তাজ ইসলাম
কবি মহিবুর রহিম মারা যাওয়ার পর কয়েকটা জাতীয় দৈনিকে ফোন করেছিলাম। সংবাদটি তাদের কানে পৌছানোর পর তাদের সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় যেন সামান্যতম আয়োজন রাখে। দৈনিকের সাহিত্য পাতা পূর্ব থেকেই সাজানো থাকে এটি জানি। বিশেষ সময়ে কিছুটা তাৎক্ষণিক আয়োজনওতো করে মাঝে মাঝে। মহিবুর রহিমের বেলায় কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। অথচ মহিবুর রহিম গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। পরের সপ্তাহেও তাকে আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়নি। রাজধানী কেন্দ্রিক কোন আয়োজন হয়নি, বা হওয়ার নমুনাও আঁচ করা যায়নি। তাকে নিয়ে কোনরকম শব্দ হয়নি তার নিজ জেলাতেও। রাজধানীতে মহিবুর রহিমের পরিচিতজন আছে বিপুল সংখ্যক। সাহিত্য সতীর্থও কম না।
তার মৃত্যুর পরপরই আমি একটি সাহিত্য সভায় উপস্থিত ছিলাম। এটি তাদের পূর্বঘোষিত নিয়মিত সভা। সেখানে তাকে শুধু স্মরণ করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। আমার কর্তৃত্ব থাকলে এই সভাটি মহিবুর রহিমকে উৎসর্গ করে তাকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করতাম। আমি আমার লেখা পাঠের সুযোগ পেলে নিজের লেখা কবিতা পাঠ থেকে বিরত থাকি। আমি পাঠ করি কবি মহিবুর রহিমের কবিতা। উক্ত সভায় আমি সভাপতি ছিলাম। মূল আলোচনার সময় অল্প কথায় কবির পরিচিতি তুলে ধরে তার পারলৌকিক কল্যাণে দোয়ার আর্জি রাখলাম।
কবি মহিবুর রহিম
১৬ জুলাই ২০২৫ দিবাগত মধ্যরাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
তার জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে হাওর অঞ্চল বলে পরিচিত কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামে। পিতা মরহুম আমজাদ হোসেন, মাতা কমলা খাতুন।
এই তথ্যটুকু শুরুতেই যুক্ত করেছি পাঠক যেন সহজে,শুরুতেই জেনে নিতে পারেন একজন কবির দুনিয়ার সফরের পরিমাণটুকু।
মৃত্যুর কোন বয়স নেই, সময়ও নেই। কখন কার সময় ফুরিয়ে যায় কেউ জানে না। কেউ না জানলেও এটা সবাই জানে সময় ফুরালেই বেজে যাবে বিদায় ঘন্টা। মহিবুর রহিমের দেহে রুগ্ন,ভগ্নস্বাস্থ্য বা বার্ধক্যের ছাপ পড়তে দেখিনি। তরতাজা কর্ম পুরুষ হিসেবেই দেখে আসছি। বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় চলে আসতেন সাহিত্য কর্মের তাগাদায়। ঢাকা টু ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাতায়াতে তাকে বয়স্ক বা রুগ্ন মনে হয়নি। সবসময় প্রাণবন্তই মনে হয়েছে। অথচ ভেতরে পুষতেন নানা রোগ। বয়স হয়েছিল।সচরাচর হিসেবে খুব বেশি না,মাত্র ৫২ বছর। এ বয়স সাধারণত থেমে যাবার বয়স না। কিন্তু মৃত্যু তাকে থামিয়ে দিল চিরতরে।
আফসোসের বিষয় হল মহিবুর রহিম চলে গেলেন খুব সন্তর্পণে। মারা যাওয়ার পরও উপেক্ষিত রয়ে গেলেন সাহিত্য মহলে।
মহিবুর রহিমের উত্থান ঢাকার বুকে। কিশোরগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করে কৈশোর কাটিয়েছেন নিজের জন্মস্থানে। তারপর শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্যে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। পড়ালেখা করেন ঢাকা ভার্সিটিতে। যৌবনের উত্তাল সময় অতিক্রম করেছেন ঢাকার বাতাসে আলোতে। শাহবাগের আজিজ মার্কেট বা রাজধানীর সাহিত্য পাড়ায় মহিবুর রহিমদের প্রবল উত্তাপ ছিল তখন। তারা একটা দশকের কাণ্ডারী।
নব্বইয়ের দশকের উত্তর আধুনিকতার নব্বইয়ের শীর্ষ কবিদের একজন মহিবুর রহিম। তারা লিটলম্যাগ আন্দোলনে, সাহিত্য চর্চায় নিজেদের অবস্থান, পৃথক পরিচয় স্পষ্ট করেছিলেন সে সময়ই। তখনই তার কবি প্রতিভার নিজস্বতার জানান দিতে পেরেছিলেন।
মহিবুর রহিম যেন কবি প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন। চর্চা ও সাধনায় সেই প্রতিভা উজ্জ্বল আলোয় উজ্জীবিত হয়েছিল। ঢাকা তার সাহিত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পরবর্তী সময়ে কর্মজীবন তাকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করে। স্থিত হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকার সাথে বাড়ে দূরত্ব। এই দূরত্ব ঘোচাতেই হয়তো তিনি বারবার মোসাফির হতেন ঢাকায়। তবু ঢাকা তার সাথে বিমাতা সূলভ আচরণ পরিহার করেনি।
মহিবুর রহিম নব্বই দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের উল্লেখযোগ্য একজন। তিনি মারা গেছেন, ঢাকার সাহিত্য সমাজে এর কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হয় না।
নীরবে চলে গিয়ে উপেক্ষিত হয়ে আছেন সাহিত্যিক মহলে। কাব্য রাজনীতি, রাজধানী রাজনীতি, কাব্য হিংসায় মহিবুর রহিম পড়েছেন কি না তা অবশ্য কেউ বলছেন না। কেউ বললে খুব সরলভাবে যুক্তি অগ্রাহ্যও করা যাবে না। তবু কবি বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়। এখন তার কবিতাগুলো পাঠকের সামনে হাজির করাই মহিবুর রহিমের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাজ।
তার প্রকাশিত বইগুলো পূন: প্রকাশ এসব কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা সবার আগের কাজ ও দায়িত্ব।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়ানো ছিটানো প্রকাশিত কবিতাগুলো বা লেখাপত্র একত্র করা সাহিত্য সেবকদের দায় ও দায়িত্ব। বাসায় যেসব লেখা আছে সবগুলো একত্র করে রাখতে হবে। কবির নিকটতম বন্ধু স্বজন তার পরিবারকে এসব বিষয়ে আগ্রহী ও দায়িত্ববান করার চেষ্টা করতে হবে।
আমরা তার সব সৃষ্টির সংবাদ জানি না। শুনেছি মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগেও তার সর্বশেষ একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি একজন সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে মহিবুর রহিম কবি হিসেবেই খ্যাত ছিলেন অধিক ।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল
১
‘অতিরিক্ত চোখ’,
২
‘হে অন্ধ তামস’,
৩
‘অনাবাদি কবিতা’,
৪
‘দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র’,
৫
‘সবুজ শ্যামল মন’,
৬.
‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’,
৭
‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’,
৮.
‘হাওর বাংলা’,
৯.
‘নরসুন্দা নদীর দেশে’ এবং
১০.
‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোকসাহিত্য’ প্রভৃতি।
মহিবুর রহিম তার সৃষ্টির জন্য প্রাপ্য ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে সম্মাননা ও পুরস্কার। জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান তা তাকে দেয়নি। তবে জনতা তাকে সম্মান দিতে কসুর করেনি। বরং তারাই জাতীয় অবহেলার জবাব বা সম্মান না দেওয়ার অভাব পূরণ করেছেন।
কবিকে বিভিন্ন সময় সম্মাননা দিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন।
তাকে মৌলিক সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রদান করা হয়–
১.
‘প্রজ্ঞা’ শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পদক’,
২.
‘স্মৃতি’৫২ সম্মাননা’,
৩.
‘রকি সাহিত্য পদক ২০১১’,
৪.
‘মেঠোপথ সাহিত্য পদক-২০১৩’,
৫.
‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহিত্য পদক-২০১৪’
৬.
ও ‘সুকুমার রায় সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা ২০১৮’
কবি মহিবুর রহিম তার সময়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ও তার কবিতার ভাষা,শব্দ,ছন্দ,অলংকার, উপমা,উৎপ্রেক্ষা, কাব্য বিনির্মাণের নিজস্ব সত্তা ও শক্তি চিহ্নিত হয়েছিল শিল্পবোদ্ধাদের চোখে। তাকে নিয়ে আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কবি সাহিত্যিক,শিল্প সমালোচকগণ। তাদের মাঝে আমরা যাদের নাম উল্লেখ করতে পারি তারা হলেন–
‘কবি শামসুর রাহমান , আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ,ড. রাজিব হুমায়ুন, কবি সমুদ্র গুপ্ত, আশুতোষ ভৌমিক, মানিক মাহমুদ,প্রফেসর ড. কামরুল আহসান,ড. ফজলুল হক সৈকত, অধ্যাপক মানবর্দ্ধন পাল, তৌফিক জহুর, নাজমা মমতাজ, কবি মিলি চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম জীবন, ড. রিটা আশরাফ ও ড. ফজলুল হক তুহিনসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখক এবং আলোচকগণের নাম।’
তারা তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। নব্বই দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য সংকলন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা প্রকাশ হতো।
আমরা তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করব অন্য নিবন্ধে।
পাঠকের জন্য এখানে নিবেদন করছি মহিবুর রহিমের কয়েকটি কবিতা। অনেকগুলো কবিতাই একত্র করেছিলাম। লেখার কলেবর সংযত রাখতে অল্প কয়েকটি কবিতাই রাখলাম। কবিতা থাকলেই কবি চিহ্নিত হয়ে যান। কবিতাই প্রকাশ করে কবির কাব্য নির্মাণের প্রতাপ ও প্রতিপত্তি।
কবিতাগুচ্ছ :
ঈদ ও হারানো সোনার পাখি
…………..
কত শত বছর পেরিয়ে গেছে
সময়ের যান্ত্রিকতা পেয়েছে নতুনতর গতি
আমি এই ক্ষুদ্র বুকে ধরে রাখি কত আশা
যা আমার অতি পুরাতন অমূল্য সম্পদ
আমি বুক ভরে রাখি কত প্রেম
যার ডালপালায় কখনো কখনো আসে রঙিন ফুলের সমারোহ
কোথা থেকে একটা সুখের প্রজাপতি উড়ে এসে বসে
আমি প্রায় নির্বাক লোচনে তাকিয়ে থাকি
আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে উপলব্ধি করি
যেন নিস্তরঙ্গ সাগরে জাগে ঢেউ
কত বার অতীতকে একটা হারানো সোনার পাখি ভেবে বিষণ্ণ হয়েছি
কিন্তু আমার আশার চারাগাছে এলো বসন্তের সওগাত
আমি অতীত ও বর্তমানকে দেখলাম এক মহা সম্প্রীতির ময়দানে
যুদ্ধ ভুলে মহা ক্রান্তিকাল ভুলে
মারি ও মড়কের বিষণ্ণতা ঝেড়ে
সে আমাকে টেনে নিয়ে যায়
সেই শহিদি ঈদগাহে
আমি দাঁড়িয়ে থাকি শুদ্ধতম লোকারণ্যে
দেখি আমার অতীত ও বর্তমান
সব রকম ভুল ও বিবাদের রাস্তা পেরিয়ে
মিশে যাচ্ছে পবিত্র প্রাণের সান্ত্বনায়
যেন সত্যি ফিরে এলো সেই হারানো সোনার পাখি
মনে হয় যেন তার গান আমরা কতকাল শুনিনি !
আমি তার পালকের অপার্থিব গন্ধ শুঁকি
তার অনন্য বিশ্বস্ততার বুকে হাত বুলাই
আর অন্যরকম আনন্দে ভেসে বেড়াই…
…………….
ফসল তোলার মওসুম
……………..
তোমার ডান হাতের জন্যে শুভ সংবাদ
এসেছে তার ফসল তোলার মওসুম
বাম হাতের পণ্য দাহ হবে
আর ভার মুক্ত হবে জরাগ্রস্ত তোমার সময়
ইমানের মাটিতে পুঁতে দাও তোমার সংযম
ধৈর্যের উপত্যকায় আবাদ করো সবুজ ঐশ্বর্য
শৃঙ্খলিত অমঙ্গল তোমার সাফল্যে হবে হতাশ
তোমার ভান্ডার ভরে উঠবে পুণ্যের সওদায়
ঝরে যাক তোমাকে ঘিরে কর্পোরেট গ্লানির সফেন
ধৌত করে নাও তোমার মলিন সত্ত¡াকে
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক তাকওয়ার সুবাস।
………….
কালো বিড়ালের চোখে
………….
রাতগুলো চেয়ে থাকে কালো বিড়ালের চোখে
যান্ত্রিকতা খুঁটে খায় আদি সব মাছের কঙ্কাল
পুরনো ভাগাড় যেন শূন্যতায় ভরেছে এখন
আর সব বিড়ালেরা কবেকার মৃত ইতিহাস
অনেক জিজ্ঞাসা আছে ব্যক্তিগত চেতনার গভীর আঁধারে
অনেক ব্যর্থতা আছে ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতার কাছে
সময়ের কর্মসূচি ওই সব দৃশ্যকে বুনেছে
দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিধালিপ্ত চলমান শিল্পকর্মে।
………
সময়
………
মনে হয় সময় ক্রমাগত ভাবেই যায়
আমাদের নিঃসঙ্গ শিথানে
কিছু কিছু দুঃখবোধ
রাত্রিকেও প্রজ্জ্বোলিত করে
যে রাত্রি গাঢ় অনুভূতির রঙ নিয়ে বাঁচে
যে রাত্রি মিশে থাকে আকাক্সক্ষার নির্জন চাদরে
হাহাকার ঝড়ো হাওয়া ডালপালা অগ্নিসত্ত্বা
ছিন্ন ভিন্ন করে
তখনও সময় ক্রমাগত ভাবে যায়
কিছু কিছু চোখ পলকের মূল্য নিয়ে ভাবে
অনশ্বর ফুল হয়ে উঠার আগ্রহ নিয়ে ভাবে
এই ভাবনাগুলো কখনো কখনো নিজস্ব সত্ত্বাও পায়
আবার বিস্মৃতি আসে
ভেঙে পড়ে প্রতিকৃতি নির্জনের আরাধ্য বিশ্বাস
সংক্রান্তির ঝরাপাতা পড়ে থাকে চৈতন্যের বিপন্ন রাস্তায়।
মহিবুর রহিমের কবিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। বহুমাত্রিক আলোচনা হওয়া জরুরি। নানাভাবে হতে পারে এ আলোচনা। সাহিত্যের খাদেমগণ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে করতে পারেন এ আলোচনা, করাতেও পারেন সাহিত্য নিয়ে যারা নিবেদিত তাদের দিয়ে। তিনি প্রভাবশালী কবি তা প্রমাণ হবে নিঃসন্দেহে সেসব আলোচনায়। মহিবুর রহিমের ইন্তেকাল পরবর্তী সময়ে তারই সতীর্থ কবি ও গল্পকার মহিবুর রহিমের একটি কবিতার আলোচনায় তুলে ধরেছেন একজন কবিকে।
তিনি লেখেন–
‘কবি মহিবুর রহিম নব্বই দশকের একজন প্রতিভাবান কবি। এর মানে তার গুরুত্বপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে। এমনটাই আমাদের সাহিত্য বিবেচনার পরিচিত ধারা। তিনি আলোচিত কবিদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত। এরও বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে এ দেশে সম্ভাবনাময় কবিরা সাংস্কৃতিক রাজনীতির শিকারই হয়েছেন বেশি। মহিবুর রহিমও হয়তো তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আমার আজকের আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমি কবির প্রথম দিকের একটি কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। যেটি তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘অতিরিক্ত চোখ’-এ অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটির রচনাকাল সম্ভবত ১৯৮৮ সাল হবে। সে সময়ই তার লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। কবিতাটি হচ্ছে ‘অসুখ-১’। দুটি কবিতা একই নামে হওয়ায় এমন নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। প্রকৃত নামকরণ ‘অসুখ’ ধরে নেওয়া যেতে পারে। গত কয়েকদিন ধরেই কবিতাটি পড়ছিলাম। একটি সিরিয়াস কবিতার নিবিষ্ট পাঠ অনেক সময় কবিতাটির শৈল্পিক চেতনায় প্রবেশে সহায়ক হয়ে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সমসাময়িক ঘটনাবলী, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষত কাশ্মীর পরিস্থিতি, আসামের তথাকথিত ঘজঈ নামে ১৯ লাখ নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া, রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হয়ে আছে, এসব ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে গোটা এশিয়ায় একটি অসহনীয় উদ্বেগ সচেতন মানুষ মাত্রকেই কুরেকুরে খাচ্ছে। ভারতের রাজনৈতিক গতিধারা শুধু উদ্বেগজনক পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেনি, সমূহ সর্বনাশের বাঁশি বাজিয়ে চলেছে অনবরত। সেটি পরমাণু যুদ্ধের হুমকি। দুশ বছরের পরাধীনতা থেকে সুদীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকারী ভারতবর্ষের মানুষজন এখনো স্বাধীনতার সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ পুরো অঞ্চলের মানুষ এখন অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে। যা পরাধীনতার সময়কাল থেকেও দুঃসহ। এ পরিস্থিতিতে আমি যখন আমার প্রিয় কিছু গান শুনি ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রু জলে।’ কিংবা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার, ওহে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুশিয়ার।’ আমার বুক কেবল ভার হয়ে আসে। মনে হয় এত রক্তক্ষয় এত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা কি তাহলে ব্যর্থ?’
(মহিবুর রহিমের কবিতা
‘অসুখ’ ও সমসাময়িক কাল:
শাদমান শাহিদ,। দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫)।
দিন যত যাবে তাকে তুলে ধরার দায় তত বেশি বর্তাবে মহিবুর রহিমের সতীর্থদের কাঁধে। মহিবুর রহিম চলে গেছেন। তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত না করলে আমরা ভারী করব আমাদের ঋণ। আমরা মহিবুর রহিমকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে লেখাটি এখানেই সমাপ্ত করলাম।
…………
তথ্যঋণ:
মেঠোপথ ওয়েবজিন
বাংলা রিভিউ ওয়েবজিন
দৈনিক যুগান্তর
দৈনিক ইনকিলাব
দৈনিক ইত্তেফাক