আবু তাহের সরফরাজ
শিল্প মানে হচ্ছে, নির্মাণের বা রচনার কলাকৌশল ও নৈপুণ্য। কলাকৌশল ও নৈপুণ্যের সাথে যা নির্মাণ করা হয় ত-ই শিল্প। মানুষ যা-কিছুই তৈরি করুক না কেন তৈরিকৃত সৃষ্টিকর্ম যত নিখুঁত ও গোছানো হবে সেই সৃষ্টিকর্ম তত বেশি শৈল্পিক। নানা মাধ্যমে মানুষ চিন্তা ও কল্পনার যে প্রকাশ ঘটায় তার সবই আসলে শিল্প। যেমন: ছবি আঁকা ও কবিতা লেখা। আভিধানিক সংজ্ঞা ছাড়িয়ে শিল্পের মানে কিন্তু আরও বিস্তৃত। সেই বিবেচনা থেকে কথা বলাও শিল্প। যে যত বেশি সুন্দর উচ্চারণে গুছিয়ে কথা বলতে পারে তার কথার প্রভাব শ্রোতার ওপর বেশি আছর করে। তরকারি রান্নায় সকল উপাদান ঠিকঠাক মতো না-দিলে তরকারি খেতে স্বাদ হয় না। খাদ্যে স্বাদ পেতে হলে খাদ্য প্রস্তুত করতে নৈপুণ্য প্রয়োগ করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, শিল্পের সঙ্গে সৌন্দর্যের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। যা পরিপাটি, সুশৃঙ্খল ও গোছানো, তার সবই শিল্প। যা বিশৃঙ্খল ও অসুন্দর তা শিল্প হয়ে ওঠে না। কারণ, শিল্প হচ্ছে নিরন্তর সৌন্দর্য। আর তাই কবিতাকে শিল্প হয়ে ওঠার জন্য কিছু অলঙ্কার দিয়ে নিজের শরীরকে সাজাতে হয়। এসব অলঙ্কার কবিতাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার পাশাপাশি নিখুঁত অবয়বে রূপদান করে। ধরা যাক, চিত্রশিল্পী তার অন্তর্জগতে প্রতিভাত একটি দৃশ্য আঁকছেন। রঙের বিন্যাস যদি নিখুঁত না-হয় তাহলে দৃশ্যটিও নিখুঁত হয়ে হবে না। কোন অংশে কী রঙ, কতটুকু রঙ লাগাতে হবে সেই নৈপুণ্য তার ভেতর না-থাকলে ছবিটি সুন্দর হয়ে উঠবে না। আর, তার সৃষ্টিকর্ম সুন্দর না-হলে শিল্পমণ্ডিত হবে না। কবিতার বেলাতেও একই কথা। তবে তফাৎ এই যে, ছবি আঁকতে কেবল ক্যানভাস ও রঙ হলেই চলে। কিন্তু কবিতা লিখতে গেলে দরকার কবিতার অলঙ্কার। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ভাষাশৈলী— এসব হচ্ছে কবিতার অলঙ্কার। সবার ওপরে কবির কল্পচিত্র তো রয়েছেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজকাল কবিতাকে শিল্প করে গড়ে তোলার প্রতি কবিদের যত-না ঝোঁক তারচেয়ে বেশি প্রাণান্ত চেষ্টা কবি হিসেবে নিজের নামটি পরিচিত করার পেছনে। ফলে, বাংলার কবিতার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।
রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন বিশৃঙ্খলা। যে যত বেশি মূর্খ, সমাজে জ্ঞানী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্য তত বেশি। এই ডামাডোলে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে সৌন্দর্যবোধ। গণমাধ্যমের প্রচারণায় যে কোনো বিষয়কে সাধারণ মানুষ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছে। আর, গণমাধ্যম যা প্রচার করছে সেখানে রয়েছে গণমাধ্যম কর্তার বাণিজ্যের দূরভিসন্ধি। এই বাস্তবতায় কবিতার শিল্পগুণ গৌণ। প্রচারণাই মুখ্য। এ বিষয়টির সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে আশির দশকের কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘উত্তরসাধক’ কবিতাটি পড়লে।
যে আমাকে অস্বীকার করে
প্রথমত অকবি সে; দ্বিতীয়ত পরশ্রীকাতর
হয়তো সে মিডিয়াপালিত কোনো প্রাবন্ধিক; ভুল বাক্যে বুকরিভিও করে
অথবা সে আসলে কালপ্রিট, দ্যাখে বড়কাগজের লঘু সাহিত্য পাতাটি
নতুবা সে ছোট কোনও কাগজের পাতি সম্পাদক
নিজেকে জাহির করে নিজের কাগজে
কাগজে-কাগজে করে সখ্যবিনিময়
ওরা কেউ কবি নয়, ওদের পেছনে ঘুরে বহু প্রতিভাকে আমি নষ্ট হতে দেখি
যে আমাকে কেবলই স্বীকার করে, বিতর্ক করে না
সে-ও কোনও কবি নয়, জেনো
যে আমাকে গ্রাহ্য করে, পাশাপাশি মধুর তর্কও
তারই মধ্যে আমি কিছু সম্ভাবনা দেখি
সে-ও কবি নয়
কে তাহলে?
অমিতসম্ভাব্য কবি ভালোবাসে একার সন্ন্যাস।
বাংলা কবিতার মনস্বী পাঠকমাত্রই জ্ঞাত যে, শাহরিয়ারকে বাংলা কবিতার রাজপুত্র বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হয় না। কবিতার কৃৎকৌশল যথাযত উপায়েই তার আয়ত্তে। কবিতার সৌন্দর্য অবলোকন করার শৈল্পিক চোখ তার ভেতর সবসময় জেগে থাকে। আর তাই, তিনি বর্তমান সময়ের কবি ও কবিতার দিকে চোখ মেলে দেখতে পান, মিডিয়াশাসিত কবিতার ভূমে ঘুরে বেড়াচ্ছে কবি নামধারী কতিপয় পিঁপীলিকা। ব্যক্তিজীবনে আবু হাসান শাহরিয়ার স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা ও আপসহীন। সত্যকে সত্য হিসেবেই তিনি জ্ঞান করেন। যা অসুন্দর, মিথ্যা ও স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত সেসব বিষয়কে তিনি আঙুল নির্দেশে স্পষ্ট করে দেন। এরই প্রেক্ষিতে রচিত ‘উত্তরসাধক’ কবিতাটি। ‘আমাকে’ বলতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন ‘প্রকৃত কবি’কে। প্রকৃত কবি আর অকবির ভেতর তফাৎ কি? এই তফাৎ শাহরিয়ার নির্দেশ করছেন এভাবে, প্রকৃত কবিকে যে অস্বীকার করে সে-ই অকবি। আর, অকবিরা হয় পরশ্রীকাতর। প্রকৃত কবিদের উন্মেষ তারা সহ্য করতে পারে না। অকবিরা জানে যে, তারা অকবি। জানে বলেই স্বীয় ব্যর্থতা ঢাকতে তারা আশ্রয় নেয় গণমাধ্যমের ছায়াতলে। বড় কাগজের সাহিত্য পাতাকে শাহরিয়ার মনে করেন লঘু সাহিত্যের আয়োজন। অকবিদের গতিবিধির কয়েকটি দৃষ্টান্তও কবিতার ভেতর শাহরিয়ার উল্লেখ করেছেন। গণমাধ্যমের সম্পাদক ও একনিষ্ঠ কবি হিসেবে শাহরিয়ারের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অকবিদেরকে কবি মান্য করে তাদের পেছনে ঘুরে অসংখ্য প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেছে। বিকশিত হওয়ার সুযোগ অঙ্কুরেই তারা হারিয়ে ফেলেছে। আরেক শ্রেণির অকবিদের সাথে শাহরিয়ার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তারা হলেন, প্রকৃত কবিকে যারা কোনো বিতর্ক ছাড়াই স্বীকার করে, স্তুতি গায়। এরই পাশাপাশি আরেক শ্রেণির অকবির কথা শাহরিয়ার বলেছেন যারা সম্ভবনাময়। মানে, তাদের কবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা হলো, যারা প্রকৃত কবিকে স্বীকার করে নিয়ে তার কবিতার বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক উত্থাপন করে। তাহলে প্রকৃত কবি কে? সেই হদিশ কবিতার শেষে এসে কবি আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন। যে কবি নির্জনে-নিভৃতে কবিতা লিখে যান, তাকেই প্রকৃত কবি হিসেবে শাহরিয়ার মান্য করছেন।
কবির এই শ্রেণি-বিভাজন থেকেই কিন্তু কবিতারও শ্রেণি-বিভাজন আমরা পেয়ে গেছি। বাংলা কবিতার মনস্বী পাঠক হিসেবে আমরা এতদিনে জেনে গেছি, একার সন্ন্যাসে কবিতা লিখে যেসব কবি তাদের কবিতাকে শিল্পের সুষমায় রাঙিয়ে তুলতে পেরেছেন, আবু হাসান শাহরিয়ার তাদের অগ্রগণ্য। তার কবিতার সৌন্দর্য আশির দশক পেরিয়ে আজতক বাংলা কাব্যসাহিত্যকে দীপ্তিময় করে তুলছে। তার কবিতার প্রধান সৌন্দর্য মূলত ছন্দের সুনিপুণ কারুকাজেই নিহিত। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যঞ্জনায় তার কবিতা বাংলা কবিতার হিরন্ময় ঐশ্বর্য। শাহরিয়ারের কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, ছন্দের ছন্দিত দোলনায় চড়িয়ে তিনি শব্দকে কবিতায় বিন্যাস্ত করেন না। বরং, ছন্দিত শব্দ নিজের থেকেই তার ভেতর দিয়ে কবিতায় বিন্যাস্ত হয়ে যায়। যে কোনো মাত্রার ছন্দকে তিনি নানা পর্বে ভেঙেছেন। আবার, গড়ে তুলেছেন নিজের মর্জিমতো। এই ভাঙা ও গড়ার প্রক্রিয়াটি পাঠকের কাছে যদিও নীরিক্ষা, কিন্তু কবির কাছে এক রকম খেলা। শিশু যেমন নানা খেলনা নিয়ে খেলতে বসে, ঠিক যেন তেমনই শাহরিয়ার ছন্দিত শব্দকে নানা পর্বে বিন্যাস্ত করে খেলতে থাকেন। বলতে কী, ছন্দ দ্বারা পুরোপুরি আক্রান্ত না-হলে এই খেলা সম্ভব হয় না। ‘রূপকথার রাজা’ কবিতাটির প্রথম দুই স্তবকের ওপর চোখ বোলানো যাক।
রাস্তা ছিল/চওড়া তবু/রাস্তা ছেড়ে/আমি
খোলা মাঠের/মধ্যে নেমে/পড়ি।
রাস্তা সে কী/দ্রুত, সে কী/অহঙ্কারে/চলে।
রাস্তা যাদের,/তাদের সাথে/পাল্লা দেওয়া/সাজে?
আমি পরম/নির্ভরতায়/একাকী পায়/দলে
মর্জিমাফিক/চলি।
মাঠের গতি/একটু ঢিলে/ঢালা—
একটু জিরেন,/একটু হাঁটা,/হঠাৎ করে/ঠা-ঠা
অট্টহাসি/দিয়ে কাঁপাই/মাটির স্থবি/রতা।
দেখা যাচ্ছে, কবিতাটির ছন্দ মুক্তক স্বরবৃত্ত। প্রতি পর্বে রয়েছে চার মাত্রা। প্রতি চরণের শেষে অপূর্ণ দুই মাত্রা। চরণগুলোর পর্বসংখ্যা এলোমেলো। আগের-পরের চরণের পর্বের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এটাই মুক্তক ছন্দের খেলা। ছন্দবিহীন পর্ববিহীন মুক্ত শব্দের অনেক কবিতা এ ধরনের আঙ্গিকে অনেক কবিই লিখেছেন। সেসব কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আর তাই আমরা দেখেছি যে, সেসব কবিতা পাঠকের মনোযোগকে আনন্দের সঙ্গে ধরে রাখতে পারেনি। না-পারার কারণ, সেসব কবিতা আঙ্গিক-সর্বস্ব। আবার এমনও দ্যাখা গেছে, প্রলাপের মতো কিছু শব্দ বসিয়ে বাক্যের পর বাক্য কবি লিখে গেছেন। সেসব শব্দের কিংবা বাক্যের ভেতর দিয়ে কী প্রকাশ পাচ্ছে, পাঠক তা উপলব্ধি করতে পারে না। অথচ কবিতার বাজারে তারা পরিচিত কবি। কোনোকিছু না-বুঝেই পাঠক স্বীকার করে নেয়, বেশ তো সুন্দর কবিতা! এসব আহাম্মক পাঠক শাহরিয়ারের কাম্য নয়। তার কাম্য কবিতার গুণবিচারী পাঠক। রসজ্ঞ পাঠক। ওপরের কবিতায় খেয়াল করতে দ্যাখা যাবে, পর্বের পর পর্বে যেসব শব্দ বিন্যাস্ত হয়েছে সেসব শব্দ খুবই সুশঙ্খল এবং অর্থবহ। একটি শব্দও বাড়তি হিসেবে কবিতার ঘাড়ে চেপে বসেনি। এই মুন্সিয়ানা বঙ্গের খুব কম কবিই দেখাতে পেরেছেন। দেখা গেছে যে, ছন্দহীন কবিতায় শব্দের মেদ থাকলে তা পাঠককে খুব বেশি বিরক্ত করে না। কিন্তু ছন্দিত কবিতায় বাড়িত একটি বর্ণও কবিতার সৌন্দর্যকে খুব তীব্রভাবে ম্লান করে দ্যায়।
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় উপমার দ্যোতনা খুবই চিত্তগ্রাহী। পাঠকের পাঠতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে সেসব উপমায় থাকে চিত্র-বৈচিত্র্যের নানা রকম শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। উপমা ব্যবহারের নৈপুণ্য যেন শাহরিয়ারের প্রকৃতিগত। কেননা, সেসব উপমা পাঠেই বোঝা যায়, কবিতার দরকারে শাহরিয়ার উপমাকে খুঁজে এনে কবিতায় বসিয়ে দেননি। শৈল্পিক এই ক্ষমতা মূলত সহজাত। যা জাতকবিদের বৈশিষ্ট্য। মিডিয়াশাসিত কবিদের কাছে এই ক্ষমতা কখনোই ধরা দ্যায় না। শাহরিয়ারের কবিতায় ব্যবহৃত কয়েকটি উপমার ওপর এবার চোখ রাখা যা:
ক. বাংলাদেশ বড় লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। ওকে
অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে
ভূত সেজে ভয় দেখিও না
ওর বুক ধড়ফড় করে।
খ. ভিক্ষা যদি করিই, হবো রাজভিখিরি
সোনার থালা ধরব মেলে—
কলদিতে চাইলে মোহর দিয়ো রাজকুমারী।
গ. আমার কালের অন্ধকার গলিটির নাম প্রথম আলো।
প্রথম উদ্ধৃতিতে বাংলাদেশকে তুলনা করা হয়েছে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের সাথে। এই সাদৃশ্য প্রকৃত দেশপ্রেমিকের। বাংলাদেশ সত্যিই সাদাসিদে শান্ত একটি কোমল কিশোরীর মতো লাবণ্যে ঢলঢল। আতকা কেউ যদি বাংলাদেশকে চোখরাঙানি দেখায় তাহলে সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে ভিখিরি অবস্থাটাকে রাজকীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন শাহরিয়ার। ভিক্ষা যদি করতেই হয় তাহলে তিনি সোনার থালা হাতে ভিক্ষে করবেন। আর ভিক্ষে হিসেবে নেবেন সোনার মোহর। সামান্য খুচরো পয়সা কিংবা দু’চার টাকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তিতে নামবেন না। এখানে আসলে শাহরিয়ারের আত্মগৌরব মহিমান্বিত হয়ে ফুটে উঠেছে। ভিক্ষা অর্থে আমরা বুঝে নিতে পারি, সামান্য প্রলোভনের কাছে নিজের মর্যাদা বিকিয়ে দেয়া। তৃতীয় উদ্ধৃতিতে দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর শাহরিয়ার তার সময়ের অন্ধকার গলির সাথে তুলনা করেছেন। অন্ধকার গলি নানা অর্থেই আমাদের কাছে ভীতিকর। কারণ, আমরা জানি অন্ধকার গলিতে নানাবিধ অপকর্ম সংঘটিত হয়। কিন্তু জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো কী-কী অপকর্ম করে, যার জন্য শাহরিয়ার প্রথম আলোকে অন্ধকার গলির সাথে তুলনা করলেন? বলতে কী, প্রথম আলোর অপকর্ম আজকের সময়ে এসে ব্যাখ্যা করা বালখিল্য। কেননা, দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক প্রথম আলোর এজেন্ডা ও লক্ষ্য অবগত। যারা অবগত নয় তারা খাঁটি মূর্খ। অবশ্য দেশের বেশির ভাগ মানুষই বিশুদ্ধ মূর্খ।
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতার ভাষাশৈলী অনন্য। তার সময়ের আরসব কবির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও প্রাগ্রসর। তার কবিতা যেন চুম্বকীয় শক্তি ধারণ করে থাকে। ফলে, প্রতিটি শব্দই শাহরিয়ারের অন্তর্বোধকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে সার-বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়। লক্ষ্যণীয় যে, পাঠকের কাছে অপরিচিত এমন শব্দের ব্যবহার শাহরিয়ারের কবিতায় নেই বললেই চলে। বাংলা ভাষায় কয়েক হাজার শব্দ রয়েছে। সকল শব্দ সাধারণ পাঠকের জানার কথা নয়। এমনকি, সাহিত্যের গবেষকেরও পক্ষেও। ফলে, সাধারণের বোধগম্যের বাইরের শব্দ দিয়ে কবিতার শরীর নির্মাণের সার্থকতা কতটুকু, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। অবশ্যি এই চেষ্টা আশির দশকের কারো কারো কবিতায় আমরা দেখতে পাই। সেসব শব্দ ছন্দিত নয়, ছন্দহীন। বাক্যের শরীরে মেদ। এরপর নব্বইয়ের দশকের বেশ কয়েকজন কবিও প্রলাপসর্বস্ব কবিতা লিখতে গিয়ে খুঁজে-খুঁজে অপ্রচলিত শব্দে কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। আসলে শব্দের প্রাণ-স্ফুরণ তারা ধরতে পারেনি। তারা মনে করে, শব্দ যেন মাটির ঢেলা। স্থবির। তা কিন্তু নয়। শব্দ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো বেগবান। এই উপলব্ধি প্রগাঢ়ভাবেই আমরা দেখতে পাই আবু হাসান শাহরিয়ারের ভেতর। তাই তো তার কবিতার শব্দ প্রাণ-প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। মানবীয় অনুভূতির রক্ত-মাংসের প্রাণোচ্ছ্বল প্রকাশ। প্রাণের এই উচ্ছ্বলতায় শাহরিয়ারের কবিতা মূলত আদি-অন্তহীন বিস্তীর্ণ আসমান। মানবীয় অনুভূতি যেমন তার কবিতাকে রাঙিয়ে যায় বহু বর্ণিল অভিজ্ঞতায়, এরই পাশাপাশি প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ তার কবিতায় ঝঙ্কৃত হয় নানা ব্যঞ্জনায়।
বিষয়-বৈচিত্র্যে আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা বিস্তৃত ক্যানভাস। তার প্রত্যেকটি কবিতাই জীবনোপলব্ধির শৈল্পিক সারাৎসার। আত্মপরিচয়ের ভাষাচিত্র। ‘মাটি বংশধর’ কবিতার কয়েকটি চরণ পড়া যাক:
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা
আমার বাপের নাম কে না জানে— চাষা-মালকোঁচা
আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠি নিম্নজনা
ধুতি-গোয়ালারা জ্ঞাতি, আরও জ্ঞাতি খড়ম-তাঁতিরা।
বাঙালির জাতীয় পরিচয়কে শাহরিয়ার খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের পরিচয়ে মহিমান্বিত করেছেন। কবির সমাজদর্শন তো এমনটিই হওয়া উচিত। সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি করে রাজনীতিবিদরা গোটা দেশটাকে শোষণের সুযোগ তৈরি করে নেয়। কিন্তু কবি তখন সাধারণ মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় সাম্য ঘোষণা করেন। শাহরিয়ার লিখেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা যখন ঘুমায়, কবিরা তখন দেশকে পাহারা দেয়।’ বলতে দ্বিধা নেই, এ ধরনের ক্ষুরধার উচ্চারণ বাংলা কবিতায় খুব কমই ধ্বনিত হয়েছে। আর, আজকাল তো প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত হচ্ছেন বঙ্গে কবিকুল। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খেয়ে তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। এসব অকবিদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে একার সন্ন্যাস যাপন করছেন প্রজ্ঞাবান কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। আর শব্দচাষে সমৃদ্ধ করে তুলছেন বাংলা কবিতার সার্বভৌমত্ব।