মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
১. মানুষ এখন এক লগ-ইন স্বরলিপি
ড্রোন না, যেন পাখিহীন উল্কা নামে—
শিশুর চক্ষু কাঁপে রক্তালো সন্ধ্যাতারে।
সংবাদ না, অদৃশ্য কায়ায় মৃতের সংখ্যা উড়ে আসে—
তারপরেই উনুন-ছবি, রসনার আস্বাদন দৃশ্য,
ততোধিক মানবতা! এক নিঃশব্দ চতুষ্পদ স্তুতি।
যুদ্ধ এখন এক অপূর্ণ নরম ঘোর,
মৃত্যু—কেবল একটি সময়চ্যুত শ্বাস,
ভালোবাসা?
সেই তো এখন বিলুপ্ত অভিধান-পৃষ্ঠা।
আমি যখন দেখি সীমান্ত রেখা,
হাসনের গানে আমার আঙুল ছুঁয়ে যায়—
“মানুষভজে যে জন, সেই জন সেজন”,
নজরুলের পঙ্ক্তিতে বাজে বিদ্রোহের রাগ:
“গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই”।
মানুষ?
সে তখনই জন্মায়,
যখন ক্ষমা প্রস্ফুটিত হয় অস্ত্রের ফাটলে।
২. রক্তপাতের পরিমিতি
মৃতদেহ আর সংখ্যার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে এক গণিতে রক্তচাপ—
যার ক্যালকুলেটরে অশ্রুর ঘনত্ব, পেছনের বোতামে চাপা পড়ে শবযাত্রার ছায়াপথ।
তার ছায়া পড়ে মানচিত্রে, অথচ ছায়ার নাগরিকত্ব নেই—
পৃথিবীর সীমান্তরেখায় রোদ যেন বহিরাগত, হিমায়িত আলোয় ঠোঁট নড়ে না মানবতার।
পাক-ভারত সীমান্ত এক চলন্ত কাঁটাতার, যেটা কেবল মানুষ নয়—
ছিন্ন করে প্রেমের ফিতেয় বাঁধা স্মৃতি, শিশিরে লেগে থাকা গোপন গানও হয়ে যায় বুলেটধ্বনি।
মায়ের স্তনের দুধ, নাম না-জানা শৈশব, ওড়নার চিত্রলিপিও ছিঁড়ে ফেলে—
যেন এক ব্যালিস্টিক সূরা, মাতৃত্বের স্তব পড়তে পড়তে শব্দহীন হয়ে যায় আকাশ।
যুদ্ধ এখন এক ব্র্যান্ডেড গ্যালারী, ব্যালিস্টিক ম্যানেকুইনের মুখে রং মেখে হাসে—
তার ঠোঁটে বারুদের গ্লস, চোখে ডিজাইনার ধ্বংস, জ্বলন্ত শহর পরে যায় ‘সিজনস কালেকশন’ এ।
গণমাধ্যমে শান্তি কেবল মাইনাসের প্রচ্ছদ—শূন্যতা ছাপা হয় পরিসংখ্যানে—
পত্রিকার হরফে লুকিয়ে থাকে কফিনের ফাঁকফোকর, মৃত্যুর বিপণন হয় ছাপার জ্যামিতিতে।
প্রতিটি বিজয়ের ছায়া মাপে—কত পঙ্ক্তি অনাথ হলো, আর কত হৃদয় শব্দহীন লাশ বয়ে বেড়ায় চিরকাল।
কবিতা তখন ছিন্ন শির—অভিমানী ঈশ্বরের হাতে ধরা লাল রুমাল, যেখানে কেবল পাণ্ডুলিপি নয়, মনুষ্যত্বও রক্তাক্ত।
৪. ইস্পাতের কান্না
সাইফুলের চাকা থেমে গেলে
ঘুরতে থাকে রাষ্ট্রের ঘূর্ণিপাক—
বুলডোজারের দাঁতে গিলে ফেলে
একটা সংসার
একটা স্টিয়ারিং
একটা শিশুর দুধপাত্র
নোটিশ ঝুলে থাকে বাতাসে
নেই কারচুপি—
আছে কেবল
ব্যাটারির আয়ু,
আর ঘামে ভেজা ঋণের ছাপচিত্র
প্রতিদিন
একটি স্বপ্ন নিষিদ্ধ হয়
একটি নির্বাক নীতির নামে
আর প্রার্থনার বদলে
রুটির পাশে
রাখা থাকে
পেট্রোলঘ্রাণে পোড়া কান্না…।
৫. নিরুত্তর দীঘির মুখে প্রশ্ন রেখে যাই
[কবি খালেদ উদ-দীন-এর জন্মদিনে নিবেদিত]
সময়ের হাড়গোড় ধুয়ে দেয় গ্রীষ্মজল
অরণ্যের হরিণেরা ঘুমিয়ে পড়ে প্রতিধ্বনিতে
প্রতিটি প্রশ্ন—একেকটি অনন্ত প্রবাহ
ফিরে আসে না, তবু গর্জে ওঠে দীঘির অভ্যন্তরে
আমরা যারা ছায়ার নিচে প্রতিচ্ছবি খুঁজি
তারা অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে সূর্য দেখে না—
শুধু শুনি শূন্যে ঝুলে থাকা উক্তির মতো নিঃশব্দ আহ্বান:
সাময়িকতা হলো স্থায়িত্বের এক অভিনব ছলনা।
তাই প্রতিটি কবিতা হয় নীহারিকায় আটকে পড়া নামহীন পাখি
আর প্রতিটি কবি দীঘির গভীরে খুঁজে ফেরে তার নিজস্ব নক্ষত্র…।
৬. প্রত্যাবর্তনের পূর্বাভাষ
ওরে শাশ্বত পঙ্ক্তি—
ফিরে আয়… অন্তর্লীন নির্জনে
ভাষাহীন ছায়ায়—
বসন্তের দৃশ্যচ্যুতি গুটিয়ে রাখে
প্রেমের অতলান্ত চিত্রকল্প
পেছনে পড়ে থাকে—
সেলাই করা অন্ধকার,
মলিন ব্যাকরণ…
ভিজে থাকে শব্দ
অথচ উচ্চারণ?
অচেনা,
অস্তিত্বহীন কোনো আলোর মতো…
কাব্যমগ্ন চেতনায় দুলুক
অনন্ত প্রেম—
যেখানে বর্ণমালা আর শুধু ধ্বনি নয়,
সেগুলি বদলে যায়…
যেমন নদী বদলায় নাম
গন্ধহীন বৃষ্টিতে বদলে যায়
দিগন্তের স্তব্ধতা।
শুশ্রূষাহীন নদীর কোলাহলে
জেগে থাকে—
স্মৃতিহীনতায় বুঁদ শব্দেরা
এখানে
বিষণ্ণতার ঝঞ্ঝাও—
একটি পুনরাবৃত্ত ছায়াপথ মাত্র
তুমি যদি ফিরে আসো—
মরমী বর্ষার ঢেউয়ের সারোদের পেছনে,
জেনো—
এ কাব্য আর প্রেম নয়
এ এক…
পুনঃসংযোজিত নির্বাক আত্মপট…।