তাজ ইসলাম
‘বীরের গল্প শোনো’ বলে কেউ যেন তার আপনজনকে উপদেশ দিচ্ছেন,পরামর্শ দিচ্ছেন।
শব্দের কোমলতা সম্পর্ক গাঢ় হয়। এটি মূলত একটি গল্পের বইয়ের নাম। গল্পগুলো শিশু কিশোরদের উদ্দেশ্যে লেখা।
গল্পকার গল্প বলছেন ছোটদের উদ্দেশ্যে। লেখক ও পাঠকের আন্তরিকতার আবহ তৈরী করেছেন কোমল বাক্যে।
তিনি তার শিশু কিশোর পাঠকদের সামনে নিজের বয়ানে গল্প বলে যাচ্ছেন। ইতিহাসে প্রসিদ্ধ বীরপুরুষদের গল্পকে উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব মুন্সিয়ানায়।
শিশু কিশোররা আগামীর নায়ক,জাতীর ভবিষ্যৎ। তাদের মন ও মনন তৈরীর পাটাতনে ইতিহাসের নায়কদের জীবনী উল্লেখযোগ্য উপাদান হয়ে কাজ করবে।
আমীর আল খাত্তাবী ঐতিহাসিক বীরপুরুষ। আধুনিক বিশ্বে সমর বিজ্ঞানে তিনি পরিচিত গেরিলা যুদ্ধের জনক হিসেবে। তার জীবন কথা সরল শব্দে, সহজ বাক্যে বর্ণনা করেছেন গল্পকার শাহানারা স্বপ্না। শাহানারা স্বপ্না একজন আইনজীবী। দক্ষ গল্পকারও। ইতোমধ্যে প্রকাশিত তার একাধিক গ্রন্থ। প্রবন্ধেও তার দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
‘গেরিলা যুদ্ধ – নীতি আবিস্কারের মহানায়ক মরক্কোর আমীর আল খাত্তাবী। যুদ্ধের এই নয়া কৌশল আবিষ্কার এবং সামান্য শক্তি নিয়ে শত্রুদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য রীফ দেশের লোকেরা তার নাম দিয়েছে – ‘ সিংহ’।…
আচমকা লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে চোখের পলকে চোরাগোপ্তা হামলা! দুর্জয় সাহস আর অসীম মনোবলে এই টেকনিক শিখিয়ে দেন রীফ যুবকদের। গড়ে তোলেন সশস্ত্র গেরিলা দল।’
চোরাগোপ্তা হামলার রণাঙ্গনের নাম গেরিলা যুদ্ধ।
ক্ষমতার লড়াই বা আধিপত্যের লড়াই শুরু হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। যুদ্ধের নতুন নতুন কলাকৌশলও যুক্ত হয়েছে লড়াইয়ের প্রয়োজনে। গেরিলা যুদ্ধও যুদ্ধের একটি আধুনিক সংযুক্তি। গেরিলা যুদ্ধ নীতির জনক হিসেবে সমরবিদগণ স্মরণ করেন মরক্কোর আমীর আল খাত্তাবীকে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮২ সালে রীফের আজদির শহরে। খাত্তাবীর অভিনব যুদ্ধ কৌশল ও অসীম সাহসিকতার গল্প বর্ণিত হয়েছে ‘ গেরিলা যোদ্ধা: রীফ দেশের সিংহ’ শীর্ষক গল্পে।
শিশু কিশোরদের কাছে গল্প বলতে হলে তাদের কাছাকাছি পৌছার তরিকা জানতে হবে।ভাষা হতে হবে নরম ও দরদী। শাহানারা স্বপ্না গল্পে প্রয়োগ করেন তেমন শব্দ। পৌছে যান তাদের মনের আঙিনায়। তিনি লেখেন, ‘ তোমরা কি ‘ অটোমান রাজার নাম জানো? জায়ান তার দাদুর কাছে এ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে। তাই সে বলে উঠল-
‘ অটোমান তো একটা সাম্রাজ্য! আর সেখানে তো অ-নেক রাজা ছিল’।’
এরপর বিস্তৃত হয়েছে গল্পের ডালপালা। গল্প দাদু বলে যান সাহসী এক শাহজাদার কথা। সাহসী শাহজাদার কথা বলেছেন তিনি ‘ নৌকা চলে পাহাড় বেয়ে’ গল্পে।
তিনি তার বইয়ে অনেকগুলো গল্প যুক্ত করেছেন। এসব গল্প বর্ণিত আছে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ছাড়াও তিনি গল্পের উপাদান সংগ্রহ করেছেন এদেশের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অংশ থেকেও।
‘ বাংলার বীর উসমান ও তার হাতী’ নাম শুনলেই অনুমান করা যায় গল্পের বিষয় ও স্থানের কথা।
‘ সময় সবসময় একরকম যায় না। এখন বাংলাদেশকে মানুষ চেনে কৃষকের দেশ বলে।কিন্ত একসময় এমন ছিল না।তখন বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ।’ বাংলাদেশের সোনালী দিনের ইতিহাস জানতে হলে পাঠককে ডুবতে হবে ‘ সৌরভে গৌরবে বাংলার নাও’ শীর্ষক গল্পে। নৌকার কথা বলতে বলতেই তিনি বলে গেছেন বাংলাদেশের গৌরবময় অতীতের কথা। ফেলে আসা অতীতের সাক্ষ দিতে গিয়ে ‘ ফরাসী ইতিহাসবিদ শাহাবুদ্দিন তালাশ লিখেছেন ‘ ঢাকার নৌবহরে তিন হাজার জাহাজ ছিল।’
‘আজ এমন একজন লোকের কথা বলবো- যার নাম ছিল দুম- দুমস্তেন্স। যিনি তাঁর নামের মতো দুম করেই পড়েছিলেন বলা যায়। এমন নামের কথা কেউ কোনদিন শোনেনি- জানতোও না। কিন্ত যিনি ‘দুম’ করে দেখা দেবেন বলে পণ করেছিলেন – তাকে কে আটকাবে? দ্যুমেদের বাড়ি ছিল সেই প্রাচীন গ্রীস দেশের একটি গাঁয়ে’। দ্যুমস্তেন্স ছিলেন একজন তুখোর বক্তা ও বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। সমগ্র সংগ্রাম মুখর জীবনকে অতি সরল বাক্যে বর্ণনা করেছেন এই গল্পে গল্পকার।
শাহানারা স্বপ্ন পেশাগত জীবনে একজন প্রথিতযশা আইনজীবী। সাহিত্য সাধক হিসেবে সময় দিচ্ছেন কয়েক দশক।
১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক এর ‘ কচি – কাঁচার আসর’ এ প্রথম ছোটদের গল্প প্রকাশ পায়। ছোটদের জন্য লিখেন মায়াবী শব্দে। তার চেষ্টা ‘ শিশু কিশোররা যাতে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।( তিনি মনে করেন)
তাদের সামনে অতীতের চিত্রগাঁথা তুলে ধরা জরুরি। এর মাধ্যমে ছোটরা যেমন শিক্ষা ও আনন্দ পায় তেমনি দুর্যোগের সময় দূর হয় মনের ভয়ভীতি। গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারা প্রবাহিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।অনুকরণীয় আদর্শ সৃষ্টি হয় তাদের সামনে। তাই বিজয়ী বীর,মহান মানুষদের জীবনী ও ইতিহাস ছোটদের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই বইটি প্রকাশ করা।’ বইটিতে মোট গল্প আছে ১২ টি। শুরুর গল্পটির নাম ‘ মরু ঈগল’।’ওমর আল মুখতারকে লোকেরা নাম দিয়েছিল ‘ প্রিয় মরু ঈগল ‘। ওমর আল মুখতার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।নিজের দেশকে মুক্ত রাখতে যুদ্ধ করেছেন জীবন বাজি রেখে।
মুখতারের জন্মভূমি লিবিয়া। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে লিবিয়াকে আক্রমণ করে হানাদার ইতালি। ওমর নিজের দেশকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। পরাক্রমশালী ইতালির বিরুদ্ধে ওমর হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও এক মূর্তিমান আতংক হয়ে আবির্ভূত হন মুখতার। ওমর আল মুখতারের বীরত্বের কথা শিশুতোষ শব্দে বলে গেছেন শাহানারা স্বপ্না।
প্রতিটা শিশু কিশোরকে এই বইটি বা এমন বই উপহার দেওয়া দরকার। বইটি মনন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সহায়ক। ‘ ঐতিহাসিক বীরদের গল্প
‘বীরের গল্প শোনো’ শাহানারা স্বপ্না। বইটি প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪. মূল্য ২০০ টাকা। প্রচ্ছদ : মনিরুজ্জামান পলাশ। আমরা চাই বইটি পৌছে যাক হাতে হাতে।