spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েসেঁজুতি বড়ুয়া'র কবিতা : 'সে যে সহজিয়া মাছ, মরমী পাহাড়গাত্র, পবিত্র কাকচক্ষু...

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

সেঁজুতি বড়ুয়া’র কবিতা : ‘সে যে সহজিয়া মাছ, মরমী পাহাড়গাত্র, পবিত্র কাকচক্ষু জলের কবিতা’


| মাহমুদ নোমান |

মোহাবিষ্ট শব্দেন্দ্রিয়ে ভেতর বাহির সুরারোপিত গানের কলি লিখে যান, যেখানে মায়া গলাগলি করে বাঁচে,সংকটে – নিদানে বা সুখে – শান্তিতেও; বলছি,সেঁজুতি বড়ুয়ার কথা। হুম, এ কবির কবিতা পড়তে পড়তে বাহারি চিত্রকল্পের ভাববাদী বস্তুতে পাহাড়ে আরোহন করবেন। পাহাড়ের চূড়ায় ফুরফুরে বাতাসে মেঘের কাছাকাছি অতলান্তে মিতালি গীত, গাঁথবেন নিজেদের অজান্তে। মনে হয়,একটি ফিল্মে পাঠকরা বিভিন্ন ভূমিকায় স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে যাচ্ছেন কবিতার পর কবিতায়। অথচ এখনকার কবিতা যখন জনবিচ্ছিন্ন; মানুষকে প্রকৃতির কাছে না নিয়ে ইট- পাথরের চারদেয়ালে বন্দিদশায় ধুঁকছে এবং এই দ্বৈরথে জয়জয়কার অবস্থা; তখন সেঁজুতি বড়ুয়ার প্রকৃতির কথা বলা,সবুজের মায়ায় ভালোবাসার জয়গানে প্রথম কবিতার বই ” হৃৎ”…

পাখি গো,
রোদে পুড়ে পুড়ে সাত রঙ খেলা
জলের বৃষ্টি আদিবাসী চোখে
নেমে যেতে পারো এই সিঁড়ি বেয়ে
পাহাড়ের নিচে নরম শ্যাওলা…

– দ্বৈরথ; ৯পৃ.)

সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতা নিজেকে গুছিয়ে, দৈনন্দিন জীবনের গৎবাঁধা সময় থেকে কিছু সময় আলাদা করে পড়তে হয় না। কেননা সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতা কখনো কবিতা মনে হবে না,যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কবিতা পড়া শুরু না করেন… কবিতা পড়ার মধ্যেই নিজের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব জানান দিবে,কবিতার রূপ-রহস্যে একটা মায়াবী জালে আটকা পড়বেন। কবিতা পড়ার শেষেই নিজের অজান্তে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে – কবিতা, এমনই হয়…

সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতায় তেমন মোচড়ামোচড়ি নেই। সহজাত শব্দ অথচ স্মার্ট, বোধের সারল্যতা
অথচ সুনিয়ন্ত্রিত আর সুবিন্যস্ত। কবিতা পড়া শুরু করার পর উঠে যাওয়ার ক্লান্তি কখনো আসবে না,এখানেই তাঁর কবিতার বাহাদুরি। সোজা কথায় বললে – একটি ঘোর তৈরি হয় পাঠকের। যেটায় শুধু প্রকৃতির কথা বলে,প্রকৃতির সাথে আত্মার আত্মীয়দের কথা বলে…এ শক্তি এখনকার কবিতায় তেমন দেখা যায় না, বলতে পারি বিলুপ্তপ্রায় ;

ক.
তড়পড়ানো মেঘ ডানায় শব্দ জপে প্রযত্নে ইতি বেয়ারিং চিঠি/ ‘ একান্ত গোপনীয় ‘ মর্মর পাথরে কেউ সন্ধ্যার সংকেত দিচ্ছে /একরঙা সুতায়…ইচ্ছেরা হাঁটে কারো অতলান্ত ডাকের অপেক্ষায়!

– ঘরে ফেরার আগে; ১২ পৃ.)

খ.
বৃষ্টির সরুরেখা জীবন সংঘাতে নামে — সজোরে নিশানা হাঁকে / শ্রাবণের ত্রিভঙ্গি মেঘ,অঝোর আন্তঃনগর ট্রেনে!

– জলশব্দের প্রতিধ্বনি ; ১৩ পৃ.)

দুই.

সেঁজুতি বড়ুয়া প্রকৃতির রূপ রহস্যের কথা আন্তরিকতায় যেমন বলেছেন,তেমনি প্রকৃতির আত্মজ মানুষদের অধিকার,সুখ- বঞ্চনা সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। অথচ কোনো উচ্চবাক্যে চিৎকার দিয়ে পরিবেশ নষ্ট করেন নি, শব্দদূষণ বা গন্ধ ছড়াছড়ি করেন নি। ঠাণ্ডা কূটকচালে মরমে মরমে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভাবিত বীজ, এই এক উৎকর্ষ মূকাভিনয় ;
সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতায় প্রধান ও প্রবল প্রবণতা মানুষ আর প্রকৃতির সাধারণ দৃশ্যরূপের তুলনায় তার ভাবরূপকে শিল্পীমানসে প্রভাবরূপকে দেখানোর সফল প্রচেষ্টা। সাঙ্কেতিকতার অনিশ্চিয়তা,অস্পষ্টতা,অনেক ক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতা রহস্যাদির ব্যঞ্জনাকে দিয়েছে পরিশুদ্ধি পাঠ। শেষপর্যায়ে,এই পাঠে ভিন্নতার সঙ্গে স্বতন্ত্রতারও স্তরভেদ ঘটেছে। কিন্তু একের সঙ্গে অপরের সূক্ষ্ম বা স্থূল অচ্ছেদ্য সম্পর্ক থেকেই যাচ্ছে। একবাক্যে,সেঁজুতি বড়ুয়া প্রকৃতির কথা বলতে নতুনত্বে, কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা পড়ানোর দিকে বেশি মজেছেন। কোনো চমক দেখান নি অথচ চমকিত হয়ে এসেছে কবিতার শব্দাদি। এখন অনেক কবি চমক দিতে গিয়ে যখন নিজে চমকিয়ে যাচ্ছে তখন শিল্পে সেসব শিল্পীকে নিয়ে হাস্যরসের উদ্রেক ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে,পাঠকমনের অনুভূতি ভোঁতা করে দেয়। একসময় বিমূখতা তৈরি করে,যা শেষে একটি ভাষার সাহিত্য দুর্ঘটনা আনয়ন করে। সেখানে সেঁজুতি বড়ুয়ার এই যে নিজস্ব ত্বরীকায় চলাচল, আমার মতো নগণ্যজনের কাছে অত্যন্ত খুশির খবর। এটা সাহিত্যের সত্যিকারের খেদমত করা…
তবে এই খেদমতে আনন্দ আছে। কেননা সবুজের দিকে তাকালেও দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। আর সেখানে সেঁজুতি বড়ুয়ার সবুজযাপন বড় তৃপ্তি ও পুলকসঞ্চারের-

ক.
জানি না তেমন গৌরি কিনা আমি
শোকের স্তবকগুলি শুধু তোমারই বৃক্ষমূলে রাখি
তপস্যায় উন্মুখ থাকি কখন ফোটাবে ফুল মনের মুকুরে!

– অনুবার্য শীত ৩ ; ৩৩ পৃ.)

খ.
কনকনে শীতলতা নিয়ে পৌষের সকাল
ঠিকই সলজ্জ হাসিতে শরীরের প্রতি বাঁকে
হরিণ হৃদয়ে মাদকতা ছড়িয়েছে
ভবঘুরে পাতার মুকুটে,হলুদ সর্ষে ক্ষেতে
বিকেল — দুপুরটুকু গিলে আদিম অন্ধকারে
শীতার্ত উষ্ণতায় ধেয়ে আসছে হন্তারক মাঘ!

ভালোবাসা দৌড়ে পালাচ্ছে, ভালোবাসা পালানোর আগে / ওম ছড়াচ্ছে

– আবেশ; ৩৫ পৃ.)

তিন.

আধুনিক কবিতা মানে ভাবের ঘোড়া নিয়ে শব্দের মাঠে পরিভ্রমণ করা। এখানে তাল, লয়ের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার থাকে। যদি বলি, দমের নাচন বা জিকির; এটাই ছন্দ। দমের সঠিক ব্যবহার না হলে এটাকে হার্ট ব্লক বা অ্যাটাক বলি। ঠিক,তেমনি আধুনিক কবিতাকে দমের খেলায় খেলিয়ে লিখতে হয়। তারপরে আসে,শব্দের কারুকাজ। এরপরে উপস্থাপনায় যথোপযুক্ত উপমা আর চিত্রকল্পের বিবিধ রসায়নে কবিতা শরীরের গঠন। মূলত উপস্থাপনায় একেকজন পৃথক হয়ে যায় শেষপর্যন্ত; এই যে,উপস্থাপনার কথা বলছি মানে কবিতাকে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে প্রকাশ করার কথা। এখনকার কবিতায় কবিরা উপমা আর চিত্রকল্পে ভাসান দিয়ে পরোক্ষভাবে অর্থ্যাৎ এক সত্যকে অন্য সত্যে প্রকাশ করে। এটাকে আমরা পরাবাস্তববাদ বলছি। সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতায় পরাবাস্তবাদের সযত্ন মাধ্যম অথচ কোনো কবিতায় আলগা ভাব ধরা দেয় না। কেননা মাটি ও মানুষের কথা বলায় কবিতাগুলোকে পাঠকের খুব চেনা চেনা লাগে। আধনিক কবিতায় আমরা প্রতীকের নানারকম প্রয়োগ দেখছি। কোনো সন্দেহ নেই একটি যথাযোগ্য প্রতীকই একটি কবিতাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। সেঁজুতি বড়ুয়ার এই ” হৃৎ” কবিতার বইটিতে এমন অনেক প্রতীকের ব্যবহারের চমৎকারিত্বের উদারহরণ দেওয়া যায়। অথচ সেঁজুতি বড়ুয়া কবিতার রাজ্যে প্রায় দেড়যুগের বেশি পদচারণের পরে প্রথম বইটি প্রকাশ করলেন এই ১৮’সালের বইমেলায়। এই যে,দীর্ঘ সময়ে নিজেকে বারবার ভাঙা- গড়ায় মেতেছিলেন; এটার অসামান্য ফসল ” হৃৎ”….এ কবিতার বইয়ের কোনো কবিতাই একবার পড়ে আরেকটা কবিতায় যাওয়ার ত্বরিত ইচ্ছে কোনো মনমরা পাঠকেরও হবে না। মনে হবে,আবার পড়ি এবং আবার পড়েই,আবার বলবে – আবার পড়ি…
সেঁজুতি বড়ুয়ার সম্পর্কে এতোকিছু বলার পরেও বলতে হয় – সেঁজুতি বড়ুয়া সহজ সরল প্রেমের কবি। কোনো আলগা অহংবোধ নেই। ভালোবাসার জয়গাঁথাই কেবল ” হৃৎ”….
সমসাময়িকতাও সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতাই ধরা দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত সত্য ভাষণে। “আমেন” কবিতাটি পড়লে সাম্প্রতিকতম বিউটির ধর্ষণ ও হত্যার কথা পাঠকের চোখের সামনে ভাসবে। তাছাড়া দেশচিন্তায় সেঁজুতি বড়ুয়ার বিমূঢ় উচ্চারণ পাঠকের কাছে অতুলনীয় পাঠ,অত্যন্ত সংবেদনশীল আর মর্মপীড়াদায়ক ।

আমাদের রক্তের মধ্যে — মধ্যাহ্নের
স্রোতস্বিনী পদ্মা দুর্মর কলকল জলোচ্ছ্বাসে
মরীয়া হয়ে দু’ ভাগ প্রশ্নের কাছে নিজেকে
ছুঁড়ে মারে… গোধূলি লগ্নের কোনো দ্রুতগামী
এক্সপ্রেস ট্রেন দূরের আকাশে উড়ন্ত পাখির
ঝাঁকে ” স্বাধীনতা” শব্দের এক অস্তগামী
সূর্যকে অকস্মাৎ অসীমের মাঝে ডুবে যেতে দ্যাখে!

– আমাদের রক্তের মধ্যে; ৪৮ পৃ.)

চার.

ঝরঝরে গদ্যছন্দে শানিত বোধের পরিশালিত কবিতা লিখতে সিদ্ধহস্ত সেঁজুতি বড়ুয়া। তাঁর প্রথম ও একমাত্র কবিতার বই ” হৃৎ” পাঠের পর এমনটাই মনে হয়েছে। তাঁর কবিতায় বোঝাপড়ার মধ্যে আন্তরিক এক হৃদয় টানাটানি থাকে। এটাই তাঁর কবিতার প্রধান শক্তি। অন্তত এ সময়ে এমন কবিতা খুঁজে পাওয়া কাব্যপিপাসুদের কাছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জল। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি,সেঁজুতি বড়ুয়া তাঁর নিজস্বতার ভুবনে এই চলাচলকে দিনদিন আরো অর্থবহ ও সুখকর করে তুলবে পাঠকের জন্যে –

ক.
পাশের বাড়ির মানুষগুলো কানে খাটো?
বিরুদ্ধবাদ, বিরুদ্ধমত, ঈর্ষাকাতর!
তলে তলে ঘোর পলিটিক্স
সুবিধাবাদী…
নিন্দা যেন মুখের চাপায় দিনে রাতে
তা নইলে সংগৃহীত তথ্যে কেমন ফিসফিসানি
— ‘ফুটপাত ওপরে ওঠে কপাল জোরে!’
— ‘ধারণাটা নিখুঁত, তবে ঘুষ খেয়েছে! ‘
— ‘মেয়েটা কি একই ধর্মের? ‘
— ‘জন্মেছে দ্যাখ – শীর্ণকাঠি বোবা ছেলে!’
— ‘বলিস্ কি তুই, শাদী হয়নি… কাবিননামাও!’

– প্রতিবেশী ; ৪২ পৃ.)

খ.
নিরুত্তর সন্ধ্যায় নিঃশব্দ ফুটপাতে
ঝাঁপি খুললেই — পাঁজরের হাড়ে
কাঠঠোকরার জিভে হলুদ বিকেলটাকে
লাজুক বসন্ত — ভীষণ আঁকড়ে ধরে!

– খাঁজকাটা বসন্ত; ৩৯ পৃ.)

গ.
হাড়ের বেদনা ক্রন্দনে বাজে
উত্তাপে ফোটে মন বেলাভূমি
গাছ হয়ে যাই
লজ্জায় মিশি
ঢেউ হয়ে উঠি পূর্ণ গ্রহণে!

– দহনের প্রতিশিল্প ; ৪৪ পৃ.)

ঘ.
জানি,কৃষকের গরু গেলে সেও যায়
পুড়ে যেতে চিতার অনলে….

– হৃৎ; ১৫ পৃ.)

ঙ.
পৃথিবী তাহলে রাতের বেলা পৃথিবীতে নামে!

ঝোপঝাড় ভেঙে নামে,নামে অথবা বাতাসে চেনা
পথঘাট চিনে নিতে অসুবিধা হয় বলে — উঁচু শিং
কালো মোষ নড়নচড়নে সাড়া দিতে ছোট পথে
সে কী এক অনুভবে,মন্ত্রবলে,পৃথিবীর টানে…

– পৃথিবীকাব্য; ১০ পৃ.)

পৃথিবীর জলে – মাটিতে জড়াজড়ি করে থাকুক সেঁজুতি বড়ুয়ার কবিতার সুললিত শব্দরাজি। সবুজের মায়ায় দৃষ্টিশক্তি বাড়ুক আর সুস্থ রাখুক কাব্যপিপাসুদের  হৃৎ…’

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

খান কাওসার কবির on লুৎফর রহমান রিটন নামা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা