নূরুল হক
১
আমার অস্তিত্ব জুড়ে অনিমিখ অবারিত তুমি
দোল খায় অনুপম দখিনের দজলা ফোরাত
এ আমার জন্ম গ্রাম জলাশয় শ্যামলিম ভূমি
উর্বর বাতাসে আমি বেড়ে উঠি শত অহোরাত।
পাড়ায় খেলার ছলে আমাদের সহপাঠী যারা
বৃষ্টিকে মুঠোয় পুরে মাঠে আর খোলা ময়দানে
খেলেছি কতক খেলা। জোছনায় আকাশের তারা
হেসে হতো কুটি কুটি আমাদের কৈশোর উত্থানে।
আজো আছে সেইগ্রাম। নান্দনিক শান বাঁধা ঘাট
কাছে কিম্বা দূরে বসে দেখি তার কল্লোলিত মুখ
যদিও কতক বন্ধু ইতোমধ্যে হয়েছে লোপাট
সময়ের পাশবিক ঝড়ে আহা সোনামাখা সুখ।
এ আমার গ্রাম আর ডাকাতিয়া বহমান নদ
আমার অস্তিত্বে তুমি অনির্বাণ শুভৈষী ধ্রুপদ।
২
চোখে তার জল নামে
চোখে তার জল নামে বিমোহিত বিন্দু বিন্দুকণা
বয়ে যায় নির্দ্বিধায় স্বর্ণসিক্ত স্নিগ্ধ তার ধারা
আনন্দ বন্যায় ভাসে চিত্রকল্প কাব্যিক আল্পনা
সাফল্যের সেই জলে মাতোয়ারা কবি খেই হারা।
যেই চোখে বান ডাকে আনন্দের সেই চোখে শোক
কবির ভাবের মতো স্রোতস্বিনী প্রবল প্রাঞ্জল
চারদিকে অন্ধকার তবু তার ঋদ্ধ কল্পলোক
আলোর গোলক হয়ে অবিরল হাসে খলবল।
নিষিদ্ধ সময় আজ দ্বিখণ্ডিত আমার সমাজ
দেখে যাও চক্ষু বুজে বিবেকের অতৃপ্ত দহন
অসভ্য লোকেরা কয় এই সবে নেই তার কাজ
সাফল্য পেছনে ঠেলে অবক্ষয় করেছি বহন।
খরাদগ্ধ এই দেশ বৃষ্টিহীন। প্রার্থনার মতো
নামুক বৃষ্টির গান ভরে যাক খাল বিল যতো।
৩
যে তুমি গুঁজে দাও সান্তনার ফুল
মাংশল শরীর তার পাটখড়ি অনুভূতিহীন
রক্তের সমুদ্রে নাই লবনাক্ত লৌহজ কণিকা
বিমূর্ত রমণী ছিলো সুপ্তোত্থিতা ছিলো না গণিকা
প্রেমের সুতোয় তাকে বাঁধে নাই কেহ কোনদিন
কখনো ঈসৎ হাসে কখনোবা অকারণে কাঁদে
মিয়ঘ্রাণ কণ্ঠ তার ভয়ে ভয়ে জড়সড় অতি
সাহসের ডানা দুটি ভেঙ্গে গেছে হারিয়েছে গতি
অনড় আড়ষ্ট মন জ্বলে পুড়ে প্রতারক ফাঁদে
পুরনো কাসুন্দি ঘেটে মন তার ভীষণ বিধুর
দীঘল খোঁপায় যিনি গুঁজে দিতো সান্তনার ফুল
তিনিও বিস্মৃত স্মৃতি! কারো কারো ছিলো চক্ষুশূল
এ বাগান পূষ্পশূণ্য, ফুটিবে না সিঁথিতে সিঁদুর
তিমিরের বাঁধ ভাঙ্গা ঢল নামে, ছিন্নভিন্ন পাল
দুজন দুদিকে আজ, দগ্ধদিনে শীতের সকাল।
৪
আমাকে খণ্ডিত করে ঘুমের করাত
চোখের শরীর বেয়ে নামে ঘুম অন্ধকার শীতে
ঢুলো ঢুলো ভেজা আঁখিপাতা মুখে তোলো হাই
অদৃশ্য ইঙ্গিতে বলো কথা হবে নীরবে নিভৃতে
কাজেতে বিভোর দিন সন্ধ্যা হলে ঘুমের দোহাই
লতানো শরীর খানি হয়ে যায় অচেতন লাশ
আমিও কেমন যেন, রাত জেগে প্রতীক্ষায় থাকি
চোখের পালক থেকে ঝরে জল সিক্ত হয় ঘাস
তোমার মুখের স্বর রুদ্ধ করে ঘুম ঘুম আঁখি
এভাবে বসন্ত আসে, তোমার সে ঘুমের পিপাসা
মিটে না কখনো আহা গ্রীষ্ম কিংবা হেমন্তে শরতে
বুকে ও পাঁজরে শুধু জমা হয় সমুদয় আশা
ভ্রান্তির ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে স্নায়ুর পরতে
কামিনী ফুলের ঘ্রাণে দীর্ঘ হয় কাঙ্খিত রাত
আমাকে খণ্ডিত করে তার সেই ঘুমের করাত।
৫
যে তুমি কাঁদাও আমায়
নদীর ভাঙ্গন শেষে যে মানুষ হারিয়েছে সহায় সম্বল
পূর্ণিমা বেহাত বলে যে রমণী পড়ে যায় গোলক ধাঁধায়
যাদের কিছুই নাই, আছে শুধু ফোঁটা ফোঁটা তপ্ত অশ্রুজল
এ কবিতা তার জন্য, যে আমাকে বারবার শুধুই কাঁদায়।
মানবিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে গেছে, অন্ধ আজ বিবেকের চোখ
পৃথিবীর কক্ষপথে স্থিত হয় আনবিক বিষ্ঠাবৎ ক্লেদ
তবুও সজ্জন কিছু নীহারিকা জ্বেলে রাখে প্রসন্ন আলোক
ভুলে গিয়ে রিরংসা কালো আর ধবলের ক্ষিপ্র মতভেদ
মানুষ মানুষ নাই, মুখোশের অন্তরালে চলে কূটচাল
গৃহহীন কিছু কীট ঠাঁই নেয় সভ্যতার নগ্ন ফুটপাতে
ক্রমশঃ বিপন্ন হয় মানবতা, অরণ্যানী পর্বতের ঢাল
পাখিরও বাসা থাকে, থাকে প্রেম। হাত রাখে পক্ষিনির হাতে
আমিও নদীর মতো। আবেগের কূল ভাঙ্গে বিরহের ঢেউ
আমার কবিতা শুধু তার জন্য যাকে আজো চিনলো না কেউ।
৬
হে পাখি সদয় হও
পাখিরা সদয় হও, তোমাদের প্রাচীন সঙ্গিতে
ডিমের কুসুমমাখা প্রভাতের রবি রশ্মিকণা
সযত্নে ছড়াক আজ, দুর্বিসহ করুণ এ শীতে
হিমেরা ছোবল হানে হিংস্রতার তোলে বিষ ফণা
বিষম এ রাতে কাঁপে অর্ধনগ্ন প্রিয় অনুভব
পুঁজির পুলক নিয়ে হিমবধ নিয়ন্ত্রিত ঘরে
তৃপ্তির ঢেকুর তোলে পুঁজিবাদ বিত্তের বৈভব
কেমন বৈষম্য আহা, শীত হয়ে হিমকণা ঝরে।
যে দেশে বিবস্ত্র নারী রাজপথে খুঁজে খুদকুড়া
যে দেশে ঘুমন্ত রাত শুয়ে থাকে উপুড় ভঙ্গিতে
অলাজ বিবেক নিয়ে হেঁটে যায় উদাসী অনূঢ়া
হে পাখি সদয় হও, ভোের আনো প্রভাত সঙ্গিতে
শীতের সন্ত্রাসে আজ প্রকম্পিত রাতের বিবর
উর্বর উষ্ণতা আনো, বাস্তবিক তপ্ত করো ঘর।
৭
ক্রন্দন ধ্বনি
আমার সম্মুখে আজ সারি সারি লাশের বহর
রক্তের চঞ্চল স্রোতে মরুঝড়, নিষ্ফল ক্রন্দন
আনগ্ন ইঙ্গিতে আহা ছিঁড়ে যায় আত্মার বন্ধন
বঞ্চনার বর্জজলে নিমজ্জিত শোকার্ত শহর
এ কোন পাতকী প্রাণী, হানাহানি প্রধূমিত তীরে
বিদীর্ণ পাখির দেহ, বিবেকের ঝরে অশ্রুকণা
বিভক্তির লাল রেখা সাপ হয়ে তোলে তার ফণা
অস্ফূট কান্নার রোল ওঠে সেই রাত্রির শরীরে
আমিতো রমণী নই! মুছে ফেলে রোদনের দাগ
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবো কীটদষ্ট পাষাণ মাতাল
তারপর নবরাগে নবপ্রাণে ফোটাবো পরাগ
দ্রাবিড় রক্তের শোধ! সাক্ষি আজ মর্ত্য মহাকাল
অকস্মাৎ নিভে যাবে বজ্রস্বরে আঁধারের রোদ
ক্রন্দন ধ্বনি নয়, নয় কোন অযথা প্রবোধ।
৮
তুমিতো স্মৃতির কন্যা
আমার স্মৃতিতে আজ লিখা হবে স্মৃতিদের স্মৃতি
শাপলা পাতার বুকে আড়পাতা জলের কঙ্কাল
বৃহস্পতি সঙ্গে ছিলো, দিন নয় পূর্ণিমার তিথি
স্মৃতিরা স্মৃতির মতো ধরে রাখে কাল মহাকাল।
একটা স্মৃতির কথা লিখতেই নিযুত অযুত
সটান দাঁড়িয়ে থাকে দ্বিধাহীন স্মৃতির কার্ণিশে
ফুটন্ত মগজ থেকে উঠে আসে কালো বুদবুদ
হঠাৎ সম্বিত ফিরে বাস্তবিক বিহগের শিষে।
তুমিতো স্মৃতির কন্যা,ধরে রাখো কতো স্মৃতিচিহ্ন
আমার স্মৃতিরা যেন ঝুলকালি, মলিন বিবর্ণ
তোমার উত্তাপে সব স্মৃতি হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন
শুকনো লতার মতো চোখ নাক খাড়া দুটি কর্ণ
স্মৃতিতে চিত্রিত হয় সময়ের সব লেনদেন
তুমি স্মৃতি অমারাত্রি স্মৃতি যেন বলধা গার্ডেন।
========