|মাহমুদ নোমান |
সময়ের তেজোবান ফোঁড়,কুচি কাঁটার শিল্পীত বুননে যেন আরামসে মর্মভেদী কবিতার সুপুরুষ কবি নূরুল হক। কবিতা অনেকে লিখেন তবে কবিতার হয়ে ওঠা কবির সংখ্যা যৎসামান্য। অনেকে কবিতা লেখার জন্য কত মেহনত করে তবুও ধরা দেয় না,অথচ নূরুল হকের কবিতা পড়লে মনে হবে কবিতা নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেলে ধরার বাসনায় নূরুল হকের কাছে আসে; কবি নূরুল হকের কবিতায় মোচড় আর প্রবাহমান এমনও উদ্ভাসিত হয় যে, মনটানা স্কিলের কবিতা; মনে হবে তারুণ্যের স্ফূর্তির সুরারোপ, নিজেকে ভেঙে ভেঙে খুঁজছেন; ষাট পেরিয়ে এখনও এমন কবিতায় সচল রাখা নতুনদের জন্য প্রেরণাদায়ক বটে। পুরাদস্তুর জানবাজ কবি। এই বছরের বইমেলায় প্রকাশিত নূরুল হকের ‘মুকুলিত বৃক্ষের ছায়া’ বইটি পাঠশেষে উপরোক্ত কথাগুলো মনে উজিয়ে উঠলো। বইটির নামে পাঠকের বুঝতে তেমন বেগ পেতে হবে না,নূরুল হক এখনও নিজেকে দুমড়েমুচড়ে লিখতে পারেন। এমনও শক্ত সামর্থ্যে ভাব মিলনে এখনও বসন্ত উদযাপন, সরলতার উপমায় নূরুল হকের কবিতা চর্চায়; আশা-রাগে মুকুলিত বৃক্ষের ছায়ায় লিখেন কবিতা-
ক.
তুমি যেন ইলিশে দোপেঁয়াজা
আজও শুনি বাংলার ইলিশি খবর
আমি আলস্যের রাজা
তাই কবিতায় বাঁধি একাকিত্বের ঘর।
- কিছু অবাঞ্ছিত পঙক্তিমালা;৫১পৃ.)
খ.
সভ্যতা বিপন্ন আজ! মৃত জোছনায়
রোদের প্রেতাত্মা এসে চাঁদের শরীরে
প্রচণ্ড চাবুক হানে; আকাশ গঙ্গায়
হত্যার উল্লাস চলে নীহারিকা ঘিরে
শোকের মাতমে ভারী সপ্তর্ষীমন্ডল
জ্যোতিষ্কের কালো ছায়া রক্তের মিছিল
পৃথিবীর উল্টোদিক আঁধার অতল
আমার এ গ্রহ যেন নিদ্রিত নিখিল।
- রৌদ্রের উল্লাস; ২৩পৃ.)
গ.
হৃদয় ফোয়ারা থেকে ঝরে প্রেম, ঝরে অবিরাম
অনন্ত আকাশ থেকে ধার করে বৃষ্টিধারা তুমি
হয়ে ওঠো কান্তিমান সঞ্জীবিত মহা সর্বনাম
দগ্ধ প্রায় এ পৃথিবী পুষ্পময় সিক্ত বঙ্গভূমি।
- আমার প্রেমিকা তুমি; ২৯পৃ.)
ঘ.
পেছনে আর ফিরে দেখো না
কারো কারো অতীত ভারী কদর্য
কাঁটায় পরিপূর্ণ যেন এক সমুদ্র দুঃখ
কারো কারো অতীত অন্ধকারে ভরা
যেন মহাকাল এক, কৃষ্ণ গহ্বর।
- যে যায় তাকে যেতে দাও;৩৮পৃ.)
সহজাত উপমার সারল্যে কবি নূরুল হকের কবিতার রিদ্মিক দোলন ছন্দের নানামুখী আলোড়ন তৈরি করে; ছন্দ নিয়ে নানারকম নিরীক্ষা, সনেট নিয়ে নানাবিধ জোড়ন কবি নূরুল হকের কবিতাকে ব্যতিক্রমী চিন্তার উৎকর্ষতা দিয়েছে। ইদানীং তথাকথিত ছন্দে লিখতে গিয়ে অনেকের আরোপ কবিতার মর্মকথা কী ভুলিয়ে দিয়েছে সেখানে নূরুল হকের কবিতা বাংলাসাহিত্যে স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়। কবিতা হয়ে উঠলেই ছন্দ, সেখানে কবি নূরুল হক সানন্দেই ছন্দিত গতিধারা আনেন।
০২.
‘মুকুলিত বৃক্ষের ছায়া’ কবিতা বইয়ে কবি নূরুল হকের সময় সচেতনতা বিশেষ স্বাক্ষর রাখে। জুলাই অভ্যুত্থানের সেই রক্তাক্ত সময় কবিকেও বিচলিত করে। কবি কারও দলের নয়, সবসময় ক্ষমতার রক্তচক্ষুর বিরোধী। কবি নূরুল হকের এই কবিতার বইয়ে কোটা নিয়েও কবিতা আছে। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশকে ভালোবাসা, দেশরক্ষায় জীবন দেওয়া শহীদী মৃত্যু। আদতে বিশেষ সুবিধার জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় না। মুক্তিযুদ্ধের বদৌলতে কোটার নামে যে দীর্ঘমেয়াদি যোগসাজশের সঙ্গে সুবিধা ভোগের উৎসব চলছিল দেশে, সেটি নিয়ে কবিতায় উচ্চকিত উচ্চারণ-
জ্বলে জনতার রোধ,দৃষ্টিতে আগুন
জ্বলে যায় এভিনিউ, জ্বলে পুড়ে খাক
কীসের কবিতা আজ সবকিছু থাক
দেখি রক্তে অশ্রুজলে হতাশার নুন।
- কোটা; ৩১পৃ.)
দীর্ঘদিন মানুষ ক্ষমতায় থাকলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সেটি অনেক আগেই বলেছি। ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা ক্ষমতাকে ন্যায়ের পক্ষে চালিত করা সহজ নয়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠে। জুলাই অভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল। দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিংবা অভ্যুত্থানের পরবর্তী দেশের কি লাভ ক্ষতি অথবা আবার সেই কোটা,আবার সেই স্বৈরাচারী মনোভাব আসবে কীনা সেটি সময়ই বলবে-
ক.
ইচ্ছে হলেই আগুন লাগাই
আগুন নিয়ে খেলি
আগুন লাগার অপবাদটা
অন্যের ঘাড়ে ফেলি।
- আমার আছে;২৬পৃ.)
খ.
জুলাই আসে আগস্টের প্রত্যাশায়
প্রতিটি প্রহরে বিজয়ের আলপনা এঁকে
কাব্য নয়, কাজ নয়
পদদলে পরাজয়
ছন্দের লাবণ্য গায়ে মেখে।
- জুলাই আসে কখনো ডিসেম্বরে; ২০পৃ.)
কবি নূরুল হকের কবিতা অন্তরের মমত্ববোধ নিয়ে কাব্যিক পরমানন্দের ঐক্যের সাঁকো; যে সাঁকো পার হতে হতে ধ্বনিত হয় মানুষের জয়গান। স্মার্ট শব্দগুচ্ছে ভেতর আলোকিত করে। কবি নূরুল হকের কবিতায় প্রাণশক্তিতে ভরপুর, অন্তরাত্মার সাথে কথা-বলা জীবন্ত কবিতা…
|||
মুকুলিত বৃক্ষের ছায়া
নূরুল হক
মিজান পাবলিশার্স
প্রচ্ছদ: মমিন উদ্দীন খালেদ
মূল্য: ২০০টাকা