spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগল্পলাল সুতো আর নীল সুতো

লিখেছেন : চরু হক

লাল সুতো আর নীল সুতো

চরু হক

সিরিজ-১. বৃষ্টির ঠিক আগে

সন্ধ্যা সাতটা কি আটটা হবে। গুনে গুনে পনেরো জন ওরা। ভুল করে নাকি ইচ্ছা করে কে জানে। বাতাস একটু দমকা হাওয়া দিল অমনি সুড়সুড় করে ওরা ঢুকে গেল তানিয়ার ঘরটাতে। এসেই এমন ঝাপটা ঝাপটি শুরু করলো,দেখে তার তো চোখ ছানাবড়া। কোত্থেকে এলো ওরা! তাও একেবারে লটবহর নিয়ে! ঋভু হকচকিয়ে বলে, তানিয়া দেখ, দেখ কতগুলো পাখি! দিশান বলে, তাইতো তাইতো! অবাক ব্যাপার। পথ ভুল করে এলো নাকি! ঋভু নাচানাচি শুরু করে দিল, অতিথি এসেছে, অতিথি এসেছে আমাদের বাসায় বলে চেঁচাতে লাগলো।
অত চেঁচাস না। তাহলে তো পালাবে ওগুলো। দেখছিস না ভয় পায় আমাদের। তানিয়া ধমকের সুরে বলে। চড়ুই পাখি গুলোর ছাই রঙের ছোট্ট ছোট্ট ডানা, নরম কোমল ওদের গা। ঘরের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে খেতে শেষমেষ ফ্যানের উপর গিয়ে বসলো। একটা পাখি ছিটকে এসে পড়ে বিছানায়। হইহই শুরু করে দিলো ঋভু। ছানাটিকে হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। পাখির ছানা তো একদম ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে । এ দেখে পড়ি মরি করে ছুটে আসে তানিয়া, কি করছিস এগুলো ? এই ছাড় ছাড়! তোরা যদি এমন করিস পাখিগুলো তো ভয়েই মরে যাবে। বলে ওটাকে আলতো করে ধরে জানালার কার্নিশে রেখে দেয় সে।
যা তা গরম পড়েছে আজকে। প্রচন্ড গরমে কাঠফাটা রোদ ছিল দিনের বেলায়। এখনো বেশ গরম ভাপ ছাড়ছে।
পাখিগুলো কিন্তু কতক্ষণ ছটফট করে ডানা ঝাপটাঝাপটি করে ফ্যানের পাখার মধ্যেই বসে থাকলো। তানিয়া একবার তাড়িয়ে দিতে চাইলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। যাক শেষমেষ একটা জুতসই ঘুমের বিছানা পাওয়া গেল মনে করে পাখিগুলো ওখানে আরাম করে যার যার বিছানা বালিশ পেতে বসলো।
কি বিচ্ছিরি গরম রে বাবা, দিশান বলে ওঠে। ফ্যানটা একটু ছাড় না তানিয়া।
এই গাধা তুই কি দেখছিস না পাখিরা ওখানে রেস্ট নিচ্ছে? ফ্যান ছাড়লে ওরা তো কেটে কুচি কুচি হয়ে যাবে।
এখনো উপায়! কাঁদো কাঁদো গলা দিশানের। ফ্যান ছাড়া ঘুমাবো কি করে? এত গরম।
চুপ করে থাক তুই। ওরা এখন ঘুমোবে। কথা বললে ঘুমাবে কি করে? জানিস না ওরা তো খুব লাজুক, খুব ভয় পায় মানুষকে।
ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল দিশান। ফ্যান ছাড়া আমি কিভাবে ঘুমাবো।
তানিয়া দিশানের মাথায় হাত বুলাতে থাকে, লক্ষ্মী ভাই তুই আমার,জাদু ভাই, এমন করতে হয় না। দেখ ওদের দিকে তাকিয়ে কেমন কষ্টে পড়েছে আজ ওরা। কোথায় ঘর, কোথায় বাড়ি, কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। রাস্তা হারিয়ে চলে এসেছে আমাদের এখানে। আর দেখ,এই দেখ না, ওরা তো আজকে আমাদের অতিথি। কি মজার না ব্যাপারটা। এতগুলো পাখি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে, দারুণ ব্যাপার কিন্তু ভেবে দেখ একটু। আর হ্যাঁ, তুই যদি ওদেরকে ঠিকমত আদর না করিস, যত্ন না করিস তাহলে কিন্তু আর কখনো তোর কাছে আসবে না তখন কেমন বুঝবি মজাটা!
দিশান চোখ মুছে তানিয়ার দিকে তাকায়, সত্যি বলছিস আপু?
চোখ পিটপিট করে তানিয়া, হ্যাঁ সত্যিই বলছি। আজকে ওরা আমাদের বাসায় এসেছে,আমাদের অতিথি। ওদের যাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয় সেটাই করতে হবে।
সেটাই করতে হবে, সেটাই করতে হবে, বারান্দার টিয়া ওর সাথে সুর মিলায়। তানিয়া আর ঋভু মুচকি হেসে দিশানের দিকে তাকায়।
পাখিগুলো ফ্যানের পাখার ওপর বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঝিমোতে থাকলো । দিশানকে ওরা শুইয়ে দিল পাশের ঘরে ছোট চাচুর সাথে। লাইট অফ করে ফ্যান না ছেড়েই ঋভু আর তানিয়া শুয়ে পড়ে বিছানায়। একটা রাতই তো। একটু গরম লাগছে, এই যা। তাতে এমন কীই বা এসে যায়!
মা কানে কানে এসে বললো, ভারী লক্ষ্মী ছানাপোনারা আমার। দেখ পাখিগুলো এমনভাবে ঘুমোচ্ছে যেনো কোনো মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আকাশের দু’একটা তারা তাদের কান্ড -সান্ড দেখতে লাগলো। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঋভুর মুখের ঘাম মুছে দিয়ে আলতো করে চুম এঁকে দেয় কপালে।

সিরিজ- ২. গাছের রঙ কই

চলো চলো চলো। বেশ হাওয়া বইছে। এমন দিনে ঘরে থাকতে মানা।
তা তো বুঝলাম কিন্তু যাব কোথায়?
‘যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে ‘।
আচ্ছা তাই সই।
ভুবনে যে লুটতরাজ চলছে তা স্বচক্ষে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লো ওরা তিনজন,তানিয়া,নীরা আর ছোট চাচু।
আমিও যাব, আমিও যাব,বলে খুশিতে ডিগবাজি খায় দিশান।
এ অবস্থায় তাকে রেখে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে। তাই ওকেও নিতে হলো শেষে।ছোট চাচু বলল, দিশান কে নিবিনা কি বলিস? ও না গেলে একদম জমেই না। ফলে দুধভাত দিশানসহ মোটেমাটে চারজন।
ওরা চারজন বেরিয়ে পড়লো নয়টার দিকে। খিলগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে চৌরাস্তা, চৌরাস্তা থেকে একটা সিএনজি নিয়ে একেবারে মাওয়া ঘাট। ভাড়া আটশো টাকা। তিনজনে চেপেচুপে সিটে বসলো আর দিশান বসলো ছোট চাচুর কোলে। মেঘলা আকাশ, ভেজা ভেজা সবকিছু। হাওয়ার পরীরা সুযোগ খুঁজছে মাটিতে নেমে আসার। ওরা তাদের স্বাগত জানাতে চায়। দেখনা কেমন ফুরফুরে বাতাসে কচি সবুজ গাছের পাতাগুলো কেমন তির তির করছে।!মনে হলো কি এক নতুন কথা বলতে চাচ্ছে আজকে। তানিয়া কান পাতে। ওরা বলল এখন না পরে; এখনো সময় আসেনি।
দুই পাশে দারুণ ঝিল পানিতে টইটম্বুর। দূর দিগন্তে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে ওদের বাচ্চা কাচ্চা সঙ্গীদের কাছে। আকাশ আঁধার হয়ে আসে এই বুঝি বৃষ্টি নামবে, নীরবতার গান ভেঙ্গে গাঙ্গিনার পাড় ভেঙ্গে ভাসিয়ে দেবে সমস্ত দিগদিগন্ত । ওরা ছুটছে যেনো উল্কার বেগে। দিশান ঘুমিয়ে গেলে তানিয়া ওকে কোলে নিয়ে নেয়। ছোট চাচু একটু রেস্ট করুক।
মাওয়া ঘাটে যখন তারা পৌঁছালো তখন দুপুর একটা বাজে। রাস্তার দু’ধারের সবুজ শ্যামলিমা দেখতে দেখতে প্রাণ শীতল হয়ে আসে।
এসে গেছি এসে গেছি বলে চেঁচাতে শুরু করে দিশান। সামনে তাকিয়ে দেখে একি, আশ্চর্য এক নদী!
এই দেখ দেখ নদী কথা বলছে, বলে উঠলো নীরা।
তাইতো। আমরা সবাই দাঁড়ালাম নদীর সামনে। পদ্মা নদীর সামনে। দুপুরের পদ্মা অনেক শান্ত ও সমাহীত। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু জল আর জল। পাশে পলি জমে চর পড়েছে। নৌকা দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়।
একটা নৌকা নেয়া হোক।
দাঁড়া দাঁড়া পেট তো জানান দিচ্ছে। তাকে শান্ত করে নেই।
ওই যে সামনে একটা হোটেল, ভালো মনে হচ্ছে, চল যাই ওখানেই।
সবাই মিলে তারা হোটেলে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে বসে গেলো একেবারে নদীর পাড়ের টেবিলে। নদীর বাতাস আসছে ঝিরিঝিরি, মনে হচ্ছে কেউ যেন এসি ছেড়ে দিয়েছে।
হ্যাঁ এসিই তো। প্রকৃতি তোমার জন্য বিশাল এসির ব্যবস্থা করে রেখেছে। দেখো কি মিষ্টি বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আহা, তার সাথে যদি একটু মিরিন্ডা থাকতো, কি যুৎসই না হতো। দিশান বলে উঠলো।
হবে হবে, সবই হবে। চিন্তা করো না। চাচু যখন আছে আর কোন ঝামেলা নাই।
ঠিক তাই। চাচু নদীর মাছ, আম ডাল, আর নানা প্রকার ভর্তা অর্ডার দিল। মায়ের স্বভাব তো জানো। ভাত টানার স্বভাব। আসার সময় মা একটা প্লাস্টিকের বক্সে করে মুরগির মাংস সবজি আর ভাত দিয়ে দিয়েছিল। আমরা ওগুলোও নিলাম।
সব মিলিয়ে ফার্স্ট ক্লাস খাওয়া হলো, একেবারে গলা পর্যন্ত যাকে বলে। সবশেষে আসলো দই আর মিরিন্ডা। কাকু দিশানের কানে কানে বললো, দেখ আমিও কিন্তু মিরিন্ডা খেতে খুব ভালোবাসি। তবে তোর মা দেখলে খুব বকা দেয়।
নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে ওরা চরে এসে পড়লো। নরম মাটিতে শুরু হলো ছোটাছুটি, দৌড়ঝাঁপ। কিছু লতা গাছ আর ফুল পেড়ে নিলো তানিয়া আর নীরা। চাচু আর দিশানকে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা গাছের তলায় তাদের উদ্ধার করা হলো। মাটিতে শুয়ে আছে তারা, আকাশ দেখবে বলে।
দিশান আর ছোট চাচু মাটির গন্ধ শুঁকছে প্রাণ ভরে। তানিয়া আর নীরা ফুল তুলতে লাগলো, শামুক ঝিনুক জোগাড় করতে লাগলো। মালা গাঁথতে হবে তো!
ওরা সবাই পাতার গন্ধ নেয়। হাওয়া আর মেঘের গন্ধ নেয়। ওরা সবাই মাটির গন্ধ নেয়। গাছের ছায়ায় বসে, গাছের গোড়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাতাদের গায়ে আদর বোলায়। ও পাতারা তোমরা কোত্থেকে এসেছ? কি তোমাদের নাম? কি তোমাদের রঙ? সারা বিকেল এক ঘোরের মধ্যে থেকে ওরা সবাই গাছের ভাষা আর রঙ খুঁজে বেড়ায়। হলুদ সবুজ লালে কেমন সাজে সে! চাচু বললো, জানো এই রঙের ভেতরেও আরো কিছু রঙ গাছ বহন করে, দেখতে পাচ্ছ সেই রঙ?
সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা,আর আকাশের নিভু নিভু আলোয় ওরা চারজন সেই অদেখা রঙটি খুঁজে বেড়ায়।

সিরিজ-৩. সাদা রিবন, দুলছে বেণী

কিরে মওকা পেয়ে খুব ঘুমাচ্ছিস? স্কুল কামাই দেবার স্বভাবটা তোর একেবারে রেগুলার হয়ে গেছে। উঠবি নাকি মাথায় পানি ঢেলে দেব? মার সরিষা ফুলের মধুমাখা কন্ঠটা একেবারে বাজখাই হয়ে উঠলো। জানোতো তানিয়াটা একেবারে গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি, গায়ে মাখলোনা মার চোখ রাঙানি। হেলে দুলে ঘুম থেকে উঠে গুনগুন করে একটা গান ধরে ব্রাশে পেস্ট মাখালো, রাস্তার টেবিল থেকে রুটি আর জ্যাম নিয়ে কতকটা খেলো আর কতকটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নষ্ট করে রেখে দিল। আচারের বোতল খুলে আচারে কামড় দিল। তারপর ধীরে সুস্থে সাদা রিবন দিয়ে ছোট্ট দুটি বেণী করে রওনা দিল কলেজে। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ মোহাম্মদপুর বাসা থেকে ঢের দূর। তাই তাকে বাসে যেতে হয় প্রতিদিনই। অবশ্য এ কিছু না তার কাছে, একেবারে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন বরং বাসে না চড়ে সিএনজি নিলে তার উসখুস লাগে।
চৈতালি বাসে একটা পিঁপড়া দাঁড়াবার ও জায়গা নেই। ঠেলে ঠুলে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে দিয়ে একটা সিট ধরে কোনো ভাবে দাঁড়ালো সে। পিঠে বইয়ের ব্যাগ যেন মস্ত বড় একটা কচ্ছপ কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মাছির চোখের মত চারদিকে নজর রাখছে কখন একটা সিট পাওয়া যাবে আর অমনি সেটার মালিকানা হস্তগত করবে।
আহ ভাগ্যদেবী আজ পূবাকাশে তার জন্য। মিনিট দশেকের মধ্যেই চমৎকার একটা আসন মিলে গেল। শান্তি, শান্তি উহ। যাক এবার চোখটা বন্ধ করে থাকি আধা ঘন্টা। মনে মনে হিসাব কষছে সে। তারপর অসীম স্যারের হোমওয়ার্ক গুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই হল। তন্দ্রাদেবী আশেপাশেই ঘুরছে। তো তিনি যখন এসেছেনই দয়া করে তার নির্দেশ না মেনে উপায় কি। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজলো তানিয়া। আর এমন সময়ই ঘটলো ঘটনাটা। কি আর বলি। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেলে তানিয়া দেখে সামনে দন্ডায়মান একজন বয়স্ক লোক। বয়স সত্তর আশি হবে । হাড্ডিসার শরীরে চামড়া তার কুঁচকে বসে আছে। দাঁড়াতে পারছে না ঠিকমত। লাঠি ভর করে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকজন লোক বোধকরি তার ছেলেই হবে প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দুলছে। মরি আরকি,কী আর করা। এত কষ্ট করে সিটটা পেলাম। যাক কি আর করি। উঠে দাঁড়িয়ে গেল তানিয়া। বলল, কাকু আপনি বসুন। কথাটা শুনে তানিয়ার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে কাকু একটু মোচড়ামুচড়ি করতে থাকলো।
তুমি বসো মা তুমি বসো। উঠে গেলে সিট পাবে না আর। কিছুটাই বসতে চায় না কাকু। কিন্তু তানিয়াও নাছোড়বান্দা। বলে উঠলো আপনি বসুন, এ বাসে অনেক সিট পাওয়া যায়। আমি বসে যাব কোথাও। কি আর করা শুভ্র বাগান মাথায় নিয়ে ঘোরা কাকু সিটে বসলেন। তানিয়া পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কাকু খুব কাচুমাচু করছিল। বারবার তানিয়ার দিকে তাকাচ্ছিল। কোথায় যাবে মা। উত্তরা। ওখানে কেন? আমি উত্তরা রাজউক মডেল কলেজের ছাত্রী কাকু। ভারী মিষ্টি মেয়ে তো তুমি। লজ্জা লাগছে, আমার জন্য তোমাকে কষ্টে পড়তে হলো। লজ্জা করে আর কি হবে। এভাবে চল্লিশ মিনিট চ্যাং দোলা হয়ে থাকার পর শেষমেষ উত্তরা পৌঁছালো বেচারা। বিকেল বেলা ঘটনা শুনে ঋভু রেগে কাঁই। তোর জন্য এটাই ঠিক আছে রে,বুঝলি। গাধী কোথাকার।
পরের দিন একপাশে সে বসেছে, আর অপর পাশে বসেছে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। হাসি তামশা করতে করতে যাচ্ছে। ভালোই লাগছিল তাদের দেখতে। কিন্তু হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি বিনা নোটিসে হেলে পরল। পাশের মেয়েটি হতবাক, কি হলো। হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে তার, দাঁতকপাটি লেগে পড়ে আছে। শ্বাস নিচ্ছে নাকি নিচ্ছে না বোঝা যাচ্ছে না। হেল্পার ও আরো কয়েকজন ছুটে এলো। শক্ত হয়ে আটকে গেছে দাঁত। খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। হাত পা শক্ত হয়ে বেঁকে গেছে,
নিঃশ্বাসের কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম দৃশ্য তার জীবনে এই প্রথম। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। যদি অন্য কিছু হয় তাহলে কি হবে। ইয়ে মানে যদি মরে টরে যায়।কেউই সে লোকের ঠিকানা জানে না। জানে না কোত্থেকে এসেছে, কোথায় যাচ্ছে, কীই বা তার কাজ। তানিয়ার ভয়ে কান্না জুড়বে জুড়বে ভাব, এই আর কি। সবাই বলাবলি করছে স্ট্রোক করেছে স্ট্রোক করেছে। তানিয়া চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, উনাকে ডাক্তারের কাছে নিচ্ছেন না কেন? কে নেবে ডাক্তারের কাছে। এখানে তো তার পরিচিত কেউ নেই। কঠিন দায়িত্ব নিয়ে হ্যাপা করতে চায়না কেউ। তানিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। তোতা পাখির মত বলতে লাগলো হার্টবিট চেক করেন, হার্টবিট চেক করেন।
হ্যাঁ এখনো শ্বাস পড়ছে তবে অজ্ঞান হয়ে আছে। ওষুধপত্র কিছু থাকলেও খাওয়ানো যেত। কিন্তু ব্যাগে কেবল মায়ের ভেজে দেয়া নুডলস আর এক বোতল পানি আর একটা মরা তেলাপোকা যেটা দিয়ে সে প্রাক্টিকাল করবে এগুলো ছাড়া কিছুই নেই। হঠাৎ মনে পড়ল তার, তাইতো, ব্যাগে তো একটা মঙ্গল কাঠি আছে। ওটা বের করে লোকটার হাতটা টেনে নিল তার কোলের কাছে। তারপর এরকম অবস্থায় যে আকুপ্রেসার করতে হয় সেটা করে দিতে লাগলো। লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার কাণ্ডকারখানা দেখে। বলছে আপনার কেউ হয় নাকি। তানিয়া কোন জবাব দিল না । লোকজন মুখে মাথায় আমি ছিটাতে লাগলো। আর তানিয়া হাত ধরে আকুপ্রেসার করে দিতে লাগলো এক মনে।
মিনিট পাঁচেক পরে লোকটার জ্ঞান ফিরল। যাক বাবা কি দেখে যে আজ বের হয়েছিলাম। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট লোকটার হাতে দিয়ে তানিয়া বলল ভাই, কিছু খেয়ে নিয়েন। টাকাটা মা তাকে দিয়েছিল ফেরার পথে দিশানের জন্য ক্যাটবেরি চকলেট আনতে। কি আর করা সবই কপালের ফের।
অবাক করে দিয়ে মা কিন্তু এবার বকুনি দিল না। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে মা।
বিকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসবো অমনি দিশানের লাফালাফি শুরু হলো। বিকালের পাঠশালায় যাবে, বিকেলের পাঠশালায় যাবে। মানে রাস্তার ধারে গিয়ে ফুসকার দোকানে বসে ফুচকা গিলবে। এতে অবশ্য তানিয়ার বিশেষ কোনো না নেই। ফুচকাওয়ালা ফুচকা বানায় আর দিশানের সাথে গুঁতোগুতি করে। ঝাল ঝাল তবে মজাই লাগে খেতে। অনেক হকার বসেছে বাহারি কাপড়ের পশরা সাজিয়ে। আরো নানা লোকজন ছুটছে তো ছুটছেই, যেন ট্রেন ধরবে ওরা। ট্রেনের হুইসেল পড়ে গেছে। দিশান ফুচকা সবটুক খেলো, ঋভুরটা থেকেও ভাগ নিল, তারপর সবটুকু টক চেটেপুটে খেলো। রাস্তার রাজার ঝলমলে আলোকবাতি গুলোকে গুনছে সে। সবশেষে যখন তানিয়া বিল দিতে গেল ফুচকাওয়ালা হাসতে হাসতে বলে লাগবে না, লাগবেনা আপা। কি বলেন আমরা কি ফ্রি খাবো নাকি। লজ্জায় নাকটা লাল হয়ে গেল তার, কিন্তু ফ্রি খাবার আশায় মুখে তার একশ ওয়াটের ভালব জ্বলে উঠলো। ফুচকাওয়ালা হাসতে হাসতে বলে,আপা ঐদিন না আপনি দুইশো টাকার নোট দিয়ে গেছিলেন। ফেরতটা তো দেননি। পিছন থেকে আমি আপনাকে কত ডাকলাম আপনি কিছুতেই শুনলেন না।
ঋভু আর দিশান দুজনেই একসাথে খলবল করে ওঠে,
আপুনি এখানেও? য়্যাঁ?

সিরিজ- ৪. স্বজন

ঋভুকে নিয়ে তানিয়া বাজারে বের হয়েছে। ঋভুর জন্য কয়েকটা হাফ প্যান্ট আর মোজা কিনতে হবে। প্রিন্স বাজারের সামনে ভ্যানে করে প্রচুর প্যান্ট আর ছেলে মেয়েদের কাপড়চোপড় পাওয়া যায়। লাল কালো আর খাকি রঙের তিনটা প্যান্ট কিনে তানিয়া, সাথে দুই জোড়া কালো লাল মোজা।পাঁচশো টাকার একটা নোট দিলো সে দোকানীকে। দোকানী সেটার বদলে ফেরত দিল তিনটা একশ টাকার নোট আর দশ বিশ টাকার নোট কয়েকটা। তানিয়া এগুলো গুনে ব্যাগে রেখে দিচ্ছিল তখন ঋভু বলে উঠলো থাম থাম দেখি আমার কাছে দে তো নোটগুলো। নোটগুলো ঋভুকে দেয়ায় সে খুঁজে বের করল তিনটা দশ টাকার নোট একদমই ছেঁড়া খোড়া।এগুলা কি দিয়েছো মামা? ছেঁড়া নোটগুলো সব দিলে? দোকানী অগ্নিদৃষ্টি ঢেলে এগুলো একটু দেখে বদলে দিল চকচকে নোট দিল তিনটা। তোকে নিয়ে আর পারিনা রে, তোর কবে একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হবে। ছেঁড়া নোটগুলো সব তোকে বেছে বেছে দেয় দোকানদাররা, বাস হেলপার, সবাই। কেন তুই কানা নাকি একটু দেখে নিতে পারিস না? আচ্ছা, মাথা চুলকায় তানিয়া এখন থেকে দেখি সব দেখে নেব। প্রমিজ। হ্যাঁ দেখে নিবি, গবেট কোথাকার।এগুলো তো অন্যরাও নিতে চায়না।

মিঠু হাওয়ায় মিঠাই খাবে। তানিয়া তাকে বড় একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিল,গোলাপি রঙের। পঞ্চাশ টাকার নোটটা মিঠাইওয়ালাকে দিলে সেও কিনা একই কাজ করলো।পুরনো নোটগুলো আবার তানিয়া সুড়সুড় করে নিয়ে ব্যাগে রেখে দিতে যাচ্ছিল। অমনি খপ করে ধরল ঋভু,মামা মামা এইটা কি টাকা দিলা, এত ছেঁড়া। নাও বদলে দাও দেখি। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা টাকাগুলো একটু দেখে বলে, চলবে তো আপা,লন। না না কেউ নেবে না, এগুলো বদলে দাও। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে টাকাটা বদলে দিল ।
এবার আসল ধান্ধা। সামনে আইসক্রিমের দোকান দেখে ঋভু বলল, আপুনি আইসক্রিম কিনে দে। গলা শুকিয়ে গেছে রে।কোনটা খাবি,কোন নাকি বেলিসিমো-এ নিয়ে টস করলে কোন আইসক্রিম পড়লো ঋভুর ভাগ্যে আর বেলিসিমো পেলো তানিয়া। আর দিশানের ভাগ্যে দুইটা ইয়া বড় বেলুন। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। আইসক্রিম খেতে খেতে ঋভু বলতে লাগলো, তুই এমন কেন রে আপুনি? সবসময় দেখি দেওয়ার সময় সবচেয়ে নতুন নোটগুলো তুই মানুষজনকে দিস। আবার দোকানদাররা তোকে ছেঁড়া নোটগুলো দেয় তুই দেখেও নিস না। এগুলো তো চলেও না কিছুই না। তানিয়া অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে বেলিসিবো আইসক্রিম খেতে লাগলো। নাছোড়বান্দা ঋভু জোঁকের মত লেগেই আছে, তুই কবে মানুষ হবি রে আপুনি? সব লোক তোকে ঠকিয়ে রেখে যায়, আর তুই কিছুই বুঝিস না। তানিয়া হাসে আর আইসক্রিম খায়। শেষে আঙ্গুলে যেটা গলে গলে পড়ছিল সেটাও চেটেপুটে নিলো। তারপর অপরাধীর মতো গলা নামিয়ে বলল, আমি যদি এই টাকাগুলো না নেই তাহলে ওরা কাকে দিবে ওগুলো? তুইই বল। সেজন্যই তো নেই। তাছাড়া নতুন টাকার গন্ধের চেয়ে ছেঁড়া টাকার গন্ধ আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। ঋভু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল তার বোকাসোকা বোনটার দিকে। সবাই যাকে ঠকিয়ে রেখে যায়। আহারে কি হবে ওর, মায়া লাগছে।
বাসায় ঢোকার আগেই শোনা যায় ছোট চাচুর গলা। হেঁড়ে গলা ছেড়ে দিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে জালাল খাঁ’র গান গাইছে সে –
কান্না হাসা ভালোবাসা
করতে মানুষ ভাও পেল না।
মোটা গলায় মিঠা দরদ তার গলে গলে পড়ছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি