spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকঈদ-উল-আযহা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব ও অন্যান্য

লিখেছেন : মীর সালমান শামিল

ঈদ-উল-আযহা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব ও অন্যান্য

মীর সালমান শামিল 

সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করলে ঈদ-উল-আযহা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব [উৎসবের সামাজিক গুরুত্বের হিসাবে বলছি, ধর্মীয় নয়]। 

২০২৫ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ২৪ লক্ষ ৭০ হাজার পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী এই পশুর দাম ৬৭ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি হিসাবে এটা ৮০ হাজার কোটিতে ঠেকবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সব মুসলিমই বাধ্যতামূলক ভাবে তিন ভাগের এক ভাগ গরিবদের দান করেন, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনদের উপহার দেন। অর্থাৎ মাত্র একদিনেই প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের মাংস দান এবং উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এটা বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ হয় এই ঈদুল আযহার মাংসে। 

কোরবানির পশুর চামড়া আরো একটি প্রধান উপাদান এই ঈদে। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০২৫ সালে চামড়া বিক্রি হবে ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এবং পুরো টাকাটাই গরিব এবং এতিমদের দেওয়া হয়। এত টাকা একত্রে আর কোন দিন দান করা হয় না। এটাও বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঈদুল আযহার মূল কথাই হল— কোরবানি। গরিবকে দাও, আত্মীয় স্বজনদের দাও, এতিমদের দাও। দান করো, উপহার দাও। আল্লাহ আপনাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করুন। 

ঈদুল আযহার চেয়ে বড় বড় ধর্মীয় উৎসব আরো আছে। তবে সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে, সামাজিক সম্প্রতি স্থাপন এবং আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করনে কোরবানির ঈদ যে ভূমিকা পালন করে; বাকী সব উৎসব একত্র করলেও সম্ভবত তার ধারের কাছে যেতে পারবে না।

— ঈদ-উল-আযহা: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব।

২.

পূর্ব বাংলার অভিনবত্ব সম্ভবত একটা জায়গাতেই, গরুর মাংস। গরুর মাংসের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রক্ত দিতে হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। বনী ইসরাইলের সামেরির পরে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গরু হল পূর্ব বাংলার গরু। 

সিলেটের রাজা গৌড় গৌবিন্দ সম্পর্কে কম বেশি সবারই জানা। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে একজন ব্যক্তি উনার শিশুপুত্রের আকিকার জন্য গরু কুরবানী করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গৌড় গোবিন্দ শেখ বোরহানউদ্দিনের হাত কেটে দেয় এবং শিশু পুত্রকে হত্যা করেন। বোরহানউদ্দিন সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। ফিরোজ শাহ উনার ভাতিজা সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একটা সেনাবাহিনী পাঠান। গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে সিকান্দার গাজী দুইবার পরাজিত হন। তৃতীয়বার প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে আবারও অভিযান প্রেরণ করা হয়। এই জিহাদে ৩৬০ জন দরবেশকে নিয়ে হযরত শাহজালাল (র.) নাসিরুদ্দিনের বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয় এবং সিলেট মুসলমান শাসন শুরু হয়। সময়টা ছিল ১৩০৩ সাল। 

এর ২০০ বছর আগে একই ধরনের ঘটনা ঘটে মুন্সিগঞ্জে। ১১৭৮ সালে এখানে ইসলাম প্রচার করতে আরব থেকে আসেন দরবেশ হযরত আদম (র.)। তিনি একটি গরু কোরবানি করেন। এতে রাজা বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে হযরত আদম (র.)-কে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। এর প্রতিক্রিয়াতে মুন্সিগঞ্জেও মুসলমান সালতানাত প্রতিষ্ঠা হয়।

১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের আমলে সূর্যাস্ত আইন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন আইনের কারনে প্রায় সব মুসলিম জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের স্থানে বসানো হয় হিন্দুদের। হিন্দু জমিদাররা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত গৌড় গৌবিন্দ, বল্লাল সেনদের মত গরু কোরবানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়। 

মুসলমানরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সংগ্রাম করে, ব্রিটিশ সরকারকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়। এতে হিন্দু জমিদাররা আরো ক্রুদ্ধ হয় এবং চরমতম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তা দমন করে। 

ঢাকায় নবাব পরিবারের প্রভাব ছিল, একমাত্র এই ঢাকা ছাড়া সারাদেশে কোথাও মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারতো না। সবাই ছাগল(বকরি) কোরবানি দিতো। তাই কালক্রমে ঈদুল আজহা ‘বকরির ঈদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। 

এভাবেই চলে শত বছর। এরপর খাজা সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। তারপর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ১৯৪৭। পূর্ব বাংলা মুক্ত হয় ব্রিটিশ বেনিয়া এবং হিন্দু জমিদারদের কালো হাত থেকে। 

সুবাতাস বইতে শুরু করে। তবে তা একদিনে হয়নি। প্রাক্তন আমলা পি.এ নজির “স্মৃতির পাতা থেকে” বইয়ে চাকুরী জীবনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন।  দেশভাগের পরেও ক্ষমতাবান সদ্য বিগত হওয়া হিন্দু জমিদারদের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু কুরবানি দেওয়া অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৬ সালেও নাটোরের মানুষ গরু কোরবানি দেবার কথা ভাবতেও পারতো না। উনার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে নাটোর শহরে প্রথমবারের মত গরু কোরবানি দেওয়া হয় তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। একের পর এক বাঁধা আসে। একই অবস্থা ছিলো ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোরে।

এখন এই পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা গরু কোরবানি দিতে পারে কিন্তু উপমহাদেশের গল্প ভিন্ন। আমাদের নড়বড়ে সীমান্তের ওপারে আরএসএস, বিজেপির ভারতে এখনো গরু কোরবানি করা নিষিদ্ধ। কাস্মীরে তো সব ধরনের কোরবানিই নিষিদ্ধ। এখনো ভারতের মুসলমানরা ঈদুল আযহাতে ছাগল কোরবানি করে। এখনো ভারতে ঈদুল আযহাকে বকরির ঈদ বলে অভিহিত করা হয়।

গরুর মাংস নেহাৎ একটা খাবার না। গরুর মাংস পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শত বছরের সংগ্রামের একটা চিহ্ন। সম্ভবত এজন্য নজরুল বলেছিলেন—

❝ওরে হ-ত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খু-ন-মোচন!

ওরে হ-ত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্‌বোধন।

৩.

মরক্কো থেকে কাস্মীর পর্যন্ত মুসলমান বিশ্ব সংযুক্ত। এর বাইরে মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই আছে এক ক্লাস্টারে। কিন্তু আমরা আছি একটা দ্বীপের মত, মেইনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, চারদিকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ পরিবেষ্টিত। 

এই ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব পড়েছে অন্য সব দিকে।

১। আমাদের ধর্মীয় পরিচয় আমরা মুসলমান। 

২। আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় আমরা মুসলমান। 

৩। এবং, আমাদের কালচারাল পরিচয়ও আমরা মুসলমান। 

যদি মুসলমান বিশ্বের অন্য কোন দেশের কথা ভাবা যায়, যেমন ফিলিস্তিন। তাদের কালচারাল পরিচয় তারা ফিলিস্তিনি। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় তারা আরব। আর ধর্মীয় পরিচয় হলো তারা মুসলমান। কিন্তু আমাদের সবগুলো পরিচয় একটাই, আমরা মুসলমান। 

এই যে আমাদের ৩ দিকে ভারত, তারমধ্যে আলাদা দেশ হয়েছি এর কারন আমরা মুসলমান। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার হিন্দুরা আলাদা দেশ চায়নি, তারা ভারতের সাথেই থাকতে চেয়েছিলো।

এখনো হিন্দু মহাজোটের সভায় গোবিন্দ প্রমানিক প্রকাশ্যে ভাষণ দিয়ে ভারতকে আহ্বান জানায় বাংলাদেশকে এনেক্স করতে। কিন্তু মুসলমানেরা ভারতের সাথে যোগ দিতে চায় না। তারা আলাদা পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি চায় কারন তাদের ধর্ম। 

যদি সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের খৃষ্টান, আল ওয়াতি, বা দ্রুয সম্প্রদায়কে দেখেন। তাদের পোশাক, খাবার, নামও সিরিয়ান মুসলমানদের মত। সিরিয়ান খৃষ্টানেরা গডকে আল্লাহ বলে। 

কিন্তু বাংলার মুসলমান এবং হিন্দুদের পোশাক ভিন্ন, নাম ভিন্ন, খাবার ভিন্ন, খাবারের পাত্র ভিন্ন, এমনকি ভাষাও আলাদা। মুসলমান এবং হিন্দুদের ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুচ্ছ তথা পরিবার এবং সম্পর্ক বাচক শব্দগুলো আলাদা। 

কোরবানি ঈদ নিয়ে প্রতিবেশীদের এত প্রতিক্রিয়ার কারন এটা। তার চোখে কোরবানি শুধু ধর্মীয় আচার না…

গরু কুরবানি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান না, গরু কুরবানি পূর্ব বাংলার সার্বভৌমত্বের স্মারক। 

………

লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি