জাফর তালুকদার

জুলাই বিপ্লব শেষ হয়েছে। মুক্তির হাওয়া বইছে আকাশে বাতাসে। অনেক দিন যাওয়া হয় না কোথাও। কিছু না ভেবেই গাড়িতে উঠে বসলাম। একা বেড়ানোয় একরকম আনন্দ আছে। তবে এতে কিছু সূক্ষ্ম কষ্টও আছে বৈকি।
সুবর্ণগ্রাম আমার বড় প্রিয় একটি জায়গা।
এই রিসোর্টের আনন্দযজ্ঞের শেষ কারিশমাটি হলো লন্ডন আই গোছের একটি বিশাল নাগরদোলা।
তখন ফাঁকা দুপুর। ব্যস্ততার হেলদোল নেই। একখানা টিকিট কেটে আকাশ-ছোঁয়া নাগরদোলাটির উড়াল গর্তে বাক্সবন্দী হলাম। ভেবেছিলাম রোদেলা আকাশ চিরে একাই স্বর্গে আরোহন করব। যন্ত্রদানব গর্জেও উঠেছিল সামান্য। এমন সময় গ্রীন স্নেকের মতো একটি ফিনফিনে তরুণি উড়ে এসে বসল আমার পাশের আসনটিতে।
বিশাল চাকাটা ধীরে ধীরে নড়ে উঠল। আমার শুকনো বুকখানাও কেঁপে উঠল বিপুল পুলকানন্দে। চাকা যত উপরে উঠছে আমরাও নেচে উঠলাম স্প্রিংয়ের পুতুলের মতন। এক অনির্বচনীয় সুখে হাবুডুবু খেতে খেতে আকাশ দেখছি চারচোখে। অস্হির বাতাসে তার বেসামাল সুগন্ধি চুল উড়ে উড়ে আছড়াতে শুরু করল আমার চোখেমুখে। চরম আনুগত্য মেনে সমর্পিত হই সেই দামাল কেশগুচ্ছের মধুর শাসনে। এভাবে অনাহূত আদরের ছোঁয়া পেয়ে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম বোধ হয়।
এমন সময় চাকাটা থেমে যায় সহসা। একটু বিরক্ত বোধ করি। শুরু না-হতেই কেন এই অযাচিত থেমে যাওয়া! আর একটু স্হির হয়ে আকাশ ছুঁয়ে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো ধরণীর?
সে অপরূপ হেসে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে একটা ভঙ্গি করল দিঘল কালো চোখের ইশারায়।
হৃদয়খানা ছিঁড়ে গেল।
দ্রুত কাঁধের ঝোলা থেকে জুলাইকে নিয়ে লেখা নতুন কবিতার বইখানা বের করে লাল কালির কলমে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলাম চারটি রক্তাক্ত অক্ষর—‘ভালোবাসি।’
সে পরম মমতায় বইটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। ঘ্রাণ শুঁকল। তারপর কলমটা চেয়ে নিয়ে সেই জ্বলজ্বল করা ভালোবাসির পাশে লিখল একটি হৃদয়-ভাঙা খুনি অক্ষর—‘না।’
সমীকরণটি সহজ হলো বটে। কিন্তু মনের গভীর টানাপোড়েনে যে জটিল রক্তক্ষরণ হলো তার দায়ভার কে নেবে !
——————