spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকচিকামারা থেকে গ্রাফিতি : নতুন যুগের এক চর্যাপদ

লিখেছেন : এনামূল হক পলাশ

চিকামারা থেকে গ্রাফিতি : নতুন যুগের এক চর্যাপদ

এনামূল হক পলাশ

চিকামারা শব্দটি কথ্যভাষায় দেয়াল লিখন বুঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে আইনগত নিষেধাজ্ঞার কারণে রাতের আঁধারে দেয়াল লিখন করা হতো। এসব লেখায় মূলত সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মন্তব্য তুলে ধরা হত। লেখার জন্য ব্রাশ হিসেবে ব্যবহৃত হতো মাথা থেঁতলে নেয়া জিগা গাছের ডাল এবং কালি হিসেবে ব্যবহৃত হতো আলকাতরা। কথিত আছে যে, হঠাৎ পুলিশের নজরে পড়ে গেলে দেয়াল লেখকরা দেয়াল লেখা বন্ধ করে দিয়ে ডাল দিয়ে এলোপাথারি ঝোপে বাড়ি দেয়া শুরু করতেন এই বলে যে, বাড়িতে চিকার উপদ্রব বেড়ে যাওয়াতে তারা চিকা মারার জন্য লাঠি নিয়ে বাইরে এসেছেন। চিকামারা নামটির উৎপত্তি সম্ভবত সেখান থেকেই। চিকামারার আরেকটি উপাদান ছিল আমের আঁটি। আমের আঁটির ভেতরের নরম অংশ কালি হিসেবে টেকসই হয়।

১৯৬২ সালে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগান দিয়ে পূর্ব বাংলায় চিকামারা শুরু হয়। তবে, ষাটের দশকের শেষ দিকে এর প্রচলন আরও বিস্তৃত হয়। তারপর ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকাকালীন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদের জন্য এটি একটি কার্যকর মাধ্যম ছিল। ড. মোহাম্মদ হাননানের লেখা বই অনুসারে, ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগান লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম চিকামারা শুরু হয়।
১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে হেলাল হাফিজের কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখার মাধ্যমে চিকামারা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। কারণ, তখন এই কবিতাটি কোন পত্রিকা ছাপতে রাজি হয় নি। শেষমেশ দেয়ালই হয়ে উঠেছিল শেষ ভরসা।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চিকামারা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে থেকে যায়। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেখতে পাওয়া গেছে দেয়ালে দেয়ালে। চিকামারার ভাষাগুলো ছিল স্পষ্ট ও পরিস্কার। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নাম ব্যবহার করেই তখন দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান লিখে রাখত। শুরু থেকে এর উত্তরাধিকার বহন করেছে সরকার বিরোধী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। তাদের মধ্যে প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এই কাজে বেশ পারদর্শী।

কিন্তু হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে হঠাৎ দেয়ালে লেখার ভাষা বদলে যায়। সময়টা ছিল ভয়ানক খারাপ। শুধুমাত্র মত প্রকাশের অপরাধে জেল, জুলুম, গুম, খুন চলছিল। সেই সময়টায় ভিন্নভাবে হাজির হয় দেয়ালের লিখন। কথাগুলো যেন কারো ব্যক্তিগত প্রলাপ। কিন্তু এর গভীরে লুকায়িত ছিল জনগণের অভিপ্রায়। কেও বুঝতে পারেনি এগুলো প্রতিবাদের ভাষা। দেয়াল লেখকরা নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়, কিন্তু মনের কথাগুলো প্রকাশ করতে চায়। সাংকেতিক লেখার সাথে যুক্ত হয় চিত্রকর্ম। ধীরে ধীরে এগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকল জনগণের অভিপ্রায়। ভিন্ন ব্যঞ্জনার এই বিষয়টিকে গ্রাফিতি বলা হতে থাকে। বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চিকামারা রূপান্তরিত হয় শৈল্পিক গ্রাফিতিতে।

গুণিজনদের মতে, বিনা অনুমতিতে শৈল্পীয় উপায়ে দেয়ালের উপরে লেখনী কিংবা অঙ্কনের মাধ্যমে জনসাধারণের অভিপ্রায় তুলে ধরার নাম গ্রাফিতি। স্প্রে পেইন্ট বা মার্কার পেন সাধারণত গ্রাফিতি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই কাজটি খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে ছাত্ররা। ঢাকা থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে মফস্বলের দেয়ালে দেয়ালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দেয়ালে কালো রঙের অক্ষরে ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ লেখাটি দেখা গিয়েছিল এক সময়। ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে এক দেয়ালে লেখা পাওয়া গেল “রবীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাবের এক সদস্য”। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের দেয়ালে গ্রাফিতি শিল্প হিসেবে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগারগাঁওয়ের এক দেয়ালে ‘সুবোধ’ এর দেখা পাওয়া যায় । ২০২৪ সালে দেখা যায় “আবার ফিরে এসেছে সুবোধ”। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির মেট্রোস্টেশনের দেয়ালে সুবোধের দেখা মিলেছে আবার। সুবোধকে দেখা গেছে একটি চেয়ারকে লাথি মেরে ফেলে দিতে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে শুরু হয় কোটা বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৬ জুলাই গুলিতে রংপুরে নিহত হয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দেয়ালে দেয়ালে আবু সাঈদের প্রতিকৃতি এঁকে স্প্রে-রঙে লেখা হয়, ‘‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’’, ‘নাটক কম করো পিও।’। তারপর লেখা চলতেই থাকে। ঢাকা সহ সারাদেশের দেয়াল ভরে ওঠে বিভিন্ন লেখায়। লেখাগুলো বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় দেয়ালে দেয়ালে ফুটে ওঠে। যেমন, ‘‘আমার টাকায় কেনা গুলি, কাইড়া নিল ভাইয়ের খুলি!’’, ‘‘আসছে ফাগুন অনেক দেরী, এক্ষুণি দ্বিগুণ হও’’, ‘‘রক্ত দেখলে বাড়ছে সাহস’’। দ্রুত এর ভাষা বদলে যেতে থাকে। আগস্টে এক দফা দাবির সমর্থনে লেখা হয়, ‘‘মুক্তি সবার!’’, ‘‘শেখ হাসিনার অনেক গুণ, পুলিশ দিয়ে করছো খুন’’, ‘‘স্বৈরাচার জুলাই’’, ‘‘এক দফা’’,”এসেছে ফাগুন, আমরা হয়েছি দ্বিগুণ”, “মুরুব্বি মুরুব্বি, উঁহু উঁহু”, “যার যার অবস্থান থেকে পালাও”। ৫ আগস্ট হাসিনার সরকারের পলায়নের পর গণভবনে গিয়ে লেখা হয়, “৩৬ জুলাই”।

এখন আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী দিনের প্রতিরোধের ভাষা কি হতে পারে তা জানার জন্য। আমরা অপেক্ষা করছি।

আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে চিকামারা থেকে গ্রাফিতি, প্রতিরোধের এক মহান ভাষা হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ সাধুদের রচিত চর্যাপদে নির্মিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধের ছোটলোকি ভাষা। নরকের ভয়কে উপেক্ষা করে এর মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষার বদলে বাংলা ভাষায় ধর্মীয় ও সামাজিক বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। এটি ছিল বৌদ্ধ সহজিয়া সন্ন্যাসীদের রচিত শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিবাদ এবং অবুঝ ও গোঁড়া সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সাহসী বক্তব্য। তার উত্তরাধিকার হিসেবে শাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে চিকামারার দিনগুলো পেরিয়ে ২০২৪ সালের গ্রাফিতিগুলোই যেন নতুন যুগের এক চর্যাপদ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
- Advertisment -

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

shahanarabanani@gmail.com on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on কবিতাগুচ্ছ
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on রসূলের (স.) শানে সনেটগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on এক চিমটি মুজিববাদ
--অতনু রায় on কবিতাগুচ্ছ