spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যমুহাম্মদ আমানুল্লাহ : প্রকৃতির শুদ্ধতম সাধক কবি

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

মুহাম্মদ আমানুল্লাহ : প্রকৃতির শুদ্ধতম সাধক কবি


| মাহমুদ নোমান |

নব্বই দশকের কবি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ স্বকালবিদ্ধ যুগন্দর দায়নিষ্ট কবি।তাঁর কবিতা জীবনানন্দ দাশের আদলে বলা যাবে না,অথচ কাব্যচেতনায় মিলে যায়।কোন কোন ক্ষেত্রে জীবনানন্দকে এড়িয়ে যান সুফিজমের ভাষা,বিষয়-বৈচিত্রে।লোকজ শব্দের কারুকার্যময় শিল্পিত বয়ানে ধর্মের বিষয়াদির বিচিত্র খন্ডনে আল মাহমুদকে পাশের আসনে বসিয়ে রাখেন। কবি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণের সোচ্চার প্রতিনিধি। হাহাকারের কুয়াশাময় বেষ্টনির মাঝে মর্মরে-মর্মরে আত্ম-বেদনে অপরূপ চিত্রকল্পে,কবিতার নির্মাণ-শৈলীতে ভিন্ন ভিন্ন ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় পাঠককে, অন্যভাবে বললে ঘোর এসে যায় অলৌকিকভাবে। মোহাবিষ্ট করে আত্মার নড়ন-চড়ন করে একেকটি শব্দে। নির্দ্বিধায় বলা যায়- মুহাম্মদ আমানুল্লাহ প্রকৃতির শুদ্ধতম সাধক কবি।

০২.
আত্মার আকুতি-মিনতি ব্যতিরেকে সবকিছুই আনুষ্ঠানিকতা, কবি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ বলেন-
কাসিদা প্রত্যহ শোনে আত্মার সেতার-মেঘের বিলাপ;/কবি,পৃথিবীর সমানপ্রবীণ-কখনও তো কবরের পরোয়া করে না।

  • কবর ও কাসিদা/পোড়ামাটির সানাই)
    দেহের কোন অমরতা নেয়, আছে শুধু আত্মার আবেদনে-সৃষ্টিশীলে। জীবনানন্দ দাশের জন্মের আগে অনেক বনলতা সেন থাকলেও জীবনানন্দ দাশ যখন নাটোরের বনলতা সেনকে নিয়ে কবিতা রচেন,তখন কবির সৃষ্টিতে বা অদ্যাবধি বনলতা সেন অমরতা পেল। তবে জীবনানন্দ দেহজ বর্ণনায় এগোলেও মুহাম্মদ আমানুল্লাহ আত্মবৎ হয়ে কখনো শীতের রাতে বেজে ওঠা রুপোলি নূপুর পায়ে,কখনো গুলতির চোটে পাখ ঝাপটানো ধূসরশালিক, ধূসরশালিক রাহেলাবুবু আবার কখনো ঈশ্বরের ভুল বিন্যাসের অজুহাত দিয়ে বিচ্ছেদে-দাম্পত্য দ্বৈরথে কামে কাতরায়ে প্রিয়াকে ‘মৌমিতা’ নাম ধরে ডাকে ‘ডুগডুগি ‘কবিতায়। অবশেষে বিজ্ঞান চেতনায় মঙ্গল যাত্রা,অদৃশ্য উদ্যানের দিকে অতৃপ্ত হৃদয়ে আহ্বান-
    অতৃপ্ত আদমের মতো মাটির গন্ধম খেয়ে মঙ্গলের দিকে যাবো/-আরেক পৃথিবী দেখো।…তুমি অনঙ্গ প্রেমের কথা বলে অদৃশ্য উদ্যানের দিকে হাঁটো/একটু দাঁড়াও সোনা,তুমিও অমরতা পাবে পুরাণে-প্রণয়ে কথা আর কবিতায়।
  • তুমিও অমরতা পাবে/মায়াবী রোদের ডানা)
    বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী অঞ্চলের সমুদ্রের গর্জন,যেখানে ঘূর্ণিঝড় বাসিন্দাদের মূল প্রতিপক্ষ। ঐ জনপদের মানুষের হাসি-কান্না,জীবনযাপনের নানান অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় মিশে শক্তিশালী রুপলাভ করেছে। কাব্যভাষা,কাব্যভঙ্গি ও বিষয়বস্তু আশ-পাশে ছড়ানো-ছিটানো হলেও মুহাম্মদ আমানুল্লাহ’র কবিতায় এসব উদ্ভট না তদুপরি শিল্পহারাও নয়।বরঞ্চ ধ্বনিগত রূপ-মাধুর্যে আধুনিকতম ও নিজস্বতায় কবিতার নয়া অলংকারাদি।মিথ ও পুরাণের বিষয়ে সুফিজমের ব্যাখ্যায় অভিনবত্ব,যুক্তি-খন্ডন মেনে নিতে কারো কষ্ট হয় না,বোধোদয় হবে নয়া আদলের নয়া কিছুর উদ্বোধন-
    রাত জেগে তোমার কুশল লিখে রাখে সে-মুমিনের কাঁধে জাগা ফেরেশতাদের/মত।
  • নীল মমি/মায়াবী রোদের ডানা)

০৩.
আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মৃত্যুচেতনাকে কবি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ আধ্যাত্বিক ভাবধারায় মিলিয়ে নিয়েছেন
সুখপাখি হিসেবে-
তুমি কি জান না হায় – মগ্ন নীরবতা নয়, শ্মশান মাতম নয়,মৃত্যু এক অচেনা/অধীর সুখপাখি;…শর্ত নয়,স্বার্থ নয়,নয় কোন সোনার মোহর/জীবন ভোরের নদী, দেউলিয়া চাঁদ-লালনীল উজালা হাপর-এক আগুনের ঘর।

  • উজালা হাপর/মায়াবী রোদের ডানা)

খ.
তবুও কিষাণ বধূ শুঁকে যায় মেঘের সুঘ্রাণ;সোনার নোলক/হাসে নাকের উঠোনে,/নীল জলে নীল মেঘে যমুনা তেরসা বহে-কায়া আর মায়া জুড়ে নিপাট সন্ন্যাস।
-সন্ন্যাস/মায়াবী রোদের ডানা)

প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জন্মস্থান ও মায়ের প্রতি সমানে ভালোবাসার বিশুদ্ধ উচ্চারণ ‘মা’কবিতাটি। তবে সামাজিকতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চরম হতাশায় কবি লিখেছেন-
এইভাবে সমুদ্র আকাশ গেলো,অরণ্য সবুজ গেলো-চেতনার রং ক্রমে পুড়ে/পুড়ে ছাই/কীভাবে এখন ভালো থাকা যায় বলো?

  • তোমার প্রস্থানের পর/মায়াবী রোদের ডানা)
    রাজনৈতিক দুষ্টচক্রে দলিত নাগরিক জীবন,দলবাজি-দখলবাজিতে মিথ্যের আশ্বাসের রাষ্ট্রীয় কলে তৈরী মুখোশপরা মানুষ-
    সড়কশালিক গোঙায় শীতার্ত দেহে-কাক ও শকুন ছোড়ে তাজা ককটেল;/দীর্ঘশ্বাস বাড়ে-মধ্যাহ্নেই রাত।অচিন আজাব – পোড়ারুটিগুলো দগদগে মুখ,/বিদঘুটে ক্ষত পোড়া বুক হাত কালশিটে পিঠে তুমি শুয়ে আছো;
    -বার্ন ইউনিট/পোড়ামাটির সানাই)
    এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বারবার বহিরাগতদের নাক গলানো, মিনমিনে শয়তানদের গোপন ধারালো নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে যাচ্ছে মাতৃভূম,কেড়ে নিচ্ছে ভাতের গরাস। এক্ষেত্রে নিজেদের দোষ স্বীকার করতে হয়। পলাশীতে মীরজাফর,একাত্তরে রাজাকার আর এখন কালো নেকাবে উগ্রবাদী জানোয়ার-
    দুপুরের রোদ কাঁপে কাকের ডানায় আনবিক আঁধারের ভুল সহোদর,/সারাটি জনম ভর আগুনবারুদ গোলা;প্রতিটি জরায়ু ভ্রুণে মিসাইলবোমা/-যুদ্ধের উত্তরাধিকার।
  • শকুন /পোড়ামাটির সানাই)

০৪.
বিষধর সাপ আজদাহোর, কুফুরি কালাম, তসবিহ তাহলিল, মথুরা, হাঁসুলি, তোয়াফ, ইথারে, ইথানে, মুজিজা, কিসতি, মুরুলি, হাঁপর, হালহকিকত, বানরুটি, যোনিফুল, কাসিদা, মেঘফুল,সাকিন,কাঁকুই,মালসার ফুল,জোছনাগজল,সোয়ারি,তাহকিক শব্দগুলো মুহাম্মদ আমানুল্লাহ’র কবিতায় উৎকর্ষ সাধনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।তিনি সমিল ও অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নব্বই দশক থেকে লেখালেখি শুরু করলেও দীর্ঘ বিরতি বলা যাবে না,হয়তো নিজেকে শাণিত করে ২০০৪ সালে প্রথম কবিতার বই ‘মায়াবী রোদের ডানা’ নিয়ে হাজির হন। এ প্রসঙ্গে বইটির ফ্লাপে কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন- ‘মায়াবী রোদের ডানা’ মেলে কাব্যভুবনে উপস্তিত হলেন মুহাম্মদ আমানুল্লাহ। দেখা যায় কবিতাগুলোর রচনাকাল দুই পর্বে বিভক্ত- (১৯৯২-৯৪) ও (২০১২-১৩)। তাঁকে নবীন মনে হলেও এই দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব তাঁর আবেগকে করেছে সংহত,বোধকে দিয়েছে গভীরতা।’

এরপরে প্রকাশ পেয়েছে মুহাম্মদ আমানুল্লাহ’র দ্বিতীয় কবিতার বই- ‘পোড়ামাটির সানাই’… এই কবিতার বইয়ে কবি নিজেকে নিয়ে গেছেন আরও বিচিত্র সজ্জাকরণে; ভাব ও বোধের চমকিত রূপে নানান অভিধায় বিশেষিত। নিম্নে দুটো কবিতার বই থেকে কিছু চুম্বক অংশ উপস্থাপন করলাম –

ক.
আপনারা কেউ কবিতাকে দেখেছেন?/নীল শাড়ি,খোলাচুল,লাল টিপ,সমস্ত শরীরে তার কাঠগোলাপের ঘ্রাণ-সাত/সাগরের নুন চোখেমুখে মেখে আজ সে ফেরারি।
-ফেরারি/পোড়ামাটির সানাই)

খ.
পৃথিবী মঙ্গলে নয়,তোমাতে/
আস্তানা যাচে-অমরতা মাগে।
-কলবের চোখগুলো মায়াপারে হাঁটে/পোড়ামাটির সানাই)

গ.
শৃঙ্গারে সঙ্গমে শূন্যতায় সংসারে কোথায় লুকাবে বলো-হৃদয়ে রেখেছি পুঁতে /ঈশ্বরের চোখ।
-ঈশ্বরের চোখ/মায়াবী রোদের ডানা)

ঘ.
আমাকে বেঁধেছো তুমি/পরম আদরে রাঙা দুটো পায়ে-এই বেশ আছি,/দরজাটা বাঁধো সোনা,/জোছনাজোয়ান রাত-রুমালে বেঁধেছি চোখ/খেলি কানামাছি।
-নূপুর /পোড়ামাটির সানাই)

কবি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ ১৯৬৭ সালের ১লা আগস্ট মহেশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বয়সের লুকোচুরিতে কবি এবার পঞ্চাশে পেরিয়ে গেছেন। বাঙলা কবিতার উর্বরতা বাড়াতে কবির অন্তত শতায়ু কামনা বাংলা ভাষাভাষী সকল পাঠকের।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ