মুনীরা বশীর
শুভ জন্মদিন দাদা।
জ্ঞানতাপস, বহু ভাষাবিদ, ভাষা বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ড. শহীদুল্লাহর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়, সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী নামে এক কামিল দরবেশ চতুর্দশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন। পীর গোরাচাঁদ নামেও তিনি পরিচিত। ১২৬৫ সালে পবিত্র মক্কানগরে এই সাধকের জন্ম। কারো কারো মতে তিনি হযরত শাহজালালের (রহ) ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম। হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের মাজার অবস্থিত। শহীদুল্লাহ সাহেবের আদি পুরুষ শেখ দারা মালিক এই দরবেশ সাহেবের প্রধান খাদেমরূপে হিন্দুস্থান থেকে এ দেশে আগমন করেন এবং তাঁর দরগাহের বংশানুক্রমিক খাদেমরূপে বহাল হন। ইনিও একজন কামেল দরবেশ ছিলেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের রক্তে এই কামেল দরবেশের রক্তধারা এবং পীর গোরাচাঁদের রুহানী ফায়েজ প্রবাহিত হয়েছিল। গ্রামের পাঠশালাতেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পাঠশালার পড়া শেষ করে তিনি হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর বই পড়ার দারুণ নেশা ছিল। সেই সময় থেকেই তাঁর ভাষা শেখার আগ্রহ জন্মে।
তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তার বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তার মা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিলো প্রবল আগ্রহ। একটু বেশি বয়সেই স্কুলে গিয়েছিলেন তিনি। পড়তে অসম্ভব ভালো লাগতো তার। সে ভালোলাগা এমনই যে চারপাশের সব কিছুই ভুলে যেতেন তিনি। এমনকি নাওয়া-খাওয়ার কথাও মনে থাকতো না তার। পড়তে পড়তে কখন যে স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে সে খেয়ালও তার থাকতো না। তিনি কমপক্ষে ২২টি ভাষা জানতেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবি-ফার্সি-উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন।
আজকে অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলছি যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হননি। তাঁর ছাত্র এবং বন্ধুরা উপাচার্য হয়েছিলেন। এমন কী তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি জীবনে পূর্ণ অধ্যাপকও হননি। তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) রূপে অবসর গ্রহণ করেন। এমন কী তাঁর স্বপ্নের ফসল বাংলা একাডেমির সভাপতি পদেও তাঁকে আসীন করা হয়নি ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারও তাঁর কপালে জুটেনি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অশুভ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন।
অথচ তিনি মনে–প্রাণে বাঙালি ছিলেন বলেই ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে বলছেন:
“হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাঙালী জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। বাঙালী হিন্দু বাঙালী মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারিবে না। বাঙালী মুসলমান বাঙালী হিন্দু ব্যতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি এভাবেই যাইবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালী জাতি, ফরাসী, ইংরাজ, ইতালিয়ান, জর্মন, জাপানী প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে পারিবে।”
আমার বাবা মুর্তজা বশীর দাদার এই উক্তিতে বলেছিলেন – “এ কথাগুলো বাঙালির নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথের বলার কথা, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বলার কথা।তবে তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো ৫৪ বছর পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিত বাঙালি জাতির একটি ভূখণ্ড স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে।”
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর ধর্মসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত উদযোগী ছিলেন। তাঁর মতে, পর্দা দু’রকম। এক রকম হলো- ইসলামিক পর্দা, সেটি হচ্ছে মুখ হাত-পা ছাড়া সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা, আর এক রকম হলো- অনৈসলামিক পর্দা, সেটি মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে চিরজীবনের জন্যে কয়েদ করে রাখে। ইসলামি পর্দায় বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরুনো কিংবা অন্যের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বলা মানা নয়; তবে অনৈসলামী পর্দায় এসব হবার জো নেই। সবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এই অনৈসলামীক পর্দা সরিয়ে দিতে। তা না হলে সবার নারীহত্যার মতো মহাপাপ হবে। নারী যে মসজিদে যেতে পারে, পুরুষের ইমামতিতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং শুধু প্রাচীন আরবে নয়, মুসলিম আমলের বাংলাদেশেও যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল, তিনি তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঢাকায় মেয়েদের জামাতে তিনিই প্রথম ইমামতি করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে দাদার মৃত্যুর এক কি দুদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ‘শেষের পাতা’র কলামে হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি জাতির উদ্দেশে কি কিছু বলবেন। তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে যে কথাটি বলেছিলেন, তা তাঁর আজীবনের সাধনা বাংলা ভাষায় নয়, ছিল ইংরেজিতে: ‘আই উইল সুন বি ফরগটেন’। আজকে মনে প্রানে বিশ্বাস করি দাদার ভবিষ্যৎ বাণী সঠিক ছিল।
১৯৮০ সালের সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পদক এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন।
বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে তাঁর জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করে না।
এ লজ্জা জাতির…
২.
আজ ১৩ই জুলাই জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্’র ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, এবং গবেষক। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন দিকপাল ছিলেন। “যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না” এই বিখ্যাত উক্তিটি তার। বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলতেন ‘আমি বাংলা ভাষাই জানি।’
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র স্ত্রীর নাম মরগুবা খাতুন। তিনি সাত পুত্র ও দুই কন্যার জনক। মাহযূযা খাতুন, আবুল ফযল মুহম্মদ সফীয়্যুল্লাহ, মাসরুরা খাতুন, আবুল কালাম মোস্তফা ওলিয়্যুল্লাহ, আবুল করম মাহমুদ যকীয়্যুল্লাহ, আবুল জামাল মুহম্মদ তকীয়্যুল্লাহ, আবুল বয়ান মুজতাবা নকীয়্যুল্লাহ, আবুল ফযল মুতাওয়াক্কিল রাযীয়্যুল্লাহ, আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ ওরফে মুর্তজা বশীর।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর ধর্মসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত উদযোগী ছিলেন। তাঁর মতে, পর্দা দু’রকম এক রকম হলো- ইসলামিক পর্দা, সেটি হচ্ছে মুখ হাত-পা ছাড়া সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা, আর এক রকম হলো- অনৈসলামিক পর্দা, সেটি মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে চিরজীবনের জন্যে কয়েদ করে রাখে। ইসলামি পর্দায় বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরুনো কিংবা অন্যের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বলা মানা নয়; তবে অনৈসলামী পর্দায় এসব হবার জো নেই। সবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এই অনৈসলামীক পর্দা সরিয়ে দিতে। তা না হলে সবার নারীহত্যার মতো মহাপাপ হবে। নারী যে মসজিদে যেতে পারে, পুরুষের ইমামতিতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং শুধু প্রাচীন আরবে নয়, মুসলিম আমলের বাংলাদেশেও যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল, তিনি তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঢাকায় মেয়েদের জামাতে তিনিই প্রথম ইমামতি করেছিলেন।
বাবা মুর্তজা বশীরের কাছে শুনেছি – আজীবন উদ্যমী আমার দাদা সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভাল হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো।’ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। দাদা ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন – শ্রদ্ধেয়া মাতা হরুন্নেছা খাতুন এবং প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মোসাম্মৎ মরগুবা খাতুনের মাঝখানে ঐতিহাসিক পারিবারিক কবরস্থান, নীলক্ষেত বাবুপুরা, বাককু শাহ মাজারে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার। আমার দাদার ওসিয়ত উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তাঁর সমাধিস্থল সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খুবই অবহেলিত অবস্থায় পরে আছে।
১৯৬৯ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র মৃত্যুর এক কি দুদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ‘শেষের পাতা’র কলামে হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি জাতির উদ্দেশে কি কিছু বলবেন। তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে যে কথাটি বলেছিলেন, তা তাঁর আজীবনের সাধনা বাংলা ভাষায় নয়, ছিল ইংরেজিতে – আই উইল সুন বি ফরগটেন’। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে তাঁর জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করে না!
আল্লাহ দাদাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।