এনামূল হক পলাশ
একটা জাতির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ইতিহাস বিলুপ্ত তারাই করতে চায় যারা ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিতে চায়। বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হটিয়ে নয়া ব্যবস্থা কায়েমের জন্য এই দেশের কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মী সহ আপামর জনতা মাঠে সরব ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হন। এই ঘটনায় শাসক পালিয়ে যান। পরিবর্তন হয় সকল সেক্টরে। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদ আজম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। সে প্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটা নয়া সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলা একাডেমি তার বিগত দিনের পাপ মোচন করবে। তারা অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে ব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের কবিতা সংকলন প্রকাশের মাধ্যমে সে তার স্পিরিটকে জানান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের অভ্যুত্থান বিরোধী শক্তিকে পূনর্বাসনের প্রজেক্ট। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে জুলাইয়ের কবি লেখক শিল্পীদের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করাই এদের মূল মিশন। সংকলনে জুলাইয়ের অধিকাংশ তরুণদের লেখা স্থান দেয়া হয় নি। এরা বলার চেষ্টা করছে,
“যে কবিতা— কবিতা হয়ে উঠেছে সেগুলোই সংকলনে স্থান পেয়েছে।”
ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের অংশীজনের যে এক অটো তালিকা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। অভিযোগ আছে যে, এই সংকলনে ঢুকে গেছে অভ্যুত্থান বিরোধী কিছু লেখক। এরকম একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এর দায় স্বীকার না করে সাফাই গাওয়ার মানে হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করা। আজকের তরুণ লেখকরা ভবিষ্যত প্রভাব বিস্তারকারী লেখক হবেন। অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা কি ছিল এই প্রশ্নগুলো তখন সামনে আসবে। আমরা হয়তো তখন সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আর জীবিত নাও থাকতে পারি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এর কারণ হচ্ছে, এই তালিকা যাদের করার কথা ছিল তারা করেন নি। রাজাকার গোত্রীয় তালিকাও সঠিক সম্পন্ন হয় নি। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকেও এখন সন্দেহের মধ্যে থাকতে হয়। তালিকা না হওয়ার কারণে শুধুমাত্র মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিলেন এমন ব্যক্তিকেও রাজাকার বলে গালি দেয়া হয়। আবার প্রকৃত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে বুক ফুলিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যাই হউক এইসব ইতিহাস সুকৌশলে বিকৃত করা হয়েছে। এখন আমাদের চোখের সামনে আরেকটি ইতিহাস বিকৃতির প্রক্রিয়া চলছে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম।
আমরা এই সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করি। এদের কাজে এদেশের আপামর বৈষম্য বিরোধী কবি লেখক শিল্পীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যে উদ্যোগ বাংলা একাডেমির গ্রহণ করার কথা ছিল সেরকম উদ্যোগ ইতিমধ্যে দুইটি লিটল ম্যাগ এর সম্পাদক গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশে প্রথম জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে সংখ্যা করেন কবি শাদমান শাহীদ। তার ম্যাগাজিনটির নাম হচ্ছে ‘বৃত্তান্ত’ [ প্রকাশকাল : আগস্ট ২০২৪] । পরবর্তীতে মনসুর আজিজ সম্পাদিত ‘আড্ডাপত্র’ [ প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৫] বের হয়। অনলাইন সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত ‘বাংলা রিভিউ’ শুরু থেকেই অভ্যুত্থানের পক্ষে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি একটি সংখ্যাও [ বাংলা রিভিউ : ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংখ্যা। প্রকাশকাল : জুলাই -আগস্ট ২০২৪] প্রকাশ করে প্রচার করেছেন। ঠিক এর বিপরীত কাজ করেছে বাংলা একাডেমি। জুলাই অভ্যুত্থানকে তোয়াক্কা না করে মোহাম্মদ আজমের নেতৃত্বে ফ্যা/সি/বা/দী শক্তিকে পুনর্বাসনের কাজে লিপ্ত হয়েছে। মোহাম্মদ আজম দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলা একাডেমির কোন গুণগত মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বরং বিগত অপশাসনের আমলে চাটুকারেরা বহাল তবিয়তে আছেন। এই অভিযোগ এই প্রজন্মের সকল তরুণ লেখকদের। তাহলে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক, মোহাম্মদ আজম কি অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বিলুপ্ত করার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন?
২.
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল। একটা বৈষম্যহীন সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে আমাদের মননের বিকাশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলা একাডেমিতে এমন একজন অথর্ব মহাপরিচালক বসানো হয়েছে যিনি জুলাইয়ের পক্ষের লেখকদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। তরুণ লেখকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী এই মূর্খ আসলে বুঝেনই না সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মূল স্পিরিট কী। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করলেই যদি সংস্কৃতিমান হওয়া যেতো তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যের লেখকরা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হতে হতো। রবীন্দ্রনাথ থেকে আল মাহমুদ কিংবা লালন থেকে উকিল মুন্সিকে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হতে হতো। এ এতোটাই মূর্খ যে দুইজন রাজ কবিকে নিয়োগ দিয়েছেন গণ অভ্যুত্থানের কবিতা সংকলনের জন্য। অথচ এই দুইজন রাজ কবির পা অভ্যুত্থানের পর আকাশে বিচরণ করছেন। এরা বুঝেনই না অভ্যুত্থানের পক্ষের সকল কবি ও লেখককে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। আমি মনে করি এই তিনজন প্রথম সাংস্কৃতিক মীরজাফর। দায়িত্ব পেয়ে এরা অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিজেদের সাথে নিতে অনিচ্ছুক। অভ্যুত্থানে মোহাম্মদ আজম কোন ভূমিকা নেন নি। আজমকে প্রমাণ দিতে হবে তিনি ৫ আগস্টের আগে লড়াইয়ে কি কি ভূমিকা রেখেছেন। অন্য দুজন মনে করছেন তাদের লেখা পড়ে হাসিনার পলায়ন ঘটেছে। সরি টু সে, এরা সাংস্কৃতিক ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অনেক তরুণ লেখক চিন্তা করেছিলেন তাদের লেখা হয়তো একটা মলাটে আসবে। তারা ত বাংলা একাডেমি পদক চায় নাই। তারা চেয়েছিল সহযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে। কিন্তু আজম ও তার সহযোগীদের মানসিক সমস্যার কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠে নি। এই দেশে ইতিপূর্বে বহু কবি সাহিত্যিক কোথাও লেখা প্রকাশ না করেই মরে গেছে। তাতে কারো কিছু যায় আসে নি। আমরা চেয়েছিলাম এইসব অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে। কিন্তু এরা যা ঘটাইলো তা গণ অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটকে নষ্ট করেছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র এদের সুবিধার জন্য হয় নাই। হাসান রোবায়েত বা রওশন আরা মুক্তাকে বাংলাদেশ সরকার কবিতা লেখার জন্য ১০০ কোটি টাকা দিলেও আমি কখনো তাদের সমালোচনা করতাম না। এদেরকে বাংলা একাডেমি এমনকি স্বাধীনতা পদক দিয়ে দিলেও আমার আপত্তি নাই। কারণ এরা কেউই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী না, বরং সহযোদ্ধা হলেও হবে হয়তো। কিন্তু এরা যা ঘটাইলো তা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। জুলাইয়ের সাথে এরা প্রতারণা করেছে। রক্ত আর কলমের কালির বিনিময়ে এরা বাংলা একাডেমিতে গেছে। আমি মনে করি এরা বেঈমানি করেছে। প্রতারক আজম এবং তার দুই সহযোগীকে বয়কট করুন।
৩.
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর পরই আমরা বলেছিলাম বাংলা একাডেমি ঘেরাও করে কর্তৃত্ববাদের দোসরদের অপসারণ করতে। আমাদের সহযোদ্ধাদের অনেকেই তখন বলতেছিলেন, যেহেতু সেখানে অনেকের রুটি রুজির বিষয় আছে সেহেতু এতো কঠোর অবস্থান নেওয়া আমাদের ঠিক হবে না। তাদের সেই যুক্তিকে মেনে নিয়ে আমরা আর অগ্রসর হই নি। পরবর্তীতে সরকার এখানে কিছু লোকজন পুনর্বাসন করেছেন। আমরা ভেবেছিলাম এরা আমাদেরই লোক। নিজের যেহেতু চাহিদা নেই কেউ না কেউ ত দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা কি তখন ভুল করেছিলাম?
অভ্যুত্থানের এক বছর পর এই প্রশ্নটা সামনে এসেছে। প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক লড়াইকে এরা রীতিমতো অস্বীকার করছে। অথচ, কথা ছিলো এরা একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা করবে।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা সংকলন ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা’। সংকলনের প্রধান সম্পাদক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন কবি রওশন আরা মুক্তা এবং হাসান রোবায়েত নামের দুইজন অভ্যুত্থানপন্থী কবি। দেশের অভ্যুত্থানপন্থী অনেক কবি সাহিত্যিকের মধ্য থেকে এই দুইজনকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
এই সংকলন নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রকাশিত হওয়ার পর সূচিপত্র দেখে অভ্যুত্থানপন্থী অনেক কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে পোস্ট করে কবিরা তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন।
প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ আজম এবং হাসান রোবায়েত ও রওশন আরা মুক্তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলনটিতে স্বৈরাচারের দোসরদের যুক্ত করা হয়েছে বলে সচেতন মহল অভিযোগ করেছেন। সূচিতে থাকা গুটিকয়েক লেখক বাদে অধিকাংশই আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত অথবা সমর্থক বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল এমন লেখকও এই সংকলনে স্থান পেয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। লেখক ও পাঠক মহল আরো অভিযোগ করছে, বাংলা একাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যে মানের সংকলন প্রকাশ করেছে তাতে উপেক্ষা করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনের মূলধারার কবিদের। একাডেমির মহাপরিচালক এবং সংকলনের সম্পাদকরা এই দায় এড়াতে পারেন না।
এর মধ্যে বাংলা একাডেমি তার পেজ থেকে সংকলনের সূচীপত্র সরিয়ে নিয়েছে। তারপর একজন সম্পাদক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন, “যে কবিতা— কবিতা হয়ে উঠেছে সেগুলোই সংকলনে স্থান পেয়েছে।”
তিনি আরও বলেছেন যে, “প্রচ্ছদ সংক্রান্ত জটিলতায় বইটির বিক্রয় আপাতত বন্ধ আছে, তাই বাংলা একাডেমি ফেসবুক থেকে তাদের প্রাপ্তিস্থানের পোস্ট সরিয়ে দিয়েছে। প্রচ্ছদ আবার ছাপা হয়ে আসা মাত্রই বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্রে বইটি পাওয়া যাবে, অতি শীঘ্রই।”
তার এই পোস্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি যথেষ্ট বেয়াদবির সাথে এদেশের সকল বৈষম্য বিরোধী কবি লেখকদের অবজ্ঞা করেছেন। কবি লেখকদের প্রতি তার উদ্ধত আচরণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাদের এই কাজ পূর্ব পরিকল্পিত। এমন উদ্ধত বক্তব্য এদেশের কোন কবি সাহিত্যিক সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। ফলে সম্পাদকদ্বয়কে অপসারণ করে নতুনভাবে সংকলনটি প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে।
অধ্যাপক আজম সাহেবের ছাত্র হাসান রোবায়েত।
সেই বিবেচনায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এটা ছিল আজম সাহেবের নির্বুদ্ধিতার কাজ।
আজম সাহেব যেমন এ সময়ের কবি ও কবিতার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখেন না, তেমনি তার ছাত্ররূপী সম্পাদকও এ সময়ের কবিদের সম্পর্কে ধারণা রাখেন না।
অর্থাৎ সম্পাদনার যোগ্যতা যেমন শিক্ষকের নেই তেমনি ছাত্রেরও নেই ।
একটা তামাশা করলেন জাতির সাথে।
এই ফাঁকে ঢুকে গেল ফ্যাসিবাদী অনেক কবি ।
বাংলা একাডেমি এই কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না
এটাই আফসোস।