spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশুভ ৬৩ তম বিবাহ বার্ষিকী আম্মা এবং বাবা

ছবি ও লেখা : মুনীরা বশীর

শুভ ৬৩ তম বিবাহ বার্ষিকী আম্মা এবং বাবা

মুনীরা বশীর

মুর্তজা বশীর এর বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মা মরগুবা খাতুন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নবজাতকের নাম রাখলেন আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। পরে বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবেন না বলেই তিনি নামের সামনের ও পেছনের অংশ ছেঁটে নিজের নাম রাখলেন মুর্তজা বশীর। 

নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম পুত্র ও কনিষ্ঠ সন্তান। জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মা মরগুবা খাতুনের প্রথম কন্যা সন্তান মহযুযা হক, তারপর পুত্র সন্তান আবুল ফজল মুহম্মদ সফিয়্যুল্লাহ্, আবুল কালাম মোস্তফা ওলীয়্যূল্লাহ্, আবুল করম মাহমুদ যকীয়্যুল্লাহ্, আবুল জামাল মোহাম্মদ তকীয়্যুল্লাহ্, আবুল বায়ান মুজতবা নকীয়্যুল্লাহ্ ও আবুল করম মুতাওয়াক্কিল রাযীয়্যুল্লাহ্। মুর্তজা বশীরের ছোট বোন মসরূরা হকের মনে খুব ইচ্ছা ছিল পর পর ছয় ভাইয়ের পর তাদের একটি বোন হবে। ভাই হওয়াতে তার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তাই তিনি তার ডাকনাম রাখলেন বকুল। 

১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে চিত্রকলা ও ড্রয়িং নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি আর্ট অ্যাপ্রিশিয়েশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র অর্থে ফ্লোরেন্সের আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্ট থেকে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। অ্যাকাডেমির সহপাঠী মারিয়ার সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। মারিয়া মঞ্চ পরিকল্পনা নিয়ে পড়াশোনা করতো। বিকেলে অ্যাকাডেমির সব ছেলেমেয়েরা একসাথে ড্রইং করতো, সেখানেই তাদের আলাপ হয়। মুর্তজা বশীর মারিয়াকে মীরা বলে ডাকতেন। প্রথম দিকে তারা ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ করতেন। কারণ মীরা ইংরেজী এবং মুর্তজা বশীর ইতালির ভাষা জানতেন না। পরে মীরা শিল্পীর কাছে বাংলা শিখেছিল এবং রোমান হরফে মুর্তজা বশীরের মা মরগুবা খাতুনের কাছে বাংলায় চিঠি লিখতে শুরু করে। কারণ তারা একসময় সংসারে আবদ্ধ হওয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু এই ভালবাসার সম্পর্ক আর পরিণতি পায়নি। মীরার বাবা-মা চেয়েছিলেন মীরার সাথে বিয়ে পরে মুর্তজা বশীর যেন ইতালিতে থেকে যান। তিনি রাজি হননি। তাদের সম্পর্কের শীতল পর্যায়ে ১৯৫৭ সালে ইতালি ত্যাগ করে তিনি লন্ডনে চলে আসলেন। 

লন্ডন থেকে করাচি হয়ে ঢাকায় আসার আগে ১৯৫৮ এ লন্ডন থেকে করাচি না এসে ফ্লোরেন্সে আসলেন শেষ বারের মত মীরার কাছেই। ক্ষমা চাইতে যদি কোন ভুল করে থাকেন। ততদিনে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ঢাকায় ফিরলেন মুর্তজা বশীর। মরগুবা খাতুন মনে করেছিলেন তার ছোট ছেলে ইতালিয়ান মেমসাহেব বান্ধবীকে বিয়ে করে ভয়ে ঘরে তুলছেন না। ঢাকায় চাকরি হলো না। করাচিতে চলে গেলেন। ১৯৫৯ এর ডিসেম্বরে চিত্র প্রদর্শনী করার জন্য তাকে লাহোরে নিয়ে গিয়েছিলেন খ্যাতিমান উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর লাহোর থেকে ঢাকায় চলে আসেন। 

ঢাকায় আসার পর মুর্তজা বশীরের সাথে চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর মাধ্যমে আমিনা খাতুনের পরিবারের সাথে পরিচয় হয়। গ্রীন রোড এ দেবদাস চক্রবর্তীর বাসার উল্টো দিকের বাসায় আমিনা খাতুনের পরিবার বসবাস করতেন। মুর্তজা বশীরের ভাষায় “ব্যাডমিন্টন খেলুড়ে একটা ফর্সা মেয়েকে আমার ভালো লাগলো।” হালকা লালচে চুল, ধূসর সবুজ চোখের মনি দেখে এবং যখন তিনি জানলেন আমিনা খাতুন বিক্রমপুরের মেয়ে তখনই মনস্থির করলেন তাকেই বিয়ে করবেন। কেননা মুর্তজা বশীর ১০ম শ্রেনীতে পড়ার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি পড়ে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরিবারকে বিশেষ করে বাবু (পিতাকে ভাই-বোনরা বাবু বলতেন) এবং মাকে বললেন “আমি বিয়ে করবো”। তারা মুর্তজা বশীরের  কথায় কোন গুরুত্ব দিলেন না। তারা তাদের ছোট ছেলের মেজাজ-মর্জি এবং মতিগতি জানতেন বলে বিয়ের ব্যাপারে দায়দায়িত্ব নিতে চাননি। তার যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করার স্বাধীনতা ছিল। মুর্তজা বশীরের বিয়ের কথা শুনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন “তুমি তো মেয়েটাকে দেখেছো, কিন্তু মেয়েটা কি তোমাকে দেখেছে? মুর্তজা বশীর অবাক হয়ে বললেন “ আমি দেখেছি, পছন্দ করেছি এটাই তো যথেষ্ট”।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ছেলেকে বললেন “পাত্র পাত্রী দুজন দুজনকে দেখে নাও। তুমি নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নাও। গায়ে হলুদ বা বিয়ের আসর থেকে উঠে আসতে পারবে না। মেয়েটার জীবনের প্রশ্ন! বিয়ের দাওয়াত নামা ছাপা হয়ে গেলে এবং বিতরণ হয়ে গেলে বিয়ের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। কারণ আমার একবার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কন্যাটি কবুল বলেছিল। শুনেছি সে আর বিয়ে করেনি”। 

মুর্তজা বশীর মারিয়ার সাথে তার বিগত জীবনের দুঃখ গুলো আড়াল করে দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন “মত বদলাবো না। বিয়ে করবো”। 

রেল কর্মকর্তা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং মা করিমুননেসার দ্বিতীয় কন্যার সাথে মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে ২৭শে মে গাটছড়া বাঁধলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় কাহেতারা গ্রামের ১৯৪০ সালের ৩০শে মার্চ কলকাতায় জন্ম নেয়া অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে আমিনা খাতুনের সঙ্গে। আমিনা খাতুন তখন মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তাদের গ্রীন রোডের বাসায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিজে তাকে আর্শীবাদ করতে গিয়েছিলেন। পারিবারিক জীবনে তিনি তুলু নামে পরিচিত ছিলেন। চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের হাত ধরে আমিনা বশীর হয়ে একান্নবতী অভিজাত পরিবারের ছোট বউ হয়ে আসলেন।

বাসর রাতে মুর্তজা বশীর তার স্ত্রী তুলুকে মারিয়ার ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন মীরা তার অতীত। এ কথাও বলেছিলেন তার স্ত্রীর কোন অতীত থাকলে তাকে না বলতে। তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়বেন। বাসর রাতে তার স্ত্রী কোন কথা না বললেও বছরখানেক পরে বলেছিলেন বাসর রাতে নববধূকে কি কোন স্বামী তার প্রেমিকার ছবি দেখায়? উত্তরে মুর্তজা বশীর বলেছিলেন ইচ্ছে করলে নাও দেখাতে পারতেন, নষ্ট করে ফেলতে পারতেন। এগুলো তার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নষ্ট করার অধিকার তার নাই। 

সংসার জীবনে পরবর্তীকালে মুর্তজা বশীরের মনে হয়েছে তার স্ত্রী তুলু ভিন্নধর্মী নারী বলেই তার প্রেমিকার ছবি দেখে সহ্য করেছে, অন্য কোন নারীর পক্ষে বোধহয় সম্ভব হতো না!!!

আল্লাহ আম্মা এবং বাবার জীবনের সকল নেক আমল কবুল করে তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা