্বের যেকোনো দেশের ইতিহাস পাঠে এটা সুষ্পষ্ট যে ওইসব দেশের দু:সময়ে জনগণকে সঠিক পথ দেখানোর অনিবার্য প্রয়োজনে জনগণের ভেতর থেকেই কেউ না কেউ বের হয়ে আসেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এমন নেতার আবির্ভাব ঘটে ‘সময়ের সন্তান’ হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের প্রায় ৭০টি ছোটবড় দেশ স্বাধীন হয়েছে, যার বেশি ভাগ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে অথবা জননেতাদের চুম্বন করে স্বাধীনতা দিয়ে যায়নি। প্রায় প্রতিটি দেশকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে অথবা বিদেশি শক্তির শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করতে হয়েছে। দেশগুলোর জনগণ অত্যাচার ও সবধরনের দলন-পীড়নের মধ্যেও এবং জানমালের বিপুল ত্যাগ স্বীকার করার পরও যখন তাদের অবস্থানে অটল থেকেছে, ঔপনিবেশিক শক্তিকে তখন পাততারি গুটিয়ে পালাতে হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা পৃথক দুটি সময়ে দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের ওপর তাদের দু:শাসন চাপিয়ে দিয়ে ভিন্ন দুটি প্রেক্ষাপেটে ভিন্ন ধরনে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছেন। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে এমনটি নাও হতে পারতো। এমনকি শেখ হাসিনা শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও রাতের ঘুম হারাম করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় এবং ভোরে ফজর আদায় করার পর পবিত্র কোরআন শরীফ তিলাওয়াত এবং তাসবিহ-তাহলিল করা সত্ত্বেও কোরআনের বাণীর মর্ম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শাসকদের ক্ষমতা দান ও ক্ষমতাচ্যুত করা সম্পর্কে কোরআনের আল-ইমরান সুরায় বলা হয়েছে : “হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করো, এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও; যাকে ইচ্ছা তুমি ইজ্জত দান করো, আর যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত করো। কল্যাণ তোমার হাতেই। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” তিনি নিশ্চয়ই এটা পাঠ করেছেন, কিন্তু ক্ষমতার জাঁকজমক ও ব্যক্তিগত দম্ভে আল্লাহর বাণীকে বিশ্বাস করেননি। ফলে তার ললাটের লিখন যা ছিল, তাই ঘটেছে। তিনি অপমানিত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন।
তার বিদায়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল — বিএনপি এবং অন্যান্য দেশকে আবারও একটি অরাজক পরিস্থিতি মধ্যে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার যে বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, তা শুভ কোনো ইঙ্গিতবহ নয়। অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের প্রধান তিন প্রতিশ্রুতি: (এক) কাক্সিক্ষত সংস্কার সাধন, (দুই) বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের আমলে হত্যা, গুম, অপহরণ, লুণ্ঠনসহ যেসব অপরাধ করেছে তার বিচার সম্পন্ন করা এবং (তিন) জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামরিক বাহিনীর সহযোগিতাকে যেভাবে সহযোগিতা করছে, সেগুলোকে অবমূল্যায়ন ও হালকাভাবে গ্রহণ করে দেশকে কার্যত আরেকবার বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতির দিতে ঠেলে দিতে চেষ্টা করছে। এমন একটি পরিস্থিতির জন্যই আওয়ামী লীগ ওৎ পেতে আছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য।
রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি যত শীঘ্র তা অনুধাবন করে দলের ইতোমধ্যে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়া নেতাকর্মীর লাগাম টেনে ধরতে পারবে দেশ জাতির জন্য তা ততটাই কল্যাণকর হবে।