দ্রাঘিমালন্ঠন
সাজ্জাদ সাঈফ
প্রারম্ভিকা
:
চারদিকে ফসল ডোবানো শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে, হয়তো কোথাও যাবার প্রস্তুতি নিয়ে থমকে রয়েছে কেউ, এভাবেই একদিন মহেঞ্জোদারো থেকে হারিয়ে গিয়েছে তার কূপগুলি, হরপ্পায় চুপ করে গেছে দ্রাবিড় নিনাদ, আর এখানে সোনারগাঁও চেয়ে আছে ঈশা খাঁর বজ্রচাহনী ছুঁড়ে ব্রক্ষ্মাণ্ড্রে, এভাবেই একদিন পৃথিবীর শেষ ঘাসেরা মাঠে মাঠে সমুজ্জ্বল হবে তোমার সামনে।
এতকিছু উপচে এসে বৃষ্টি লাগছে গায়ে। তুমি নির্বিকার। যেন হৃদয়হীনের বধিরতা নিয়ে বুকের ভিতর কথা চালাচালি করছে অতীত।
কতদূর এগিয়ে গেলে যাত্রাপথেরা পায় কবিতার মর্যাদা, আর থাকে মানচিত্রের বিক্ষত দাগ, সবুজ তামাদি হবার গল্প। এতখানি নিঃসঙ্গতা হতে স্বপ্নেরা মাথা উঁচু রাখে তাই মনে হয় কিছু তো বলার কথা ছিল তোমারই, তুমি সেই ভূমিসন্তান, তবে কেন তুমি নাই শ্লোগানের মঞ্চে, নাই বিধানে কোনো!
এমনতর নীরবতা কি ধ্যানের শামিল নাকি দৃঢ় কোনো প্রতিজ্ঞার প্রস্তুতি?
৫/
নদী শুকিয়ে পাটকাঠি লাগে এইখানে, বাতাসে টের পাবে সিসা। এ-রকম পৃথিবীতে বেঁচে আছো, একেকটা গলির শেষে একটা করে নর্দমার ঘাট, মিথ্যা বলছি না, আলাওল পূর্বসূরি আমাদের, ঘুমানোর আগে আসে কাজলরেখার পায়ের শব্দ কানে, আয়না ঘুরিয়ে টিপ পড়ছে কাজলা দিদি।
সত্য হতে আমরা আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দা। ক্ষেতের কাকরোলে ঠোকর দিচ্ছে পাখি। তোমার কলমে এসে ধাক্কা দিচ্ছে গুরুত্বহীন নিন্দারা, যাতে ভর করে আকবরের দরবারে এসেছিলো আবুল ফজলের কর্তিত মুণ্ড।
৬/
আমাদের ঘর ভরে গেছে ফসলি ধুলায়। তুমি উদ্বিগ্ন। কাছে প্রাণের ফসিল হয়ে প্রাচীন গাছেরা আজতক পাখির আশ্রয়। এখানে আগুন বধির। মানুষের রাগ বলে কিছু নেই, ক্ষোভ গেছে পালিয়ে। টিভিতে প্রতিদিন দেখো যুদ্ধের রিয়ালিটি শো। তুমি হতাশাগ্রস্ত কেউ। চারদিকে সৌরস্নিগ্ধ গ্রাম। সুদূর বিস্তৃত ধানের মঞ্চ থেকে হাত নেড়ে ডাকে যৌবন। তবুও মানুষ নিজেকে কেন্দ্রে রেখে নিঃশেষে বিভাজ্য আজ। তুমি বিব্রত। ভাবছো তোমার এপিটাফ নিয়ে। ভাবছো তোমার কীর্তি কী!
অসংখ্য গ্রাম ঘিরে ফেলেছে দৈত্যাকার নগরীগুলি। বিদেশি বিনিয়োগে বিষাক্ত সব অরণ্যপথ। আর তোমার কবরে বিলাসিতাও স্পষ্ট, শুধু সমাধিফলকে লিখে গেছে কারা- ‘এই লোক কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি, মস্ত ফেরেব্বাজ ছিলো’!
১৬/
কবিতার সমস্ত বাক্যই বাংলাদেশ।
খোঁপায় তার রক্তচোয়ানো ফুল, হাতে ফেস্টুন; হৃদয়ে মিনার হয়ে স্থির শহীদ মুগ্ধ ও সাঈদ!
হাড়ে জাগে হাড়ের তরঙ্গ, শীতরাত্রি;
কবিতা কি এমন রাতে মিছিলফিরত হাত?
গান গেয়ে চলে যাবে ঘাসফড়িঙ
হাড়ে মজ্জায় বাংলাদেশ, থাকবে গীতল!
কবিতার সকল হরফ ক্লান্তিহীন, কথা ও কথ্যভাষার ধারে সটান খুটিতে দুলছে পতাকা নাকি পাখি হয়ে ডানা ঝাপটানো আগুনফিরত পাখি, বুলেট ঠেকানো মানচিত্র জুড়ে!
১৭/
নিঃশেষ থেকে দু’একটা পাতা তখনও ঝরে পড়ছে জানি! আগুনের নিঃশ্বাস ফুরায় নাই তবু, সমস্ত মিথ্যার কাছে সোপর্দ রয়ে গেছে তার কিছু অঙ্গীকার, ধমনীতে বিপ্লব; তখনও ছিপ খুলে বাটিতে জমছে রূপা ধোয়া মাছ, অনন্ত লেজ মাছ।
যেন রূপকথা মাথার ভিতর হতে উসকে দিচ্ছে মন
শীতে শালবন, মেলে দিচ্ছে পথ, রাজফটকের পথ!
রাস্তার ধুলি ও শ্যামলী পাতার ভিড়ে মনুষ্য ক্রন্দন
ক্ষুধা ও ভুখার পায়ের ছাপে সুস্পষ্ট!
তুমি আছো, তুমি প্রাণপণে আছো
সমস্ত গল্পে, মিথ্যাকে অটুট রেখে একটা সভ্যতা
তোমার চোখের সামনেই হত্যা ও জিঘাংসায় পরিপূর্ণ!
তুমি আছো, তুমি জেগে আছো তাই আজো
‘মিছিল-মিছিল’ তপ্ত মশালে আলোকিত হয় রাজপথ!
১৮/
এদিকে নালন্দাবর্ণে আঁকা একটা হৃদয়ের অধিকারী তুমি। শাওন-গহন ডাক ছেড়ে কাঁদো, সে কি বিরহবন্দনা? চোখে টানটান বিশদ আলোর ঝাড়!
এক জন্মে কতটা গড়ালে প্রেম, বুকে স্রোতস্বিনী হাওয়াকে শীতল লাগে? যেভাবে শুকনো গাঙ জিইয়ে রাখে অভিমান আর জোছনায় জড়সড় থাকে।
সৌরপাতায় ছাওয়া এই গ্রহে তুমি কিনা হেমন্তমেঘ, আমাকে পর্যুদস্ত করো! সামনেই রেসকোর্স, হাঁটাপথে শিখা অনির্বাণ। প্রেমে-অপ্রেমে সভ্যতা নিয়ে এই গ্রহে কত শত দরবার হলো আর গেলো কত দুর্গদেয়াল ধ্বসে, রাত্রে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে কাবুল! বলো তবে, বিষে আর বিষাদে মর্সিয়া গায় নাকি আহত পলাশী আজো?
যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র গছিয়ে দিয়েছে কত গণহত্যা, ফ্যাসিস্ট সমন হাতে! বলো তবে অক্ষরে মেটাল রক আমাদের প্রতিরোধ নয়? এতসব প্রতিরোধের দেশে যুদ্ধের কি শেষ বলে কিছু হয়?
তুমি রাজিয়া সুলতানা নাকি মিনা কুমারীর হাসি? পিছু ডাকে হৃত গৌরব; সমস্ত প্রাণপাত, জয়-পরাজয় পেরিয়ে আসা তেজী সব ঘোড়ায় সওয়ার গাজীর ভিড়ে আলাদা করে চিনবে আমায় শেষে?
১৯/
তোমার ঘুমেরা ধাক্কা খাচ্ছে নাকি মিসাইল কিংবা ঝড়ে?
যেন সবুজ খামের চিঠি এই ভূপৃষ্ঠ নিজেই
অথচ নিজেকেই চিনতে পারছে না আজ ঝাঁঝরা বুকের দৃশ্যে। আর তুমি কিনা আক্রান্ত ইগোর ট্রমায়, ফেসবুক ট্রলে!
একটা বুকের খোপে কতগুলা লাশ জমা হলে
স্মৃতির চক্ষু ফেটে রক্ত বেরোয় জানো?
অথবা শিমুল ফুল সামান্য বৃষ্টির পর
একে একে ভেসে যাচ্ছে উদ্বাস্তুর মত
যেন-বা ফিলিস্তিন, যেন-বা রাফার ক্রসিং
কখনোই পাবে না এরাও কারো
খোঁপার ঠিকানা খুঁজে!
প্রকাশকাল: ২১শে বইমেলা, ২০২৫
দেশ পাবলিকেশন্স
প্রচ্ছদ- তাইফ আদনান
পাঠে আনন্দিত হলাম।
কবিতায় শব্দের ব্যবহার, প্রতীকের সমাহার এবং বোধ
কবিতাগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
শুভপাঠের শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানবেন