spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাকবি নূরুল হক এর অপ্রকাশিত কবিতা

লিখেছেন : নূরুল হক

কবি নূরুল হক এর অপ্রকাশিত কবিতা


[ নূরুল হক (১৯৪৪-২০২১) বাংলাদেশের ষাটের দশকের একজন শক্তিমান কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৫ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মদন থানার বালালী গ্রামে । মাতা মজিদা খাতুন। পিতা আবু সাইদ। গ্রামের সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। একমাত্র ভাই ফজলে রাব্বি । স্ত্রী ফেরদৌসি সুলতানা রুপু ছিলেন গৃহিণী।
নুরুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নেত্রকোনা সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শেষে তিনি ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এবং শিক্ষা ভবনে কর্মরত ছিলেন। সে সময় সরকারি দায়িত্বসূত্রে তিনি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে একাধিকবার পরিভ্রমণ করেন। তিনি ২০২১এর ২২ জুলাই দুই পুত্র সাব্বিরুল হক, রাইন হক ও কন্যা চরু হক এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে পরলোকগমন করেন।
৭০ দশকের আলোচিত সাহিত্য ছোটকাগজ ‘নাগরিক’এর সম্পাদক কবি ও রবীন্দ্রগবেষক ড. আহমদ রফিক তাঁর সম্পাদকীয়তে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, শামীম আজাদ সহ যে পাঁচজন কবিকে নতুন ধারার কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, নূরুল হক তাঁদেরই একজন। অস্তিত্ববাদ ও প্রচন্ড দেশপ্রেম তাঁর মূল সুরচেতনা। সমকালীন এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি কলম ধরেননি। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি নতুন ধারার কবি হিসেবে গণ্য। তাঁর ভেতর ছিল গানের মর্মখোলা এক বাউলের বাস। তাঁর আর্তিঝরা ছোট ছোট কবিতাগুলো বাশোর হাইকুর মতো সহজ এবং ভাববহুল। ফলে প্রবলভাবে সমাজ সচেতন কবি নূরুল হক পাঠকের কাছে ‘আধুনিক মরমী কবি’ বলে চিহ্নিত। একই সাথে তাঁর গদ্যও পাঠক হৃদয়ে তুমুলভাবে রেখাপাত করে। তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধই পাঠকনন্দিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পৌরহিত্যে, বিজলী প্রভা সাহার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাহিত্যপত্র”এ মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কিত তাঁর প্রবন্ধ “জন্মের আগে একটি মৃত্যু ” প্রকাশিত হলে উভয় বাংলায়ই পাঠকনন্দিত হয় বলে জানা যায়। নাঈম হাসান সম্পাদিত ভিন্নধর্মী সাহিত্য সাময়িকী ‘নিরন্তর’এ তাঁর দীর্ঘ ৫০ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ “শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় :কবিতার দিকে একজন ” প্রকাশিত হলে বুধমন্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবির বয়স যখন তেষট্টি বছর, তখন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ (২০০৭)প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো যথাক্রমে –‘একটি গাছের পদপ্রান্তে'(২০১০),’মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা'(২০১২), ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া ‘(২০১৪),’এ জীবন খসড়া জীবন ‘(২০১৫),’কবিতাসমগ্র'(২০২০)। প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়: কবিতার দিকে একজন ‘(২০১৭) ।বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই প্রচারবিমুখ কবিকে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার ১৪১৯ প্রদান করা হয়। তাঁর কন্যা কবি চরু হকের সহায়তায় তাঁর অপ্রকাশিত কিছু কবিতা সংগ্রহ করে এখানে পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হলো। ]

কবি নূরুল হকের (২৫.১১.১৯৪৪-২২.০৭.২০২১) অপ্রকাশিত কবিতা

১. লীলা

স্বপ্ন আর কল্পনার মাঝে
যত স্পন্দন রয়েছে
আমি তার অভিব্যক্তি কোনো?
তা আমাকে কে জানাবে?
আমাদের পৃথিবীর এখানে যা নেই
তা কি মহাশূন্যতার অন্য পারে উচ্ছ্বসিত আছে?
উদ্ভাসিত আছে?
জীবনের সব অর্থ লুকায়িত আছে?
স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে?
ভাবি
এইসব ইত্যাকার এলেবেলে ভাবি।

২. জয়ধ্বনি

আমার কাগজ নেই,
শুধু স্তব্ধতাই একখন্ড টুকরো কাগজ।
সেই আশ্চর্য কাগজে কিছু লিখে দেবো
শুয়ে। এ আশায় বসে আছি
রাত্রি দিনভর
স্তব্ধতার মাঝে।
জয় হীরক শান্তির জয়
যে সত্যের মাঝে আমি বাঁধা আছি
জন্ম-মৃত্যু -পারাপারে ভেসে
জয়ধ্বনি করে যাব তার আমি
বাকি এ জীবন।

৩. মানিকগঞ্জ যেনো শরবত

আমরা মানিকগঞ্জ যাচ্ছি বান্ধবীকে নিয়ে
শেষ বারের মতো।
কারণ তিনি চলে যাবেন কানাডা,
তাই আমরাও আর মানিকগঞ্জ যাব না।
পথে পথে সাভারের এতো শান্ত শিখা,
চোখ যেন গেলাস দিয়ে পিয়ে নিচ্ছে
এই সবুজ, এই শরবত,
পাশের খালে জলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে
একটা লোক,
আবার বের হয়ে আসছে,
তার শরীরের তরঙ্গ গিয়ে বাসা খুঁজছে আকাশে।
আহা,সারাটা মানিকগঞ্জই যেন এক গেলাস শরবত,
যেতে যেতে আমরা চারিদিক থেকে
এই শরবতই শুধু
পান করছি।

৪. ব্যাখ্যা

কোন কিছু দেখা মানে
এক ধরনের কথা বলা
কথা বলা মানে
মাংস,, হৃৎপিন্ড,রক্তের স্রোত,
অতীত এবং স্বপ্ন অদলবদল করা।
তাহলে এরপর তোমার নিজের বলতে থাকে কী?

৫.হাতের তালুতে

থাকে
পরতে পরতে
ভাঁজে ভাঁজে
নালে নালে।
হারায় না কিছুই।
সৃষ্টির এমনই এক অবিনাশী লীলা।
শুধু
এক চিমটি দৃষ্টির ছোঁয়ায়
ধরা দেয় কারো না কারো
হাতের তালুতে।

৬. স্বপ্নের পদ্মার পাড়ে

স্বপ্নের পদ্মার পাড়ে বসে থেকো
আমি হাঁটুজল রক্ত ভেঙে ফিরে আসবো ফের
কুড়িয়ে নৈ:শব্দদ্রব্য কিছু
সুদূর দুয়ার খোলা মুর্শিদা নক্ষত্রদল দেখাবে হৃদয়
লোক চলাচল, পাখি
ঘরে ফিরে এলে
পায়ের খড়ম ধুয়ে জল হলো শেষ
পুবের পথিক যারা পশ্চিমের দেশে চলে যায়
হৃৎপিণ্ডে লৌহবেড়ী পরে
একে একে গাঙিনা পথের দিকে ধীরেন্দ্র ধারায় জল বয় ভাসায় অজানা ঢেউ, পাড়ি
কত ছায়া ইতোমধ্যে রোদ হয়ে গেলো
তবে তুমি রোদের শরীর?
কত নদী বারবার পাতা হয়ে গেল
তবে কি তুমিও ওই পাতার আবাস?
কত দেশ পাখি হল দাহিত জীবনে
তুমিও কি তবে ওই নদী, মাঠ, দেশ?
নইলে নদীর তীরে কেনবা তোমার স্মৃতি আসে?
জেগে ওঠে পক্ষীকাতরতা কেন চোখে?
কার কথা মনে হলে নির্জনতা ছড়াও বাগানে
বনের উতলা ঋতু স্নান করে দাঁড়ায় যখন?

৭. বাকি

এ সফরে কত অভিজ্ঞতাই না
জমা হয়ে গেছে আমার।
বলা চলে সব রকমই।
উঁচু ও নিচু মোটা ও চিকন,
ভেজা ও শুকনা
সব ধরনের।
শুধু
একটা অভিজ্ঞতাই এখনো বাকি রয়ে গেছে।
সে জন্যেই তো আমি বসে আছি আদিগন্ত
যেমন করে সকল প্রাণীই চেয়ে থাকে
সেদিকে শেষ দিন পর্যন্ত।
কিন্তু সেটির আমি কিছুই জানিনা।

৮. করোনা; বিশ্ব মোড়ক

খুবই আশ্চর্য হচ্ছি যে,
পুরো বিশ্ব আজ
একযোগে তপস্যায় বসে গেছে-
কী করে এ মহাদুঃসময় থেকে
পরিত্রাণ পাবে
জটাধারী সূর্য সাহসী
এ কোন মৌন উপাসনায় নিবেদিত?
লগ্ন এখন এমনই যে,
মানব প্রজাতির ভেতর তা আসতে,
হয়তোবা লক্ষ লক্ষ বৎসরের প্রয়োজন হয়।
বেসামাল
একেবারেই উদয়াস্ত বেসামাল।
ভাবছি,
এই গ্রহের উপরিভাগ কি তবে
সত্যি সত্যি শূন্য এবং
সমতল হয়ে যাবে?
কী ঘন্টাধ্বনি তাহলে
বাজাব এখন-
সার্থক ভাবে রুখে দাঁড়াও
অথবা অখন্ড ধ্বংসের জন্য
একসঙ্গে প্রস্তুত হও?

৯. খাই খোরাকির গান

কতই না ভাবি
হাতের মুঠোয় আমি
ধরে ফেলবো ফুলেল জীবন।
পরক্ষণ চেয়ে দেখি
দুঃখের নিক্তি দিয়ে
ওজন করছি হায়
সওদাগুলি মনপবনের হাহাকারে।

১০ ক্ষুধা

কোন উদাস খেয়ালীর
হাত লেগে
চলছে পৃথিবী
এমন আশ্চর্য অভিনয়ে,
নিত্যজন্মে,
ক্ষুধার ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে,
যে ক্ষুধা সাজিয়ে রাখে সে
চিরজ্বলা ঘরে
প্রকৃতির মর্মমূলে
শতধা অতৃপ্তি ঢেলে ঢেলে
তা শান্ত হতে দেবে কি এ মায়াবিনী
কোনোদিন?

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ