spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশাকিল রিয়াজ এর 'কাফকার কাছে' : একটি বিশ্লেষণ

লিখেছেন : সোহেল মাহমুদ

শাকিল রিয়াজ এর ‘কাফকার কাছে’ : একটি বিশ্লেষণ


সোহেল মাহমুদ

কাফকার কাছে
কবি শাকিল রিয়াজ

তোমার চিবুকে গাঁথা চুম্বনের চতুরতা থেকে
খসে পড়তে পড়তে
অদৃশ্য হয়েছিলাম একটি তিলের গভীরে।
এই তিলের সৌন্দর্যে লুকিয়ে ছিল
সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোল। সুনসান অন্ধকারের
বাঁকল আঁচড়ে কিছু কালি নিয়ে
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি কাফকা,
কতো জটিলতা পাড় হয়ে বলো
ফিরে আসা যাবে আগের জীবনে?
বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো নিরাসক্ত
সেই এক ভোজবাজি জীবন!
রোদের ভেল্কিমারা কাঁচা আলো
কেটেকুটে খাওয়ার মতো টক টক জীবন!
অক্ষর থেকে অক্ষরে
মেঘ ফেটে নেমে আসা বিদ্যুৎ
তার স্ফুলিঙ্গ ঢেলে দিলে
খুব নিচু নিঃশ্বাসও ফুঁসে ওঠে ঝড়ের মতো।
বিশ্বাস করো, আমি ফুঁ দিইনি
আমি কোনো দীর্ঘ নিঃশ্বাস রাখিনি আশেপাশে
তবু তোমার কানের দুল নড়ে উঠলো বলে আমি আজ দায়ী হয়েছি সীমা লঙ্ঘনের!
কঠিন কংক্রিটে ঘাসফুল হয়ে ফুটেছিলাম
তুমি শুধু তাকিয়েছিলে বলে
তুমি জল দিয়েছিলে বলে ফুটেছিলাম লাল।
জলজ্যান্ত এক মানুষ
তোমার রাতজাগা আঙুলে
একবার গুম হয়েছিল সারারাত
আজ ঘাসফুল হয়ে ফিরেছে মেঠোপথে
পাথরের নুড়ি, ইঁটের খোয়ার ফাঁকে ফাঁকে
ফুটে আছে তোমার ভ্রূক্ষেপহীন পায়ের আশেপাশে, নির্মোহ আপেল তলায়
ফুটে আছে দিশাহারা ঘাসফুল হয়ে।
তোমার পায়চারি বেণী হয়ে যেদিকে যাচ্ছে
সেদিকে জ্বর ছুঁই ছুঁই গ্রীষ্ম নামে
ক্ষরা ও দাহনে পোড়া বিকলাঙ্গ গাছপালা থেকে
কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি কাফকা,
এই আরসোলা জীবন আর ভালো লাগে না
আমাকে ফের রূপান্তরিত করো।
🍀🍀

কবি শাকিল রিয়াজের “কাফকার কাছে” কবিতাটি ফ্রান্‌ৎস কাফকার সাহিত্যিক ভাবধারার গভীরে প্রবেশ করে এক অস্তিত্ববাদী সঙ্কট ও রূপান্তরের আকুতিকে তুলে ধরেছেন। কবিতাটি জুড়ে কাফকার প্রভাব সুস্পষ্ট, যেখানে অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতি, পরিচয়হীনতা, এবং এক ধরণের অনিবার্য পরিণতি বর্তমান।

কবিতার শুরুতেই কাফকার প্রতি সরাসরি সম্বোধন পাঠককে এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যায়। “তোমার চিবুকে গাঁথা চুম্বনের চতুরতা থেকে / খসে পড়তে পড়তে / অদৃশ্য হয়েছিলাম একটি তিলের গভীরে।” এই পঙ্‌ক্তিগুলো এক আকস্মিক এবং অলৌকিক রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়। একটি সাধারণ চুম্বনের পরিণতি হিসেবে একটি তিলের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যেন কাফকার “রূপান্তর” গল্পের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে গ্রেগর সামসা সকালে উঠে নিজেকে এক বিশাল পোকাতে রূপান্তরিত দেখে। এখানে, তিলের “সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোল” হয়ে ওঠা অস্তিত্বের এক গভীর শূন্যতা, এক মহাজাগতিক গহ্বরকে বোঝায়, যেখানে কবি তাঁর নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলেছেন।
এই ব্ল্যাকহোল থেকে “সুনসান অন্ধকারের বাঁকল আঁচড়ে কিছু কালি নিয়ে” চিঠি লেখার চেষ্টা করা যেন এক নিরর্থক সংগ্রাম, যেখানে যোগাযোগ স্থাপন করাও এক অসম্ভব কাজ। কবির প্রশ্ন, “কতো জটিলতা পাড় হয়ে বলো / ফিরে আসা যাবে আগের জীবনে?” এক গভীর নস্টালজিয়া ও পূর্বের সরল জীবনের প্রতি আকুতি প্রকাশ করে। “বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো নিরাসক্ত / সেই এক ভোজবাজি জীবন!” বা “রোদের ভেল্কিমারা কাঁচা আলো / কেটেকুটে খাওয়ার মতো টক টক জীবন!”—এই বর্ণনাগুলো এক হারানো নির্দোষিতা এবং প্রাণবন্ততার চিত্র তুলে ধরে।
দ্বিতীয় স্তবকে কবি এমন এক পরিস্থিতিতে নিজেকে দেখতে পান যেখানে তিনি তাঁর অজান্তেই অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। “অক্ষর থেকে অক্ষরে / মেঘ ফেটে নেমে আসা বিদ্যুৎ / তার স্ফুলিঙ্গ ঢেলে দিলে / খুব নিচু নিঃশ্বাসও ফুঁসে ওঠে ঝড়ের মতো।” এই পঙ্‌ক্তিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ক্ষুদ্রতম কাজ বা অনুচ্চারিত অনুভূতিও কীভাবে বৃহৎ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। “বিশ্বাস করো, আমি ফুঁ দিইনি / আমি কোনো দীর্ঘ নিঃশ্বাস রাখিনি আশেপাশে / তবু তোমার কানের দুল নড়ে উঠলো বলে আমি আজ দায়ী হয়েছি সীমা লঙ্ঘনের!”—এই অংশটি কাফকীয় বিচারব্যবস্থার প্রতিধ্বনি, যেখানে ব্যক্তি কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই অভিযুক্ত হয় এবং তার অপরাধের ব্যাপ্তি তার নিজের কাছেও অজ্ঞাত থাকে। এটি অযৌক্তিক অপরাধবোধ এবং অনভিপ্রেত পরিণতির এক স্পষ্ট চিত্র।
কবিতার সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং প্রতীকী অংশ আসে তৃতীয় স্তবকে। “কঠিন কংক্রিটে ঘাসফুল হয়ে ফুটেছিলাম / তুমি শুধু তাকিয়েছিলে বলে / তুমি জল দিয়েছিলে বলে ফুটেছিলাম লাল।” এখানে ঘাসফুল কবির দুর্বলতা, সংবেদনশীলতা এবং আশার প্রতীক। অন্যের সামান্য মনোযোগ বা স্পর্শে যে জীবন পল্লবিত হয়েছিল, সেটিই পরবর্তীতে “জলজ্যান্ত এক মানুষ” থেকে “ঘাসফুল” এ রূপান্তরিত হয়। “তোমার রাতজাগা আঙুলে / একবার গুম হয়েছিল সারারাত” এই চিত্রটি কবির সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে তাঁর সত্তা অন্যের নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ঘাসফুলের এই রূপান্তর এক ধরণের অধঃপতন নির্দেশ করে, যেখানে একসময়কার সজীব মানুষ পাথরের নুড়ি ও ইঁটের খোয়ার ফাঁকে, “তোমার ভ্রূক্ষেপহীন পায়ের আশেপাশে” এবং “নির্মোহ আপেল তলায়” নিরাশ্রয় হয়ে ফুটে থাকে। এটি ব্যক্তির সামান্যতা, উপেক্ষা এবং নিয়তি দ্বারা চালিত হওয়ার বেদনাকে ফুটিয়ে তোলে।
শেষ স্তবকে কবি তাঁর বর্তমান জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেন। “তোমার পায়চারি বেণী হয়ে যেদিকে যাচ্ছে / সেদিকে জ্বর ছুঁই ছুঁই গ্রীষ্ম নামে / ক্ষরা ও দাহনে পোড়া বিকলাঙ্গ গাছপালা থেকে / কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে / তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি কাফকা,”—এই পঙ্‌ক্তিগুলো একটি বিষণ্ণ ও নিদারুণ পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রেমাস্পদের অনুপস্থিত বা উদাসীন বিচরণ যেন এক শুষ্ক, দহনময় গ্রীষ্ম নিয়ে আসে, যা সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেয়। “কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে” চিঠি লেখার চিত্রটি হতাশা এবং শূন্যতার এক চূড়ান্ত প্রতীক।
কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তিটি “এই আরসোলা জীবন আর ভালো লাগে না / আমাকে ফের রূপান্তরিত করো।” এখানে “আরসোলা জীবন” বলতে নিকৃষ্ট, ঘৃণিত এবং টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামরত এক জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই রূপকটি আবারও কাফকার “রূপান্তর” গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত। কবি এই অসহনীয় জীবন থেকে মুক্তি চান, তবে সে মুক্তি পূর্বের জীবনে ফিরে আসা নয়, বরং এক নতুন ‘রূপান্তর’ যা তাঁকে এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবে। এটি এক ধরণের পুনর্জন্মের আকুতি, যা জীবন থেকে মুক্তির এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।
সামগ্রিকভাবে, “কাফকার কাছে” কবিতাটি আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট, পরিচয়হীনতা, অযৌক্তিক অপরাধবোধ এবং অসহনীয় জীবন থেকে মুক্তির এক মর্মস্পর্শী আর্তি। এটি কাফকীয় সাহিত্যিক ধারাকে সফলভাবে ধারণ করে এবং পাঠককে এক গভীর দার্শনিক চিন্তায় নিমজ্জিত করে।

………….
ব্রাহ্মণবাড়িয়া

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. কবিতা এবং আলোচনা আকর্শনীয় হয়েছে ‌‌।
    কবিতার জন্ম শাকিল রিয়াজ এবং আলোচক সোহেল মাহমুদকে ভালোবাসা জানাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ