পাঠ প্রতিক্রিয়া
সোহেল মাহমুদ
সিঁড়িগুলো হেঁটে হেঁটে পায়ের পরিধি মাপে
গলে যায় গোড়ালির উত্তাপে পথের দৈর্ঘ্য।
একটি পুরনো নৌকা তবু ঘাটে বাঁধা
কুয়াশার ভেতরে লুকিয়ে রাখে ছৈয়ার ঐশ্বর্য।
দৃশ্যমান প্রগাঢ় গলুই
বয়সের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে
বুকের ভেতর ঠোকরাতে থাকে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৩ জুন ২০২০।
কাজী জহিরুল ইসলামের ‘প্রগাঢ় গলুই’ কবিতাটি জীবন, বার্ধক্য, স্মৃতি এবং সময়ের প্রবাহকে ঘিরে এক গভীর অনুভূতির প্রকাশ। কবিতাটি স্বল্প পরিসরে জীবনের অনেক গভীর অর্থ বহন করে, যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে।
কবিতার মূল বিষয়বস্তু ও তাৎপর্য একটি “পুরনো নৌকাকে” কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এই নৌকা কেবল একটি জড় বস্তু নয়, বরং এটি মানবজীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি।
প্রথম দুটি পঙ্ক্তি ‘সিঁড়িগুলো হেঁটে হেঁটে পায়ের পরিধি মাপে / গলে যায় গোড়ালির উত্তাপে পথের দৈর্ঘ্য’ – এখানে জীবনের যাত্রাপথ এবং সেই পথে চলার ক্লান্তি ও অভিজ্ঞতাকে বোঝানো হয়েছে। সিঁড়ি এবং পথ হাঁটা মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতীক। পায়ের পরিধি মাপা এবং গোড়ালির উত্তাপে পথের দৈর্ঘ্য গলে যাওয়া signifies the continuous effort and the passage of time, where each step contributes to the journey’s end.
‘একটি পুরনো নৌকা তবু ঘাটে বাঁধা / কুয়াশার ভেতরে লুকিয়ে রাখে ছৈয়ার ঐশ্বর্য।’ – এই পঙ্ক্তিগুলো কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। ‘পুরনো নৌকা’ এখানে বার্ধক্য, অতীত এবং স্মৃতির আধার। নৌকাটি ঘাটে বাঁধা থাকলেও এর ভেতরের ‘ছৈয়ার ঐশ্বর্য’ (নৌকার ছাউনি বা আবরণ, যা নৌকার ভেতরের জিনিসপত্রকে রক্ষা করে) কুয়াশার ভেতরে লুকিয়ে আছে। এই ‘ঐশ্বর্য’ বলতে জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন এবং অপ্রকাশিত সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। কুয়াশা এখানে সময়ের ধোঁয়াশা, যা অতীতকে আবৃত করে রাখে কিন্তু তার গুরুত্বকে ম্লান করতে পারে না।
‘দৃশ্যমান প্রগাঢ় গলুই / বয়সের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে / বুকের ভেতর ঠোকরাতে থাকে।’ – ‘গলুই’ হলো নৌকার অগ্রভাগ, যা জলের মধ্য দিয়ে পথ কাটে। ‘প্রগাঢ় গলুই’ অর্থাৎ গভীর বা সুদৃঢ় গলুই – যা অতীতের অভিজ্ঞতা ও বার্ধক্যের ভার বহন করে চলেছে। নৌকাটি বয়সের ঢেউয়ে দুলছে, যা জীবনের উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনার প্রতীক। এই দুলুনি যেন বুকের ভেতর ঠোকরাতে থাকে, যা স্মৃতির ভার, অনুশোচনা, বা অপ্রাপ্তির এক নীরব যন্ত্রণা। এটি কেবল শারীরিক বার্ধক্য নয়, মানসিক টানাপোড়েনকেও নির্দেশ করে।
কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ দার্শনিক উপলব্ধির দিকে ইঙ্গিত করে। আমরা যতই জীবনের পথে হেঁটে চলি, ততই সময় গড়িয়ে যায় এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। বার্ধক্য আসে, শরীর জীর্ণ হয়, কিন্তু স্মৃতির ভান্ডার অক্ষত থাকে। সেই স্মৃতিগুলোই আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। পুরনো নৌকা যেমন ঘাটে বাঁধা পড়ে থাকে কিন্তু তার ভেতরের ঐশ্বর্য লুকিয়ে রাখে, তেমনই মানুষও বার্ধক্যে উপনীত হলেও তার ভেতরের আত্মিক ঐশ্বর্য – তার স্মৃতি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা – অমূল্য থেকে যায়। এই ঐশ্বর্য দৃশ্যমান না হলেও তা আমাদের বুকের ভেতর অবিরাম আঘাত করে চলে, আমাদের অস্তিত্বকে অনুভব করিয়ে দেয়।
পরিশেষে ‘প্রগাঢ় গলুই’ একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর কবিতা, যা মানবজীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং স্মৃতির চিরন্তনতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। কাজী জহিরুল ইসলাম অত্যন্ত সুনিপুণভাবে একটি সাধারণ নৌকার প্রতীক ব্যবহার করে জীবনের এক অসাধারণ চিত্র এঁকেছেন। এটি পাঠককে নিজেদের জীবনের পথ, সঞ্চিত স্মৃতি এবং সময়ের প্রভাব সম্পর্কে ভাবতে উৎসাহিত করে।