spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধইরান-ইজরায়েল সংঘাত 'মালহামা'র অশনি সংকেত

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

ইরান-ইজরায়েল সংঘাত ‘মালহামা’র অশনি সংকেত

আবু তাহের সরফরাজ

শুক্রবার ১৩ জুন, ভোর সাড়ে ৪টা। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন লক্ষ্য করে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ও মোসাদ বড় ধরনের বিমান হামলা চালায়। ইরান বসে থাকেনি। সেইদিন থেকেই ইরানও পাল্টা-হামলা চালালো। এখনো পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে হামলা ও পাল্টা-হামলা চলমান রয়েছে। ইজরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ইরানের ৬৩৯ জন নিহত ও ১ হাজার ৩২০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তি। এর পাশাপাশি ইরানের হামলায় ইজরায়েলে কতজন নিহত ও আহত হয়েছে সেই হিসাব জানা যাচ্ছে না। কারণ সংবাদমাধ্যগুলো জানাচ্ছে, ইজরায়েল তাদের হতাহতের সংখ্যা গোপন করছে। ইরানের ভূখণ্ডে ইজরায়েলের এই হামলা আকস্মিক বলে মনে হলেও অভাবনীয় নয়। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষজনই জানতো, হামলা অবশ্যম্ভাবী। ঘটবেই। এবং ঘটলোও তাই। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও হাদিস বিষয়ে জ্ঞাত তারা জানতেন যে, ফিলিস্তিনের পর ইজরায়েল ইরানকে হামলার লক্ষ্যস্থল হিসেবে চিহ্নিত করবে। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েলিরা অবৈধভাবে জেরুসালেম দখল করে। এরপর থেকে তারা নানাভাবে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করতে থাকে। যেখানে সেখানে মুসলিমকে হত্যা করতে থাকে। এই অত্যাচার সীমাহীন মাত্রায় পৌঁছে গেলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন গোষ্ঠি হামাস। এর পরপরই গাজায় নৃশংস হামলা চালাতে আরম্ভ করে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী। তাদের হামলা এখনো চলমান। কার্যত, গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ। ইজরায়েরি হামলায় গাজায় এই পর্যন্ত ৫৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও ১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। ইরানে হামলার পাশাপাশি ইজরায়েলি বাহিনী এখনো গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। হামাসকে নির্মূলের কথা বললেও ইজরায়েল আসলে চায়, গাজার দখল। সেই ঘোষণাও তারা দিয়েছে। তাদের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরান সবসময়ই প্রতিবাদ করে আসছে। বিশ্বের আরসব মুসলিম দেশ থেকে এক্ষেত্রে ইরানের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আর তাই, ইরানকে নিস্ক্রিয় করতেই ইজরায়েলের এই হামলা।
ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে কে জিতবে আর কে হারবে সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো বিশ্লেষণী অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে লোকজন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই হারবে না, আবার জিতবেও না। এই যুদ্ধ মহানবি (স.) বর্ণিত মালহামার অশনি সংকেত। যারা মনে করছেন এই সংঘাত রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই তারা প্রকৃত ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ। গাজায় কিংবা ইরানে ইজরায়েলের হামলা রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের দ্বন্দ্ব নয়, মূলত ধর্মীয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব জেরুসালেম শহরকে কেন্দ্র করে। ইজরায়েল ও ফিলিস্তিন দুই দেশই জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে জেরুসালেম স্থানটি খুবই পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। ইহুদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রাজা দাউদ জেরুসালেমে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সেই অর্থে, জেরুসালেম ইহুদি জাতির জন্মস্থান। দাউদের পুত্র রাজা সলোমন এখানে প্রথম ইহুদি জাতির জন্য প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করেন। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে এখানে নির্মিত হয় ইহুদিদের দ্বিতীয় প্রার্থনাগৃহ। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা সেই গৃহ ধ্বংস করে দেয়। এই গৃহের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বড় একটি পাথর এখনো দেখা যায়। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল জেরুসালেমের পুরনো শহর দখল করে বুলডোজার দিয়ে পুরনো বাড়িঘর ধ্বংস করে পশ্চিম দেয়ালের সামনের অংশে নতুন একটি ভবন নির্মাণ করে। এই পশ্চিম দেয়ালের উপরই অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান হারাম আল আকসা। ইহুদি জাতি বিশ্বাস করে, তাদের তৃতীয় প্রার্থনাগৃহ জেরুসালেমেই নির্মিত হবে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, জেরুসালেমে যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় এবং এখানেই যিশুর পুর্নাবির্ভাব ঘটবে। যে পথ দিয়ে যিশুকে বধ্যভূমিতে হাঁটিয়ে নেয়া হয় সেই পথটি এখনো রয়েছে। এই পথ ধরেই যাওয়া যায় যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্থানে। মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান হারাম আল শরিফ জেরুসালেমে অবস্থিত। আল আকসা মসজিদ ও পাথরের গম্বুজের সমন্বয়ে নির্মিত হারাম শরিফ। মহানবি (স.) প্রথমে আল আকসা মসজিদকে কেবলা ধরে নামাজ আদায় করতে বলেছিলেন। পরে তিনি মুসলমানদের কেবলা হিসেবে মক্কার কাবাকে নির্ধারণ করেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) আল আকসায় প্রথম ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর ৭০৫ সালে এখানে বড় আকারের মসজিদ নির্মাণ করা হয়। দুই দফায় ভূমিকম্পে দুই বার মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেলে পরে সেটা আবারও নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সে মসজিদটি রয়েছে সেটা ১০৩৫ সালে নির্মিত। মসজিদের পাশে রয়েছে সোনালি গম্বুজবিশিষ্ট পাথরের গম্বুজ বা ডোম অব দ্য রক। ইহুদিদের দ্বিতীয় প্রার্থনাগৃহ ধ্বংস করে রোমানরা এখানে এখানে দেবতা জুপিটারের মন্দির নির্মাণ করেছিল। ৬৮১ সালে ক্রুসেডাররা স্থানটি দখল করে পাথরের গম্বুজকে গির্জা হিসেবে এবং আল আকসাকে রাজপ্রাসাদ ও টেম্পলারদের দফতর হিসেবে ব্যবহার করে। আট কোণাবিশিষ্ট এই পাথরের গম্বুজের ভেতর সেই পাথরের ভিত্তি রয়েছে যেখান থেকে মহানবি (স.) মিরাজে গিয়েছিলেন বোরাকে চড়ে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জেরুসালেম স্থানটি ঘিরেই ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল ও মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত। বাকি রইল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে তাদের ভূমিকা কী? ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ইজরায়েল রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ১১ মে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতিসংঘের ১৯২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৬৪টি রাষ্ট্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেয়নি ২৮টি রাষ্ট্র। কারণ, ২৮টি রাষ্ট্র মনে করে, ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে দখলদারিত্বের মাধ্যমে। ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগ রাষ্ট্রই খ্রিস্টানপ্রধান। আর স্বীকৃতি না-দেয়া দেশগুলো মুসলিমপ্রধান। দেশগুলো হচ্ছে: আলজেরিয়া, কোমোরোস, জিবুতি, ইরাক, ইরান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, সিরিয়া, মৌরিতানিয়া, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ব্রনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, লাইজার, কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। তো, জেরুসালেম থেকে মুসলিমকে হটাতে খ্রিস্টানরা ভর করে ইহুদিদের ওপর। যেহেতু জেরুসালেম থেকে খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো দূরে এবং ইজরায়েল পবিত্র ভূমিতে ঢুকে বসে আছে, সেই হেতু ইজরায়েলকে সমর্থন ও সব-রকমের সহযোগিতা প্রদান খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সবসময় অন্ধের মতো ইজরায়েলকে সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালাতে ইজরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে এসেছে। এখনো করছে। এবার ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের উদ্যোগ নিচ্ছে।
আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বে সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল শীর্ষে। গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এমনকি সংস্কৃতি-কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে এই দুই রাষ্ট্র। বর্তমানে সামরিক শক্তিতে বিশ্বের প্রথম নাম্বারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইজরায়েল মূলত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির গবেষণায় শীর্ষে অবস্থান করছে। বিস্ময়কর যে, মাত্র ৭০ বছরের রাষ্ট্র ইজরায়েল এখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রক একটি রাষ্ট্র। এই সাফল্যের কারণ কী? কারণ একটাই, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা। ইজরায়েলের জনগণ প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। দেশটির প্রায় অর্ধেক জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় বা সম-পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার মান গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অর্থনৈতিকভাবে ইজরায়েল খুবই উন্নত শিল্পপ্রধান রাষ্ট্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে দেশটি বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। ইজরায়েলের প্রতি দশ লাখ অধিবাসীর জন্য ৮৩৪১ জন বিজ্ঞানী, গবেষক ও প্রকৌশলী আছেন, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। ইজরায়েল বাৎসরিক বাজেটের শতকরা প্রায় পাঁচ ভাগ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করে। বিশ্বের আর কোনো দেশ বাজেটে এই পরিমাণ বরাদ্দ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বরাদ্দ করে না। গবেষণামূলক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যারয়গুলোর সহযোগিতার ভিত্তিতে ইজরায়েল বিশ্বের ১ নম্বর রাষ্ট্র। বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ১৩ ভাগ ইজরায়েল তথ্য ও প্রযুক্তি সেবা রফতানিতে নিয়োজিত করে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। জ্ঞানের বিস্তারে ইজরায়েল বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ। এরই পাশাপাশি আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাই, একই অবস্থা চোখে পড়বে। বিশ্বজুড়ে সকল দেশের মানুষের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড পাওয়া মানে সোনার হরিণ পাওয়া। এর পেছনে একটাই কারণ, ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। এই উদ্দেশ্যে তাদের নাগরিকদেরকেও উপযুক্ত রূপে গড়ে তোলে।
এই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামের মূলকথা। হেরা গুহায় মহানবির (স.) কাছে ফেরেস্তা জিবরাঈল (আ.) প্রথম ওহি এনেছিলেন, পড়ো। মানে, জ্ঞান অর্জন করো। যে যত বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করবে সে তত বেশি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। যে যত বেশি বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য বুঝতে পারবে সে তত বেশি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও মহত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। যে কারণে কোরআনের প্রায় প্রতি বাক্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নানা শাখার সূক্ষ্ম সূত্র কোরআনে বিধৃত হয়েছে। কোরআনের নির্দেশ মান্য করে ইসলামের সোনালি যুগে অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক জ্ঞানের চর্চা করে গেছেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুসলিম মনীষীদের আহরিত জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান কুড়িয়ে নিয়ে আজকের ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। যার পরিপূর্ণ রূপ এই মুহূর্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে। পশ্চিমা দেশগুলো আসলে ইসলামের রীতিপদ্ধতি অনুসরণ করে নিজেদেরকে শক্তিশালী জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ দুর্ভাগ্য যে, সারা বিশ্বের মুসলিম জাতি কোরআনের মূল নির্দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে দিয়ে এখন ভিখিরির জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছে। ইসলামের আনুষ্ঠানিক কিছু কর্মপদ্ধতি পালন করাকেই মুসলিমরা এখন ইসলাম বলে মনে করে। অথচ সেই কর্মপদ্ধতির তাৎপর্যও তারা ঠিকঠাক না-বুঝে বিশ্বাস করে নিয়েছে, নামাজ-রোজা করলেই আমি মুসলমান। অথচ ঘুসের টাকা পকেটে নিয়ে তারা নামাজ পড়ছে। সারাদিন রোজা রেখে সুদের টাকায় কেনা ইফতার করছে। এহেন মূর্খ জাতিকে খুব সহজেই ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। বিশ্বে বর্তমানের মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২.০২৭ বিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। এর পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বে ইহুদির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ইহুদি ইজরায়েলে বসবাস করে। সংখ্যার দিক থেকে দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কী বিস্তর ব্যবধান। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এখন নির্যাতিত হচ্ছে সংখ্যালঘু ইহুদিদের হাতে। এই বাস্তবতা যে আসবে সে বিষয়ে মহানবি (স.) বলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন কাফির-মুশরিকরা তোমাদেরকে এমনভাবে ঘেরাও করে ফেলবে যেন মনে হবে একই দস্তরখানায় সবাই খাবার খেতে বসেছে। সাহাবিরা জিগেশ করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.), আমরা কি সেই সময় সংখ্যায় কম হবো? রাসূল জবাব দিয়েছিলেন, না, তখন তোমরা সংখ্যায় হবে সমুদ্রের ফেনার মতো। রাসূলের এই কথায় সাহাবিরা বিস্ময়ে কপালে ভাঁজ ফেলেছিলেন। কারণ, তাদের সময়টা ছিল ইসলামের বিজয়র যুগ। তাদের বাস্তবতা হচ্ছে, ওহুদ যুদ্ধে সাতশো মুসলিম তিন হাজার মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বিজয় অর্জন করেছিল।
অথচ তাদের উত্তরসূরী হয়ে এখন আমরা ভিখিরির জাতি। যদিও নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করি, তবে মুসলমানের কোনো বৈশিষ্ট্যই আমাদের ভেতর নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা না করার কারণে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে ইজরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিরোধের যথোপযুক্ত সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ইরান সম্ভবত সকল মুসলিম দেশ থেকে এগিয়ে। ঠিক এই কারণেই ইজরায়েল ইরানকে ঘায়েল করতে মরীয়া হয়ে উঠেছে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের প্রধান সামরিক লক্ষ্য ইরান, এরপর পাকিস্তান। এরপর হয়তো তুরস্কের ওপর জায়নবাদীরা হামরা করবে। এইভাবে একেকটি মুসলিম দেশকে তারা হামলার লক্ষ্যবস্তু বানাবে। এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য, যেসব মুসলিম দেশ সামরিক শক্তিতে বলীয়ান সেসব দেশকে ধ্বংস করা অথবা সেখানে এমন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যে সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের নির্দেশমতো কাজ করবে। ইরানে হামলার পেছনেও তাদের এই দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে। হয় ধ্বংস নয়তো নিজেদের নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠা। এক্ষেত্রে ইজরায়েলকে সহায়তা করছে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সময় ক্ষমতাচ্যুত শাসক পাহলভি পরিবার। পাহলভি রাজবংশের শেষ শাসক রেজা শাহ পাহলভির ছেলে রেজা শাহ পাহলভি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ইরান সরকার এখন সবচেয়ে দুর্বল। আঘাত হানার এখনই উপযুক্ত সময়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, রেজা শাহ পাহলভির সঙ্গে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর গোপন যোগাযোগ আছে। এরই মধ্যে ইজরায়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত যদি ইজরায়েল সামরিক কৌশলে ইরানকে পরাস্থ করতে পার তাহলে সেখানে পরবর্তী শাসক হিসেবে তারা রেজা শাহকেই প্রতিষ্ঠিত করবে, বিষয়টি পরিষ্কার। কিন্তু সেই পথ কি সহজেই হতে দেবে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো? বিস্ময়কর যে, ইরান-ইজরায়েল সংঘাত শুরু হওয়ার পর কোনো মুসলিম দেশ এখনো পর্যন্ত ইরানের পক্ষে বিবৃতি দেয়নি। তবে লেবানন ও ফিলিস্তিন জানিয়েছে, তারা ইরানের পাশে আছে। বরাবরের মতোই নিশ্চুপ হয়ে আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বাকি মুসলিম দেশুগুলো। কিন্তু এরই মধ্যে সামরিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছে ইরানে হামলা না চালানোর বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মতোই রাশিয়া খ্রিস্টানপ্রধান দেশ। চীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রধান দেশ। উত্তর কোরিয়ার শতকরা ৭৩ ভাগ মানুষ ধর্মহীন। প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম রাষ্ট্র না-হয়েও রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া কেন ইরানকে সমর্থন করছে? করছে কারণ, এই দুটি দেশ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের অনৈতিক আধিপত্য বরদাস্ত করে না। এর বাইরে আরও একটি কারণ হচ্ছে, এই দুই দেশের মানুষ ধর্মনিষ্ঠ। নিজ নিজ ধর্মের উদার নীতির প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। মুসলিমদের উৎখাতে ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ মূলত ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই হলেও দেশদুটি মোটেও নিজ নিজ ধর্মের রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। শ্রদ্ধাশীল হলে তারা দিনের পর দিন মানুষ হত্যা করতো না। নিষ্পাপ শিশুদের রক্তে ভেজাতো না ইশ্বরের পবিত্র ভূমি। গোটা মুসলিম বিশ্ব যখন নিশ্চুপ তখন রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে ইরানের মুসলমানরা বুকে জেহাদি প্রেরণা অনুভব করছে।
মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণারয় বিবৃতিতে জানায়, ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রকল্পে ইজরায়েলের চলমান ব্যাপক হামলা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ। এই হামলা একদিনে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অগ্রহণযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে বিশ্বকে পারমাণবিক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বুধবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বিবৃতিতে বলেন, ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোয় ইজরায়েলি হামলায় বিশ্ব এখন বিপর্যয় থেকে মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা সতর্ক করছি, ইজরায়েলকে সরাসরি সামরিক সহায়তা প্রদান না করতে।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন কেসিএনএ প্রকাশিত বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ইজরায়েরি হামলায় ইরানের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা মানবতার বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন অপরাধ। ইজরায়েল রাষ্ট্রীয়ভাবেই সন্ত্রাসবাদে জড়িত, যা এই অঞ্চলে নতুনভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ইরান ও ইজরায়েলের চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে হস্তক্ষেপ না করতে সতর্ক করা হচ্ছে। বিশ্বে বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য ক্যানসার সদৃশ সত্তা। তারা বৈশি^ক শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংসের মূলহোতা।
গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারছি, চীন থেকে একের পর এক কার্গো বিমান যাচ্ছে ইরানে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব বিমানে সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে। বসে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলি আক্রমণ শুরুর পর থেকে মিত্র দেশগুলোর বিমানগুলো আকাশ ও সমুদ্রপথে তাদেরকে সাহায্য পাঠাচ্ছে। যা তারা এই যুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। জানা গেছে, ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিতে ১৪টি কার্গো বিমানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। অবস্থা দৃষ্টে বোঝাই যাচ্ছে, পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে গোটা পৃথিবী। এই যুদ্ধকেই মহানবি (স.) মালহামা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

২০ জুন ২০২৫

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি