১. ঐতিহাসিক ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব নিয়ে জানতে চাই। ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক হাসিনার পতন ও পলায়নের আগে ও পরে আপনার অবস্থান ও মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করতে চান?
নিজের মূল্যায়ন? কঠিন। তারচেয়ে বলি, আমি কিভাবে জুলাই বিপ্লবে জড়িয়ে পড়লাম। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কেমন ছিল আমার অংশগ্রহণ, কেমনই বা ছিল অনুভূতি।
নির্বাচন নিয়ে কারচুপি, বাজারে খাদ্যদ্রব্যসহ প্রতিটি নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের অগ্নিমূল্য, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করার ঘটনা, সাংবাদিক সম্মেলনের নামে প্রধানমন্ত্রীকে(সাবেক) চিহ্নিত কয়েকজন সাংবাদিকের তেলবাজির প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার দলীয় ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনা থেকে অনেকদিন ধরেই মনে ক্ষোভ জমেছিল। তবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন শুরু হলো তখন ভাবতেও পারিনি এই আন্দোলন এমন বিপ্লবে রূপ নিবে। অফিসে যাতায়াতের পথে চোখে পড়তো শিক্ষার্থীরা রাজপথে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন। ফেসবুকে দেখতাম পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম স্ট্যাটাস।
আমি তখন এমন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি যেখান থেকে ব্যক্তিগত কোন ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যাটাস দেয়া সমর্থনযোগ্য ছিল না।
এদিকে পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছিল। ১৬ তারিখে যখন আবু সাঈদের দু বাহু মেলে দিয়ে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও দেখলাম সেই মুহূর্তের অনুভূতি কোন দিন ভুলবো না। সেদিনই আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই বিপ্লবকে সমর্থন জানালাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল এই বীর তরুণদের পাশে যদি না দাঁড়াই তাহলে আমি কোনো মানুষই নই। সেসময় আমি একের পর এক কবিতা লিখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি, রাজপথে দাঁড়িয়েছি। তখন চাকরির মায়া করিনি। কারণ মানুষ যেখানে জীবন দিচ্ছে সেখানে এসব তুচ্ছ।
আমি যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। এরা যে আমারই সন্তানের বয়সী। এরা যেন আমারই সন্তান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপর ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডাদের আক্রমণ, নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, টিভিতে দেখলাম কতিপয় দালাল সাংবাদিকের গণহত্যায় উসকানি দান, মানুষ মরছে আর মেট্রো রেলের জন্য স্বৈরাচারের নাকি কান্না- এসব এমনভাবে সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল যে তখন যদি আমি ছাত্র জনতার আন্দোলনে শরিক না হতাম তাহলে মানুষ হিসেবে আর কখনও আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে পারতাম না।
আমি বিভিন্ন স্ট্যাটাসে লিখছিলাম, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি, হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেয়ায় বাধাদান –এমন ফ্যাশিস্ট আচরণ দেখেও কোন মানুষের পক্ষে কি চুপ করে থাকা সম্ভব? যেখানে আমার সন্তানসম ছেলে মেয়েরা গুলিতে শহীদ হচ্ছে সেখানে কি কোন অভিভাবকের পক্ষে তাদের পাশে না দাঁড়ানো সম্ভব?
৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট ) বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো ঢাকায় জনতার ঢল। যাত্রাবাড়িতে সেই জনতার উপর ভয়াবহ গুলিবর্ষণ। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারে চড়ে পলায়ন, জনতার গণভবনে প্রবেশ। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার বিজয়ের পর পাঁচ দিন দেশে কোন পুলিশ প্রশাসন কার্যকর ছিল না। সেসময়টায় আমরা নিজেরাই যার যার পাড়া মহল্লা পাহারা দিয়েছি। ডাকাত পড়ার গুজব রটনাকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সফলভাবে রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছে। আমার মনে হচ্ছিল এই দিনগুলোতে সমস্ত দেশের শান্তিকামী মানুষ যেন এক হয়ে গিয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন ঐক্য এর আগে কখনও দেখিনি। ৩৬ জুলাই রাস্তায় নেমে জনতার সঙ্গে উল্লাস করেছি, প্রেসক্লাবে গিয়েছি। বিভিন্ন প্রবন্ধে জুলাই বিপ্লবের প্রকৃত চেতনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
২.জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে কাজই জীবন। যে কোন পেশায় হোক, যে কোন অবস্থানে হোক, কাজ করে যাওয়া, সমাজের জন্য, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য শ্রম দেয়াটাই জীবন। সেইসঙ্গে এই বিশ্বকে ভালোবাসা, পরিবেশের উন্নয়নে নিজের সাধ্যমতো অবদান রাখাই জীবন। আমি ছোটবেলায় বৈজ্ঞানিক হতে চেয়েছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পারিবারিক কয়েকটি কারণে ডাক্তারি পড়া হয়নি। সেজন্য আক্ষেপ রয়েছে। কারণ ডাক্তার হতে পারলে হয়তো আমি মানবসেবায় কিছুটা অবদান রাখতে পারতাম। আমার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তারপর ১৯৯৭ সাল থেকে সাংবাদিকতা। এখন চীনের ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা বিভাগের শিক্ষক। আমি স্কুলে বেশ মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছি। আমার ক্যারিয়ার আরও অনেক ভালো হতে পারতো। কিন্তু আমার মনে হয় সব ভুল ভ্রান্তি, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়েই আমি। জীবনের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।
৩. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?
আমার জন্ম ১৯৭০ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা শহরে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পুরানো ঢাকাতেই কেটেছে। আমার দাদা বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাবা ভাষাসৈনিক কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। ছোটচাচা শিল্পী মুর্তজা বশীর। আমার নানা খান বাহাদুর আফাজউদ্দিন আহমেদ যিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতে প্রথম বাঙালি এক্সাইজ কমিশনার।
পরিবারে আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ আছেন। ফলে পারিবারিক সূত্রে সেই সময়কার অনেক বিখ্যাত মানুষদের দেখেছি। অনেক স্মৃতি। বলতে গেলে ঢাকা শহরকে মহানগরী হয়ে উঠতে দেখেছি। নব্বই এর গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি। আমার স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে ‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ শিরোনামে দুইখণ্ডে প্রকাশিত বইতে। সেখানে বিস্তারিত লিখেছি ঢাকা শহরের ইতিহাস এবং গত পঞ্চাশ বছরে আমার অভিজ্ঞতা।
৪. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
আমার মা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত। তিনি চমৎকার আবৃত্তি করতেন। মায়ের রবীন্দ্র কবিতা বলার চোটে আমার মগজ ধোলাই শুরু হয়েছিল মাতৃগর্ভ থেকেই। কথা ফুটেছিল রবীন্দ্র কবিতা বলে। সেই শব্দগুলোই ছিল খেলার প্রধান সঙ্গী। আবোল তাবোলভাবে সেই শব্দগুলো উচ্চারণ করতাম। একদিন বাবা, মা খেয়াল করলেন যেগুলো বলছি সেগুলো কবিতার মতো। তখন তিন বছর বয়স হবে। বাবা এবং মা সেই আবোল তাবোল কবিতাগুলো টুকে রাখা শুরু করলেন। বাবার মতে সেগুলো কবিতা। লিখতে শেখার পর এই ‘কবি রোগ’ আরও বাড়লো। স্কুলে ছড়া লিখে সহপাঠীদের বিরক্ত করা বা অবাক করার চেষ্টা। বাড়িতে ছোট ছোট কবিতা লেখা চললো ধুমিয়ে।
আমার কাছে এখন মনে হয়, সব শিশুই এমন কবিতা বলে বা লিখতে পারে। শিশু হিসেবে আমি মোটেই অসাধারণ কিছু ছিলাম না। অসাধারণ ছিলেন আমার বাবা যিনি পরম স্নেহে সেগুলো সংগ্রহ করতেন। কচি কাঁচার আসর, খেলাঘর, সাত ভাই চম্পায় একটি দুটি ছাপাও হলো। সংগ্রহ যখন জমে উঠলো তখন বাবা ভাবলেন এবার বই প্রকাশ করা দরকার। আইডিয়াটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত কাকা যিনি ছিলেন বাবার বিশেষ বন্ধু।
কবিতার ডায়েরি হাতে আমাকে নিয়ে বাবা প্রথমে দেখা করলেন কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর কায়েতটুলির বাড়িতে। ভাবতেও লজ্জা লাগে রাহমান ভাইয়ের মতো অত বড় একজন কবিকে কিনা বিরক্ত করা হচ্ছে আমার কবিতা পড়িয়ে। রাহমান ভাই ধৈর্য্য সহকারে সেগুলো পড়লেন, তারপর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভদ্র কণ্ঠে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে এত ছোটবেলায় বই বের না করে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত। সঠিক কথা বলেছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাবার সেটা মনোঃপুত হলো না।
এবার গেলেন কবি আল মাহমুদের কাছে। তিনিও মোটামুটি একই রকম পরামর্শ দিলেন। এরপর কবি ফজল শাহাবুদ্দিন। তারপর রফিক আজাদ। মোটামুটি বলতে গেলে সে সময় প্রতিষ্ঠিত বাবার পরিচিত সকল কবিকেই তিনি যথাসাধ্য বিরক্ত করেছিলেন।
কারও কথাতেই দমে না গিয়ে বাবা বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
সন্তোষ গুপ্ত কাকার কথা আগেই বলেছি। তিনিই বইটির ভূমিকা লিখলেন।
মুক্তধরা থেকে শুরু করে তখনকার কোন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীই সংগত কারণেই বইটি প্রকাশে সম্মত হয়নি। বাবা তখন নিজের টাকায় বই প্রকাশ করলেন। বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভিতরে প্রতি পাতায় ছবি আঁকলাম আমি নিজেই।
বইটির নামকরণও আমারই। ১৯৭৮ সালে বই প্রকাশের তোড়জোড় চলছিল। তখন আমি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। মাত্র জেনেছি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে একটা বিষয় রয়েছে। আর ছোটদের বিশ্বকোষও পড়তাম তুমুল আগ্রহে। সেই কারণেই বইয়ের নাম হলো মাধ্যাকর্ষণ। কবিতার বইয়ের নাম ‘মাধ্যাকর্ষণ’। পাগলামি ছাড়া আর কি? বাবা অবশ্য এরমধ্যেও সৃজনশীলতা খুঁজে পেলেন।
বইটি প্রকাশ হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। আমার ৯ বছর বয়সে। সেটি ছিল আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ।
বই প্রকাশ করেই অবশ্য বাবা ক্ষান্ত হননি। এক কপি করে বই পাঠানো শুরু করলেন দেশে বিদেশে। উত্তর এলো জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিব কুর্ট ওয়াইল্ড হাইম, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ইন্দিরা গান্ধী, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্ট মার্কোজ, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আরও অনেকের কাছ থেকে।
ইন্টারভিউ ছাপা হলো অনেক পত্রপত্রিকায়। সচিত্র সন্ধানী, দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা, ধান শালিকের দেশ, আরও কিছু ইংরেজি পত্রিকায়।
মাধ্যাকর্ষণ বইটি আমার কাছে বাবার অপরিসীম স্নেহের প্রতীক। কত যত্নে, কত সময় ব্যয় করে তিনি বইটি প্রকাশ করেছিলেন। এমন বাবা ক’জন মেয়ের ভাগ্যে জোটে?
বলতে গেলে সেসময় থেকেই লিখে চলেছি। বাবা আমাকে লেখালেখির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
৫. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ প্রমুখ– তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিলো? তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
পারিবারিক সূত্রে বাংলাভাষার প্রধান কবিবৃন্দের অনেককেই বেশ কাছ থেকে দেখেছি। এঁদের মধ্যে কবি আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, আবিদ আজাদ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিটিভিতে ‘বইপত্র’ নামের একটি অনুষ্ঠানে আমি ২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সহ-উপস্থাপক ছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে কবি আবিদ আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং আসাদ চৌধুরী ছিলেন প্রধান উপস্থাপক। বুঝতেই পারছেন, দীর্ঘ সময় কেটেছে তাদের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনায়। বলা উচিত, আমি তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি। এদের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ সময়ের বিষয়। যাঁদের কথা বললেন তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য পাঠ্য। এঁদের লেখা বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় স্থান অধিকার করে আছে। কবি শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ দুজনেই আমার প্রিয় কবি। কুনমিং শহরে আমার নিরালা আবাসে বারান্দায় পাহাড়মুখী একটি চেয়ারে বসে আমি তাঁদের কবিতা পাঠ করি।
সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবিদ আজাদ আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতীম ছিলেন। আমার কাছে মনে হয় তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। আবুল হাসান এবং আবিদ আজাদ দুজনেই অকাল প্রয়াত। দুজনেই আমার খুব প্রিয় কবি অবশ্যই। আমার সঙ্গে এখনও খুব গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে অগ্রজ কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ এবং ড. মাহবুব হাসানের। সমসাময়িকদের মধ্যে শাকিল রিয়াজ আমার জনকণ্ঠের সহকর্মী ছিলেন। তিনি এখনও আমার ভালো বন্ধু। আবদুল বাতেন, ফাতিমা তামান্না, জুনান নাশিত, জাকির আবু জাফর, জামিল জাহাঙ্গীর, তৌফিক জহুর, আবু জুবায়ের, ফরিদ ভুঁইয়া, সৈয়দ রনো, মনসুর আজিজসহ অনেকের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব আছে। আপনিও(সাজ্জাদ বিপ্লব) আমার ভালো বন্ধু। আপনার কবিতাও আমি বেশ পছন্দ করি। রাজু আলাউদ্দিন, শাহীন রেজা, হাসান হাফিজ এরাও খুব কাছের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবির সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব আছে। আর আমার জীবনসঙ্গী কবি শাহিন রিজভির কবিতা আমি অবশ্যই পছন্দ করি।
৬. আপনি একাধারে একজন কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক–অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার মনে হয় সবচেয়ে আগে আমি নিজেকে একজন লেখক হিসেবেই দেখি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছি। তবে যাই লিখি না কেন, সবমিলিয়েই তো আমি। আমার লেখায় সেই অনুভব নিশ্চয়ই ফুটে ওঠে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখি ভ্রমণ গদ্য। আবার সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখি কলাম। পেশাগত কারণে করেছি রিপোর্টিং, লিখেছি ফিচার। আর নিজস্ব অনুভব থেকে লিখেছি কবিতা, গল্প। আমি যখন যে কাজ করেছি, যা লিখেছি, যে পেশায় থেকেছি যেমন বিদেশে সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা সবকিছুকেই উপভোগ করেছি। সকল দোষত্রুটি অসম্পূর্ণতা নিয়েও শান্তা মারিয়া নামক মানুষটিকে আমি ভালোবাসি।
৭. আপনার পূর্ববর্তী দশকের কবিদের মধ্যে কে- কে আপনার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ? কেন? বিস্তারিত জানতে চাই।
আশির দশকের কথা বলছেন? আমি কারও নাম উল্লেখ করতে চাই না। গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই আছেন। যার কবিতায় নিজস্ব কণ্ঠস্বর ফুটে ওঠে তিনিই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমার মনে হয় সময়ই বলে দিবে কে ছিলেন আর কে সেভাবে থাকতে পারলেন না।
৮. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?
আমার কাছে মনে হয়, সেই চর্যাপদের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাভাষাকে একের পর এক লড়াই চালাতে হয়েছে। বাংলাভাষা চিরদিনই জনসাধারণের ভাষা। প্রাকৃতজনের ভাষা। সংস্কৃতকে এই ভাষার উপর চাপিয়ে দেয়ার বহু চেষ্টা অনেকবারই হয়েছে। মহাভারতের যুগে বাংলা অথবা সেইসময়ে এই ভূমিতে যে জনগোষ্ঠী ছিল তাদের ভাষাকে ‘পক্ষীর ভাষা’ বলে অপমান করা হয়েছে। সেন আমলে বলা হয়েছে বাংলাভাষায় যারা কথা বলবে তাদের স্থান হবে রৌরব নরকে। মোগল আমলে দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি। বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ একমাত্র বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন কারণ তারা নিজেরাও অর্ধেক বাঙালিই ছিলেন। কোম্পানির সময়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা বাংলাভাষাকে সংস্কৃতের ছায়ায় ঢেকে দেয়ার প্রভূত চেষ্টা করেছেন। তারা গণমানুষের ভাষাকে বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দে ভারাক্রান্ত এক কৃত্রিম বাংলাভাষার প্রচলন করেন।
অন্যদিকে বহুদিন পর্যন্ত শহুরে অভিজাত বাঙালি মুসলমান মনে করতেন বাংলা তাদের ভাষা নয়। তারা উর্দুকে মনে করতেন মুসলমানের আর বাংলাকে হিন্দুর ভাষা। তবে গ্রামের কৃষক, তাঁতী থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষ বাংলাতেই কথা বলতেন তা তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন। এতে বোঝা যায় বাংলা ভাষা সবসময়েই জনসাধারণের ভাষা ছিল এবং এখনও তাই আছে।
পাকিস্তান আমলে আবার বাংলা ভাষাকে আরবি ও ফার্সির ছায়ায় ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলায় অনেক যুগ ধরেই বাংলা ভাষার বহুল প্রচলিত আরবি ফারসি শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দের আমদানি করা হচ্ছে। এমনকি বাংলাভাষাকে বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী না অধ্যয়ন করে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম দিয়ে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজির দাপটে বাংলাভাষা কোণঠাসা। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রমিত বাংলার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক কিছু শব্দ মিশিয়ে এক ধরনের খিচুড়ি পাকানোর চেষ্টা হচ্ছে। এখনও দেশে ভালো বাংলা জানা লোকের কোন কদর নেই। এজন্য বাংলাভাষাকে আজও লড়াই চালাতে হচ্ছে। বাংলা ভাষার গৌরব রক্ষার জন্য দরকার আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা, বিদেশিদের জন্য বাংলাভাষার মান যাচাই পরীক্ষা এবং আমাদের যতগুলো দেশে দূতাবাস রয়েছে সেখানে বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থাও করতে হবে।
৯. সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?
অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ক্ষমতার আশপাশে থাকার জন্য এবং লেখায় বড় না হয়েও পদ পদবী পুরস্কারের লোভে এক শ্রেণীর লেখক নামধারী দালালের প্রাদুর্ভাব। এদের দাপটে ভালো লেখকরা সামনেই আসতে পারেন না। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে সব জায়গায় এদেরই দাপট। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো বই প্রকাশ করা। ভালো লেখকের ভালো লেখা কেউ প্রকাশ করতে চায় না। অথচ ব্লগ টগ করে কোনভাবে কেউ ভাইরাল হলে তার বই প্রকাশের জনব্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ফেসবুকে অখাদ্য লিখে একেকজন বড় লেখক হয়ে যান। অথচ সত্যিকারের ভালো লেখক হারিয়ে যান, হতাশ হয়ে যান। বইমেলায় দেখেছি এমন লেখকের পিছনে টিভি চ্যানেলগুলো বুম হাতে ঘুরছে যিনি সাহিত্য পদবাচ্য কিছু লেখেননি। লিখেছেন কেবল কার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক ছিল সেই কিচ্ছা। দৈনিক পত্রিকা ও কোনো কোনো ম্যাগাজিনের সাহিত্য সম্পাদকরাও বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ তৈরি করেন। জনপ্রিয় একটি পত্রিকা সব সময় তার নিজস্ব বলয়ের লেখক, অলেখক, কুলেখকদের লেখা ছাপেন এবং গুণকীর্তন করেন। তারা বাংলা সাহিত্য জগতের বাপ মা হয়ে থাকতে চান। প্রবাসী লেখকদের কাছে টাকা নিয়ে কোন কোন সাহিত্য সম্পাদক তাদের ব্যাপক প্রচার করেন। কোনো কোনো ধনী বা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি টাকার জোরে বই ছাপিয়ে , আমলারা ক্ষমতার দাপটে বড় লেখক হন। তাদের অধীনদের বাধ্য করেন বই কিনতে।
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রবল খাতির রাখা, নিজেই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে মস্ত লেখক বনে যাওয়া আজকাল খুবই সাধারণ ঘটনা। পনেরো বছরে আমরা দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি না করলে তিনি কোন লেখকই নন, এমন একটা অবস্থা। এমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। বলতে গেলে বিশাল কাহিনী হয়ে যাবে।
আমি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করি আমার নিজস্ব উপায়ে। সেটা হলো পাত্তা না দেয়া। আমি পদ, পদবী, পুরস্কারকে পাত্তা দিই না। কোনো সাহিত্য সম্পাদককে তোষামোদ করি না। কেউ চাইলে লেখা দিই, না চাইলে দিই না। আমি মাঝে মধ্যে ফেসবুকে কবিতা শেয়ার করি। গল্প প্রকাশ করি কখনও কখনও। খ্যাতি বা অখ্যাতিতে আমার কিছু আসে যায় না।
১০. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
প্রথম প্রকাশিত বই মাধ্যাকর্ষণের কথা আগেই বলেছি। সেটা ছিল শিশুর লেখা, শিশুদের জন্য। সেই অর্থে আমার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘সকল দোকান বন্ধ ছিল’। সেটি প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের আওতায়। বইটির কাজ সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের একুশে বইমেলায় এটি প্রথম আলোর মুখ দেখে। এই বইটি প্রকাশের অনুভূতি ছিল দারুণ আনন্দের। মনে পড়ে আমরা কয়েকজন তরুণ লেখক স্টলে দাঁড়িয়েই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মতো একটা ছোট আয়োজন করেছিলাম। একে অন্যের বই কিনেছিলাম, উপহার দিয়েছিলাম। আমার বইটির প্রথম কবিতার নাম ‘মীননাথ’।
১১. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
চর্যাপদের কবি মীননাথ, ভুসুকু, লুইপা, কাহ্নপা থেকে শুরু করে চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, আলাওল, শাহ মুহম্মদ সগীর, চন্দ্রাবতী, লালন, হাসন রাজা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরীসহ সকল বাংলাভাষী লেখককেই আমি আমার চেতনায়, মননে ধারণ করি। তাই আমি মনে করি আমি বাংলা ভাষার সাহিত্য স্রষ্টাদের উত্তরাধিকার বহন করছি।
১২. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
২০২৫ সাল পর্যন্ত ঊনিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আরও দুটি বই এ বছরই প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু কোনো কারণে হয়নি। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘ওম মণি পদ্মে হুম’ ,‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ‘চীনা সাহিত্যের আশ্চর্য ভুবন’ এবং ‘কবোষ্ণ পূর্ণিমা’কে আমি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। ওম মণি পদ্মে হুম বইতে এমন কিছু কবিতা রয়েছে যা আমার প্রিয়। এখানে মিথ নিয়ে কিছু ভিন্নধর্মী কাজও করেছি। ‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ বইটি পুরনো ও নতুন ঢাকার অনেক পরিবর্তনের ইতিহাসকে ধারণ করেছে। এখানে রয়েছে এমন অনেক তথ্য যা সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের কাজে লাগবে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষা আন্দোলন, নব্বই এর গণ আন্দোলন, সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্মৃতিসহ বেশ কিছু আগ্রহ জাগানিয়া বিষয় এ দুই খণ্ডে পাবেন। ‘কবোষ্ণ পূর্ণিমা’ আমার প্রথম গল্পের বই। বইটিতে রয়েছে এমন সব গল্প যা পাঠককে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি দেয়। চীনা সাহিত্যের আশ্চর্য ভুবন’ বইটিতে চীনের প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেকজন কবির জীবনী, তাদের কবিতা রয়েছে। আরও রয়েছে চীনা মিথ, চীনের উৎসব নিয়ে আলোচনা। চীনের কয়েকজন কবির কবিতা আগেও বাংলায় কিছু কিছু অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন ও মধ্যযুগের এতজন কবির জীবনী, তাদের অবদান, সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা বাংলাভাষায় এর আগে হয়নি।
১৩. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার দুটি বই। প্রথমটি হলো কবোষ্ণ পূর্ণিমা। এটি গল্পের বই। তেইশটি গল্প আছে। প্রকাশ করেছে বিশ্বসাহিত্য ভবন। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। যারা বইটি কিনেছেন, পড়েছেন তারা প্রত্যেকেই খুব প্রশংসা করেছেন। আমি এমন সব গল্প বলতে চেয়েছি যা গতানুগতিক ধারা থেকে আলাদা।
এ বছরই প্রকাশিত হয়েছে আমার আরেকটি বই ‘পাখিটা এলিয়েন ছিল’। এটি শিশু ও কিশোরদের জন্য লেখা গল্পের বই। প্রকাশ করেছে ঝিঙে ফুল। গল্পগুলোতে আমি শহুরে ছেলেমেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনার কথা বলেছি। আরও রয়েছে পশুপাখির গল্প। ছেলেমেয়েরা যেন প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখে, পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হয় সেই ইচ্ছা থেকেই গল্পগুলো লেখা।
১৪. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
আমি নব্বই দশকের কবি। আমার প্রথম বই জন্ম দশকেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমি সচেতনভাবে লেখালেখি শুরু করেছি নব্বই দশকে। নব্বই দশকেই আমার কবিতায় নিজস্ব একটা অবয়ব ফুটে ওঠে।
১৫. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
সমকাল নিয়ে বলা কঠিন। এটুকু বলা চলে, নব্বই দশক হলো বাংলা সাহিত্যের বাঁক বদলের দশক। এই সময়ে যত প্রতিভাবান ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক তাদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন তেমনটি অন্য সময়ে খুব কমই হয়েছে। এখনও সাহিত্য ভুবনে নব্বইয়ের স্রষ্টারা বেশ দাপটের সঙ্গেই তাদের রাজ্যপাট ধরে রেখেছেন। তবে আমার মনে হয়, নব্বই দশক নিয়ে যতটুকু আলোচনা হয়েছে তারচেয়ে আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। নব্বই দশকের বিশিষ্ট কবিদের লেখা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলা রিভিউ হয়তো এ কাজটি করতে পারে।
১৬. আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।
আমি আমার অধিকাংশ কবিতাতেই মিথ ব্যবহার করেছি। গ্রিক, বৈদিক, মিশরীয়, চৈনিক সব ধরনের মিথই আমার কবিতায় ব্যবহার করেছি। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর মিথ অনেক সময়ই আমি ব্যবহার করেছি। যেমন ‘ইউসুফের আহত ঈগল’, ‘বেথেলহেমের পথ’। কবিতায় মিথ ব্যবহার করতে হলে নতুন ন্যারেটিভ আনতে পারলে খুবই ভালো। কারণ মিথকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করাটা জরুরি। আমার ওম মণি পদ্মে হুম বইটিতে বিভিন্ন ভাবে মিথের ব্যবহার রয়েছে। ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য অবশ্যই কবিতায় আসতে পারে। যেমন, ফররুখ আহমদ লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামও লিখেছেন। আল মাহমুদও ইসলামী মিথ ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয়, গল্পেও ব্যবহার হতে পারে। শাহেদ আলীর জিবরাইলের ডানা গল্পের কথা ভাবুন। লাগসইভাবে ব্যবহার করতে পারলে যে কোন ফর্মেই মিথ ব্যবহার করা যায়। এটি রচনাকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করে।
১৭. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর আধুনিকতা আমার কাছে কোনো ট্রাইম ফ্রেম নয়। বরং একটা চিন্তাধারা। আমি নির্দিষ্ট কোনো যুগের লেখকের লেখায় নয় বরং যে লেখায় লোকজ ঐতিহ্যর স্পর্শ পাই সেটাকে উত্তরাধুনিক বলে মনে করি। আমি মনে করি উত্তরাধুনিকতা মানে শিকড়ের অনুসন্ধান। তবে, শুধু মাত্র শিকড়ের কথা বলাই উত্তরাধুনিকতা নয়। তার সঙ্গে ফর্ম ভেঙে ফেলা বা প্রচলিত ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসাও উত্তরাধুনিকতা। নতুন ও নিজস্ব কাব্যভাষার নির্মাণও তাই।
উত্তরাধুনিকতা বা পোস্ট মর্ডানিজম শব্দটা পাশ্চাত্য থেকেই এসেছে। কিন্তু আমরা এটাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করতে পারি। ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসার কাজটি কিন্তু ষাট ও সত্তরের দশকের কবিরাও করেছেন। শামসুর রাহমান যখন ‘মাতুয়ালা রাইত’ ও অন্যান্য কবিতার মধ্য দিয়ে ঢাকা শহরকে একটি চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, যখন আল মাহমুদ সোনালি কাবিন লেখেন তখন কিন্তু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের উত্তর আধুনিক বলতে দ্বিধা হয় না।
সত্তরের দশকে কবি আবিদ আজাদ টানা গদ্যে কবিতা লেখেন, কবি মাহবুব হাসান নিয়ে আসেন লোকজ উপাদান, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ বদ্ধ মাতাল রোদে কাব্য পরিক্রমায় বের হন, মাহমুদ কামাল ফর্ম ভেঙে ফেলেন, তারা কি তাহলে উত্তর আধুনিক নন?
নব্বই দশকে অনেকের লেখায় উত্তর আধুনিক সাহিত্য ধারা পরিস্কার একটা রূপ পায় এবং একটি আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আশি, নব্বই দশক এবং তারপরে অনেক কবির লেখাতেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে।
উত্তর আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যের একটি বাঁকবদল। শুধু বাংলাদেশের লোকজ উপাদান নয়, আমার মনে হয় সমগ্র এশিয়ার লোকজ সাহিত্য, লোকজ দর্শন আমাদের সৃষ্টিকর্মে নতুন প্রেরণা দিতে পারে। নিয়ে আসতে পারে বৈচিত্র্য। তার মানে আপনি পাশ্চাত্যের সাহিত্য পড়বেন না বা সে বিষয়ে খোঁজ খবর রাখবেন না, তা কিন্তু নয়।
সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতা প্রয়োজন। আর নতুন ধারায় সাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হবে চিরায়ত কিছু হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার হলো পাঠ। বিচিত্র বিষয়ে পাঠের অভ্যাসই কেবল আপনাকে নিয়ে যেতে পারে নতুন সৃষ্টির ভুবনে।
১৮. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?
সচেতনভাবে হয়তো নেই, তবে অবচেতনে থাকতে পারে। আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে রুশ সাহিত্য পড়ে। তাই রুশ সাহিত্যিক যেমন, লিও তলস্তয়, ভেরা পানোভা, ম্যাক্সিম গোর্কি, আন্তন চেখভের প্রভাব থাকতে পারে। মার্কিন লেখক ও হেনরি, জ্যাক লন্ডন, অ্যাডগার অ্যালান পোর কিছুটা প্রভাব সম্ভবত আমার গল্পে রয়েছে। স্মৃতিকথা লেখার সময় লরা ইঙ্গলস প্রভাবিত করেছেন।
নব্বই দশকের লেখা কবিতায় প্রথমদিকে জীবননানন্দ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বহুকষ্টে সচেতন প্রয়াসে সেই প্রভাব মুক্ত হয়েছি।
১৯. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
আমি এখন চীনের কুনমিং শহরে ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। আমি বাংলা বিভাগের শিক্ষক। আমার স্বামী শাহিন রিজভি ঢাকায় আছেন। তিনি আবহমান থিয়েটারের নির্দেশক ও অন্যতম পরিচালক। আমাদের একমাত্র সন্তান জুলকার সৈয়দ সামির অর্ণ ইউননান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। সে ঢাকায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছে। আমি এখন মঞ্চনাটক লেখা নিয়ে বেশ ব্যস্ত। আগামিতে এ নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হবে। আমার লেখা নাটক চণ্ডীদাস মঞ্চে এসেছে। রূপেশ্বরী নামে আরেকটি নাটকের মহড়া চলছে। জানুয়ারিতে মঞ্চায়ন হবে। এখন আলাওলকে নিয়ে নাটক লিখছি।
২০. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
আমি ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ‘ঋগ্বেদ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলাম। এখন ‘আবহমান’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালাই। আবহমান থিয়েটার নামে একটি নাট্যগ্রুপের অন্যতম পরিচালক।
২১. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
প্রথাগত চিন্তার বাইরে, প্রগতিশীলতাকে ধারণ করে এগিয়ে চলা সাহিত্য চর্চার বাহন হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। প্রাতিষ্ঠানিকতা, বাজামুখীতাকে চ্যালেঞ্জ করাই লিটল ম্যাগাজিনের কাজ। লিটল ম্যাগাজিন কখনও সস্তা জনপ্রিয়তার পিছনে ধাবিত নয়। বরং লেখায় পরীক্ষা নিরীক্ষাকে ধারণ করে।
২২. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আমি এটাকে খুবই পজিটিভলি দেখি। আধুনিক প্রযুক্তিকে তো ব্যবহার করতে হবে। এখন আর কাগজে ছাপা ম্যাগাজিনের কি প্রয়োজন? ধরুন, আমি কাগজে ছাপা একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করলাম, সেটি দেশে বিদেশে কতজনের কাছে পৌছানো সম্ভব? অনলাইনে সারা বিশ্বের পাঠকের হাতের নাগালে সেটি চলে যায়। গাছ কেটে কাগজ তৈরির দরকারও পড়ে না। এই যে আমি চীনে বসে ‘বাংলা রিভিউ’ পড়তে পারছি সেটাও তো এই প্রযুক্তির কল্যানেই।
২৩. ‘বাংলা রিভিউ’ পড়েন? কেমন লাগে? কোন পরামর্শ বা অভিমত থাকলে জানাতে পারেন।
অবশ্যই পড়ি। ভালো লাগে। জুলাই বিপ্লবের সংখ্যাটা অত্যন্ত ভালো হয়েছে। বলতে গেলে বাংলা একাডেমি যে সংকলন করেছে তারচেয়ে শতগুণে শ্রেষ্ঠ হয়েছে। এরকম বিশেষ ইস্যু ধরে সংকলন বা সংখ্যা করা যেতে পারে। বিশেষ বিশেষ লেখককে কেন্দ্র করে বিস্তারিত আলোচনাও হতে পারে।
২৪. কেমন পৃথিবী দেখতে চান?
আমি দূষণমুক্ত, যুদ্ধমুক্ত, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন একটি পৃথিবী দেখতে চাই। আমি পুরো বিশ্বে এমন একটি মানব সমাজ দেখতে চাই যেখানে কেউ কারও ওপর নির্যাতন করে না, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত কারণে কেউ কাউকে ঘৃণা করে না। যেখানে প্রতিটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে। যেখানে মানুষ পরিবেশকে রক্ষা করছে। যেখানে মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা হয়েছে। যেখানে মানুষ কাজ করে ক্ষুধাতাড়িত হয়ে নয়, বরং মহত্তর প্রয়োজনে। যেখানে শিল্প সাহিত্য, সংগীতের চর্চা করছে মানুষ, বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন রয়েছে। মারণাস্ত্র তৈরি নয়, জীবন বাঁচানোর জন্য চলছে বিজ্ঞানের গবেষণা। মরুকরণ রোধ হয়েছে, সাহারা সবুজ হয়েছে, নদীতে স্বচ্ছ্ব পানি প্রবাহিত হচ্ছে, ছিদ্রহীন ওজোনস্তর, নীল আকাশ রয়েছে এমন বিশ্ব দেখতে চাই। পৃথিবীতে বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বৈষম্য নয়। সব জেলখানা বিলুপ্ত হবে। কেউ আর অপরাধ করবে না। কোথাও কোন যুদ্ধ হবে না। যেখানে শিশুরা নিরাপদ, বৃদ্ধরা সম্মানিত, যুবরা কর্মমুখর। সকল জাতি, ধর্ম,বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী বৈষম্য বিলুপ্ত হোক। আবার বলছি, বৈচিত্র্য থাকুক, বৈষম্য নয়। নান্দনিক, সুস্থ, সুখী, সুন্দর, সবুজ, শান্তিময় পৃথিবী চাই।
………….
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
নভেম্বর ০৮, ২০২৫









কবি শান্তা মারিয়ার সাক্ষাৎকারটি এক কথায় চমৎকার। অনেক প্রশ্ন। প্রতিটি প্রশ্নের জুতসই ও সাবলীল জবাব। বিস্তারিত কিন্তু বাহুল্যবর্জিত। মাত্র ৯ বছর বয়সে তাঁর ” মাধ্যাকর্ষণ ” নামক বই প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাটি রূপকথার মতো বিস্ময় ও শিহরন জাগানিয়া তথ্য। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন বিষয়ক তাঁর অভিমত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথ্যসমৃদ্ধ ও ইতিহাসনিষ্ঠ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী হিসেবে তাঁর পারিবারিক অভিজ্ঞতার বয়ানও খুব সমৃদ্ধ। তবে ইসলামী মিথের ব্যবহার শুধু নজরুল- ফররুখ আহমদগণই করেননি, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবিরাও করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারের ” স্বপনপশারী ” কাব্য, ” ফেরদৌসী ” নামক কবিতা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ” কবর-ই নুরজাহান “, “কোরানের বাণী ” প্রভৃতি কবিতাসহ আরও অনেক কবিতায় ইসলামী বা মধ্যপ্রাচ্যীয় মিথের চমৎকার ব্যবহার ঘটেছে। শামসুর রাহমানের ” একরাতে হযরত উসমান “, আল মাহমুদের ” আরব্যরজনীর রাজহাঁস “, ” জুলেখার আগুন”, ” ইউসুফের উত্তর “, ” ধাতুর ওলান থেকে”, ” প্রাচীর থেকে কথা”, “নীল মসজদের ইমাম” প্রভৃতি কবিতায় ইসলামী / মধ্যপরাচ্যীয় মিথের জুতসই ব্যবহার দেখা যায়। নবীন কবিদের মধ্যে হাসান রোবায়েত তাঁর কবিতায় মধ্যপাচ্যের মিথ ব্যবহার করে চলেছেন নিপুণতার সাথে। নব্বই দশক নিয়ে শান্তা মারিয়ার অবজারভেশন ভালো। তবে এই দশকের কবিদের মধ্যে অযৌক্তিক বিভেদ ভয়ংকর এবং একজিন আরেকজনকে নাকচ করে দিতে তৎপর। এই দশকের কবিরা নিজেরা যতগুলো কবিতা সংকলন বের করেছেন, সবগুলোই আত্মরতি ও গোষ্ঠীবদ্ধতায় সংকীর্ণ এবং ফলে শোচনীয়ভাবে সংকীর্ণতায় আকীর্ণ। শান্তা মারিয়া বেশ সাহসী মানুষ। তিনি অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন খোলাখুলিভাবে এবং বস্তুনিষ্ঠ মন নিয়ে। তাকে সাধুবাদ জানানো যায়। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কবি +সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবকেও।