spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবহুবর্ণিল চিত্রকল্পে জীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচন সরকার মাসুদের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

বহুবর্ণিল চিত্রকল্পে জীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচন সরকার মাসুদের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

জীবন সহজ যদি সহজে জীবনকে যাপন করা যায়। কিন্তু আজকের ভোগবাদী সমাজে জীবনপথের যাত্রায় কোনো মানুষই সহজের সাধনা করতে পারছে না। ফলে, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজ ও ব্যক্তিজীবন জটিলতার আবর্তে ঘূর্ণায়মান। সাহিত্য জীবনের প্রতিরূপ। মানে, জীবনের জটিলতার ভেতর থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে সাহিত্যের ভেতর মানুষ ডুব দ্যায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট পথে চলতে সাহিত্য মানুষের অন্তর্গত জীবনীশক্তিকে উজ্জীবিত করে। তাহলে দ্যাখা যাচ্ছে, মানুষের জীবনে সাহিত্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সাহিত্যের ভাষাও যদি যাপিত জীবনের মতো জটিল হয় তাহলে সেই সাহিত্য মানুষের বোধগম্যতার বাইরে চলে যায়। সেই সাহিত্যপাঠে মানুষের ভেতর জীবনীশক্তির কোনো স্ফুরণ ঘটে না। এ কারণেই দ্যাখা যায়, মহৎ সাহিত্যকর্মীরা সাহিত্যের ভাষা ও রীতিতে যুগে-যুগে সহজের সাধনা করে গেছেন।
বাংলা কবিতার আশির দশকের কালখণ্ডে যেসব কবি কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন সেসব কবির কবিতা আগের দশকগুলো থেকে নানা বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতর বাঁক পরিবর্তন করে। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কারণেই সত্তরের দশকের কবিতা ছিল গণমানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। বিষয়বস্তুও ছিল কিছুটা স্লোগানধর্মী প্রতিবাদমুখর। কিন্তু আশির দশকে এসে কবিতা বিচিত্র বিষয়ে ও আঙ্গিকে রূপ নেয়। এই সময়ের কবিরা কবিতার অঙ্গসৌষ্ঠবকে শিল্পের বিচিত্র কারুকাজে রাঙিয়ে তুলতে চেষ্টা করতে লাগলেন। ফলে, পাওয়া গেল নানা বৈশিষ্ট্যেও ও নানা স্বাদের কবিতা। এদের মধ্যে সরকার মাসুদের কবিতায় সহজের সাধনা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ‘শাদা কাগজ’ কবিতার ওপর চোখ বোলানো যাক:

শাদা কাগজের মতো মন
আমি কল্পনা করি শাদা কাগজের মন
তার নির্মল স্মিত হাসি
তার নিঃশব্দ শাদা কান্না!
বাতাসের লম্বা ঢালে শাদা কাগজ
ধরে রাখে তার ফুরফুরে উড়াল
শাদা বুকের আড়ালে জমিয়ে রাখে
ঝরাপাতা, ঊর্ধ্বমুখি ডালপালার বিস্ময়।

এই হচ্ছে সরকার মাসুদের কবিতা। সহজ শব্দে জীবনের গূঢ়তর সত্যের উন্মোচন। আমাদের যাপিত জীবন যদিও সহজ নয়, কিন্তু জীবনের প্রকৃত স্বরূপ সহজ ও সুন্দর। যে-রকম সহজ ও সুন্দর প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান। প্রকৃতির রীতিনীতির বিরুদ্ধে জীবনযাপন করার কারণেই মূলত মানুষের জীবন জটিল হয়ে ওঠে। মানুষ যদি প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে ঐক্য গড়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করতো তাহলে প্রকৃতির মতো মানুষের জীবনও সহজ হয়ে উঠতো। তা কিন্তু হচ্ছে না। তবে কবিতার ভেতর দিয়ে সহজ জীবনের ইঙ্গিত সরকার মাসুদের কবিতার ছত্রে-ছত্রে। সহজেই এই সাধনাই তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। জীবনকে সহজ করার প্রথম ধাপ হচ্ছে অন্তর্করণকে শাদা কাগজের মতো ধবধরে করে তুলতে হবে। আর তাই কবি কল্পনা করেন শাদা কাগজের মতো মন। যার অন্তর্করণ শাদা কাগজের মতো ধরধবে তার হাসি নির্মল। পবিত্রতার অভিব্যক্তি সেই হাসিতে ফুটে ওঠে। বাতাসের বুকে নির্ভার আনন্দে ভাসতে থাকে শাদা কাগজ। এই চিত্রকল্প থেকে আমরা বুঝতে পারি, যাপিত-বাস্তবতায় সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে-যেতে নির্মল মনের মানুষেরাই নিজের জীবনের ছন্দিত গতি ঠিক রাখতে পারে। প্রতিকূল অসংখ্য ঘটনার অভিঘাতে নিজেকে নির্ভার ভাবতে পারে। যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা বুকের গহনে জমিয়ে রাখতে পারে। যেমনটি শাদা কাগজ বুকের ভেতর জমিয়ে রাখে ঝরাপাতা। যদিও তা আমরা খোলা চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু অন্তর্চোখে তাকালে কবির কল্পচিত্র আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। দেখি যে, ওপরের দিকে উঠে যাওয়া ডালপালার বিস্ময় সঙ্গোপনে শাদা কাগজ বুকের ভেতর লালন করে। যেমনভাবে শাদা মনের মানুষ মহাবিশ্বের অনন্ত সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে বিস্মিত হয়। সেই বিস্ময় মানুষটি কাউকে বোঝাতে পারে না। কেবল নিজের ভেতরই জমিয়ে রাখে।
বলতে কী, অনন্ত বিস্তৃতির মতোই মানুষের অন্তর্জগৎ। প্রতিমুহূর্তে সেই জগতে বিচিত্র অনুভূতি অন্তর্লীন স্রোতের মতো উঠছে, আবার ভেঙে পড়ছে। ভাঙা-গড়ার এই দোলাচালেই ছন্দিত মানুষের জীবন। এই জীবন মানুষের আকাঙ্ক্ষার বহুবর্ণিল সৌন্দর্যে রাঙানো। এই জীবন মানুষের অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি দ্বারা নির্মিত। এই জীবনে প্রত্যেক মানুষই তার নিজের জগতের সম্রাট। স্বপ্ন-কল্পনার বিচিত্র এই জগৎ সম্ভবত মানুষ ছাড়া সৃষ্টির আর কোনো প্রাণীর নেই। স্বপ্ন-কল্পনার সৌন্দর্য দিয়ে শোভিত এই জগতের পাশাপাশি মানুষের রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এই জীবন দ্বন্দ্বমুখর। আজকের সমাজে ভোগ্যপণ্যের তুমুল আলোড়ন চলছে পৃথিবীজুড়ে। তার অভিনব সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ক্রমাগত চেষ্টা করছে মানুষের বাসনাকে উসকে দিতে এবং বড় বাজার তৈরি করতে। এরা বিশেষভাবে চেষ্টা করে যৌনবাসনাকে কাজে লাগাতে। এর জন্য আর্থসামাজিক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে সেই পরিস্থিতি একদিকে অপূরিত আকাঙ্খার জন্য হতাশার জন্ম দিচ্ছে, আরদিকে বাড়ছে বিভেদ, দুর্নীতি ও হিংসা। ফলে আজকের সময়ের বেশির ভাগ মানুষ ভোগকেই জীবনের মানে বলে জানে। এই বিশ্বাস নিয়েই প্রত্যেকে একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দৌড়চ্ছে। মানুষের এই গতি একটুখানি থামিয়ে দিয়ে সরকার মাসুদ জীবনের টুকরো-টুকরো অনুভূতির রঙছবি ছোট-ছোট বাক্যে মুদ্রিত করেন তার কবিতায়। এসব কবিতা পাঠে পাঠক শিল্পের তৃপ্তি পান। পাঠকের ভেতর ফুরফুরে আনন্দ বয়ে যেতে থাকে। পাঠকের কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি পাওয়া কবির আর কী হতে পারে! এই বিবেচনায় সরকার মাসুদ পাঠকের ঘনিষ্ঠ স্বজন। যার কাছাকাছি বসে পাঠক জীবনের জটিলতা থেকে কিছু সময় বেরিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। অথচ দ্যাখা যাচ্ছে, আশির ও নব্বইয়ের বেশির ভাগ কবির কবিতার ভাষাশৈলী ও বোধের স্ফুরণ জটিল কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে। কবিতার শরীরে শব্দপুঞ্জ যেন একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন। কবি যেন পাঠককে জোর করে তার কবিতা পাঠে বাধ্য করছেন। কবি ভুলে যান, জীবনের জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে কিছু সময় সরলতা ও সরসতার রস আস্বাদন করতেই পাঠক কবিতা পড়ে।
সরকার মাসুদের কবিতা মূলত গল্পনির্ভর। একটির পর আরেকটি চিত্রকল্প ভাষাচিত্রে চিত্রিত করে তিনি কবিতার শরীর নির্মাণ করেন। তার কবিতা পড়তে-পড়তে পাঠকের মনে হবে, শব্দের বিন্যাসে যেসব ছবি তিনি ভাষায় অঙ্কিত করছেন সেসব ছবিই বুঝি কবিতা। এই বৈশিষ্ট্য আশির দশকের রিফাত চৌধুরীর কবিতায় আমরা দেখতে পাই। চিত্রকল্পের বহুবর্ণিল রঙে পাঠক জীবনের প্রতিচ্ছবি গল্পের ভেতর দিয়ে অন্তর্চোখে দেখতে পায়। এই দ্যাখার ভেতর দিয়ে কবির অন্তর্জগতের বিচিত্র অনুভূতি অন্তর্লীন স্রোতের সাথে পাঠকও একাত্ম হয়ে ওঠে। যাপিত জীবনে প্রতিমুহূর্তে আমরা নানা রকমের দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন-অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছি। এসব দৃশ্যের সমান্তরাল শিল্পের রঙে রাঙিয়ে মাসুদ কবিতার ভেতর নির্মাণ করেন চিত্রকল্প। সেসব চিত্রে পাঠক জীবনকে অন্তর্লীন কল্পনার রঙে রাঙিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে পায়। শিল্পের এই আনন্দের কারণেই পাঠককে বারবার ফিরে আসতে হয় সরকার মাসুদের কবিতার সান্নিধ্যে। ‘মাথা খুলে রাখা টিউবওয়েল’ কবিতাটি পড়া যাক:

বাড়ি ফিরি অনেক রাতে
মহল্লার মুখে মাথা খুলে রাখা টিউবওয়েল
নিঃশব্দে বলে, ফিরলে তাহলে!
ঘুম আসে না, এটা-ওটা চিন্তা করি
গুমোট গরমের রাতে
শাদা শাদা মেঘ নেমে আসে
ওই মাথা খোলা চাপকলের ওপর
শেষরাতের আধো স্বপ্নে দেখা যায়
ঝরঝর করে পানি পড়ছে কলতলায়!

প্রতিদিনের যাপিত জীবনের এক-টুকরো ছবি কবি এখানে ভাষাচিত্রে অঙ্কিত করেছেন। আমাদের জীবন মানেই তো গল্প। প্রতিমুহূর্তে চারপাশের সাথে আমরা যে যোগসূত্র তৈরি করে চলেছি সেই সূত্রের ভেতরই আমাদের গল্প গ্রোথিত হয়ে রয়েছে। এসব গল্প নানা রকম। কখনো বিষাদের, কখনো আনন্দের। আবার কখনো গভীর কোনো দার্শনিক উপলব্ধির। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কবির বেশ রাত হয়ে গেছে। মহল্লার মুখে তিনি দেখলেন মুখ রাখা টিউবওয়েল। কবির মনে হলো, কোনো শব্দ উচ্চারণ না-করেই টিউবওয়েলটি যেন তাকে বলছে, ‘ফিরলে তাহলে!’ কেন বললো? আমরা ধারণা করতে পারি, যাপিত জীবনের জটিলতায় কবি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। জীবনযাপন একঘেয়ে অবসাদে পর্যুদস্ত। ফলে, সেই জীবনের কাছে কবি ফিরে যেতে চান না। কিন্তু ফিরতেই হয়। ফিরতে ফিরতে তার বেশ রাত হয়ে যায়। শুয়ে-শুয়ে নানা চিন্তা এসে ভিড় জমায়। এরই মধ্যে শাদা শাদা মেঘ আকাশে জড়ো হয়। শেষরাতের দিকে কবি স্বপ্ন দ্যাখেন, মুখখোলা সেই টিউবওয়েল থেকে ঝরঝর শব্দে পানি ঝরে পড়ছে। পাঠক হিসেবে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, এই পানি আসলে প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। কবির মরুতপ্ত জটিল জীবনে সারল্যের সরসতা নেবে আসবে, কবির এই আকাঙ্ক্ষাই ওই প্রতীকের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।
এইভাবে এবং নানাভাবে নানা বৈচিত্র্যের চিত্রকল্পের বুননে সরকার মাসুদ যাপিত জীবনের সমান্তরাল আরেকটি জীবনচিত্র অঙ্কন করেন। যে জীবন তার আকাঙ্ক্ষার, যে জীবন সারল্যের শাব্দিক মূর্তি। লক্ষ্যণীয় যে, মাসুদের বেশির ভাগ কবিতার অবয়ব ছোট-ছোট। বড়জোড় ১২-১৩ শব্দের ভেতর। সীমিত এই পরিসরে বোধের অন্তর্লীন বুদবুদকে তিনি শব্দের ভেতর দিয়ে স্ফুরিত করেন। এই যাত্রায় বাহুল্য কোনো শব্দের জায়গা তার কবিতায় নেই। কবি হিসেবে শব্দ ব্যবহারে তিনি ভীষণ পরিমিতি বোধের পরিচয় দেন। যেখানে যে শব্দটি দরকার সেখানে ঠিক সেই শব্দটি তার কবিতায় আমরা দেখি। এই পরিমিতিবোধের পেছনে রয়েছে মাসুদের শৈল্পিক সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। যেন তিনি ফটোগ্রাফার। পথ চলছেন, আর চোখের সামনে যা-যা দেখছেন ঠকাস ঠক সেসবের ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করে ফেলছেন। এক্ষেত্রে শব্দের পর শব্দের বিন্যাসই তার দৃশ্য-ধারণের ক্যামেরা। শব্দে-শব্দে মাসুদের ধারণকৃত দৃশ্যগুলো একটির পর আরেকটি চমৎকার শৈল্পিক নৈপুণ্যে সাজানো থাকে কবিতায় অবয়বে। পাঠক যখন তার কবিতা পাঠ করেন সে সময় বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন, এসব দৃশ্য তো তার চারপাশেরই দৃশ্য। কিন্তু সেসব দৃশ্য কবিতার ভেতর দিয়ে অনন্য কোনো কৌশলে প্রতিদৃশ্য হয়ে উঠছে। আর ঠিক তখনই মাসুদের কবিতা পাঠের আসল আনন্দ পাঠক উপলব্ধি করেন। যাপিত-বাস্তবতার জটিল আবর্তনে ঘুরতে ঘুরতে পাঠক ক্লান্ত। ফলে, জটিল জীবনেরই প্রতিচ্ছবি যখন সে নান্দনিক চিত্রকল্পে অন্তর্চোখে দেখতে পায় তখন তো পাঠকের আনন্দ হওয়ারই কথা। এই আনন্দই যে শিল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
মাত্রাভিত্তিক ছন্দের কবিতা তেমন লেখেননি সরকার মাসুদ। কারণ, ছন্দিত শব্দের ঢেউয়ের ওপর তুলে দিলে মাসুদের ধারণকৃত দৃশ্যগুলো ভেঙে পড়তো। ফলে, তার কবিতার অবয়বও ভেঙে পড়তো। মাসুদের কবিতা পাঠে পাঠকের মনে হবে, ছন্দের বাইরেও কবিতা শৈল্পিক সুষমায় অনন্য হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য এই কর্মে কবিকে কবিতায় স্বকীয় কোনো বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে নিতে হয়। সরকার মাসুদ সেই বৈশিষ্ট্য তৈরি করে নিতে পেরেছেন। তার কবিতার যে বৈশিষ্ট্য সেখানে শব্দের ছন্দিত শৃঙ্খলা আরোপিত হয়ে উঠতো। আর, কবিতায় আরোপিত যে-কোনো কিছুই শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দ্যায়। সত্তার গভীরে প্রগাঢ় অনুভূতির নানা রঙছবি কবি দেখতে পান। সেসব রঙছবির সাথে বাস্তবতার সাদৃশ্য থাকলেও কবিতায় সেই বাস্তবতা প্রতিদৃশ্য হিসেবে রূপায়িত হয়। এ কারণে মাসুদের কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের মনে হবে, বাস্তবতা আসলে মানুষের ছায়া। আর, মূল মানুষটি সত্তার গভীরে আত্মোপলব্ধিতে রয়ে গেছে। এহেন উপলব্ধি মূলত দার্শনিক উপলব্ধি হলেও মাসুদ কবিতার ভেতর শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় সেই সত্য মুদ্রিত করে তোলেন। ফলে, উপলব্ধিজাত সত্য দার্শনিকতার বলয় ভেঙে তার কবিতায় সাহিত্যের রসে জারিত হয়। এই কৌশলটি কবি হিসেবে মাসুদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য বলেই পাঠকের মনে হবে। যা বাস্তবতা, তার ওপর তিনি শিল্পের মাধুর্য দিয়ে প্রলেপ ছড়িয়ে দেন। ফলে দৃশ্যমান বাস্তবতা শৈল্পিক বাস্তবতা হিসেবে পাঠকের চোখের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। মানে, বাস্তবতার সমান্তরাল আরেক বাস্তবতা। তবে নির্মিত বাস্তবতায় ভেতর পাঠকের নিঃশ্বাস নেয়ার অবকাশ থাকে। যে সুযোগ যাপিত বাস্তবতায় পাঠকের থাকে না। মাসুদ নির্মিত বাস্তবতা প্রতীক ও উপমার সৌন্দর্যে রাঙানো। ‘পরাবাস্তব’ শিরোনামের ছোট্ট কবিতাটি পড়া যাক:

মধ্যদুপুরে ডাস্টবিন কুকুরের কুরুক্ষেত্র। হঠাৎ
ওভারব্রিজ ভেঙে পড়ে, ঘোলা জলে ভাঙা প্রেম
বিরক্তির কটু রোদে ভেসে চলেছে কাপা পা, হাত
ভেসে আসছে বাঘের কাটা মাথা, চশমার ফ্রেম!

বাস্তবতার বিরপরীতে আরেক বাস্তবতার চিত্ররূপ এই কবিতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। একেকটি বাক্য মানেই যেন ক্যামেরায় ধারণ করা একেকটি দৃশ্য। প্রত্যেকটি দৃশ্য আসলে আমাদের যাপিত-বাস্তবতার প্রাত্যহিক চিত্রপট। এসব দৃশ্য ভীতিকর, অথচ এসব দৃশ্যের ভেতর দিয়েই প্রতিদিন প্রতিরাত্রি বয়ে চলেছে আমাদের জীবন। জীবনের ভীতিকর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যখন এই কবিতাটি পাঠ করি তখন শিউরে উঠি এই ভেবে যে, এই জীবনের ভেতর দিয়েই তাহলে আমরা বেঁচে আছি! আমরা বিস্মিত হই। যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, কবিতায় ভয়ঙ্কর যে চিত্র ভাষাচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে সেই চিত্র আমাদের জীবনযাপনের কোনো অংশ নয়, তা যেন আরেক কোনো জীবনের। কবিতা যে জীবনের প্রতিচ্ছবি এই সত্যের সার্থক রূপায়ন আমরা দেখতে পাই সরকার মাসুদের কবিতায়।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ