spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়ে'জলপাহাড়ের ভূগোল' : আলী প্রয়াসের বাসভূমের উপাখ্যান

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

‘জলপাহাড়ের ভূগোল’ : আলী প্রয়াসের বাসভূমের উপাখ্যান


| মাহমুদ নোমান |

‘কত সৌরনক্ষত্রের অবগুণ্ঠন খুলে
একটা মাটির জোনাক
বাতাসের গায়ে কড়া নাড়লো
আর এভাবে জন্ম হলো প্রাণ ও পৃথিবী
জন্ম হলো শব্দের রক্ত
দৃশ্যের আরেক উন্মোচন ‘
– প্রাণ কিংবা মাটির জোনাক; ৯পৃষ্টা)

গদ্যছন্দ,ভাবের মধ্যে দমের নাচন।রস্বাদনে ভাব আসে,ভাবের তালে দম্।আর যেখানে দম্ থামে, সেই থামাটা যদি ঐ কবিতাটিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী করে তুলে,তবেই আধুনিক কবিতার স্বার্থকতা নিরুপিত হয়।
পরাবাস্তব বিভ্রম বা দৃশ্যকল্পের ভেতরে অভিব্যক্তির চালান করে,নিজস্ব ঘরণার মার্জিত শব্দগুচ্ছের বাইন্ডিংয়ে আত্মজৈবনিক বোধ ও বিশ্বাসের গীতিকাব্য ‘জলপাহাড়ের ভূগোল’এর স্রস্টা আলী প্রয়াস। প্রতিটি কবিতায় আলাদা টোনে হৃদয়ে টোকা মেরে মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে প্রয়োজনীয় উপমা,প্রতীক ও সাংকেতিকতা সহযোগে। আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ ও আটপৌরে পরিবেশের বিশ্বস্ত উপস্থাপনার নাম রিয়ালিজম। ব্যক্তিমনের গায়েবি ক্রিয়াকলাপ,চিন্তন ও অনুভূতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যক্তির চরিতার্থ বা ব্যক্তিত্বকে কিছুটা হলেও যথাযত বাস্তবতার চিত্রণের নাম ‘সুয়ারিয়ালিজম’ বা পরাবাস্তব। ব্যবহারিক পরিভাষায় যদি বলি,ঠেস্ মেরে কথা বলা।
আলী প্রয়াস পরাবাস্তবতার মধ্যে স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক বিশ্লষণে- ধর্মীয় চেতনার পরিশুদ্ধ মিশেলে অন্যজগতের কাব্যশরীর তৈরি করে-
প্রাণ কখনো ছিল না ঈশ্বরের হৃদয়ের নির্যাস/মূলত ঈশ্বর/যিনি সমস্ত প্রাণকে একত্র করে/একটা সভা বসিয়েছিলেন/যাকে আমরা ব্ল্যাকহোল বলি ‘

  • প্রাণ কিংবা মাটির জোনাক;১০পৃষ্টা)
    ‘জলপাহাড়ের ভূগোল’ আলী প্রয়াসের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এতে নিরেট গদ্যছন্দের চৌদ্দটি অনন্য দীর্ঘ কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। কবিচৈতন্যকে বাস্তবতার নিদারুণ হৃদয়বত্তা দিয়েছে তার বাসভূমের পাশে বিস্তৃত নাফ নদী,সীমানা প্রাচীরে করুণ দশা ও ঐতিহ্যের অনুরঞ্জন। আলী প্রয়াসের প্রজ্ঞা ও প্রতিভা-অন্তর্গত নৈরাশ্য,নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নতার অন্তর্লীন শক্তিও নাফ নদী ও তাঁর আশ-পাশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণের লোকায়ত অনুষঙ্গ। জীবন ও অস্তিত্বের এই যৌথ সন্নিকটে কবির অন্তঃপুরে ছড়িয়ে পড়ে বিবমিষা ও গরল –
    যারা জানে নগ্নযোনির স্পর্শের সুর/খেলাটা দারুণ খেলে/চতুরামিতে পাকা/তাদের কথা ও ভাষণে রচিত হয়/একেকটা সর্পবিতান/তারা জানে গোপন উরুর খবর/বেদবাক্যের আদলে মুখে তারা গর্ভপাত ঘটায়
    -দেশপ্রেমের হাঁক;১৭পৃষ্টা)
    এই আত্মধিক্কার কবির নৈতিক বোধকে রক্তাক্ত করে তুলেছে,তাঁর কৌম জীবনের কৃষিজ স্মৃতিতে শস্যের দহন এবং অরণ্যের সামূহিক সংগীত বেতাল হলে বিপন্নবোধ করেন। এই বিপন্নতা কবির অস্তিত্বচেতনা থেকে বোধ ও মনীষার সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞানে সর্বজনীন। অন্যদিকে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন; সমাজ,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,ভূমি এমনকি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে ক্রমাগত।সেই বিশ্বগ্রাসী লোলুপতায় আমাজন থেকে সুন্দরবন-কোনোকিছুতেই তাঁর স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। ‘বন্ধুত্ব’ নাটকের মঞ্চায়নের কালো পর্দার অন্দরে চলছে সব নষ্টের বীজ বপন-
    কাঁটাতারের দুইপাশে ভরা রোদ/দুই পাশে দুই দেশ/দুই পাশে ঘোড়াদের দল/দুই পাশে সোনার খনির লোভ
    -কাঁটাতার;২৫পৃষ্টা)
    কবিতাটির শেষে,দেশপ্রেমের মিথ্যে নাটকের অভিনয় দেখতে দেখতে কবি, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে আর নিজেকে রুখতে পারেনি –
    কাঁটাতারটা আজো বেকুবের পাজামার গিঁটের মতো/খুলছেই না!
  • কাঁটাতার;২৮পৃষ্টা)
    জন্মসূত্রে, দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রকূলের টেকনাফে নাঁড়ি পোঁতা বলে,ঐ ভূগোলের সুখ-দুঃখ প্রতিটি কবিতায় জড়াজড়ি করে আছে। দক্ষিণাঞ্চলের পাহাড় ও সমুদ্রের জলকেলিতে বেড়ে উঠা কবি’র হৃদ-কলমে লেখা ‘জলপাহাড়ের ভূগোল’।প্রতিটি কবিতার পাঠ শেষে,ঐ ভূগোলের চেনা-জানা আত্মীয় হয়ে উঠবে পাঠককূল। মৃত্যু নিয়ে পরিহাস!
    …. তার নাম মৃত্যু /যে তোমাকে সঙ্গীতের বিপক্ষে দাঁড় করায়/যে তোমাকে বলে জীবন মূলত বিভ্রমের চর/এবং আলস্যের আয়ু/এইসব কথা জাদুকরের মতো শোনায়/মনে হয় দুর্দান্ত প্রতাপে কেউ টানছে/কফিনে নিয়ে যেতে কোরাস করছে কেউ
  • মৃত্যু;২২পৃষ্টা)
    আলী প্রয়াসের এই কাব্যগ্রন্থে উপমা-উৎপ্রেক্ষার বাহুল্য নেই,কিন্তু বিশেষণ ব্যবহারে বৈচিত্র রয়েছে। যেমন :
    মাটির জোনাক,শব্দের রক্ত,অগ্নির মিনার,অষ্টাদশী কলসী,ঘনশ্যাম মাদুরের ক্ষেত,চিতল হরিণী,রক্ত চিল,জোনাক বিদ্যুৎ, পিতলের বাজপাখি,ঘোলাটে রঙের জিভ,পাথরের সাপ,পুংকেশরের হাসি,ষড়মাত্রিক জলবায়ু,রমণক্লান্ত ভোর…
    এরুপ অসংখ্য বিশেষণ আলী প্রয়াসের কবিতাকে করেছে হৃষ্টপুষ্ট ও নান্দনিক। বাহুল্য দোষে দুষ্ট না হয়ে কবিতায় ভিন্নমাত্রা সংযোজিত হয়েছে।
    এই কাব্যগ্রন্থে বেশকিছু কবিতা বারবার পড়ার আকুতি জানায়। যেমন : দরিয়ানগর এক্সপ্রেস, নাফ পেরিয়ে,জলোগন্ধবুকে, আয়াতের দিনে, নীলাদ্রীশৈশব, জলের মোকাম, মানবিক হে…প্রভৃতি।
    কবিতাগুলো নিছক চিত্রকল্পসর্বস্ব অথবা অলংকারভারে জড় বস্তুপিন্ড নয়,নির্মেদ ও নিরাভরণ। আত্মার মাঝে সূচিত সৌন্দর্য ও আনন্দপুর তৈরি করে।
    খেলাশেষে,মেলাশেষে-পাঠকের মনে গেঁথে থাকবে উৎসর্গপত্রের বাণী- ‘জলেই জন্ম জীবের মাটিতে মৃত্যু সবার….
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ