spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যস্বপ্ন ছোঁয়া মানুষ খন্দকার আবদুল মোমেন ও তার 'প্রেক্ষণ' পত্রিকা

লিখেছেন : ওমর বিশ্বাস

স্বপ্ন ছোঁয়া মানুষ খন্দকার আবদুল মোমেন ও তার ‘প্রেক্ষণ’ পত্রিকা

ওমর বিশ্বাস

১.

আমাদের একজন সম্পাদক ছিলেন। খন্দকার আবদুল মোমেন। সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়েছিল। সম্পাদনার দক্ষতা তাকে ছাপিয়ে নিয়ে গেছে তার অন্যান্য যোগ্যতাকে। তিনি অধ্যাপনা করেছেন সারা জীবন। লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য ছিলেন নিবেদিত। তাদের জন্য সংগঠন করেছেন। তাদের সংঘটিত করার কাজ করেছেন সব সময়। এসবকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছিল তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘প্রেক্ষণ’। 

দীর্ঘদিন তার পত্রিকা প্রকাশের সরব অনুপস্থিতি অনুভূত হয়ে আসছিল। অসুস্থতার কারণে এর প্রকাশনা বন্ধ ছিল। পত্রিকাটি একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে বের হতো। দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাটি বের হতো। বলা যায় প্রায় দুই দশক ধরে নিয়মিত-অনিয়মিত করে বের হয়েছে। তবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় নিয়মিত বের হয়েছে। তার ইচ্ছা ছিল যতদিন সম্ভব এটা নিয়মিত বের করে যাওয়া। কখনো একটা সংখ্যা বের করতে দেরি হলে সে সংখ্যাটিতে জুড়ে দিতেন পরের সংখ্যার সাথে। তারপরও পত্রিকাটি বের হয়েছে। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে আর বের হতে দেখা যায়নি। শেষ যখন পত্রিকাটি বের হয় তখন পর্যন্ত প্রায় চল্লিশটির মতো সংখ্যা বের হয়েছিল। সেটাও প্রায় এক যুগ আগে।

দীর্ঘদিন এরকম একটি পত্রিকা বের হওয়ার জন্য খন্দকার আবদুল মোমেন নিজেই ছিলেন মূল চালিকা শক্তি। তার প্রবল ইচ্ছা তাকে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন অত্যন্ত ভালো ও উদার মনের সদা হাস্যজ্জল মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার কাছে গ্রহণীয় একজন মানুষ। সম্পাদক হিসেবে ছিলেন প্রিয়।

প্রেক্ষণ পত্রিকাটির সূচনা করেছিলেন কবি ফররুখ আহমদকে দিয়ে। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম সংখ্যাটি বের হয়। এরপর বিভিন্ন সংখ্যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিষয়ের উপরে করেছেন বিভিন্ন নাম দিয়ে। বিভিন্ন লেখক-ব্যক্তিত্বের উপর করেছেন একাধিক। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছিলেন কবি ফররুখ আহমদের উপর সূচনা সংখ্যা করার মধ্য দিয়ে। ‘ঢাকা সাহিত্য শতদল’ নামের ব্যানারে তিনি ‘প্রেক্ষণে’র প্রথম সংখ্যা করেছিলেন– ১১ মার্চ, ১৯৯৪ সালে। খন্দকার আবদুল মোমেন ১৯৯৩ সাল থেকে প্রেক্ষণের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

২.

মোমেন ভাই একটা স্বপ্ন দেখতেন। এ স্বপ্নটা তার তৈরি হয়েছিল ‘প্রেক্ষণ’ কেন্দ্রিক। ‘প্রেক্ষণ’ তার একটি ভালোবাসা, একটি স্বপ্ন। এর ভিতর থেকে বের হওয়া একটা স্বপ্ন তার ভিতর থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের মধ্যে। এটি স্থান করে নিয়েছিল ভালোবাসার। একটা প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ছিলেন খন্দকার আবদুল মোমেন। প্রেক্ষণ পত্রিকাটি ছিল চমৎকার একটি সাহিত্য পত্রিকা। এক পর্যায়ে স্বপ্নটা তার সাথী হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রায় বলতেন এটার একশটা সংখ্যা বের করতে হবে। হাসতেন আর বলতেন, পারব কি না জানি না। তার এই উৎসাহের পিছনে আশা ও সাহস যুগিয়েছিল খ্যাতিমান বহুমাত্রিক লেখক-কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনিই তাকে একশটি সংখ্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

আমাদের সম্পাদনার কাঙালের যুগে তিনি সম্পাদনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তার একাগ্রতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি নবীন-প্রবীণ কাউকে ছোট করে দেখেননি। সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তরুণদের প্রতি তার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেটা বেশ বোঝা যেত। তার পত্রিকার মাধ্যমেও এটা অনুধাবন করা যায়। তার সংখ্যাগুলোতে তরুণদের উপস্থিতি থাকতো উল্লেখ করার মতো। এটা তার একটা উদার মানসিকতার প্রমাণ বহন করে। আজকাল চেনাগণ্ডির বাহিরে পত্রিকাগুলোতে লেখক দেখা যায় না। সেখানে লেখার গুরুত্বের উপর তাকে বিভিন্ন তরুণের লেখা ছাপাতে দেখা যেত। এসব লেখা যে-কোনো বিষয়ে উপর হতো। তিনি গুরুত্ব দিয়েই ছাপাতেন।

তবে তার সমকালীন লোকেরা তার পত্রিকায় স্থান নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাদের অন্তরে তার ঠাঁই ছিল কি না সন্দেহের অবকাশ আছে! কেননা তার সমকালীন লেখক-কবি সাহিত্যেদের মধ্যে তাকে নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়নি। তাকে নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি দেখা যায় না। তাদের মধ্যে ব্যক্তি মোমেন ও  পত্রিকা প্রেক্ষণের জন্য লিখিত মূল্যায়ন কার্পণ্যের আবরণে ঢাকাই মনে হতো। এরকম একটা সম্পাদককে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল আমরা তাকে সেটা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছি।

৩.

‘প্রেক্ষণ’ একটি সাধারণ মাপের পত্রিকা ছিল না। সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে এর অবদান অপরিসীম। এর মধ্যে খন্দকার আবদুল মোমেনের নিরলস পরিশ্রম জড়িয়ে ছিল। এটা নিয়মিত বের করতে পারলে আমাদেরই লাভ হতো। বাংলা সাহিত্য উপকৃত হতো আরো অনেক বেশি। কেননা তিনি যা করেছেন তার গুরুত্ব অমূল্য। তিনি পত্রিকাটি নিজের মতো করে সাজাতেন। বিভিন্ন সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র আক্ষরিক অর্থেই এ পত্রিকার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার কাজগুলো ছিল খুব সাজানো গোছালো। সে-সব সবার কাছে গ্রহণীয় হতো।

নিজে একা একা কাজ করতেন। নিরলস পরিশ্রম করতে পারতেন। ‘প্রেক্ষণ’ নিয়ে পরিশ্রম করতেন খুব। তিনি কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। যদিও তার ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’ নামে একটি প্রবন্ধ বই আছে কিন্তু তিনি নিজে খুব কম লেখতেন। তাকে খুব কম লেখতেই দেখেছি। তিনি কবিতা লিখতেন তবে অল্প-স্বল্প। তার একটি কবিতার বইও আছে। তবে তিনি কবিদের অত্যন্ত কদর করতেন।

সংখ্যাগুলোতে তিনি ইতিহাস ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি নিজে খুব ঐতিহ্য সচেতন লোক ছিলেন। তুলে ধরতেন দেশ সমাজের বিভিন্ন বিষয়। তিনি নিজে একজন বিশ্বাসের মানুষ ছিলেন। পত্রিকা বের হলে সংশ্লিষ্টদের কাছে কপি পৌঁছানোর প্রতি ছিলেন যত্নবান। এটা তার একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য যে তিনি ‘প্রেক্ষণ’ বের হলে তার লেখক কপি পৌঁছে দিতেন নিজ দায়িত্বে। পত্রিকা বের হওয়ার সাথে সাথেই সবার আগে তিনি সবার কপি পৌঁছে দেওয়াকে প্রথম কাজ মনে করতেন। দূরের হলে তিনি সবার কাছে কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রেরণ করতেন। তারপর তিনি নিজেকে ভারমুক্ত মনে করতেন।

৪.

খন্দকার আবদুল মোমেনের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম। তিনি আমাকে তার স্নেহভাজন হিসেবে গুরুত্ব দিতেন। আমার কাছে ব্যক্তি মোমেনের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল তার ‘প্রেক্ষণ’। তিনি লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের খুব গুরুত্ব দিতেন যেরকম ভাবে সেটা চোখে পড়ার মতো। সেদিক থেকেও আমি মনে হয় তার স্নেহভাজন হতে পেরেছিলাম। বয়সে আমার থেকে ঢের বড় হলেও তিনি আমাকে ‘ওমর বিশ্বাস’ ভাই বলে সম্বোধন করতেন। আমি নিজেও পত্রিকা করেছি একাধিক নামে। লিটলম্যাগ করা আমার একটা শখ। সাহিত্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করার মানসিকতা নিয়ে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাতেও হাত দিয়েছিলাম। যদিও ‘চাঁড়ুলিয়া’ নামে এ পত্রিকাটি তিনটি সংখ্যা বের হয়েছিল ঠিকই, এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি। এজন্য যারা পত্রিকা করে তাদের প্রতি আমার একটা বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ থাকে। এটা বড়ো ছোটো সবার ক্ষেত্রেই আমার ভিতর এই মানসিকতা কাজ করে। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ছিলেন। সেই হিসেবে একটা বাড়তি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানের স্থান এমন একজন মানুষের জন্য আমার ভিতর সব সময় ছিল। ‘প্রেক্ষণ’ বাদেও তিনি বিভিন্ন পত্রিকা-সংকলনের সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি সে-সবে সম্পাদক, প্রধান সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, সহ-সম্পাদকের মতো বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। 

ব্যক্তি পর্যায়ে তিনি ছিলেন একজন মিশুক মানুষ। সামাজিক ভাবে ছিলেন সবার কাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের। তিনি বহুমুখী কাজ করেছেন। সে-সবে প্রতিভার, যোগ্যতার ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি পত্রিকাটি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একপর্যায় এসে আর বের করতে পারেননি। তিনি ছুঁয়ে গেছেন মানুষের স্বপ্ন আর আকাঙ্খাকে। ভালোবাসা যেমন দিয়েছেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা পেয়েছেনও। 

ব্যক্তির পর্যায়ে আমাদের দেশে এমন অনন্য কাজ করা খুব কঠিন। কিন্তু খন্দকার আব্দুল মোমেন সে কাজটি করতে পেরেছিলেন। তিনি আন্তরিকতার সাথে দীর্ঘদিন এর পিছনে লেগে ছিলেন শ্রম দিয়েছেন। একে সামনে রেখে একটা লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে গিয়েছেন। সেই হিসাবে ব্যক্তি পর্যায়ে তার এমন প্রচেষ্টা তাকে এক অনন্য উচ্চতা দান করেছিল।

এই গুণী সম্পাদকের জন্ম ২৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের সীচা গ্রামে। কিছু দিন আগে, গত ১৩ জুন, ২০২৫ সালে, ঢাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা এই গুণী সম্পাদকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেই সাথে তার রেখে যাওয়া ব্যক্তি জীবন ও কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন হবে সেই আশা ব্যক্ত করছি। 

২৬.০৬.২০২৫

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. আলহামদুলিল্লাহ ‌।

    ” প্রেক্ষণ” গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ছিল ‌‌।
    খন্দকার আব্দুল মোমেন ছিলেন অত্যন্ত সাহিত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ‌। তাঁকে নিয়ে আলোচনাটি বেশ সুন্দর হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ