নজওয়ান দারবিশ প্যালেস্টাইনের জেরুজালেমের কবি। জন্ম ১৯৭৮ সালে জেরুজালেম, প্যালেস্টাইন। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে আরব দুনিয়ার মানুষের যে মানসিক ও ভৌগোলিক রূপান্তর হয়েছে, তা আরব কবি- পুরাতন ও নতুন প্রায় সবারই ভাবনার ভিতকে নাড়িয়ে চেতনাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, কবিতায় এনেছে নতুন সংজ্ঞা। তার আগে আরবি সাহিত্য ক্লাসিক্যাল ও রোমান্টিক ধারায়, প্রেম বিরহ আর নারীর সৌন্দর্য বন্দনায় লিরিক্যাল কবিতার সয়লাব ছিল। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর বাইরের শত্রুর আক্রমণ কীভাবে অনুভবের চোখ আর বোঝার অন্তর্দৃষ্টিকে একদম উপড়ে ফেলে দিতে পারে, কীভাবে হারানো রাজ্য ফিরে পাবার মর্মবেদনা আরব কবিদের মানসিকতাকে টান টান করে রাখতে পারে- তা সেই সময়ের কবিরা বুঝেছিল জীবন দিয়ে। এই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা বুঝেছিল যে বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে তারা শুধু ভূমি হারানোর জ্বালায় পুড়বে না, বহিঃশত্রুর শাসন ত্রাসনে, তাদের অবিচার অত্যাচারে আরবরা অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়বে। রাজনৈতিকভাবে এই যে তাদের উপর হঠাৎ ’দখলদারি’ এই জুলুম, তা কবিতার ভাষা চিরদিনের জন্য পাল্টে দেয়। নজওয়ানের কবিতাও ব্যতিক্রম নয়। তার কবিতায় মাহমদু দারবিশের প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং এডোনিসের ভিশন ও পরাবাস্তববাদি ইমেজেরি লক্ষ্য করা যায় ।এ পর্যন্ত আরবি ভাষায় তার আটটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এবং তাঁর কবিতা বিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত কবিতার বই নাথিং মোর টু লস (এনওয়াইআরবি পোয়েটস, ২০১৪) এবং এক্সজস্টেড অন দ্য ক্রস (এনওয়াইআরবি পোয়েটস, ২০২১) তাকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি এনে দিয়েছে। নজওয়ান দারবিশকে আরবি ভাষার বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম কবি হিসাবে ধরা হয়।
জেরুজালেম
তোমাকে যখন ছেড়ে চলে আসি আমি পাথর হয়ে যাই।
যখন আবার ফিরে আসি তখনো আমি পাথর হয়ে যাই।
আমি তোমার নাম রাখি মেডুসা,
আমি তোমার নাম রাখি সোডম ও গোমোরার বড় বোন।
তুমি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষার জলপাত্র- যা রোমকে পুড়িয়ে দিয়েছে।
নিহতরা কবিতা গুঞ্জন করে পাহাড়ে,
বিদ্রোহীরা তাদের গল্প বলার লোকদের তিরস্কার করে।
আমি সমুদ্রকে পিছনে ফেলে ফিরে আসি তোমার কাছে,
ফিরে আসি তোমার হতাশার মধ্যে বয়ে যাওয়া-
ছোট্ট নদীর মধ্য দিয়ে।
আমি কুরআন তিলাওয়াতকারি ও মৃতদেহের কাফনের শব্দ শুনি।
শুনি মাতমকারীদের ধুলিবালির ঝংকার।
আমি এখনও ত্রিশ হই নাই, কিন্তু তুমি আমাকে বারবার কবর দিয়েছ
আর আমি প্রতিবার তোমার জন্য পৃথিবী-গর্ভ থেকে বের হয়ে আসি।
আমি তোমার নাম রাখি মেডুসা,
আমি তোমার নাম রাখি সোডম ও গোমোরার বড় বোন
তুমি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষার জলপাত্র- যা এখনো জ্বলছে।
তোমাকে যখন ছেড়ে চলে আসি আমি পাথর হয়ে যাই।
যখন আবার ফিরে আসি তখনো আমি পাথর হয়ে যাই।
কবিতা উৎসবে
প্রতিটি কবির সামনে ঝুলে আছে
তাদের নিজ দেশের নাম।
আমার নামের পিছনে
জেরুজালেম ছাড়া
আর কিছুই নাই।
তোমার নাম কত ভয়ঙ্কর,
আহা আমার ছোট দেশ!
আমার কাছে তোমার নাম ছাড়া
আর কিছুই অবশিষ্ট নাই।
আমি এতে ঘুমাই
এতে আমি জেগে থাকি।
আমার দেশ যেন একটা নৌকা।
যার আগমন অথবা ফিরে আসার
কোন আশা নাই।
আসওয়ানের ট্রেনে
আমি এখনো মরেনি,
তাহলে মাতমকারীরা কেন এখানে?
আমি অন্ধকারে বসে লিখছি।
এখানে, শুদ্ধজাত ঘোড়া প্রদর্শন
আর পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নেমে যাওয়া খচ্চরগুলি
যাদেরকে আরোহীরা লাথি মারছিলো
উভয়ই সমান
এখানে, লর্ড বায়রন পুরুষযাত্রী পূর্ণ
একটি ট্রেনের মুখোমুখি হন
যারা আসওয়ানের দিকে যাচ্ছে-
আর শকুন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে
সুয়েজ খালে।
এটা এখন ২০১৪ সাল,
না লেখা চিঠিগুলি
এখনও আমার কাছে পৌঁছাচ্ছে।
একজন ভিজে রুটির টুকরো রাখে
আমার সামনের টেবিলে।
কত শত জীবন যাপন আমি করেছি?
আমাকে আর কতবার মরতে হবে?
হাইফার উপর দিয়ে সমুদ্র আছড়ে পড়ছে।
আমি অনেকবার মরেছি,
কিন্তু মাতমকারীরা আগে কখনো আসেনি।
আমাকে কি আমার নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
ব্যবস্থা করতে হবে ?
আমি অন্ধকারে বসে
সেই চিঠিগুলো লিখছি
তারা যা কখনো পাঠায়নি।
আমি কখনো থেমে থাকি না
ফিরে যাওয়ার জন্য আমার কোনো দেশ নাই।
বিতাড়িত হয়ে যাবো এমন কোনো দেশ নাই।
একটি গাছ যার শিকড়
একটি চলমান নদী:
থেমে গেলে মরে যায়,
না থামলেও মরে যায়।
আমি আমার সেরা দিনগুলি কাটিয়েছি
মৃত্যুর গালে ও বাহুতে,
আমি প্রতিদিন যে ভূখণ্ড হারাই
প্রতিদিনই তাকে আবার নতুন করে পাই।
মানুষের একটাই দেশ ছিল,
কিন্তু আমারটা বহুগুণ হয়েছে নিজেকে হারিয়ে
সে নিজেকে নুতন করে পায় নিজের অনুপস্থিতিতে।
এর শিকড়, আমার মত, জল:
থেমে গেলে শুকিয়ে যায়,
থেমে গেলে মরে যায়।
আমরা দুজনেই দৌড়াচ্ছি
সূর্যকিরণের নদীর সাথে ,
সোনার ধুলোর নদী
যা প্রাচীন ক্ষত থেকে ওঠে আসে ,
এবং আমরা কখনই থামি না।
আমরা চলতে থাকি,
কখনই থামার কথা ভাবি না
যাতে আমাদের দুটি পথ এক হতে পারে।
বিতাড়িত হয়ে যাবো এমন কোনো দেশ নাই,
ফিরে যাওয়ার জন্য আমার কোনো দেশ নাই
থেমে গেলে মরে যাবো,
চলতে থাকলে মরে যাবো।
মেরি
আমার মা আজকাল যীশুকে নিয়া লেখা বইগুলি মরিয়া হয়ে পড়তে চায় ।
আমি তার বিছানার কাছে বই দেখতে পাই । বেশিরভাগই আমার লাইব্রেরি থেকে ধার করা: উপন্যাস, হ্যান্ডবুক, সাম্প্রদায়িক বিতর্ক- যা নিয়ে লেখকরা হাতাহাতি করে এমন। কখনও কখনও আমি যখন তার ঘরের পাশ দিয়ে যাই তখন সে আমাকে তাদের মাঝখানে এসে বিরোধ মেটাতে বলে। (কিছুক্ষণ আগে আমি কামাল সালিবি নামের একজন ইতিহাসবিদকে সাহায্য করতে এসেছি, যার কপাল ক্যাথলিক-পাথর দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল।)
তিনি যখন যীশুর সন্ধান করছেন তখন তিনি কতই না পরিশ্রমী পাঠক ! এই মহিলাকে আমি কখনই নিরাশ করিনি: আমি প্রথম ইন্তিফাদাতে শহীদ হইনি, দ্বিতীয়টিতেও না, তৃতীয়টিতেও না। আমি ভবিষ্যতে কোন ইন্তিফাদাতেও শহীদ হবো না , আর ফাঁদপাতা কোনো সারস পাখি দিয়েও আমাকে হত্যা করা যাবে না ।
যখন সে বই পড়ে, তখন তার গোঁড়া খ্রিস্টান কল্পনা দিয়ে আমাকে প্রতিটি পৃষ্ঠায় ক্রুশবিদ্ধ করে…. কিন্তু বিনিময়ে আমি তাকে আরও বই এবং পেরেক সরবরাহ ছাড়া কিছুই করি না।
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫; কিশোরগঞ্জ। পৈতৃক নিবাস রায়পুরা, নরসিংদী। ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স), এমএ। পেশা : ইংরেজির শিক্ষক, নাভিটাস ইংলিশ ফেয়ারফিল্ড কলেজ, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া। প্রকাশিত বই : কবিতা— সিজদা ও অন্যান্য ইসরা [চৈতন্য, ২০১৬], ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে [চৈতন্য, ২০১৫], নো ম্যানস জোন পেরিয়ে [শুদ্ধস্বর, ২০১২], জল্লাদ ও মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি [নিসর্গ, ২০১২], শাদা সন্ত মেঘদল [নিসর্গ, ২০১১], গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ [নিসর্গ, ২০১০], পলাশী ও পানিপথ [নিসর্গ, ২০০৯], বাল্মীকির মৌনকথন [জুয়েল ইন্টারন্যাশনাল, ১৯৯৬], শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ [জুয়েল ইন্টারন্যাশনাল, ১৯৯৫], গদ্য— কবিতার ভাষা [চৈতন্য, ২০১৬]
ই-মেইল : abusayeedobaidullah@gamail.com
ধন্যবাদ আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ কে অসাধারণ অনুবাদের জন্য। মিলিয়ে নিচ্ছিলাম ফিলিস্তিনি কবি নজওয়ান দারবিশকে আরেক ফিলিস্তিনি নক্ষত্র কবি মাহমুদ দারবিশের সাথে আর মিলিয়ে নিচ্ছিলাম জেরুজালেম কবিতার পঙ্ক্তিমালা,
“আমি এখনও ত্রিশ হই নাই, কিন্তু তুমি আমাকে বারবার কবর দিয়েছ
আর আমি প্রতিবার তোমার জন্য পৃথিবী-গর্ভ থেকে বের হয়ে আসি” এর সাথে ‘জেরুজালেম’ নগরীকে যাকে বলা হয়- পৃথিবীর পবিত্র স্থান হলো সিরিয়া, সিরিয়ার পবিত্র স্থান হলো ফিলিস্তিন, ফিলিস্তিনের পবিত্র স্থান হলো জেরুজালেম, জেরুজালেম এর পবিত্র স্থান হলো মাউন্ট, মাউন্টের পবিত্র স্থান হলো নামাজের স্থান, আর নামাজের পবিত্র স্থান হলো ডোম অব দ্যা রক। আজ সকল পবিত্র স্থান গুলো হয়েছে প্রতিদিনের কবরস্থান ঠিক যেভাবে চিত্রিত হয়েছে – “আমি এখনও ত্রিশ হই নাই, কিন্তু তুমি আমাকে বারবার কবর দিয়েছ
আর আমি প্রতিবার তোমার জন্য পৃথিবী-গর্ভ থেকে বের হয়ে আসি” মুক্ত হোক পৃথিবীর এই পবিত্র স্থান
সকল হায়েনীয় গোলাবারুদের মধ্য হতে জেগে উঠুক পুত পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন-জেরুজালেম-মাউন্ট অব দ্যা রক।