শিবলী আহমেদ
প্রেম-প্রকৃতি ও নানা বয়সী মানুষের মনের আবেগ টুকরো-টুকরো গল্পের সমারোহে মলাটবদ্ধ করা বইটির নাম ‘একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প’। এতে লেখক রেজা নুর মোট ১৭টি গল্পে রূপায়ন করেছেন নানা চরিত্র। প্রতিটি চরিত্র পাঠকের সমস্ত চৈতন্যকে এক যোগে স্পর্শ করে। কেননা, চরিত্রগুলোতে কৃত্রিমতার কোনো প্রলেপ নেই। আছে কেবল প্রকৃতির ছাঁচে গড়া কিছু মানুষের অনুভূতির ফিরিস্তি। বইটির ১৭টি গল্পের পাঠ-প্রতিক্রিয়া আলাদাভাবে না লিখলে গ্রন্থের মূলরসের সঙ্গে ছলনা করা হবে। কৌতূহলী পাঠকের জন্য সংক্ষেপে গল্পগুলোর সার তুলে ধরার প্রচেষ্টা রইল এই রিভিউয়ে।
আঙুলের ঘষায় কয়েকটি পাতা ওল্টালেই সামনে আসবে ‘ঘোর গৃহবাস’ গল্পটি। বিবাহোত্তর ক্রমে-ক্রমে দুটি পৃথক মানুষের একাত্ম হতে চাওয়ার নীরব প্রচেষ্টার চিত্র ফোটাতে গিয়ে লেখক এখানে প্রথম প্রেমের চিত্ত-দুর্বলতার বয়ানও করেছেন। প্রেমিকমন মাত্রই যৌবনের প্রথম প্রেমের পা-কাঁপা অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত। সেই প্রেম যদি হয় নিজ স্ত্রীর সঙ্গে, তাহলে তা আলাদা মাত্রা পায়। ঘোর গৃহবাস গল্পটি পাঠককে যেন সেই ঘোরই নিয়ে ফেলে।
পরের গল্পের শিরোনাম ‘সোহেলী’। এই গল্পটির মূল উপজীব্য—বাংলার চিরায়ত শাশুড়ি-পুত্রবধূর দ্বন্দ্ব। অল্প কিছু চরিত্র সৃষ্টি করে লেখক খুব কম আলাপে পাঠকের হৃদয়ে নিদারুণ আবেগের খোরাক জুটিয়েছেন এই গল্পে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর চরম ভালোবাসার পাশাপাশি শ্বশুরবাড়িতে নববধূর খাপ মেলানোর যুদ্ধ—এই যাতনাই কালো অক্ষরে লেখক বুনে দিয়েছেন ‘সোহেলী’ গল্পে। মূলত সংসারে আকস্মিক সুখ ও দুঃখের আবির্ভাবের ওঠানামা দেখতে-দেখতেই অশ্রুসিক্ত ট্র্যাজিডিতে শেষ হয় সোহেলীর গল্প।
অধরা প্রেমের একটি গল্প হলো ‘ডিভি’। শাহেদ ও মিতা নামের দুটি চরিত্র দিয়ে একটি অপূর্ণ প্রেমের পূর্ণ হদিস দিয়েছেন লেখক। জীবন সংগ্রামের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত জীবনের যে ফারাক সেটিই ফুটে উঠেছে এই গল্পে। সুন্দর জীবনের খোঁজে প্রবাসে পাড়ি দেয় অনেকে। কিন্তু কাম্য জীবন, জীবনসঙ্গী ও প্রকৃতি পড়ে থাকে স্বদেশেই। বিনেসুতোয় গাথা অপ্রকাশ্য প্রেমের বলী দিতে হয় কঠোর জীবন সংগ্রামের পদতলে। একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প বইয়ের ‘ডিভি’ ছোটগল্পটির ঘটনা অনেকটা এমনই।
শক্তিমত্তার বিচারে এই বইয়ের ‘ব্ল্যাক মার্কেট’ শিরোনামের গল্পটিকে বেশ শক্তিশালী বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। দুষ্টুশক্তির বিনাশই হলো এই গল্পটির পরিণতি। সহজ-সরল গ্রামেও বাস করে কিছু চটুল ব্যক্তি। যারা নিজেরা অবৈধ পন্থায় আয় তো করেই, নানাভাবে তটস্থ করে রাখে গাঁয়ের অন্য লোকেদের। এমনকি গ্রামের সাধারণ মেয়েরাও হয় ওসব বখাটেদের লালসার শিকার। এক ভাই কীভাবে তার বোনের সম্ভ্রমহানীর প্রতিশোধ নিল, সেটিই ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
পরের গল্প ‘আশ্রয়’-এ এসে লেখকের গল্প বলে যাওয়ার ক্রমধারা কিছুটিা বাঁক বদল করেছে। শেষ বয়সে উপনীত হওয়া এক ব্যক্তির কল্পনায় তার সোনালী অতীতকে তুলে এনেছেন লেখক। মূলত মানবজীবন অসংখ্য স্মৃতির সমষ্টি। বয়সের শেষলগ্নে মানুষ যখন আর ঘটনা তৈরি করতে পারে না, তখন সে পুরোনো দিনগুলোর জাবর কাটে আর অপেক্ষা করে চিরবিদায়ের। লেখকের আশ্রয় নামে গল্পটির মূল প্রতিপাদ্য এটিই। নাম পুরুষের দৃষ্টিতে লেখক যেভাবে শেষ বয়সী কারো স্মৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
বইটির ‘দীননাথ কবিরাজ’ গল্পটি রচিত হয়েছে কিছুটা ‘সোহলী’ গল্পের উল্টো আবেগে। শ্বশুরবাড়ি সব মেয়ের জন্য বিষাক্ত হয় না, সেই আঁচ মেল এই গল্পে। মূলত বাবা ও মেয়ের পারস্পরিক মমতার বিষয়টি বেশ সাবলিলভাবে ফুটে উঠেছে ‘দীননাথ কবিরাজ’-এ।একজন বাবা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্য ঘরে পাঠান, আবার অন্য কারো মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনেন। এভাবেই পৃথিবীতে মমতার বন্টন হয়ে আসছে দীর্ঘকাল। মেয়ে যখন কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে, তখন পিতার বুকে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। কিন্তু এরপরই আসে ভাটা। মেয়ের বিদায় ব্যথিত করে বাবার মনকে। আনন্দ-বেদনার এই ওঠা-নামাই লেখক দেখিয়েছেন তার এই গল্পে।
পরের গল্পের নাম ‘একদিন কপোতাক্ষ’। এখানে অপরিণত মনের মানসপটে সুপ্ত প্রেমাবেগের হদিস দিয়েছেন লেখক। মূলত প্রেমের ভিত্তিটা মানুষের মনে বপন হয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই। সামান্য মমতা বা আদরের স্পর্শে অপরিণত মনের আবেগ ঠিকরে বেরোতে চায়। তেমনটিই ঘটেছে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া আলমের সঙ্গে। অল্প সময়ের নৌকাভ্রমণে নূপর নামে একটি মেয়ের সামান্য ভালোবাসা তার নাবালক মনকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিয়ে যায়। এরপরই অবশ্য তার খেয়াল চলে যায় অন্যত্র। জমজমাট হাঁটের কর্মবৈচিত্র আলমকে পথভোলা বালকে পরিণত করে।
এই পর্যন্ত লেখকের প্রতিটি গল্প বাস্তবতার নিরিখে রচিত। কিন্তু এর পরের গল্প লিখতে তিনি অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদির আশ্রয় নিয়েছেন। ‘পরী’ নামে এই গল্পে তিনি প্রেম দেখালেও সেই প্রেমের উৎস বয়ানে স্বপ্ন ও পরীর মতো অদেখা সত্ত্বাগুলোর আশ্রয় নিয়েছেন, যা বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে ভিন্নস্বাদের অবতারণা করেছে।
বইটির আরও একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প হলো ‘দাউদের বউ’। দাউদ নামে একজন খোঁড়াব্যক্তির সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন সখিনা। স্বামীর এই প্রতিবন্ধকতা সখিনার প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। উল্টো স্বামীর গুণ তাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু দাউদকে নিয়ে পাড়া-পড়শির কটূক্তি সখিনার হৃদয়কে চৌচির করে দেয়। বেদনামিশ্রিত সেই ভালোবাসার এক নিদারুণ গল্প হচ্ছে দাউদের বউ।
প্রযুক্তির গুঁতোয় এগিয়ে চলা এই সভ্যতা মধ্যে আজও মানুষ তার অতীত দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়। বইটির ‘বৈকালী অপেরা’ গল্পটি পাঠককে সেই স্বাদ দেবে। এক সময়ের যাত্রাপালা গায়ের লোকেদের মনকে কতটা আন্দোলিত করত তা রচিত হয়েছে এই গল্পে। এখানেও সামান্য পরিসরে এক কিশোর মনের প্রেম ফুটে উঠেছে। যাত্রাপালার এক মেয়ের রূপ অল্প বয়সী কোনো ছেলের মনের নদীতে কীভাবে ঢেউ তোলে, সেটারও যৎসামান্য বর্ণনা মেলে এই গল্পে। এরপর চলে আসে ‘কবুতর’ গল্পটি। সেটিও বেদনার। কিশোর মনে কবুতরের প্রতি তৈরি হয় নিখুঁত ভালোবাসা। শয়নে-স্বপনে, জাগরণে কিশোরের সমস্ত চিন্তায় বাস করে এক কবুতর। কিন্তু এত শখের কবুতরটি নিয়ে যায় খাটাশে। এই পর্যায়ে এসে পাঠক হৃদয় প্রবলভাবে আহত হয়। লেখকের লেখার মুনশিয়ানায় মনে হয়, পাঠক নিজেই বুঝি তার শখের কোনো জিনিস হারিয়েছে। মূলত প্রিয় জিনিস হারানোর শোক গেথে দেওয়া হয়েছে কবুতর গল্পে।
বাইয়ের পরের গল্প ‘পেয়ারাতলার বউ’। অদম্য যৌনতার মুখোমুখি দাঁড়ালে যে কোনো কিশোরী হতভম্ভ হয়ে যেতে পারে—এমনই এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব লেখক তার এই গল্পে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ঝুনু নামে একটি চরিত্র তার সদ্য বিবাহিত ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার ভাই-ভাবীর রতিক্রিয়ার সাক্ষী হয়ে যায়, যা মেয়েটির স্বাভাবিক জগতকে ওলট-পালট করে দেয়। যদিও মেয়েটির ভাবী বিষয়টিকে সাধারণভাবে দেখে এবং ঝুনুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। এই নিয়েই গল্পটি এগোয়।
এরপরের ’যাত্রা’ নামে গল্পে দেখা যায় মৃত্যুচিন্তায় মগ্ন এক বাবার বিচিত্র ভাবনার সমারোহ। জাগতিক ও অনিশ্চিত ভূবনের মাঝখানের যে জগৎ, সেই জগতে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তির মানসিক চিন্তাধারাই এই গল্পটির উপজীব্য। পরের গল্প ‘বাগের আমতলা’। এটাকে অনেকটা ‘আশ্রয়’ গল্পের থিমেই সাজিয়েছেন লেখক। সোবহান নামে একটি চরিত্রের ওপর ভর করে প্রতিনিয়ত বদলে চলা আশেপাশের পরিবেশের একটি চিত্র যেন এই গল্পে এঁকে দিয়েছেন লেখক।
এরপরের দুটি গল্পে যাওয়ার আগে লেখকের ব্যক্তিজীবন নিয়ে দুয়েক কথা বলা নেওয়া ভালো। যশোর জেলার লেখক রেজা নুর বাস করেন মার্কিন মূলুকে। ফলে তার গল্পের বইয়ে আমেরিকার দুই-একটি ঘটনা থাকাই স্বাভাবিক। বইয়ের ‘ডেভিড ব্ল্যাকম্যান’ ও ‘শীপ প্যাসচার’ তেমনই দুটি গল্প। প্রথমটিতে আমেরিকায় একটি শপে কর্মরত ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়টিতে একটি অ্যানিমেলে ফার্মে অবসর কাটানোর গল্প তুলে ধরেছেন লেখক। এরপরই চলে আসে বইয়ের শেষ গল্প ‘দিকশূন্য’। এখানে চলন-অক্ষম এক ব্যক্তির জৈবিক তাড়নার ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন লেখক, যা অবহেলিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ পাঠকের অন্তরকে কোমল করে তুলবে।
১৪৪ পাতার এই বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে, ২০১২ সালের বইমেলায়। লেখকের পৈতৃক নিবাস ঝিকরগাছায়, ফলে পুরো বইয়ের চরিত্রগুলোর সিংগভাগের কথোপকথন হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায়। ছোটগল্পের আদল যথাযথ বজায় রেখেই গল্পগুলো লিখেছেন রেজা নুর। তবে বইটির কিছু বিষয় পাঠকভেদে বাহুল্য মনে হতে পারে। বেশ কিছু গল্পে ঘটনা বেশ সামান্য, কিন্তু প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে গল্পটিকে লম্বা করার চেষ্টা পাঠকতে নিরানন্দ করতে পারে। আবার এটিই কিন্তু প্রকৃতিবিলাসী পাঠককে তুমুল আনন্দ দিতে পারে। ফলে এটিকে রচনার দোষ না বলে ‘বৈচিত্র’ বলা যেতে পারে। তা ছাড়া ছোট-ছোট বাক্যগঠন বইটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। প্রতিটি গল্পই অল্প কিছু চরিত্রের সমারহে লেখা বিধায় পাঠককে গল্পরসে ডুব দিতে গিয়ে বাড়তি চাপ নিতে হয় না। বাকিটা পাঠক বইটি পড়ার পরই সিদ্ধান্ত নেবেন।
——**——