spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআমার জামাল ভাই

লিখেছেন : মাঈন উদ্দিন জাহেদ

আমার জামাল ভাই

মাঈন উদ্দিন জাহেদ  

আমার সুখস্মৃতি কম। জীবনটাই ছেঁড়াবেরা, এক বোকা জীবন পার করেছি– এপর্যন্ত। বিশেষ করে প্রাত্যহিক জীবনে সমৃদ্ধ হতে শুধু বই পড়লে চলে না, মানুষও পড়তে জানতে হয়– সে বিদ্যা আমার রপ্ত হয়নি কখনও। তারুণ্যের ভরা ভাদর থেকে প্রৌঢ়ত্বের হাঁটুবেদনা অবধি , আজও ভুল মানুষকে অভিবাদন  জানিয়েছি, কাছের মানুষটিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এর পেছনে সব চেয়ে বড় ভূমিকা রাখেছে– আমার ঠোঁটকাটা স্বভাব আর দ্বিতীয়টি নির্বুদ্ধিতা– যা লাভ লোকশান বা বাণিজ্যবুদ্ধিতে  অক্ষমের জীবনস্মারক হয়ে আছে আমার যাপনে, তাই শৈশব থেকে আমার বন্ধু সংখ্যা কম। একটি আবেশময় পরিবেশ তৈরী হতে হতেই — বন্ধুমহলকে আমার আসসালামু আলাইকুম জানাতে হয় মাওলানা ভাসানীর মতো।

শিল্পী জামাল উদ্দিন আহমেদ এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় সম্ভবত একটি কোরআন পাঠের আসরে। সময়টা ১৯৮৮/৮৯ সালের পবিত্র রমজান মাস — তখন। সলিমা সিরাজ মাদ্রাসায় পড়াতেন একজন চমৎকার সুরেলা ক্বারী মুখম্মাদ মুসা। তাকে ঠিক করা হয়েছিল রমজান মাসে পরিত্র কোরআন শুদ্ধরূপে পড়া শেখানোর জন্যে। মুক্তকণ্ঠে সদ্যাগত বলে– আমীরুল ইমলাম ভাই অগ্রজদের সাথে এ অধমকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, সেই শেখার আসরে। আলীয়া মাদ্রাসার দোতলায়–আমার প্রিয় ক্লাসরুমটি জোহরের পর ক্লাস চলতো। প্রশিক্ষক মুসা সাহেব কখনও আসতে দেরী হলে উপস্থিত শিল্পীরা-গান ধরতেন, বিশেষ করে হামদ-না’ত। কোনো দিন আমীর ভাই, নাসিমূল হুদা নওশাদ মামা, কোনো দিন আব্দুল হালিম ভাই, কোনদিন আহসান  হাবীব ভাই, কিংবা কখনো জামাল ভাই। মাঝে মাঝে মুস্তফা মুনির ভাইও আসতেন। শাহরিয়ার ভাইও আসতেন, আ জ ম মুসা ভাই  এবং হাসান মুর্তাজা ভাই, রেজাউল হক ভাই।

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলতো চমৎকার আড্ডাও। বিশেষ করে আ.স.ম. শাহরিয়ার ভাইয়ের মজার মজার গল্প ও ফোঁড়ন কাটা। তার সাথে জামাল ভাইয়ের রসগল্প জুড়ে দেওয়া। পুরো সময় হয়ে উঠতো অন্যন্য আনন্দঘন ও উপভোগ্য। বিকালে রোজার ক্লান্তিতে এসব বড়তি সংযোগে, ক্লান্তি উবে গিয়ে কোর্সটি হয়ে উঠেছিলো সে কৈশোরে বেশ আকর্ষণের। 

বিশেষভাবে অগ্রজদের সাথে সময় কাটানো ও সমৃদ্ধ হওয়ার অসাধারণ সুযোগ। সেই থেকে আমার মধ্যে ঢুকেছে জ্যাঠামী স্বভাব — যা আজো গেলো না। নিজের তারুণ্য উচ্ছ্বাসকে হারিয়েছি অবচেতনে, শুধু দায়িত্ববোধ, ন্যায়বোধ, উচিত-অনুচিতের ফ্যাকরায় পরে — জীবনের স্বাভাবিক আনন্দটকু হারানো। না-আমি অগ্রজ, না আমি তারুণ্যের প্রতিনিধি– নিজের আড়ষ্ট জ্যোঠামী নিয়ে– কিছুটা আলাদা, কিছুটা একা, অনেকটা বন্ধুহীন পথচলা।

ঐ ক্লাসেই জামাল ভাইয়ের মুখেই শুনেছিলাম তার লেখা– ‘নালাইয়া’  ছড়াটি এবং এর পেছনে আ.স.ম. শাহারিয়ার ভাইয়ের লেখা গল্পের পটভূমি। আড্ডায় এ দু’জনের রসঘণ পরিবেশনা ছিলো সবার আরাধ্য। সেই থেকে জামাল ভাইয়ের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাওয়া।

মুক্তকন্ঠের সাহিত্য আড্ডাগুলোতে  জামাল ভাই মাঝে মধ্যে আসতেন। সাথে তার প্রিয় পানের কোটা। এমন শৈল্পিক ঢঙে তিনি পানখাওয়াকে  রপ্ত  ও উন্নত করেছিলেন– দেখে আমরাও মাঝে মাঝে পানের ভোক্তা শ্রেণি হয়ে উঠতাম। তার পান খাওয়া দেখে গল্প করতাম সৈয়দ মুজতবা আলী’র আদ্ভুৎ চাখোর গল্পের চরিত্রটির । সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে যখন তাকে তাম্বুলরস আস্বাদনের উপর কিছু লিখতে বলতাম — তিনি তার স্বভাবসুলভ সরলতায় বলতেন– গান গেয়ে কিছু প্রশংসা পাই, এখন আমাকে পচাঁনোর জন্য এসব বলছো ?!– তাঁর অসাধারণ বিনয় ও বন্ধুতা অনুজদের মুগ্ধ করে রাখতো।

যেকোনো সাহিত্য বা সংগীত আড্ডা শেষে জামাল ভাইকে নিয়ে জমে উঠতো আরেকটি আড্ডা। আমাদের খাদ্য বিলাশ ও প্রণোদনার অসীম উৎস হয়ে ওঠেন তিনি এবং এক একটি স্বপ্নসাজানোর পরিকল্পনার রূপকার। পরবর্তীতে এক এক প্রজন্ম তাকে ঘিরেই বেড়ে ওঠে, আর  প্রাণভোমরা হয়ে উঠেন তিনি। তাকে ঘিরেই আপন স্বক্রিয়তায় বেড়ে ওঠে তার সন্তানতূল্য অনুজরাও। এমন প্রশ্রয় দেয়ার মানুষ কিন্তু আমাদের দ্বিতীয়টি নেই। তার ঘরটি ছিলো– আমাদের সবার প্রিয় আপন ঘর । নির্দ্বিধায় চলে যেতেম অনায়াসেই। আপন সন্তানের মত আমাদের আপ্যায়ন ও  অত্যাচার গুলো সইতেন খালাম্মা। পরবর্তীতে ভাবী। সময়ের পরিক্রমায় তার চারটি সন্তানও আমাদের আড্ডা-গান, সমস্ত আয়োজনের অনিবার্য সদস্য হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের অন্য কোনো সদস্যের ঘরে এমন পারিবারিক প্রণোদনাময় আবেশ এ অংগনের শিল্পী- কুশলীরা পাইনি। সবাই আপন স্বভাবে ব্যাস্ত, কিন্তু জামাল ভাই ব‍্যস্ততার মাঝেও এক টুকরো প্রাণোচ্ছল আনন্দের অমীয় ধারা হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন আজীবন। 

মুক্তকণ্ঠের সভাপতির দায়িত্ব পালন কালে চরম অর্থনৈতিক সমস‍্যার সম্মুখীন হই আমি। তিনি নিজ থেকে ডেকে  তার ছোট ভাই মাঈনুকে পড়ানোর টিউশন দেন আমাকে। ক’দিন পড়াতাম মনে নেই, তেমন পড়াতে পারতাম কিনা জানিনা, বরং আমার মনে হয়েছে- কারো কাছে আমার এমন তথৈবচ অবস্থা শুনে তিনি একটি সম্মানজনক ব্যাবস্থার আয়োজন করেছিলেন।

মুক্তকণ্ঠের একটি কবিতাপত্রে একটি কবিতা লিখেছিলাম ‘বায়োস্কোপ’ নামে। এ কবিতাটি তার এতোই পছন্দ হয়েছিলো, আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বলেছিলেন– এমনই কবিতাতো চাই… বেশ ক’বার  কবিতাটির পছন্দের ক’টি লাইন আউরাচ্ছিলেন। এমন মুগ্ধ পাঠক আমার জীবনে কমই পেয়েছি। সব সময় আমাকে আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন–‘কবিতা দুর্বোধ্য  হতে পারে আবোধ‍্য নয়– বলে হাসতেন আর সহজবোধ্য করার জন্য বিনয় প্রকাশ করে বলতেন ‘আমারতো সবাই মান্নান সৈয়দ হতে পারবো না, আমাদের জন্য কিছু কিছু লিখো।

 বিগত ষোল বছরের বৈরী সময়ে– আমাদের সম্পর্কের বাগানে নানা দুর্বাঘাস জন্মেছে। নানা অনৈক্য তৈরী হয়েছে। মাঝে মাঝে ফোন করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হতো কিন্তু কখনো সম্পর্ক একেবারে নষ্ট হতো না, সব সময় বলতেন সময় করে কথা হবে। কথা হতো টেলিফোনে বেশী কিন্তু সুবর্ণসময় আমাদের আর হলো না, বিতর্ক গুলো শেষ কিংবা অশেষ রইয়েই গেলো।

একটি অমিমাংসিত বির্তকের সমাপ্তি টানার দায়ভার দিয়ে তিনি আমাদের থেকে  গত বছর ছেড়ে চলে গেলেন। 

নানা তর্কে বিতর্কে যখন আমি কারো

উপর নির্ভর করতে পারছিলাম না, নিজ উদ্যোগে সাংস্কৃতিক তৎপরতায় নানা কিছু করে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি দূর থেকে ভরসা ও নির্ভরতার প্রতীকা হয়ে মানস ভূগোলে ছায়া হয়ে থাকতেন। তার শূণ্যতায় সবচেয়ে বেশী বোধ করছে অনুজরাই । যারা সাহসে সংগ্রামে, নানা মহৎ উদ্বেগ ও উৎসবে, তাঁর সারথী ছিলো–  আর তিনি প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন; সাহসের দীপ্ত শিখা হয়ে ছিলেন শত তরুণের দীপ্ত প্রাণে।

আজ ২ জুন শিল্পী জামাল উদ্দিন আহমেদের জন্মতিথি। হে মহান পরওয়ার দিগার– আমার ভাইটিকে তুমি ক্ষমা করে দাও, তাঁকে তোমার রহমতের চাদরে জড়িয়ে রাখো। তাঁর স্বপ্নগুলো তার সন্তান ও অনুজদের পূর্ণ করার যোগ্যতা দাও। তাদের সাহস ও সম্মানের সাথে পৃথিবীর সময়গুলো অতিক্রম করার ব্যাবস্থা করে দাও। 

হে মালিক, আমাকে ক্ষমা করো.. আমাদের ক্ষমা করো…

‘আমার জামাল ভাইকে’ সম্মানিত করে রাখো।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি