spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েকাটা পড়া মানুষ : দুঃসহ কালের প্রতিবিম্ব

লিখেছেন : রফিক সুলায়মান

কাটা পড়া মানুষ : দুঃসহ কালের প্রতিবিম্ব


রফিক সুলায়মান

এখন যে কবিতার বইটি পড়ছি এর নাম ‘কাটাপড়া মানুষ।’ লিখেছেন কবি মজিদ মাহমুদ। বইটি কেন আগে হাতে আসে নি সে জন্যে আফসোস হচ্ছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিবিধ অসঙ্গতি, অন্যায়, গুম, গুপ্তহত্যা, স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত, গণতন্ত্রহীনতা, বুটতন্ত্র, হঠকারীতা, অনগ্রসর চিন্তা, সরকারী সন্ত্রাস, তোষামোদি – সবকিছু নিয়ে কবিতা লিখেছেন মজিদ মাহমুদ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। অর্থাৎ বিগত সরকারের মধ্যগগণে দাঁড়িয়ে কবির দৃঢ় উচ্চারণ একটি যুগের সকল নেতিবাচক অধ্যায় ডকুমেন্টেড থাকলো এই গ্রন্থে। একই সময়ে দেশের আর কোন কবি কি এমন সাহসী কাব্যিক প্রতিবাদ করেছেন?
কবির প্রতিবাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার কবিরা ইংরেজ আমলে নজরুলের নেতৃত্বে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলো। পাকিস্তান আমলে প্রথমে ভাষা, পরে রবীন্দ্র-সঙ্গীত নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। ঊনসত্তরেও কবিতা লিখেছেন কবিরা, লিখেছেন একাত্তরেও। স্বাধীনতার পর কবিকূলের মধ্যে রফিক আজাদ সবচে বড় প্রতিনাদী কবিতা লিখেছেন মুজিব আমলকে কটাক্ষ করে। এর প্রায় এক যুগ পর নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে বিশ্বের বাঘা বাঘা কবিদের সারিতে বাংলাদেশের কবিরাও লিখলেন ‘বর্ণবাদ বিরোধী কবিতা।’ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধেও কবিরা সোচ্চার ছিলেন। এরপর কবিরা কেমন যেন নির্বিষ হয়ে গেলেন!
প্রতিবাদী কবিতার কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে মায়া এঞ্জেলো’র নাম : ‘You may trod me in the very dirt / But still, like dust, I’ll rise.’ গত মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার কৌশল নির্ধারিত হয়েছিলো এক কবির রচনা থেকে। তাঁর নাম ল্যাংস্টোন হিউজ। তিনি লিখেছিলেন কোটি আমেরিকানের স্বপ্নের বাণী : ‘Let America be the dream the dreamers dreamed / Let it be that great strong land of love.’ এই কবিতার উপর ভর দিয়ে রিপাবলিকানরা স্লোগান সাজিয়েছিলো : ‘We will make America great again.’
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। মানবাধিকার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মহামহিম নিকিতা ক্রুশ্চেভ মস্কো শহরের রেডস্কয়ারে এক ‘মানবধিকার’ সম্মেলনের আয়োজন করলেন। রেডস্কয়ার সিটি প্লাজা অগণিত মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ। এতো জনসমাগমে ক্রুশ্চেভ পুলকিত।
তিনি ভাষণ দিতে উঠে বলা শুরু করলেন – স্ট্যালিন ছিলেন একজন আপাদমস্তক স্বৈরাচারী। তিনি মার্ক্সবাদী রাজনীতিবিদ মহামতি ট্রটস্কিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
ভিড়ের মধ্য থেকে কোন এক উজবুক (!) আকস্মিক বেয়াড়া প্রশ্ন ছুড়ে বসলো, ‘তা আজ যে খুব বুক চিতিয়ে বলছেন, একথা এতোদিন বলেননি কেন? আপনিও তো ছিলেন তাঁর ক্যাবিনেট মন্ত্রী!’ পুরো সভাস্থল সূচপতন নিস্তব্ধতা। “কে? কে বললো কথাটা?” ক্রুশ্চেভ লাউডস্পিকারে গর্জে উঠলেন। “প্রশ্নটা কে করেছেন? উঠে দাঁড়ান।” কেউই উঠে দাঁড়ানোর মতো সাহস দেখালো না। প্রশ্নকারী ভিড়ের মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো।
কমরেড ক্রুশ্চেভ পকেটের রুমাল বের করে কপাল মুছে বললেন, “আশাকরি আপনি – হ্যাঁ যে প্রশ্ন করেছেন ‘আপনি’ এবং আপনারা সবাই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছেন। আমিও একই কারণে ভিড়ের মধ্যে এতদিন নিশ্চুপ বসেছিলাম।’ কিন্তু কবি মজিদ মাহমুদ নিশ্চুপ থাকেন নি।
যে বইটি পড়ছি সেখান থেকে কয়েকটি চরণ তুলে ধরছি :
১। ‘যেসব শব্দের মানে আমার বোধগম্য নয়
প্রয়োজনে সেসব সরিয়ে দেব অভিধানের পাতা থেকে
বেয়াদব শব্দ জব্দ করার কৌশল রয়েছে আমার আয়ত্তে
আমাদের ছন্দের খাপে যারা মিলতে পারবে না
আমার কবিতার জগতে তাদের নেই ঠাঁই…’
২। ‘যেসব জঙ্গি পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছে টাইম বোমা
আর যেসব পুলিশের বেল্টে ক্রসফায়ারের নোট
এই পবিত্র দিনে তাদের পাশে আমি বসতে পারবো না…’
৩। ‘টুইন টাওয়ারে বোমা হামলায় আমি ছিলাম না
ফ্রান্সের ঘাতকদেরও আমি চিনি না
কে আইএস আর কে আল কায়দা
দেশী জঙ্গিদেরও দেখিনি কখনো
হতে পারে তাদের রয়েছে অন্য কোন এজেন্ডা।’
৪। ‘আহা রে লিটল বয় তোমার জয়
এই ফেলানির কথা কে বা কয়’
৫। ‘হয়তো রানা প্লাজার দ্বংসস্তূপ থেকে উত্থিত নারী
বলবে মানুষের জীবিত থাকা তো ঈশ্বরের মহিমা
যদিও ঈশ্বরের বান্দারা জানেন
প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে একটি জীবিতের গল্প।’
৬। ‘দল ও ক্ষমতা বিবেচনায় পাল্টে যায় কবিতার রূপক
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মাত্রা যোগ হতে পারে
টেলিভিশনের প্রোগ্রাম নির্মাতা কিংবা
এনজিও কর্মীদের মদের টেবিলগুলো কবিতার
শৈলি নির্ধারণের উপযুক্ত স্থান।’ [বিবিধার্থ, পৃ ২১]
৭। ‘একজন কবির কি রাজনৈতিক কবিতা লেখা উচিত
মোটেও না, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
খুন গুম এসব কবির বিষয় নয়’
এই কবিতার বইটি নানা দিক থেকে অনন্য। রিপোর্টিং বেইজড পোয়েট্রি সাহিত্যের এক সাম্প্রতিকতম ধারা হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই হিসেবে বাঙলা ভাষায় প্রথম। যখন পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদনকে উপজীব্য করে কবিতা লিখিত হয়, তখন এটি গল্প বলার এক অনন্য পদ্ধতির ইঙ্গিত দেয় যেখানে সাংবাদিকতামূলক বাস্তব তথ্য, কাব্যিক ভাষা এবং কাঠামোর নিখুঁত সৃজনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। প্রতিবেদন থেকে কাব্যিক উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিশ্লেষণের একটি রূপ হিসেবে উপযুক্ত কাব্যভাষা ব্যবহার করা, এমনকি তথ্য প্রকাশের প্রাথমিক পদ্ধতি হিসেবে তির্যক ও প্রতীকি শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস কবি মজিদ মাহমুদ রপ্ত করেছেন তাঁর সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। কাব্যগ্রন্থটিকে কালের ডকুমেন্টেশন হিসেবে একজন দু:সাহসী কবির প্রতিবাদ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
[‘নিরবতাই মৃত্যু। যদি তুমি কথা বলো তাহলে মরবে। আর যদি তুমি কথা না বলো, তাহলেও মরবে। তাই প্রতিবাদ করো এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করো।’

  • তাহের জাউত, কবি ও সাংবাদিক, আলজেরিয়া]

‘কাটাপড়া মানুষ’ কালের প্রতিবিম্ব। পড়তে পড়তে আলজেরিয়ার কবি ও সাংবাদিক তাহের জাউতের এই বিখ্যাত পঙক্তিটি মাথায় ঘুরছিলো। তাহের জাউত ১৯৯৩ সালে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। বেঞ্জামিন মলয়েজ আমাদের কাছে যতোটা পরিচিত, তাহের জাউতের নাম ততোটাই অপরিচিত।
আপনারাও পড়তে পারেন। একটি দুঃসহ কালকে অনুভব করতে পারবেন। আনমনে স্বগতোক্তির মতো হয়তো প্রশ্ন করবেন ‘একই সময়ে দেশের আর কোন কবি কি এমন সাহসী কাব্যিক প্রতিবাদ করেছেন?’

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ