আবু তাহের সরফরাজ
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার মূল কারণ কী? অনেকে অনেক কথা বলবেন। সবার সকল মতামতকে গ্রাহ্য করেই বলা যায়, বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় চরিত্র খুব ভালোভাবেই বুঝতেন হুমায়ূন আহমেদ। সেই চরিত্রের আদলেই তিনি নির্মাণ করতেন তার কথাসাহিত্য ও নাটকের চরিত্র। সেইসব চরিত্রে আছে হিউমার ও শ্লেষ। বলা চলে, গুজব-প্রভাবিত বাঙালির জাতীয় চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ওইসব চরিত্রের ভেতর নিখুঁতভাবে চিত্রিত করে হুমায়ূন বাঙালিকে মূলত ন্যাংটো করে ছাড়তেন। তার কথাসাহিত্যের এই সূক্ষ্ম কারুকাজ খুব প্রচ্ছন্নভাবে পাঠক না-বুঝলেও বর্ণনার সরসতা ও হিউমারের কারণে হুমায়ূন এই দেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তার লেখা ও পরিচালিত নাটক ‘মহান চিকিৎসক ওয়াং পি’ নাটকের একটি দৃশ্যের দিকে চোখ রাখা যাক। ড. এজাজ ভুয়া চিকিৎসক সেজেছেন। প্রচার করছেন, তিনি চীন থেকে এসেছেন। তার সাগরেদ হিসেবে আছেন ফারুক আহমেদ।
সাগরেদ ওস্তাদকে জিগেশ করছে, ‘ভাইজান, বিপদে পড়বো না তো?’
ওস্তাদ জবাব দিচ্ছেন, ‘বিপদে পড়বো ক্যা? লতাপাতা বেইচা ১০-১৫ হাজার টাকা তুইল্যা পালায়া যাব।’
সাগরেদ বলছে, ‘বিরাট পাপ হবে। মানুষ ঠকানো।’
ওস্তাদ বলছে, ‘শোন, মানুষের জন্মই হইছে ঠকার জন্যে। যে নেতা তাদের ঠকায় মানুষ সেই নেতারে আবারও ভোট দ্যায়। আরও ঠকতে চায়।’
সাগরেদ জবাব দিচ্ছে, ‘কথা সত্য।’
মাত্র তিন-চারটে সংলাপের ভেতর দিয়ে সহজ ও মর্ম-উদ্ঘাটনি উপায়ে হুমায়ূন আহমেদ বাঙালির চরিত্র চিহ্নিত করে দিয়েছেন। সাগরেদ ফারুক আহমেদের মতো আমরাও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই যে, ‘কথা সত্য।’ কেন সত্য, সেই বিষয়টি একটু ভেঙেচুরে বুঝে নেয়া যাক। সত্যিই কি ঠকার জন্যই মানুষের জন্ম? হুমায়ূন কিন্তু সকল মানুষ অর্থে এই উক্তি করেননি। করেছেন কেবল বাঙালিদের উদ্দেশ্য করেই। কারণ, বাঙালি জ্ঞানবিমুখ জাতি। নিজের কিংবা সমাজের ভালো-মন্দ বোঝার ধীশক্তি এই জাতির নেই। প্রচলিত সিস্টেমকেই এই জাতি জীবনের যাত্রাপথ হিসেবে মান্য করে। নিজের বোধবুদ্ধি কাজে লাগানোর দরকার আছে বলে তারা বিশ্বাসই করে না। ফলে পায়ে-পায়ে তারা ঠকে। বাঙালি নিশ্চিতভাবেই জানে যে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাকে সে নির্বাচিত করছে সে একজন লুটেরা, শোষক। দুর্নীতিবাজ। এরপরও বাঙালি মহা-উৎসাহে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বাচন করে, কে তাকে পাঁচ বছর ধরে শোষণ করবে। যে জনপ্রতিনিধি সৎ ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, সেই জনপ্রতিনিধিকে মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে না। করে না কারণ, সেই জনপ্রতিনিধি শোষণ না করে জনগণের কেবল উপকার করে। এহেন মানুষকে নেতা হিসেবে বাঙালি সহ্য করতে পারে না। বাঙালি তো ঠকতে পছন্দ করে। সৎ জনপ্রতিনিধি তাদেরকে না-ঠকিয়ে খালি কল্যাণ করেই যাচ্ছে এটা কোন বুদ্ধিতে বাংলার মানুষ মেনে নেবে? অবশ্য সত্য যে, সৎ থেকে জনকল্যাণে কাজ করে যাওয়া জনপ্রতিনিধির জন্য খুবই মুশকিল। কারণ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সেই উপায় নেই। নানা কারণেই নেই। এর মধ্যে প্রধান একটি কারণ, একটি আসনের জনপ্রতিনিধিকে ওই আসনের স্ব-দলীয় অসংখ্য কর্মীকে প্রতিপালন করতে হয়। সেই খরচ তো সংসদ সদস্য নিজের পকেট থেকে দেবে না। কর্মীদেরকে নানা উপায়ে লুটপাটের ব্যবস্থা করে দেবে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট অংকের বখরাও জনপ্রতিনিধি নিজের পকেটে ঢোকাবে। এটাই সিস্টেম। কর্মীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব না-নিলে তার আসন নিশ্চিত করবে কারা? মূর্খ জনগণকে ভুংভাং বুঝিয়ে ভোটের ব্যবস্থা করবে কারা? আর তাই দ্যাখা যায়, পাঁচ বছর পরপর ভোট দেয়া ছাড়া রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই পাঁচ বছরজুড়ে যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকে তারা মূর্খ জনগণকে শোষণ করে আখের গুছিয়ে নেয়। যারা ভোট দিয়ে তাদেরকে লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে সেসব চিহ্নিত ভোটারদেরকে টিসিবির কার্ড ধরিয়ে দ্যায়। মূর্খ মানুষগুলো সেই কার্ড দেখিয়ে মাসে-মাসে কিছু চাল-ডাল ঘরে নিয়ে আসে। আর ভাবে, ভাগ্যিস মখলেস ভাইয়ের দল করি! না-হলে তো এই কার্ড পেতাম না। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামের প্রত্যেক পাড়ায়-পাড়ায় একজন করে মখলেস ভাই রয়েছে। কয়েকজন মখলেস নিয়ে একটি ওয়ার্ড। কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে সরকারি রাজনৈতিক দলের জেলা শাখা। বিপুল পোষ্যবাহিনী। ভরণপোষণ আছে। ঠিক ব্যবসায়িক সূত্র। সবার নিচে রয়েছে জনগণের ভোট, আর সবার ওপরে রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা। জনগণ এখানে ব্যবসার কাঁচামাল। রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে দল সেই দলের পাতি থেকে প্রধান নেতা পর্যন্ত লুটপাটের ব্যবসা চালায়। এসবের ছিঁটেফোঁটা কিছু সুবিধে জনগণও পায়। বাঙালি ঈর্ষাকাতর জাতি। ঈর্ষা থেকেই রেষারেষি। প্রতিবেশী আক্কাসকে জব্দ করতে হবে। পাড়ার পাতিনেতার সাথে ভিড়ে থাকলে এই ক্ষমতা হবে। এছাড়া তো আছেই, জমি-জিরাত, মামলা-মোকদ্দমা। স্থানীয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি নানা ঝামেলা লেগেই থাকে। সেসব থেকে নিরাপদ থাকতে জনগণ মখলেস ভাইয়ের সাথে সখ্য রাখে। এই সখ্যটাই হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবসার পরিকল্পনাপত্র।
কোনো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসরণ অনেকের কাছে ধর্মের মতো অবশ্য পালনীয় হয়ে ওঠে। বাপ অমুক দল করতো, বাপের চৌদ্দগুষ্ঠি এখন ওই দল করে। কোন বাড়ির মানুষ কোন দল করে, সেসব ফিরিস্তি এলাকার সবার জানা। বাংলাদেশের যে কোনো একটি গ্রামে গিয়ে সবচেয়ে ঝকঝকে ও নতুন যে দালান বাড়িটা দেখা যাবে, সেই বাড়িটা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা একজন পাতিনেতার। এর বিপরীতে পুরনো দালান বাড়িগুলো ক্ষমতা হারানো রাজনৈতিক দলের পাতিনেতার। ক্ষমতায় থাকা, আর ক্ষমতায় না-থাকা দুটো দলের কাছেই জনগণ কিন্তু ব্যবসার কাঁচামাল। অথচ জনগণের কাছে নির্বাচন এক ধরনের উৎসব। ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে জনগণ ভোট দিতে যায়। অবশ্য যদি সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ হয়। বেশিরভাগ জাতীয় নির্বাচনেই ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম হয়। প্রত্যেক দলেরই যেন তীব্র প্রতীজ্ঞা, কোনো উপায়েই ব্যবসাটাকে হারানো যাবে না। রুটি-রুজির ব্যাপার! জনগণ মূর্খ। তারা ঠকতে চায়। ঠকতে চায় কারণ, তারা মূর্খ। রাষ্ট্র কিভাবে চলছে সেই বিষয়ে জনগণ উদাসীন। তারা খেয়েপরে বেঁচে থাকার সংগ্রামে দৌড়চ্ছে। তাদের এসব ভাবনার ফুরসৎ কোথায়?
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্বীকার করতেই হবে, স্মরণকালের মধ্যে ইউনূসের শাসনামলে দেশের প্রতিটি সেক্টরে উন্নয়নের প্রচ্ছন্ন প্রভাব সুস্পষ্ট। রাষ্ট্রের বিবিধ সেক্টরের দিকে সাধারণ মানুষের চোখ থাকে না। তারা এসব বোঝেও না। সাধারণ মানুষ খেয়েপরে দিন কাটাতে পারলেই সন্তুষ্ট। বাজারে খাদ্যদ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই আছে। এরপরও বাঙালির চরিত্র কি বদলেছে? কথায় বলে, কয়লা ধুলেও ময়লান যায় না। একইভাবে, বাঙালির জাতীয় চরিত্রে ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি সন্তুষ্টির চিহ্ন আমরা দেখতে পাই না। নিজের অভিজ্ঞতা বলি। গ্রামের চা-দোকানে বসে একজন বলছে, ‘ইনূস লোক ভালো না। ভোট দিতেছে না। ভোট আইলে বিম্পি থিকা বেশ ট্যাকা পাওয়া যাইতো।’
এটাই হচ্ছে বাঙালির রাজনৈতিক দর্শন। বাজারে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে, বিষয়টি ওই মানুষটির কাছে কোনো বার্তা দিচ্ছে না। তার চুলকানি উঠেছে, ভোট আসলে বিম্পির কাছ থেকে বেশকিছু টাকা পাওয়া যেত। নির্বাচনের আগদিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে শেষমুহূর্তে ভোট নিশ্চিত করে। এটাই বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এককালীন কিছু টাকা পেয়ে তুরাব আলিও খুশি। কিন্তু যে দল টাকা দিয়ে ভোট কিনে রাষ্ট্র-ক্ষমতায় আসবে সেই দল তুরাব আলির মতো কোটি-কোটি তুরাব আলির শ্রমে ভাগ বসিয়ে কত কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে, সেই হিসাব এই দেশের মানুষ রাখে না। রাখতে চায়ও না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল বাঙালির কাছে ফ্রেমের মতো হয়ে গেছে। এক-একটি দল মানে এক-একটি ফ্রেম। ওই ফ্রেমের ভেতর দিয়েই জনগণ রাষ্ট্রটাকে দ্যাখে। শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আজকাল গণতন্ত্র বলে একটা বহু-অর্থবাচক তথা বিভ্রান্তিকর শব্দ আবিষ্কৃত হয়েছে। যা আসলে সামন্ততন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। সত্য কথা বলতে গেলে, আদর্শ গণতন্ত্র এখনো সম্ভব কিনা তাই সন্দেহ। কারণ, আমাদের দেশের লোকের চরিত্র এমনই যে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি যা বলবে, শতমুখে তারই প্রতিধ্বনি উঠবে। আবার অপর একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি যদি বর্তমান ক্ষমতাসীন ব্যক্তির হাত থেকে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে তাহলে তিনি যেমনই হোক না কেন, তার মতই জনগণের ঠোঁটে ঠোঁটে বিপুল উল্লাসে ধ্বনিত হতে থাকবে। প্রধানত এই কারণেই আমাদের কর্তৃপক্ষের চারদিকে এমন একটা চাটুগিরির মোহনীয় আস্তরণের সৃষ্টি হয় যে, তার জাদুকরী প্রভাবে আমাদের কর্তা-ব্যক্তিরা প্রকৃত জনমতের সংস্পর্শে আসতে পারে না। আর তাদের পরিবেষ্টনকারী আস্তরণ খাঁটি না মেকি, সে চিন্তাও কখনো তাদের মনে আসে না। পরিতুষ্ট, বিশেষ করে আত্মতৃপ্তি এমনই মোলায়েম জিনিস। স্বভাবতই যে দেশে নিরক্ষর লোক শতকরা ৮০ জনেরও অধিক, সেখানে কিঞ্চিৎ শিক্ষিত বিত্তশালী ও প্রভাবশালী লোকেরাই তো ভাব ও আদর্শ যোগাবার মালিক। আর বিপুল জনতা তাদের পিছনে পিছনে জৈ-জোকার করা ছাড়া আর কিই-বা করতে পারে? এমন অবস্থায় গণতন্ত্রের অর্থই হলো আমলাতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র ও একনায়কত্ব।’
রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সর্বাংশে শিক্ষিত ও ভালো-মন্দের বোধসম্পন্ন জাতির জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, কোনোভাবেই মূর্খ জনগোষ্ঠির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হতে পারে না। কিন্তু সেই ব্যবস্থাকেই রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত ফ্রেম করে রেখে দেয়া হয়েছে। ওই ফ্রেমের বাইরে রাষ্ট্রের আর কোনো ব্যবস্থা যে আছে, জনগণকে সেটা বুঝতেও দেয়া হচ্ছে না। কারণ, জনগণ রাজনৈতিক ব্যবসার কাঁচামাল। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের দেশের মানুষ স্বস্তিতে আছে। সামান্য বোধজ্ঞান যাদের আছে তারা ইউনূসকে পাঁচ বছর দেশ চালাতে নানাভাবে অনুরোধ করছে। কিন্তু প্রধান একটি বিরোধী দল দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। নানা উপায়ে তারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে। বলছে যে, যেসব সংস্কার ড. ইউনূস করে যাবেন তাদের দল ক্ষমতায় গিয়ে সেসব সংস্কার ছুড়ে ফেলে দেবে। এরপরও দ্রুত নির্বাচনের ডামাডোল বাড়ছে ছাড়া কমছে না। ইউনূসকে রাষ্ট্র-ক্ষমতায় রাখার উপায় কী, সে বিষয়েও জনগণ জানে না। তারা আটকে আছে রাজনৈতিক দলের ফ্রেমে। এই ফ্রেমের বাইরে গিয়ে কোন উপায়ে ইউনূসকে সরকারে রাখা যায়, সে বিষয়ে জনগণ অজ্ঞ। তবে বেশিরভাগ মানুষই তাকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। মানুষ দেখেছে, যুগের পর যুগ ভোটের খেলায় কিভাবে তারা শোষিত হয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও হবে। এই শোষণ প্রক্রিয়াকে যেন দেশবাসী ভাগ্য হিসেবেই মেনে নিয়েছে।