spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকঅভ্যুত্থানে চূড়ান্ত বিজয়ে আমার দেখা নেত্রকোণা শহর

অভ্যুত্থানে চূড়ান্ত বিজয়ে আমার দেখা নেত্রকোণা শহর

  • এনামূল হক পলাশ

৫ তারিখ বুঝতে পারলাম আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী আর গণহত্যার ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দী থাকলেও তাদের সমর্থন ছিল ছাত্রদের পক্ষে। এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হলো নেত্রকোণা শহরের মানুষ। লাখো জনতা নেমে পড়েছে রাস্তায়। এতো মানুষ, এতো চেনা অচেনা মানুষ একত্রে আমি কখনো দেখিনি। সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে যেন বিজয় উদযাপন করছে।

প্রথমেই আমার মনে হলো এই দৃশ্য যদি আমার স্ত্রী সন্তানকে না দেখাই তাহলে জীবনের এই মহান দৃশ্য দেখা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। মোটর সাইকেলে আমরা বের হলাম। বাতাসে মুক্তির স্বাদ। রাস্তায় মানুষের ঢল। আওয়ামী লীগ অফিসে কারা যেন আগুন দিয়েছে। থানার সামনে অনেক লোক পাহাড়ায় যুক্ত হয়েছে যেন কেউ থানা আক্রমণ করতে না পারে। প্রশাসনের সকল অফিসার আত্মগোপনে চলে গেছেন। আমাদের ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে বললাম, “বাবা, এখান থেকে শিক্ষা নিও। কখনো মানুষের ঘৃণা অর্জন করবে না, জুলুম করবে না। জালিমের কি পরিণতি হয় তা দেখানোর জন্য তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি।”

আমাদের ছেলে ইতিপূর্বে আমাকে গোপন করে কোটা বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে গিয়েছিল সেই ১৭ তারিখেই। আমি নেত্রকোণা শহরে চলে এসেছিলাম কর্মস্থল ত্যাগ করে। সেদিনই আমি হাসিনার পতনের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম। সরকার পতনের অনিবার্যতা আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল এবং আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে মাঠে ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিল সায়েম, তানভীর, নাদিমের নেতৃত্বে সংগঠিত ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ। নিয়মিত যোগাযোগ চলছিলো ঢাকায় কবি পলিয়ার ওয়াহিদ আর কবি অনার্য শান্তর সাথে। ঘন্টার পর পর ঘন্টা আলোচনা হচ্ছিল চিন্তক অনুপ সাদীর সাথে। মাঝে মাঝে চিন্তক আনোয়ার স্যারের সাথে কথা হচ্ছিলো। আমি, চিন্তক অনুপ সাদি, চিন্তক আনোয়ার হাসান প্রতিদিন ভাবতাম হাসিনা কবে যাবে। আমি আর সাদী মনে করতাম হাসিনাকে বিদায় করতে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজন হতে পারে। আমি ছাত্র ইউনিয়নকে সর্বাত্মক সহায়তা ও মানসিক শক্তি যোগাচ্ছিলাম। সারা শহর নিরব অথচ উত্তেজনায় টান টান। শহরের অধিকাংশ মানুষ মনে মনে হাসিনাকে পরিত্যাগ করে। হাসিনা বিরোধী চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বুঝা যাচ্ছিলো, যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা গোপনে আমার সাথে উত্তরা হোটেলের সাথে একটি মার্কেটের একটি রুমে দেখা করত। এর মধ্যে পলিয়ার ঢাকা থেকে ৪ আগস্ট আমাকে জানালো, হাসিনা সম্ভবত পলায়ন করেছে। ফোন পেয়ে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল হাসিনা পলায়ন করেছে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সুদিনের জন্য অপেক্ষা করতে বলি। আমাদের আড্ডাগুলোতে প্রায় প্রতিদিন উপস্থিত থাকতো প্রথম আলো পত্রিকার নেত্রকোণা প্রতিনিধি পল্লব চক্রবর্তী। সে কখনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করতো না। নিরবে আমাদের কথাগুলো শুনে যেতো। সেই সময়গুলোতে আমার আড্ডার অধিকাংশ বন্ধু ও অংশীজনরা আমাকে পাগল হয়ে গেছি মনে করতে থাকল। শুধুমাত্র পল্লব মাঝে মাঝে বলতো, পলাশ ভাইয়ের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মত না। এমন পরিস্থিতিতে চলে আসল ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই।

স্ত্রী আর ছেলেকে বাসায় রেখে আসার পথে মোক্তারপাড়া এলাকায় একজন মা কে পেলাম তার দুই কন্যা সন্তান নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন। তাকে বলতে শুনলাম, “আল্লাহর রহমতে ফেরাউনের পতন হয়েছে। আমরা মুক্ত বাতাসে ঘুরতে পারতেসি।”

শহরে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। ছাত্রজনতা তাদের দিকে হাত ওড়াচ্ছিল। সেনাবাহিনীর কতক সদস্য হাত উঁচিয়ে প্রতি উত্তর দিচ্ছিলেন। যমুনা টিভির সাংবাদিক ও কবি কামাল হোসাইনকে উপরে উঠিয়ে একদল ছাত্র জনতা উল্লাস প্রকাশ করে অভিনন্দন জানায়। বিএনপি, হেফাজত, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ শহর রক্ষার টহলে নেমেছেন। প্রশাসন নেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই। তবুও যেন এক অসম্ভব শৃঙ্খলা। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মীর ফরেন ফার্নিচার, দুর্গা কেবিন মিস্টির দোকানে কিছু সুযোগ সন্ধানী দুর্বৃত্ত লুট করে। পরবর্তীতে জানা গেছে দুদিন আগে যারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঘুরেছে ছাত্রলীগের হয়ে তারাই এ ঘটনার সাথে যুক্ত। এর সাথে রাজনৈতিক কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীদের বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করা হলেও কোন হতাহতের ঘটনা ঘটে নি। এদিন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সকল প্রকার ভাংচুরের চেষ্টা প্রতিহত করেছেন।

স্ত্রী ছেলেকে বাসায় রেখে আবার রাস্তায় নামলাম। শহরের আগুন থামাতে হবে। ইতিমধ্যে নাজু ভাইদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অফিসের আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। কারণ এই আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে বড়বাজার ও ছোটবাজারের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বড় বাজারের লোকজন সংগঠিত হয়েছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে। মোক্তারপাড়ার গলিতে গলিতে টহল চলছে যেন কেউ ভাংচুর করতে না পারে। তারপরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা কেউ কেউ ঘটিয়েছে পূর্ব শত্রুতার জেরে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

তারপর থেকে আমাদের মাথায় এসেছে, যে কোন মূল্যের বিনিময়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সকলের সম্মিলিতভাবে মাঠে থাকতে হবে। বিএনপি, হেফাজত, জামায়াত, প্রগতিশীল দলমত নির্বিশেষে এই কাজটি করে গেছেন অভ্যুত্থানের পরবর্তী আরও কমপক্ষে এক সপ্তাহ। তখন এদেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না।

লেখক – কবি ও ভাবুক।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
- Advertisment -

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

--অতনু রায় on কবিতাগুচ্ছ
তনজিম আতিক on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on না
খান কাওসার কবির on লুৎফর রহমান রিটন নামা