মুজতাহিদ ফারুকী
আমি এক দুর্ধর্ষ লেখক। এমনই দুর্ধর্ষ যে প্রথম গল্পের বই এবং দ্বিতীয় বইয়ের প্রকাশনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান সমুদ্রসমান। প্রথম বই ‘ঝুলে আছে’ বেরিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে মোটেই ৩৭ বছর! ঝুলে আছে প্রকাশক নিজের আগ্রহেই করেছিলেন। ওতে গল্প ছিল নয়টা। গল্পগুলোতে প্রথম যৌবনের উত্তাপ যেমন ছিল, তেমনই কিছু প্রত্যয়, প্রতিশ্রুতিও ছিল নিশ্চয়ই। বইয়ের দুটি গল্প ‘একটি মৃত্যু ও অস্পৃশ্য মানুষের সন্ধান’ এবং… এবং … এই যাহ্ দ্বিতীয়টার নাম তো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তরুণ লেখকদের গল্পপাঠ আয়োজনে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। পেয়েছিলাম কিছু নগদ কড়ি। ঘটনা সম্ভবত ১৯৮৮ সালের। বইটা পড়তে দিয়েছিলাম প্রিয় শিক্ষক ঔপন্যাসিক শওকত আলীকে। তিনি তখন ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে কাজ করেন। একদিন এলিফ্যান্ট রোডে তার অফিসে গেলে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখনও অক্ষত শরীরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছো! তোমার বিরুদ্ধে তো মোল্লাদের রাজপথে নেমে যাবার কথা। বুঝলাম স্যার বইটি পড়েছেন। তার উদ্বেগের কারণটাও বুঝলাম। ‘ওভারকাম‘ নামের একটি গল্পে পীরগিরির ভণ্ডামির বিষয়টি কায়দা করে ব্যবহার করেছিলাম। স্যার বললেন, তিনি আমার বইয়ের ওপর রিভিউ লিখবেন। তারপর যেমন হয়! আর কোনওদিন এ বিষয়ে স্যারকে তাগিদ দেয়া দূরের কথা, মনে করিয়েও দিইনি। সম্ভবত আমিই একমাত্র লেখক যে নিজের লেখালেখি নিয়ে এতটা উদাসীন, নাকি দায়িত্বহীন। এটুকু লিখতে লিখতে মনে পড়ল, পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় গল্পটা ছিল, ‘জীয়নখোলার জীবনমৃত্যু অথবা দুধমাতা’। গল্পটা এখন কোথায় জানি না। সম্প্রতি সম্ভাব্য সবখানে তন্ন তন্ন করে গল্প খোঁজার সময় এটি পাইনি। মনেও ছিল না গল্পটার কথা। খুবই ব্যতিক্রমী গল্প ছিল এটা। খুঁজে পেতেই হবে। তৃতীয় বই যদি হয়, সেখানে এটা অন্যতম গল্প হবে। আরেকটা বই তো হবেই, কারণ বেশ কয়েকটি গল্প এখন হাতে আছে, যেগুলো বিরান মসজিদে আঁটাতে পারিনি।
ঝুলে আছে’র সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত গল্প ছিল ‘সাত ধোয়া শাড়ি অথবা নারী’। নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশ করেছিলেন সম্পাদক আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু। মাস তিনেক আগে তিনি ফেসবুকে প্রসঙ্গক্রমে একজনের কমেন্টের প্রেক্ষিতে লিখেন, মুজতাহিদের গল্পটা ছেপেছিলাম এমন আশা নিয়ে যে, ও একসময় দেশের সেরা গল্পকার হবে। তার আশা পূরণ করতে পারিনি। তবে অনেক পাঠক এখনও ওই গল্পটা মনে রেখেছেন। এ গল্প নিয়ে নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের পর পর ছয়টি সংখ্যায় পাঠকের চিঠি ছেপেছিলেন সম্পাদক। তাতে গল্পকারের চামড়া তুলে নেয়া থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকিও ছিল। আবার এই গল্প পড়ে সে সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক কবি আফজাল চৌধুরী মন্তব্য করেন, মুজতাহিদ ফারুকী হলো আরেক মঞ্জু সরকার। তার এ মন্তব্য শুনলাম বছরখানেক আগে একজন আলেমের মুখ থেকে।
৩৭ বছর পর আমার দ্বিতীয় গল্পের বই ‘বিরান মসজিদের ইমাম’ বেরুচ্ছে অনশ্বর প্রকাশনী থেকে। এতে থাকবে গোটা পাঁচেক গল্প। না, ওইরকম আলোচিত কিংবা বিতর্কিত গল্প না। ২৯-এর রক্ত ৬৬-র বডিতে কি একইরকম ততা থাকে! রক্ত এখন সেই দুর্মর পাহাড়ি ঢলের মত যা সমতলে নেমে শমিত ও শান্ত। এবারের গল্পগুলি তাই সুচিন্তিত ও দূরাভিসারী। অন্তত দুটি গল্পের কথা বলতে পারি, যার বিষয়বস্তু বাংলা গল্পে আগে আসেনি। প্রথমটা ‘অদৃশ্য প্রতিশোধ’। এতে গ্রামীণ সমাজজীবনে মাছ ধরার নেশা এবং এ নিয়ে প্রচলিত যেসব লোকজ বিশ্বাস সংস্কার শত শত বছর ধরে চলে আসছে তারই অনুপুঙ্ক্ষ উপস্থাপনার চেষ্টা করেছি। সেই সঙ্গে আছে বাংলার বহমান গ্রামীণ সংস্কৃতির কিছু অনুসঙ্গ, কিস্সা, পালাগান ইত্যাদি।
বিরান মসজিদের ইমাম-এ চেষ্টা করেছি বাঙালি মুসলমানের জীবনের কিছু অনুষঙ্গ তুলে ধরার, যেগুলো কখনওই বাংলা কথা-সাহিত্যের পাতে ওঠার উপযুক্ত বিবেচিত হয়নি । এস্তেখারার নামাজ পড়ে কোনও কাজের ভালোমন্দের বিষয়ে আগাম ঐশী ইঙ্গিত প্রত্যাশার বিষয় নিয়ে বাংলায় কোনও গল্প বা উপন্যাস কি লেখা হয়েছে? অথবা নকশবন্দিয়া তরিকায় জিকির-আজকারের বিষয় নিয়ে? আমার জানা মতে হয়নি। অথচ আমাদের সমাজে ধর্মপ্রাণ মানুষের বড়ো অংশের মধ্যে এখনও এসবের অনুশীলন যথেষ্টই আছে। আমাদের লেখকরা এ দিকটা একদমই এড়িয়ে গেছেন অথবা বাঁকা চোখে দেখেছেন। মনে করুন ক্রীতদাসের হাসি, সংশপ্তক, লালসালু, কাঁদো নদী কাঁদো এবং এমন অসংখ্য গল্প উপন্যাস।
আমি চেষ্টা করেছি বিষয়গুলিকে আধুনিক গল্পের উপজীব্য করে তোলার এবং সেটা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। হ্যাঁ, ইসলামী অনুসঙ্গের ইতিবাচক উপস্থাপনারও উদাহরণ আছে। একমাত্র উদাহরণ, শাহেদ আলীর ‘জিবরাঈলের ডানা’।
এই বইটা অথবা গল্পটা কালজয়ী হবে এমন দুরাশা আমার নেই, তবে আশা করি এটি বাংলা গল্পে নতুন সংযোজন হয়ে থাকবে। প্রিয় পাঠক বইটির দু ‘এক পাতা উল্টে দেখতে পারেন।