মাহমুদ নোমান
ঝুরঝুরে ভাষায় কুড়মুড়ে ভাবে স্মার্ট উপমায় ঠাসা, অপরূপ বুণটে জৌলুসভরা শোয়েরা সারওয়ারের একেকটি কবিতা। কোনো দ্বান্দ্বিকতা নেয় অথচ রসসিক্ত সবুজের সমারোহে এইমাত্র যেন রোদ উঠল; সাবলীল বোধসম্পন্ন কবিতাগুলো বিষয়- বৈচিত্রের গাম্ভীর্যতায় খোলাসা করে উপস্থাপনের স্বকীয়তার ঢঙ মনোমুগ্ধকর। চিত্রকল্পের ভাসানে পাঠক ভেসে চলে ভাববেগের ভেলায়, যখন বলে –
জোয়ার- ভাটায় নেশাগ্রস্ত নোনা কলসীতে অগ্নি ঝলমলে/ মুচকি ঢেউয়ে মিষ্টিজলে দুজন- দুজনার হৃদয় খু’ লে।
- নোনাজলে মিষ্টি কলসী)
শোয়েরা সারওয়ার বিষয়কে প্রেমবিন্দুতে রেখে কম্পাস ঘুরিয়ে চলে জীবনের সম্পাদ্যে; ছলকে ছলকে উঠে ভাবের ভাবনদীর জল হয়তো প্রেমে জয় করতে চায় নিজস্ব পৃথিবী। কখনো কখনো বিষন্নতার বলয়ে পাঠককে মারাত্মক সত্যের আয়নার সামনে দাঁড় করায়,নিজেদের ভেলকিবাজির মায়াখেলার প্রতিবিম্ব যেন –
জীবনটা শুধু চেয়েছিল নির্দোষ চুমুর ঝিল,হিংস্রতাহীন সঙ্গম/ জলজ ফুলের রসে সবকটা কাফন গোধূলীতে অনাত্মীয়, একা
- জলের সিগন্যাল )
দুই.
আজকালকার কবিতা সময়তাড়িত শৈল্পিক যন্ত্রণায় কাতরায়ে খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব গতিপথ। বিশেষভাবে ভ্রম অর্থ্যাৎ বিভ্রমে,আমি বলি ঠেঁস কথায় মানে এক সত্যকে অন্য সত্যে দাঁড় করিয়ে বিষয়বাষ্পের সমূহ স্বার্থ হাসিল করার নবতর প্রয়াস। এটাকে পরাবাস্তববাদ( সুয়ারিয়ালিজম) বলে। শোয়েরা সারওয়ার যখন বলে-
নোলক পড়া কোকিলের ডাকে পাড়ায় উৎসব/ কোকিল তুই আমার ঠোঁটে শিস হয়ে থাক।
- ফাগুনের মাদক)
পরাবাস্তবতা মানে ইঙ্গিতময়তা,এক বিষয়ে বলতে গিয়ে অনেক বিষয়ের ঘনঘটা,অনেক ভাবের আস্ফালন কবিতাকে দিয়েছে অবাধ বিচরণভূমি। আর এখান থেকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে গদ্যছন্দ। গদ্যছন্দ বললে ভাবের ছন্দ বুঝি মানে দমের নাচন। দম যেখানে পড়ে সেখানে বিরামচিহ্নের ব্যবহারে কবিতায় আনে নান্দনিকতা। এখানে একজন মহৎ কবি হৃদয়বৃত্তির গভীরতা ও বহুমাত্রিকতার অবলম্বনে পাঠক মনের খোরাক দেয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞানে জীবনদ্রষ্টা কবিকে কখনো- কখনো আপন চরিত্রের অধিক মহিমায় উত্তীর্ণ করে। আপন সৃষ্টিতে হয়ে ওঠেন অমর,অজর,অক্ষয়। কবি শোয়েরা সারওয়ার নিরেট গদ্যছন্দে নিজের সৃষ্টির ব্যঞ্জনা দিয়েছেন অন্যমাত্রায় –
ক.
প্রতি শ্রাবণে জোনাকিরা সম্মিলিত শব্দে খুনসুটি খেলবে/ আমার অন্ধকার মুখে আয়না তুলে!/ আমিও চুপিচুপি কবিতার স্ফীত পরশে আসবো/ বৃষ্টি রঙের শাড়ী পড়ে!
- বৃষ্টি রঙের শাড়ী)
খ.
আজকাল কুয়াশাও চিবুক ঝাঁকিয়ে বলে/ ওগুলো আমি না/ কোনো নাটকের রিহার্সালে উড়নচণ্ডী ঘামের দানা/ মানুষগুলো চিবুক নাচিয়ে সারাদিন যতোই বলুক/ আর ভাবুক আসলে সবই হয় অন্য চিবুকের বর্ণে/- মানুষ তার নিজ জিহ্বার কাছেও অচেনা
- এসব কিছুই আমার নয়)
তিন.
সমাজস্বভাব,মানব- অস্তিত্ব ও রাজনীতির বহিঃপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবির মধ্যেও অন্তর্বিবর্তনের নিগূঢ় শিল্পক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। রাষ্ট্রের ভেতর- বাহিরের রক্তক্ষরণ,ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনের বিদীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত রূপ শোয়েরা সারওয়ারের কবিতায় বিপন্নতা,নৈঃসঙ্গ্য,হতাশা,যন্ত্রণা এবং স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের পীড়িত হয়। উচ্চারণ করে-
বাংলাদেশ,/ তুমি এখোন আমার চোখের নীচে আর্তনাদের আছাড়ে/ প্রেমহীন বড় একটা কালো ছায়া।
- প্রেমিকের খোঁজে)
খ.
খেয়ার কোলে ডুব দিয়ে ফিতে সব খুলছে;/লালজিভে ভেসে আসে কামড় তুলে ক্ষুধার্ত নলে/- শাসককুলের কামনা কেবলই নাব্যতার কথা ভুলে!
- ডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে)
শোয়েরা সারওয়ার এসবের মাঝেও স্বপ্ন দেখেন,দেখান ও স্বপ্নের মাঝে সুন্দরের আশ্বাস দেন। উপমার,প্রতীক ও শব্দঋণে চমৎকৃত,চিত্রকল্প অনবদ্যতায় বলে –
শিল্পী ধমক দিয়ে বললেন,/এই মেয়ে তোমার গল্প শুনে জেদ হচ্ছে,মেয়ে আমার হাত ধরো/ মেয়েটি বললো,আমি ভয় পাচ্ছি/ উনি বললেন,ভয় করলেই ভয়/দেহের জয়ে ভয় মিলিয়ে হবে ম্যাজিক রক্তগোলাপ।
- বৃষ্টি ছুঁয়ে বলছি)
খ.
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখদুটো দূরবীন করে/ গন্তব্যমুখী ট্রেনের অপেক্ষায়/ ভোরবেলাকার কুয়াশায় গিলাপ মোড়ানো ট্রেন-/ শব্দহীন মন তোমার অক্সিজেনে রঙ্গে বিরঙ্গে আটক!
- সিঁথিতে শিশির)
|||
অন্ধকার উঠোনে অপরূপ শ্রী
শোয়েরা সারওয়ার
দেয়াঙ পাবলিশার্স
ধরনঃ কবিতা
প্রচ্ছদঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্যঃ ২০০ টাকা