spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যজাকির আবু জাফরের কবিতা : প্রাণের ভিতর শব্দের অনুরণন

লিখেছেন : মনসুর আজিজ

জাকির আবু জাফরের কবিতা : প্রাণের ভিতর শব্দের অনুরণন


মনসুর আজিজ

তারকাখচিত আকাশে কবিতার শব্দ গুনগুন করে গান গায়। গানের শব্দ প্রাণে বাজে। প্রাণের ভিতর শব্দের অনুরণন। কবিতার ঝংকার। কবি কখনো মাতাল তরণীর নাবিক, কখনো আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। কখনো প্রেমিক পুরুষ। কবিতা এক রহস্যঘেরা রমণী হৃদয়। গোটা জীবন যে রমণীর সাথে পথ চলা, সেও রয়ে যায় অচেনা। কবিতা এক অধরা প্রেমিকা।
কবি এই অধরা প্রেমিকার পিছু চলে তারুণ্য ক্ষয় করে জীবনের পলেস্তারা খসিয়ে দেয়। এই অধরার মন পেতে কবির কাল চুল সাদা হয়। এই বর্ণালি রূপের কাছে সপে দেয় কবির সময়। কবির জীবন। যে কবি নিরাশ হয়ে পোতাশ্রয়ে জাহাজ ভিড়ায়, সেতো খুঁজে পায় না হাইনের যৌবন ভরা বিমিনি দ্বীপের সন্ধান। আর যে নাবিক সাত সাগরের মাঝির মতো মাতাল তরণীর হাল ধরে তার গন্তব্য হয় কবিতার সবুজ দ্বীপাঞ্চল। এই সবুজ দ্বীপাঞ্চলের কবি জাকির আবু জাফর। চল্লিশ বসন্তে কবিতার বরপুত্র। যে কবি উচ্চারণ করতে পারেন–
‘যে ফুল ঝরে যায় তাকে ধরে রাখে কবিতা। যে প্রেম মরে যায় তাকে বেঁধে রাখে কবিতা। ডুবে যাওয়া স্মৃতির ডুবুরি ওই কবিতাই। এভাবে কবিতাই আমার স্বপ্নের অতিরিক্ত স্বপ্ন হয়ে জীবনকে মহিয়ান করে তোলে। আমি যেন প্রতিটি মানুষের অন্তর্গত উচ্চারণ অনুভব করি। (ভূমিকা/ নির্বাচিত কবিতা) তিনিইতো আলোকতোড়ন নির্মাণ করতে পারেন কবিতার মহাসড়কে।
জাকির তার কবিতার দ্বার খোলেন ভোরের সূর্যোদয়ে। ভোরের কুয়াশা গায়ে মেখে পথ চলেন। গনগনে মধ্য দিনে প্রতিবাদী প্লাকার্ড হাতে শ্লোগান ধরেন কখনো। কখনো বা চারণ, কখনো নাগরিক। সন্ধ্যায় প্রকৃতির জোনাকপোকা বুকপকেটে ভরে বের হন রাতের সংলাপে। মহাসৃষ্টির উন্মাদনায় হয়ে যান ধ্যানি সাধক পুরুষ।
‘কী করে ডিমভাঙা বাচ্চাটি সমস্ত পুকুরের দৃশ্যকে পরাজিত করে/
পানির কোলে বসে আকাশ দেখে। মাঝে মাঝে অসম্পূর্ণ ডানার
দাপটে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায় বাতাসে।
এ এক পৃথিবীর নতুন অতিথি। মৃত খোলস থেকে বেরিয়ে
ঢেউ ভাঙছে পুকুরে। তার ঠোঁটে বেজে উঠছে আগামীর গান।’
(ডানাওয়ালা গ্রহের শিশু/ রোদেরও আছে অন্ধকার)
জাকির চিত্রকল্পপ্রধান কবি। তার কবিতায় মূহুর্তের চমক নেই। আছে এক দূরগত আনন্দধ্বনির কম্পন। কান পাতলে মৃদু শব্দগুলো কাছে মনে হবে। ধ্যানি মাছরাঙার মতো তার কবিতা ধরতে হয়। পানির কোলে বসে আকাশ দেখতে চান যে কবি তিনি আর সাধারণ পাঁচজনের মতো থাকেন না। হয়ে যান অন্যগ্রহের বাসিন্দা। জাকিরের মানবতাবোধ প্রবল। মানুষের বোবাকান্না তার অন্তরে প্রসারিত হয়। অন্তর থেকে নিসিক্ত হয় মানবতাবোধের অশ্রুকণা। তাই তিনি বলতে পারেন—
‘অশ্রুই যদি না রইল/ মানুষ আর পাথরে কীই বা ব্যবধান থাকে।
(কোন কোন দৃশ্য দেখে/ নির্বাচিত কবিতা পৃ-১৭)
পুজিবাদীর মাশোহারায় পূর্ণ হয় বুদ্ধিবাজের দেহ। তৃতীয় বিশ্বের ধ্বংসের মহোৎসব চলে যাদের প্রেসক্রিপসনে, তাদের শরীর এতটাই স্থূল যে তার স্থিরচিত্র জাকিরের চোখে ধরা দেয় এভাবে—
‘দৈর্ঘ্য প্রস্থে এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে কোন জামার ভেতরই/
তাদের শরীর রাখা যায় না।
কী করেন? জিজ্ঞেস করতেই দিগন্ত জোড়া হা হেসে বলেন—
নীতি ব্যবসা!
নাগরিক বেদনায় আকাশ ফেটে গেলে আপনার কী
আপনি তো বেইমানদের স্বার্থ-প্রহরী।’
এই বেইমানদের জেব্রাপকেট ভারী হয় ইউরো-ডলারে। আর নাগরিক জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা। এর পরিসমাপ্তি কি ঘটাতে পারবে দুঃখ কুড়ানি মেয়েটি। যে ‘মেয়েটির ইচ্ছে হয় সময়কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে/ পৃথিবীকে স্থবিরতায় ডুবিয়ে দিতে’। কিংবা ‘পুজিবাদী নির্মমতার বিরুদ্ধে পাখিরা জড়ো হয়।/ তারপর অধিকার অধিকার শ্লোগান তোলে সব ফুল, প্রজাপতি ও বিহঙ্গদল/ এভাবে জড়ো হয় বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, বুভুক্ষু স্বপ্নেরা/ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে রোদ ও ছায়ার মিছিল।’
(দুঃখ কুড়ানি মেয়ে/ রোদেরও আছে অন্ধকার)
সভ্যতা এখানে নির্বাক। মানুষের বিবেক যেন অজ্ঞান রোগীর মতো শায়িত আছে হাসপাতালের বেডে। এলিয়ট এই স্থবিরতার চিত্র অঙ্কন করেছেন এভাবে—
`Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table.’
(The love song of J. Alfread Profrock)
জাকির আবু জাফর দুইটি শতাব্দীর সঙ্গমস্থলের কবি। দুই দশকের চাষবাসে কবিতার গোলাঘর সমৃদ্ধ। প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ নিয়েই তার কবিতার সংসার। মানুষের উৎসভূমির দিকে তার কবিতা সঞ্চরণশীল। কবিতার প্রতি মমতা তাকে আরো বড় করে তুলছে। তার কবিতা ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, আপন করে নেয়া যায়। প্রিয়ার গালের মতো তুলতুলে তার কবিতার শরীর। মেদহীন কবিতায় শব্দের ঝংকার তরুণীর হাসির মতো মনে বাজে। উপমা আর চিত্রকল্পে টলটলে কবিতার জল। দুর্বোধ্যতার পাশা তিনি খেলেন না কবিতায়। পাঠকের সাথে ধাঁধায়ও মাতেন না তিনি। তিনি আধুনিক। তিনি রোমান্টিক। প্রেমের সরল অনুবাদ করেন কবিতায়। জটিলতা ও কুটিলতা থাকে না সেখানে। যেমন—
‘যতদিন প্রাণ আছে বুকের খাঁচায়
প্রেম পাশে ঝুলে থাক ফুলের মাচায়।
(নারীর শরীর/ মুখোমুখি আজীবন)
মানুষই মানুষকে ভালোবাসতে পারে। ভালোবাসার স্তরবিন্যাস আছে। নারীকে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসতে হয় মানুষকে। দেশকে ভালোবাসতে হয় তারও অধিক। দেশ থাকলেই নারীর সাথে কবির মুগ্ধকর পর্যটন সম্ভব। দেশ না থাকলে সুন্দর মেয়েটির সাথেও ঝিলামের পারে বসা যায় না। বসরাই গোলাপ তার খোপায় গুজে দেয়া যায় না। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতিও জাকিরের ভালোবাসার কমতি নেই। এই গ্রহের বাসিন্দা বলেই তিনি বলতে পারেন—
‘মানুষকে মানুষই হতে হয়। জীন ফেরেশতা অথবা পেঙ্গুইন হবার সাধ মুছে
ফেলো বলেই আমাকে ছুঁড়ে দিলো শূন্যের উপর।
মূহুর্তে আমি মহাশূন্য ভেদ করে
মেঘের তরঙ্গ ভেঙে আছড়ে পড়লাম আমার পৃথিবীতে। এখন আমার
জানালা গলে প্রবেশ করছে পৃথিবীর কোমল আদর।
(বুনো বসন্তের দেশে/ রোদেরও আছে অন্ধাকার)
জাকিরের রোমান্টিকতার পর্যায়টি এখানে an instinct for the elemental simplifies of life এ উত্তীর্ণ হয়েছে। জীবনের মৌলিক সারল্যের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ তার কবিতাজীবনকে পূর্ণতা দান করে। তিনি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে, এক গ্রহ থেকে অন্যগ্রহে পাড়ি জমান। এখানে রহস্যবোধের চেতনায় (a subtle sense of mystry) কবিতা হয় দূরগামী, বেগবান, আন্তর্জাতিক। জাকির আবু জাফরের এই মনস্বীতা কবিতাকে করবে আরো সুদৃঢ় ও গভীর। ধ্যানে, অনুধ্যানে কবিতার পাঠক জাকিরের কবিতায় মিশে থাকবে অনন্তকাল।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. লেখাটি সংক্ষিপ্ত অবয়বে সাবলীল হয়েছে।
    কবি জাকির আবু জাফর একজন মেধাবী কবি।
    তার কবিতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।

    কবি মনসুর আজিজকে এবং ” বাংলা রিভিউ”— এর
    সম্পাদক ও খ্যাতিমান কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ