spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যসাম্প্রতিক বাংলা কবিতা : পাঁচ

ধারাবাহিক আলোচনা রচনাকাল ডিসেম্বর ২০১৬ লিখেছেন সাজ্জাদ বিপ্লব

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা : পাঁচ

রিকেল

…..

এই আলোচনা পর্বের শুরুতে আমি প্রথমে উচ্চারণ করেছিলাম, কালপুরুষ (Tarikul Islam)-এর নাম। তাকে আমি বলেছিলাম, এ প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্ভাবনাময় কবিকণ্ঠ।

“কালপুরুষ, একটি নেশা, একটি ঘোর”, মতামতে জানিয়েছিলো, তার সমকালীন কবিবন্ধু, রিকেল।

কিন্তু, রিকেল, কি জানে সে নিজেও একটি ঘোর, একটি নেশার নাম? তার হাতেও আছে, কালপুরুষ -এর মতো যাদু তৈরীর ক্ষমতা।

…..

রিকেল এর কবিতা:

১.

আপনি কি নির্বোধ? মাতাল? স্বপ্ন দ্যাখেন মধ্যরাতে কোনো নগ্ন রমণীর?

ঘুম ভাঙার পর আপনার কি রাষ্ট্রের কথা মনে পড়ে?

আপনার কি তিনটি আত্মহত্যার অভিজ্ঞতা আছে?

আপনি কি বামহাতে ধর্ম আর ডানহাতে বিজ্ঞান নিয়ে ঘোরেন?

আপনার দেয়ালে কি কবি এবং দার্শনিক ঝুলিয়ে রাখেন? তাঁদের ব্যথা নিয়ে একটা স্কুল বানাতে পারবেন?

আমি সঙ্গম শেখাবো— কী করে রাষ্ট্র উৎপাদন করতে হয় ৷

*

রাষ্ট্র নির্মাণ বিদ্যালয় 

২.

লিখতে বসেছি আকাশ আর মেঘেদের ব্যবধান নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা

যদি গড়িয়ে পড়ে বরফ আমি কার কাছে যাব নিয়ে রবিবারের দুঃখ?

প্রেমে, একটা মৃত পাখিরও ডানা গজায়

কেউ কেউ ঘুরে আসে— কবর— মৃত্যুহীন—নভালবাসা করে ৷

প্রেম কি চিরকাল স্বর্গের দিকে যায়?  যাবে চিরকাল?

প্রেমিকা কি চিরকাল অন্যের দিকে যায়?  যাবে চিরকাল?

এই নরম গভীর ব্যথা নিয়ে আমি আর কার কাছে যাব?

কার কাছে গেলে আরও অধিক মধুর ব্যথা পাব?

তবু, এই ঠোঁট মরণের পাশে শুয়ে তোমার গল্প করে

তবু, এই ঠোঁট মরণের পাশে বসে তোমার গান ধরে ৷

‘তোমাকে ভালোবাসি’

এই নিয়েও সারারাত গল্প করতে পারি,

তোমার নামে দোকানে কোনো দুঃখ পাওয় যায়? লাইব্রেরিতে বই?

ভাবছি নিজের মৃত্যুটাও বিক্রি কোরে দেব

*

মৃত্যুটা বিক্রি কোরে দেব 

৩.

উজ্জ্বল এই পৃথিবীতে একটি মাত্র জীবন আমার ৷

আশ্চর্য এই পৃথিবীতে মাত্র একটি জীবন আমাদের ৷

সকল প্রেম সঙ্গে নিয়ে তবু উড়ে যাচ্ছি নরকের দিকে

সকল আলো সমস্ত রাত্রি সব ব্যথা নিয়ে তুমি আর আসবে না— আসবে না ভোরে? আগস্টের রূপালি অন্ধকারে?

সকল অতীত সমগ্র ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি একটি পাখি বানিয়েছি

একটি গাছ একটি বাসা একটি কিশোর প্রেম

তুমি কি আজও ষোল? আকাশ দ্যাখো একা?

একটি ঘুড়ি ওড়ছে আকাশে; উড়ে যাচ্ছে চিল— উড়ে যাচ্ছে মেঘ— উড়ে যাচ্ছে পাখিদের ডানা

আমি কার কথা নিয়ে লিখছি গান— তোমার?

আমি কার ব্যথা নিয়ে লিখছি গান— তোমার?

আমি কার ঠোঁট নিয়ে লিখছি গান— তোমার ৷

তোমার নাভি-ই একমাত্র কবর যেখানে মৃত্যু নিয়ে প্রবেশ করা যায়;

আমার আছে গোলাপ আছে সত্য চুম্বন— আমি কি একা সমুদ্রে যাব?

শ্মশানে এত নীরব এত আগুন আমার দুঃখ লাগে হে প্রেম!

আমি উড়ে যাই আকাশে? সঙ্গে নিয়ে দু’একটা মধুর পূর্ণিমা

*

কবর 

….

রিকেল, ভাই আমার, তুই কি আমাদের ধার দিবি তোর সোনার কলম?

…..

মজিদ মাহমুদ

…….

“মাহফুজামঙ্গল” লিখেই যিনি খ্যাত, তিনি কবি মজিদ মাহমুদ (Mozid Mahmud)। আমাদের কালের একজন শক্তিমান কবি ও গদ্যকার।

প্রাবন্ধিক ও নজরুল গবেষক হিসেবেও তিনি পরিচিত। আদৃত।

লিটলম্যাগাজিন “পর্ব” সম্পাদনা, তার আরেক দিক। এতোসব পরিচয় পর্ব পেরিয়ে আমাদের কাছে যা মুখ্য ও প্রধান হয়ে ভেসে ওঠে, তা, তার কবিসত্তা। কবিতায় তার অবদান আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এ সময়ে যাদের হাতে বাংলাকবিতা তরঙ্গের মতো ঢেউ তুলে কবিতার সীমানা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের অন্যতম একজন কবি মজিদ মাহমুদ।

কবিতা কত ব্যঞ্জনায় প্রস্ফুটিত হতে পারে তা এই কবি’র সাম্প্রতিক কবিতা পড়লেই বোঝা যায়।

কবি মজিদ মাহমুদ এর কবিতা

….

বারাক-হিলারি আলিঙ্গনের পরে

……

হিলারি ও বারাক যখন পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরলেন

তখনই সম্পন্ন হলো মানুষের পূর্ণাঙ্গ মিলন

কেউ আর তখন নারী নয়

কেউ আর তখন পুরুষ নয়

তাদের একটি আকাঙ্ক্ষা হলো পুরণ

মানুষের যে অর্ধেক ছিল শাদা

বাকি অর্ধেক কালার সাথে মিলিত হলো

টেকটোনিক বিভাজনে যে অর্ধেক

ছিটকে পড়েছিল পৃথিবী থেকে

তা আবারও কাছাকাছি এলো

তার আগে জেসাস ও মহামেডান

একত্রিত হয়েছিলেন বারাকের সাথে

এবার শাদা ঘরের বাইরে থাকা মানুষের

অর্ধেক স্পর্শ করছে মার্কিন সংবিধান

যে বিধান তৈরি করেছিলেন ওয়াশিংটন

লিঙ্কন যা রক্ত দিয়ে ধুয়েছিলেন

এবার ঘুচে গেল তার অস্পৃর্শতা

যদিও ইয়াঙ্কিরা অনেক দুঃখের কারণ

তবু মানুষের দিকে তাদের এই যাত্রা

নারী এখন থেকে আর নারী নয়

কালো এখন থেকে আর কালো নয়

লিঙ্গ ও বর্ণের বাইরে ইয়াঙ্কিরাও মানুষ।

২.

দৃশ্যেন্দ্রিয়

…..

চোখ কী আসলে মানুষের দৃশ্যেন্দ্রিয়

চোখ পারে না করতে ভালো-মন্দের বিচার

ভালো বলে তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে

চোখ তার করে কেবল সমর্থন দান

যারা কালোকে ভালো নয় ভাবে

তাদের চোখ কি কালোর পক্ষে থাকে

যে নারীর প্রেম তোমার হৃদয়ে ঢুকেছে

স্থুল বা কৃশ

চোখ তারই পক্ষে চিরদিন

চোখ বন্ধ হলেও তুমি তাকে দেখতে পাও

হয়তো নয় সে আয়তলোচনা

চোখ দিয়ে তাই আমরা দেখি না

বিজ্ঞান বলে

বস্তু থেকে আলো ঠিকরে মস্তিস্কে গেলে

আমরা দেখি

আবার আলো না থাকলেও

বস্তুর উপস্থিতি আমাদের হৃদয়ে থাকে

কেবল চোখ নয় মানুষের দৃশ্যেন্দ্রিয়

করতল, স্পর্শ, ঘ্রাণ ও লেহন

এমনকি মস্তিস্কের নিউরোনগুলো

দেখার জন্য উদ্রগিব

দেখতে চাইলে কমাও চোখের নির্ভরতা

অনুভূতি এক ধরনের দেখার নাম

বস্তু থেকে ভাবে উন্নীত হলে

খুলে যেতে পারে তোমার দৃশ্যেন্দ্রিয়

দেখবে চোখের প্রতিটি অদৃশ্য কণা

দুষ্টু শিশুদের মতো এমন খেলায় মত্ত

তখন আলাদা করে চিনতেও পারবে না।

৩.

বুড়ো হয়ে যাচ্ছি

……

বেশি বেশি কবিতা লেখার অর্থ তুমি বুড়িয়ে যাচ্ছ

তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে, সলতে শুকিয়ে যাচ্ছে

প্রবল বেগে নিতে চাচ্ছ দম

তাই কবিতার বদলে ঘরৎ ঘরৎ শব্দ হচ্ছে

নিঃশব্দে যতদিন শ্বাস নিয়েছ

ততদিন কেউ লক্ষ্যই করেনি

অথচ আজ বলছে, আমার এখন আর কিছু হচ্ছে না

বলছে, কবিতা লেখার দিন নাকি শেষ

তাহলে কি আমি কবিতা লিখেছিলাম কখনো

এখন মনে হয়, কবির কাজ খারাপ কবিতা লেখা

প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি সর্বদা হতে হবে খারাপ

তাহলে কিছুটা হলেও গ্রাহ্যতা পাওয়া যেতে পারে

খারাপ কবিতার প্রতি বন্ধুদের করুণা থাকে

অনেককেই যৌবনেই এই সত্য বুঝেছিলেন

তাই যুদ্ধে যাওয়ার ডাক দিয়ে কেউ হারিয়ে গেলেন

কিংবা রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট, ব্যাস

তারপর যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গেলেও

যুদ্ধভীতুরা সুযোগ পেলেই সে-সব করে আবৃত্তি

লোকে যাতে ভাবে এইসব বীর যুদ্ধে নাহি ডরে

তাই জীবনে একটা কবিতা লেখ, না হয় দুটি

অহেতুক বাজে মালে গুদাম বোঝাই

অহেতুক ঘরৎ ঘরৎ

বুড়া পাঁঠার মতো একই শব্দ

ফ্রজেন সিমেনের যুগে

সবাই অপ্রয়োজনীয় ভাবে

যখন ভার্চুয়াল উত্তেজনায় যাচ্ছে ঝরে তরল

তখন আমাদের সাক্ষাৎ সময়ের অপচয় ছাড়া কি

তবু দপ করে নিভে যাওয়ার আগে

নিজেই হয়ে উঠছি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি।

……

তমিজ উদদীন লোদী

…….

প্রবাসী কবিদের মধ্যে কবিতা ও কথা সাহিত্যে পারঙ্গম যে ক’জন আছেন, কবি তমিজ উদদীন লোদী (Tamiz Uddin Ludi), তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, আলোচক, টিভি উপস্থাপক ও সাহিত্য সম্পাদক।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের কাছে তিনি কবি হিসেবে অধিক আদরণীয়। বরণীয়। শক্তিমান।

কবিতায় তার স্বাতন্ত্রতা ইতিমধ্যেই তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি নিরন্তর সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন, বাংলা কবিতা, তার মতো করে।

কবি তমিজ উদদীন লোদী’র কয়েকটি কবিতা:

…..

তন্ময় স্বাপ্নিকের মতো

[লোকমান আহমদ অগ্রজপ্রতিমেষু]

সমাজ বদলাবো বলে

আমরা নেমেছিলাম রাস্তায় হাতে হাত ধরে

আপনি ছিলেন পুরোভাগে

প্রত্যয়দীপ্ত ,সাহসী,যুযুধান ।

মনে পড়ে খুব রপ্ত করেছিলাম ‘ডাস ক্যাপিটেল’

বুক পকেটে মার্কস-লেলিন , চোখে ইউটোপিয়াসম স্বপ্ন

তখন আমাদের রাত্রি নেই ,কোনো দিন নেই

হু হু হাওয়ার মতো ,অনেকটাই বোহেমিয়ান, বন্য

কোনো প্রতিবন্ধক-কে আর প্রতিবন্ধক মনে হচ্ছিল না তখন ।

আপনি এখনো আছেন তন্ময় স্বাপ্নিকের মতো

তবু আগের মতোই প্রশ্ন ওঠে,’সমাজ বদলালো কই’?

নাকি বদলেছে ?

নাকি এখনো ঝরছে রক্ত , এখনো ক্ষরণ !

এখনো দগদগে ঘা-য়ে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য অজস্র ডুমোমাছি ?

এখনো কি নুয়ে আছে প্রলেতারিয়েত ,হাজারো প্রান্তিক চাষী

এখনো কি গড়িয়ে যাচ্ছে জল একদেশদর্শী গড়াইয়ের দিকে ?

২.

পৌরাণিক সন্তের মতন

[ বব ডিলান-কে মনে রেখে ]

ওরা তোমার জন্য নিয়ে এসেছে হীরার মুকুট

আর তুমি ভ্রূক্ষেপহীন বেরিয়ে পড়েছো বনজ্যোৎস্নায়

খুঁজছো চাঁদের হীরে

ত্রসরেণুগুলো ভাসছে অকৃত্রিম নদীতে ।

তুমি খোলসবিহীন হেঁটে যাচ্ছো আদি পৃথিবীর রাস্তায়

মগ্ন,ব্যাপৃত ,বুঁদ -ঝুরির মতো চুলে নেমে গেছে জটাজাল

খুঁড়ে তুলছো আকরিক

কাঁচের জৌলুসে ভেসে যাওয়া এসিড বৃষ্টির মতো তুমি একা

ভিজে যাচ্ছো পৌরাণিক সন্তের মতন ।

৩.

অভয়ারণ্য  ব্যেপে হরিণেরা মুখ তোলে

বিভ্রান্ত মানুষেরা  হালাকুর গল্প বলতে চায় । যদিও কখনো থেমে যায়নি সিম্ফনি,এস্রাজ ।

গোলাপের গন্ধ নেবার জন্য এখনো প্রেমিকেরা পাড়ি দেয় বৃষ্টিভেজা তরঙ্গের রাত ।

সমূহ মৌনতা নিয়ে সন্তেরা খুঁজে ফেরে নির্বাণের পথ । শিস দিতে দিতে বাড়ি ফেরে

কিশোরেরা । এখনো আজান ও ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে যুগপৎ ।

হলোকাষ্ট ও গণহত্যার করোটিগুলি যদিও নিয়ত নৃশংসতার ছবি এঁকে যায় তবু

অভয়ারণ্য  ব্যেপে হরিণেরা মুখ তুলে আবারো নামায় । শাখামৃগ ঝাঁপ দেয় গাছে ।

মানুষেরা শিল্পগামী হয় । গোয়ের্ণিকা অথবা লাস্ট সাপারে  বুঁদ হয়ে থাকে । খোঁজে

অজন্তা কিংবা ইলোরার গুহাগাত্র । এচিং কি আঁচড়ের দাগ থেকে তুলে নেয় বিভা ।

থেমে যায়নি বৃষ্টি । থেমে যায়নি মেঘ-চিত্র । ঈশান কি  নৈর্ঋতের হিসহিসে ক্রোধ ।

নিউইয়র্ক

১৯ অক্টোবর ২০১৬

……

মিনার মনসুর

…….

আমার অগ্রজ ভালো লাগা কবিদের মধ্যে কবি মিনার মনসুর (Minar Monsur) অন্যতম। তিনি একাধারে একজন শক্তিমান কবি ও গদ্যশিল্পী। সম্পাদনা করেছেন, লিটলম্যাগাজিন : এপিটাফ

উচ্চ কণ্ঠ নয়, ঋজু ভঙ্গীতে তিনি গেঁথে চলেন তার কবিতার শরীর।

সমকালীন নানা অসঙ্গতি ও ঘটনা একজন সচেতন ও সংবেদী কবি হিসেবে তাকে করে তোলে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচক্রে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা ও দুর্ঘটনার একজন কবিস্বাক্ষী তিনি। তিনি শুধু ইতিহাসের এ সব অধ্যায়ের স্বাক্ষী হয়েই নিশ্চুপ থাকেননি। সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পালন করেছেন বিবেকী দায়িত্ব।

“শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ” বা “অবরুদ্ধ মানচিত্রে” সঙ্কলন দু’টি তার সাহসী সম্পাদনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তবু, সবকিছুর পরেও তিনি একজন কবি। আমাদের সাম্প্রতিক অবরুদ্ধ মানচিত্রে এক ব্যতিক্রম প্রহরী।

পড়ুন, কবি মিনার মনসুর এর কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা:

শরতের কবিতাগুচ্ছ–৪

ঘাসফুলটি হাসে

……

কী রাজসিক তোমার উদযাপন! রক্তগালিচার ওপর দিয়ে নাঙা তলোয়ার হাতে ধেয়ে আসছে তোমার অশ্বারোহী বাহিনী। তোমাকে কে দেখে? দেখে শুধু ধাবমান ধূলিঝড়। আর তাকে বিদীর্ণ করা তরবারির বিদ্যুৎ। তবু গোলাপের পাপড়ির মতো অবিরাম বর্ষিত হচ্ছে কাটা মুণ্ডের অর্ঘ্য।

তোমার অপেক্ষায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে কবন্ধ কাফেলা। কারো হাতে গঙ্গাজল। কেউ-বা ধরে আছে চন্দনের বাটি। যেন উৎসব! আছেন অতীশ দীপঙ্কর। গেরুয়া বসনে তাঁর কৃষ্ণ কারুকাজ। অদূরে অর্জুন– বর্মাবৃত। ফোরাতের দুই পাড়ে ধ্যানমগ্ন বকের মতো শুভ্র আলখেল্লার বাহার। কোনটা কারবালা আর কোনটা কুরুক্ষেত্র– তোমার তাতে কীই-বা আসে যায়!

সহস্র বছর ধরে গ্রহাণুর মতো তুমি ছুটছো। পেছনে করোটির দীর্ঘ মিছিল কদাচিৎ ঢেকে দেয় সূর্যের সপ্রতিভ মুখ। গুহারা সদলবলে প্রমোদভ্রমণে যায় জার্মানির জল্লাদখানায়। পোল্যান্ডের পতিত জমিতে পরিত্যক্ত করোটির ভেতরে বসে ঘাসফুলটি হাসে। কেননা সান্তা ক্লজের তুষারশুভ্র শ্মশ্রুর মতো মিষ্টি মেঘেরা খুনসুটি করে তার সঙ্গে।

২.

শরতের কবিতাগুচ্ছ-৩

ভল্লুকের থাবায় তুমি ওত পেতে থাকো

…..

যদি বলি সর্বত্র তোমাকেই দেখি– সাগর ক্রুদ্ধ হবে জানি। বৃক্ষবন্ধন হবে বনে বনে। কাঠবিড়ালির চঞ্চল পায়ে চকিতে উঠবে বেজে তাচ্ছিল্যের নূপুর।

…এমনকি ঘাসের ডগায় বেজে ওঠে যে শিশিরের গান– তাতেও অস্পষ্ট নয় তোমার গর্জন। বেহুলার পাশে তুমি শুয়ে থাকো লোহার বাসরে। পতপত করে ওড়ে তোমার পতাকা সপ্তডিঙার দর্পিত মাস্তুলে।

তারপরও বিবাদ থামে না। ভল্লুকের থাবায় তুমি ওত পেতে থাকো– তাতে কি থেমে যায় স্যামনের সমুদ্র বিহার? হাজার বছর ধরে ক্লান্তিহীন তোমার দশ হাত রুধিরে রাঙাতে চায় শরতের মেঘ আর হাকালুকির জল।

ভোরের আকাশ তবু ভেসে যাচ্ছে নবজাতকের সদর্প সংগীতে।

৩.

একটি ষাঁড়কে দেখি

…..

রবীন্দ্র রচনাবলী ফুঁড়ে প্রথমেই বেরিয়ে আসে বার্নিশ করা দুটি শিং। তারপর ধূলিঝড়। গোটা শান্তি নিকেতন উড়তে থাকে ছিন্নভিন্ন পাণ্ডুলিপির মতো। অতঃপর মূর্ত হয়ে ওঠে লোমশ দুই কৃষ্ণগহ্বর। সেখান থেকে নির্গত হচ্ছিল সহস্র কোবরার গর্জন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে স্বরূপে উদিত হয় যুগল বল্লম। গোলফ্রেমের চশমাশোভিত।

ষাঁড়টি আয়নায় নিজের মুখ দেখে। একের পর এক সেলফি তোলে এবং সেগুলো পোস্ট করে ফেসবুকে। তার প্রোফাইল জুড়ে থাকে উদ্যত শিংয়ের শাসানি।

মুখটি বড়ো চেনা মনে হয়। তবে কি পিকাসো এ ষাঁড়টির কথাই বলেছিলেন গুয়েরনিকার বিষন্ন সন্ধ্যায়? ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার দিকেই অঙ্গুলি-নির্দেশ করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান? শুনে গাবতলীর লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো হাসে। বলে, এইডারে আপনে ষাঁড় কন! ভেড়ার জঙ্গলে আচানক গরুর দঙ্গল দেইখ্যা আউলাইয়া গেছে বুঝি সব।

হতেও তো পারে! ফের ষাঁড়টিকে দেখি। শুনি সমবেত আত্মবন্দনা গীত। আচমকা অন্তর্জাল ছিঁড়ে ষাঁড়টি তেড়েফুঁড়ে আসে। ‘শালা, লাইক দে..!’ ঠিক তখনই নিভে যায় সিনেপ্লেক্সের আলো। কালোর ক্যানভাসজুড়ে চলতে থাকে আন্তঃমহাদেশীয় শিংয়ের ঠোকাঠুকি আর লোমশ গর্জন।

চলুন তবে হিলারি আর ট্রাম্পের তর্কযুদ্ধের ফলাফল দেখি।

…..

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

…….

ইদানীং, রাজনীতি মানুষের মাঝে বিভেদের বিষাক্ত দেয়াল তুলে দেয়। অথচ রাজনীতির কথা ছিলো, সুন্দর মনের মানুষ ও নির্মল সমাজ উপহার দেয়ার। ভিন্নতা সত্ত্বেও সুন্দরতা প্রস্ফুটনে সাহায্য করার।

কিন্তু কেউ-কেউ অন্ধ আবেগ ও অনুদারতা পরিত্যাগ করতে না পারায়, তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।

মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। থাকেও। কেননা, সবাই এক রকম ভাবলে, আর বৈচিত্র্যতা থাকে কোথায়?

ভিন্ন ভাবনা বা চিন্তা আছে বলেই ভিন্ন-ভিন্ন কবিতা লেখা হয়। ভিন্ন স্বাদের মুভি তৈরী হয়।

মানুষ এখনো বৈচিত্র্য প্রয়াসী। ভিন্নতার পূজারী।

রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সে কারণেই, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ, এই দুই বিপরীত মেরুর কবি’র কবিতার রসাস্বাদনে আমাদের, বিশেষ করে আমার, কোন অসুবিধা হয় না।

যেমন কট্টর রাজনৈতিক চিন্তায় জারিত হলেও কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এর কবিতা আগে থেকেই আমার ভালো লাগতো। এখনো সময় ও সুযোগ পেলে তার কবিতা পড়ি।

প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় বলে রাখি, এক সময় এই কবি আমার এতোটাই প্রিয় ছিলেন যে, তাকে আমার প্রথম বইটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম। পরে নানা কারণে তা আর করিনি। তাতে কি! ব্যক্তি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল আমার দূরের বাসিন্দা হলেও তার কবিতার আমি কাছের পাঠক।

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এর সাম্প্রতিক কালে রচিত কয়েকটি কবিতা :

.…

ইঁদুর খাই, গুলি খেতে চাই না 

আমরা ক্ষুদ্র; ক্ষুধা আমাদের নিত্য ছায়াসাথী, সহোদর।

আমরা ইঁদুর খাই, গুলি খাই।

গাঙ’এর জল পান করি, মাটিই আমাদের সাবান,

থাকি বনজঙ্গলে, বনপাহাড়ের কাছাকাছি। গাছগাছালি মহাঔষধ।

বউ, বাচ্চা, অলচিকি এবং তীর-ধনুক ছাড়া আর কিচ্ছু নাই

ওদের জন্য, ক্ষুধার জন্য তীর ছুঁড়ে ইতরপ্রাণী শিকার করি,

এই তীর আর কারো জন্যই ক্ষতিকর নয়।

*

১৮৫২, নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়েছি। কিন্তু কর-খেলাপি নই,

আমরা নরম নিরীহ; দরিদ্রের চেয়েও গরীব, ভূমিহীন  ঘুমাই,

শুয়রের বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে থাকি।

আমরা কারো শহরে, কারো স্বপ্নে, কারো দুধভাতে ভাগ বসাইনা,

আমরা ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র জাতী, ক্ষুদ্র জাতী স্বত্ত্বা। কিছু দিন পর বিলুপ্ত হবো।

এই কটা দিন ইঁদুর খেয়েই বাঁচতে চাই।

*

আমাদের সিদু-কানু ক্লান্ত। বিদ্রোহ ভুলে গেছি, বাঁচতে চাই।

আমারও সামান্য মা এই দেশ, এই মাটি

মা-মাটি কামড়ে পড়ে থাকি খোলা আকাশের নিচে

আমরা কান্নার বদলে নৃতত্ত্বের গান গাই,

আমরা ইঁদুর খাই, শেয়াল-সাপ-পাখি খাই; কিন্তু গুলি খেতে চাইনা!

নভেম্বর ১১, ২০১৬, টরন্টো।

২.

পরাবাস্তবে 

মৃত্যুর পর পরাবাস্তবে পরীদের সাথে ছিলাম, পাহাড়ে।

আহরে কী এক অদ্ভুত!

*

তাহারা পাহাড়ের বোন, থাকে পর্বতের গুহায়। গুহাঘরে আলো নেই।

পরীদের স্তনের ঘ্রাণ আর শরীরের সুবাসেই আলোকিত গুহাঘর-

লাল-নীল-হলুদ-সবুজে সাজানো যেনো পাতা বাহারে,

আহরে কী অদ্ভুত!

*

তাহাদের ক্ষুধা-খাদ্য নেই, ধর্ম এবং দুঃখ নেই।

বহুযুগ আগে ভূতপেত্নিরা পূর্বপুরুষ ছিলো তাহাদের।

আকাশের ছাদে, চাঁদে, মেঘবাড়ি ঘুরে বেড়ায় বাতাসের ক্যাবল কারে।

আহরে কি অদ্ভুত!

*

আমার হাতের হাড়হাড্ডি যেনো জাদুর কাঠি, কংকালখুলি তবলা; বাজায়।

পাখা খুলে, খুলতে খুলতে খুলতে খুলতে নগ্ন নৃত্য করে, গান করে

অলৌকিক ভাষা বুঝিনা। তবু বান্ধব মনে হয় তাহারে।

আহরে কি অদ্ভুত!

নভেম্বর ০৩, ২০১৬, টরন্টো।

৩.

শাওয়ার 

স্নানঘরে ছায়া খুলে যেও

ভুলে যেও সাবানের ঘ্রাণ।

টের পান, দেখে যদি কেউ

নদী, ঢেউ, চাঁদ ছুঁয়ে দিবে

ধুয়ে দিবে দুধফুল, দু’পা

চুলখোপা খুলে নগ্ন হবে।

মগ্ন হবে–

কবি রবীন্দ্রনাথ।

…….

রুহুল মাহফুজ জয়

……..

কবি’রাও মানুষ। অন্যান্য আর দশজন মানুষের মতো। তাদেরও আছে কাম-ঘাম-ক্ষুধা-তৃষ্ণা-হাহাকার-আর্তি…

কবি হলেও জীবনানন্দ দাশকে বাজারে যেতে হতো, আমাকেও যেতে হয় ফার্মার্স মার্কেট, ওয়ালমার্ট, আপনাকেও যেতে হয় কোথাও না কোথাও সওদা করতে। কিছু কিনতে না হয় কিছু বেঁচতে। বাঁচার তাগিদে। এবং এভাবেই এগিয়ে চলে জীবনচক্র।

এই রূঢ় এবং কর্কশ জীবন, এ কালের একজন তরুণ কবি’কে কীভাবে আলোড়িত করে তার তীর্যক বর্ণনা, “সাদা ভাতের মতো” ছড়িয়ে আছে কবি রুহুল মাহফুজ জয় এর “আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো” কাব্যগ্রন্থের পরতে-পরতে।

“আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো” শোনার পর থেকেই আমার মনে অনুরণিত হতে থাকে। তবে, শুধু ক্ষুধা নয়, আমাদের অনেক-অনেক ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি অনেককিছুই, আত্মহত্যাপ্রবণ।

একজন কবি ছাড়া কে তা বুঝবে, এমন করে!

আসুন, বইটির সামান্য ভাঁজ খুলে কয়েকটি অসামান্য কবিতা দেখে আসি।

……

কবি রুহুল মাহফুজ জয়-এর কবিতা :

…..

শ্রীরামপুরমুখী ক্ষুধার পেটে সূর্য অস্ত যায়; ইহ-জান্নাতের দিকে ধাবমান আমার সব ক্ষুধা আত্মহত্যাপ্রবণ। অনেকের অনেক ক্ষুধার চিঠি আমি খুলেও দেখি নাই, অনেক ইশারা সানাই বাজিয়ে চলে গেছে সারিবদ্ধ পিঁপড়ার মতো। যেভাবে মানুষেরে নাচায় অদৃষ্ট, রূপালি পর্দায় মেগাস্টাররে নাড়াচাড়া করে রিলমাস্টার—ওভাবেই আঙুল নাড়াও, দূরবর্তী দেয়ালে নেচে উঠুক আমার নিজস্ব ক্ষুধা; ফাঁসির দড়ি থেকে আমার আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো জীবনের দিকে ফিরে গিয়ে বলুক— নুশরাত! নুশরাত!!

[আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো ১, রচনাকাল জানুয়ারি ২০১৪]

২.

সন্ধ্যা হইসে গোধূলির আগেই, গাইতেসো সান্ধ্যসঙ্গীত, বিষ্টি বিষ্টি খেলসো দিনভর, ভেজার গল্প কইসো কত্তজনারে, দিনটার মৃত্যুগন্ধ তুমি গায়ে মাখো নাই— মৃত্যু এমনই এক জিলাপিওয়ালা, যার হাত নাড়া দেইখা থমকায়ে যায় জাদুকর, জিলাপির প্যাঁচকে সে ভাবে অধীত মন্ত্রের শ্লোক-আনত স্বর— সেও আরেক অস্ফুট আত্মহত্যা ঘনায়মান সন্দেহ-শিরায়; এখন আষাঢ়ে ক্ষুধায় পাখিরাও কেমন মরে মরে যায়!

[আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো ২ / রচনাকাল: জানুয়ারি ২০১৪]

৩.

প্রতি সকালে আম্মা থালা ভরা ভাত রাখেন বারান্দায়— পাড়ার পাখি উড়ে আসে, ভোরের মর্মরে বাজে ক্ষুধার ঢোল। আমার চোখ থেকে ক্যাকটাসের মতো কোমল ঘুম খেয়ে নেয় চড়ুইয়ের ঠোঁট। পাখির জন্য আম্মা বাটিতে পানি রাখেন— আমার ত্বকে জন্ম নেয় সহস্র ব্যাঙাচির তৃষ্ণা। আমার ক্ষুধারা পাড়ার পাখিগুলোকে মনে করে জলতভাই; আম্মার হাসিকে ওরা মা মা বলে ডাকে। কাকেরা, চড়ুইরা (অন্য পাখিও আসে, নাম জানি না) একই থালায় ভাত খায়— আমি মানুষের বাচ্চা হয়ে পাখিজন্মকে ঈর্ষা করি।

[আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো ৩ ।। রচনাকাল: জানুয়ারি ২০১৪]

‘আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো’ বইয়ের প্রকাশক ঐতিহ্য। 

……

ফেসবুক থেকে আহরিত কবি রুহুল মাহফুজ জয়-এর ক্ষোভ মিশ্রিত উচ্চারণ নিম্নরূপ :

বই প্রকাশ হয়েছে আট মাস। কৃপণ পাঠকরা যেন ‘আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো’ বইটা পড়তে পারে, সে বিবেচনায় বইয়ের সবগুলো কবিতা একে একে ফেইসবুকে পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ থেকে আগামী ৫৪ দিনে প্রতিদিন একটি করে লেখা পোস্ট করবো। বইটি প্রকাশ হয় এ বছর জানুয়ারিতে। প্রকাশকঐতিহ্য।

আজ রইলো ‘আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো’ সিরিজের ভূমিকা।

“মা, ধরিত্রির খুব জ্বর, গা পুড়ে যায়, কেউ দেখার নাই তারে। মহাবিশ্ব এতিমখানা। ধরিত্রি এতিমদের রাণী। তার রাজা নাই, মুকুট নাই, সিংহাসন নাই, প্রজারা দরিদ্র, যা ছিল তার সবই যেন খেয়ে ফেলেছে লোভী মানুষ, রাষ্ট্র আর সংঘ।

জননী কহেন — চাল নিয়ে নাড়াচাড়া করি, মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সহস্র উদর। পিশাচের চোখ আর বুভুক্ষু হৃদয় নিয়ে অনেক অনেক মানুষ ঘুরছে এ পথ থেকে ও পথে, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, বাজার, শহর, দেশ থেকে দেশান্তর। খাবারের জন্যে মুখ হা করে থাকে, চোখ খুলে রাখলে পিটপিট করে। শিরা-উপশিরা, লৌহকণিকা, প্রতি ফোঁটা রক্ত নিজস্ব ক্ষুধার দিকে আত্মহত্যাপ্রবণ।

ও মা, মাগো…আমিই যেন ভাতের মাড় গলে পড়া চালের অসুখ। আমাকে ফেরাও, সিদ্ধ হয়ে গলে পড়ার এই খেলা আর ভাল্লাগে না আমার।”

………..

প্রত্যেক কবি’ই চান, তার বইয়ের প্রচার। তার খ্যাতি বা কীর্তির বিস্তৃতি। বিক্রি। আমিও চাই। আপনিও চান। চান, কবি রুহুল মাহফুজ জয়-ও। এতে অন্যায় কিছু নেই। একজন কবি’র বই যত বেশি বিক্রি হবে, তত সে কবি, কবিপরিবার এবং প্রকাশক, পাঠক, সর্বোপরি দেশ এগিয়ে যাবে। সমৃদ্ধ হবে, জাতি, গোষ্ঠী।

আসুন, আমরা “আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো” বইটি সহ অন্যান্য কবি’র কাব্যগ্রন্থ নিয়মিত কিনি এবং উপহার দেই, একে অপরকে।

বইটি’র বহুল প্রচার ও বিক্রি কামনা করছি।

…..

রাসেল রায়হান

……

এ সময়ের তরুণ কবিদের মধ্যে কবি রাসেল রায়হান (Rassel Raihan) একটি বিশেষ স্থান ইতিমধ্যেই দখল করেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত, দৈনিক প্রথম আলো প্রবর্তিত “জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি  ১” পুরস্কার প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ “বিব্রত ময়ূর “ তার প্রমাণ। এটি একটি অর্জন। একটি স্বীকৃতি।

এই পুরস্কার আমরা কেউ চাই বা না চাই কিম্বা পছন্দ করি বা না করি, সেটি ভিন্ন কথা। এটি নিয়ে দীর্ঘ অথবা স্বল্পমেয়াদী বিতর্ক হতে পারে। হোক। হওয়া উচিতও। কেননা, কাজ করলেই তার সমালোচনা হয়। না করলে, তারও সুযোগ নাই।

এ নিয়ে কবি রাসেল রায়হান, নিজেও তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও খোলামেলা কথা উঠে এসেছে।

আমার নিজের, কবি রাসেল রায়হান এর কবিতা পড়ে, তার সমকালীন অন্যান্য কবিদের মতোই তাকে মেধাবী ও সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে।

একালের কবিগণ তাদের কবিতায় গভীর জীবন বোধ তথা দর্শন ফুটে তোলেন গল্প বলে বা আখ্যানের ছলে। সরল ভাবে।

কবি রাসেল রায়হান এর কবিতাতেও এই দর্শন বা জীবন বোধ পাওয়া যায়, গল্পের আড়ালে। এটি একালের কবিদের একটি অন্যতম লক্ষণ।

কবি রাসেল রায়হান এর প্রতি এখন আমার একটি কথাই বলার আছে, এই পুরস্কার বা প্রাপ্তি যেন তাকে বিব্রত না করে!

কারণ কবিতার দীর্ঘ পথে তার যাত্রা সবে শুরু।

শুভ কামনা করছি।

কবি রাসেল রায়হান এর কবিতা :

…….

ভবিষ্যদ্বাণী

একদিন পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ থাকবে না। নিজেরাই হত্যা করবে নিজেদের।  এমনও হতে পারে, নিজেকে হত্যার জন্য খুনি ভাড়া করবে তারা। আকাশ থেকে নেমে আসা কোমল দড়ি বেয়ে যে লোকটি স্বর্গে পৌঁছে যেতে পারত জীবিত, সেও আহম্মকের মতো সেই দড়িতে গলায় পেঁচিয়েই সুইসাইড

করে বসবে!

শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষের মতো দেখতে শপিংমলের ম্যানিকুইনগুলো।   চাপা হাসি শোনা যাচ্ছে তাদের, অনতিদ্রুতই মানুষ হওয়ার অনুমতি পাবে তারা

২.

ঘড়ি 

সন্দেহ করতাম আপনি শিরিনকে ভালোবাসতেন, বেঁচে থাকতে স্বীকার করেননি।

মারা যাওয়ার  আগে যে ঘড়িটি  আমায় দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা ঘড়ি নয়, আমার

হৃদয়; ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় আব্বা দিয়েছিলেন’—সেটি এখনো চলছে।

আমি ডানহাতে পরি!

আশ্চর্য ব্যাপার, শিরিন  সামনে দাঁড়ালে তার ঘূর্ণন  অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। সময়

দৌড়ায় তীব্র গতিতে, দৌড়াতেই থাকে।

বেঁচে থাকতে লুকিয়েছিলেন, মরে গিয়ে সেসব পদ্ধতি দিব্যি ভুলে বসে আছেন।

৩.

মাছ

সার্কাসে থাকতে আমি একটি নীল রঙের ঘোড়া ছিলাম। আজ তোমার চারপাশে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দুপায়ে দাঁড়িয়ে যাই, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি, সার্কাসের পুরনো বিদ্যা এখনো আমার মগজে গেঁথে আছে বলে। যেমন আমি প্রচণ্ড একটি ফলা হয়ে গেঁথে থাকতে চাই তোমার শরীরে। চারপাশে বছর জুড়ে হতে থাকবে বৃষ্টি। পানি জমতে জমতে তলিয়ে যাবে কাঁধ

.

যেভাবে পানিতে থাকতে থাকতে মাছ হয়ে ওঠে একটি প্রাণ, আমিও তাদের মতো মাছ হয়ে সাঁতরে বেড়াব, তোমাকে কেন্দ্রে রেখে অনন্তকাল

….

সোহেল হাসান গালিব

……

আমরা যখন তুমুল আন্দোলিত, ব্যাস্ত, নিজেদের তুলে ধরতে, ঠিক সে সময়ে  আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের যে ক’জন সম্ভাবনা নিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাদের একজন আজকের কবি সোহেল হাসান গালিব।

আজ সে স্বনামে সিক্ত। পরিচিত।

সোহেল হাসান গালিব এ সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি-আলোচক ও সম্পাদক। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সঙ্কলন : “শূন্যের কবিতা” একটি দরকারী কাজ। এ ক্ষেত্রে তার দশকে সে অগ্রগণ্য, পথ প্রদর্শক।

এ ছাড়াও “পরস্পর ” ওয়েব ম্যাগাজিন এর সম্পাদনা পর্ষদে যুক্ত থেকে এ সময়কে তুলে ধরা, বিশ্লেষণ করা তার সচলতা প্রমাণ করে।

কবি সোহেল হাসান গালিব এর সাম্প্রতিক কবিতা :

বউকে দেয়া প্রথম দিনের উপহার : একটি কবিতা

…….

সসেমিরা

…….

বইতে না পেরে বট, নিজেরই দেহের ভার, মাটিতে নামায় ঝুরি—

পাখিরাও জানে ঠিক, নতুন একটি কাণ্ডে সে চায় দাঁড়াতে।

যে হাত সহসা থেমে, নেমে আসে হাতে

তাকে প্রশ্ন ক’রো না; প্রশ্নটি নয় তেমন জরুরি।

ছুঁয়ে দ্যাখো, ছুঁলেই তো ফেটে যাবে দোপাটির ফল—

অপেক্ষার গোপন বেদনা।

মনে হবে এ সবই সাজানো, শুধু চমকে দেবার ছল;

হয়তো বুঝবে, হয়তো না।

তারপরও সাহসে কুলালে

কাঁটাঝোপ পার হয়ে বনফুল তুলে নিও।

নীলে ডোবা তুলি এনে হলুদে বুলালে

কী করে সবুজ হয়, বুঝি নি আমিও।

২.

নবিজি বা রবিজি কাউরে নিয়া কখনো কবিতা লিখি নাই। কী মনে কইরা শহীদ কাদরীরে নিয়া একটা কবিতা লিখলাম—

অপেক্ষা

বাস্তুসাপেরাও আজ তোমাকেই ডাকে। তারা বলে

প্রবাস একটি অভিমান। বলে ছোবলই চুম্বন।

‘ফিরো এসো’ তাই বলি না কাউকে। ‘উদ্বাস্তু’ শব্দের

দরোজাটা খুলে বহুদিন এক ডাকপিয়নের

অপেক্ষায় আছি, ঠান্ডা আমলকী বনের ভিতর।

ঘুমন্ত পাতারা ঝরে আর মনে পড়ে : চিঠিযুগ

কবেই তো শেষ। সাইকেল-চেপে তবু কেউ আসে;

ঘণ্টা বাজে ওই—টুং টাং—‘স্বপ্ন তুমি নিরক্ষর’।

স্মৃতিতে আয়না ফেলে, ছিপ তুলে রিরংসায়, দেখি

শববাহী শকটের মতো, ঠিকই দিন চলে যায়।

সন্ধ্যা ৬.২০

৩০/০৮/৩১

৩.

সমকামীদের বিয়েতে কি দেনমোহরের ব্যবস্থা থাকবে?

সুবহে সাদিকের সামান্য পর

এই প্রশ্ন আমাকে করেছিল পেয়ারা গাছের ডালে বসা

এক দোয়েল পাখি

পাখিটিকে খুবই চিন্তিত মনে হলো

মনে হলো সারা রাত ঘুমায় নি সে

অথচ আমি তাকে কিছু ভাবনা ধার দিতে চেয়েছিলাম

জাতীয় পাখির পক্ষে যা শোভন ও স্বাভাবিক

এই যেমন আমাদের ভারতীয়তা, এই যেমন প্রমিত ভাষা

ইসলামি জঙ্গিবাদ ও খ্রিস্টানি মিডিয়াসন্ত্রাস

কিংবা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র

অথচ সেহেরির সময় থেকে

সে কেবলই পেয়ারার পাতা চিবুচ্ছে

আর অপেক্ষায় আছে

ভোর হলেই কখন ঢুকে পড়বে

পৃথিবী নামক বিবাহমণ্ডপে

আমিও শুনছি আজ আজানের পর থেকে

ইউটিউবের মিউজিক টানেলে বসে

বিসমিল্লাহ খানের সানাই

……

জব্বার আল নাঈম

……

সাম্প্রতিক সময়ে যে ক’জন তরুণ তাদের কবিতায় আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করেছে, কবি জব্বার আল নাঈম ( Jabbar Al Nayeem) তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।

সমসাময়িক ঘটনা, প্রেম, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি তার কবিতায় মূর্ত হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।

অপরূপ দক্ষতায় সমাজের অসঙ্গতি এঁকে যান কবিতায়। ব্যঙ্গ করেন, নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতির। দু:স্বপ্নের ভিতরেও বুনে যান আগামীর বীজ।

ফেসবুক এর টাইমলাইন থেকে চয়ন করা, জব্বার আল নাঈম এর কয়েকটি কবিতা :

…..

(রক্তমাখা ইটের গল্প)

একবার আমেরিকা গ্লাসভর্তি ক্রোধের পানি আফগানের দিকে ছুড়ে মারে

ব্যথা পাওয়ার পরিবর্তে হেসে উঠল তারা-

আরেকবার মুঠোভর্তি মাটি মারল ইরাকের গায়ে

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ইরানের খোমেনি!

বিভ্রান্ত মজলিশ পানি আর মাটি একত্রিত করে কাদার পিরামিড বানিয়ে

আগুনে নিক্ষিপ্ত করল আমাকে।

এরপর বেরিয়ে এলো রক্তমাখা ইটের শরীর

ইটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত বিশ্বের হৃদপিণ্ড;

মানুষ জানে না, আইএস রক্তমাখা ইটের আরেক নাম!

২.

গুলবদন

*

গুলবদন,

তোমার রূপে অন্ধ হয়ে পথ হারায় একবিংশ শতাব্দী।

এশিয়া- মেরিকায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

জাপান পুড়েছে অানবিক বোমে

ফিলিস্তিন উদ্ধাস্তু শিবির

অাদর্শহীনতার খরায়

                 বেপথে অাফ্রিকা

মরছে অাদিবাসী অস্ট্রেলিয়া

ভেঙে পড়ছে মানুষের শির

অাজও পত্র পল্লবে গুলবদন গুলবদন জিকির।

( Ashraf Jewel ভাই আর Rassel Raihan

প্রেমিকাদের নিয়ে লিখে। সেই উৎসাহে আমার প্রেমিকার নামে এই কবিতাটি কোরবান করলাম)

৩.

(অঙ্গীকারনামা)

সামনে অন্ধকার গলির ভেতর সরু গর্ত

গর্তের গর্ভে বেঘোরে ঘুমাতে ইচ্ছে হয়।

কেবল ঘুমাতে;

ঘুমের মধ্যে খুন করব প্রিয়তম স্বপ্নগুলো।

এরপর একটা লাশ বরফঘরে সংরক্ষণ করব

আড়ালে আবডালে আবার ঘুমিয়ে পড়ব

সমাধান খুঁজতে খুঁজতে নিরুদ্দেশে।

….

জব্বার আল নাঈম এর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ : “তাড়া খাওয়া মাছের জীবন” ইতিমধ্যেই সুধী মহলে সমাদর পেয়েছে।

কাব্যাঙ্গণে তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

….

ভায়লা সালিনা লিজা

…..

কবি আল মাহমুদ একদা আমার প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “প্রিয়তম কোন কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপর লিখতে গেলে যে সংযত ভাষা ব্যবহার করতে হয়, কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের ব্যাপারে আমার পক্ষে অতোটা সংযত তথা বানানো ভদ্রভাষা ব্যবহার করা সম্ভবপর নয়।…”

কবি ভায়লা সালিনা লিজা’র ( Vaila Salina) কবিতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার এই কথাগুলি মনে এলো। কেন? জানি না।

কবি ভায়লা সালিনা লিজা, থাকেন সুদূর নিউইয়র্ক। আমি থাকি আটলান্টা। তার সঙ্গে দেখা মাত্র ঐ একবার-ই। মে ২০১৬ মুক্তধারা আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলায়। তাও চকিতে। কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বইমেলা ও অন্যান্য ভীড়ে আর দেখা হয়নি, তার সঙ্গে। তাতে কি? নিউইয়র্ক এ আমার অন্যান্য সাহিত্যিক বন্ধু কত জনের সঙ্গে যে দেখা হলো! এ এক অমূল্য স্মৃতি।

বিশেষ করে, কবি শহীদ কাদরী ও কবিপত্নী নীরা কাদরী ভাবী’র কথা খুব মনে পড়ছে। তাদের দর্শন ও সাহচর্য এক স্বর্ণস্মৃতি সঞ্চয়।

এখানেই দেখা মিললো, জার্মান প্রবাসী সাহিত্যিক নাজমুন নেসা পিয়ারী, কানাডা থেকে আগত কবি ইকবাল হাসান, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কথা সাহিত্যিক জসিম মল্লিক, বাংলাদেশ থেকে আসা শিশুসাহিত্যিক সৈয়দ আল ফারুক ও আমীরুল ইসলাম প্রমুখদের।

আর নিউইয়র্ক এ বসবাসরত একঝাঁক প্রিয়মুখ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, ফেরদৌস সাজেদীন, কাজী আতিক, হাসান ফেরদৌস, সালেম সুলেরী, তমিজ উদদীন লোদী, শামস আল মমিন, আবু রায়হান, কাজী জহিরুল ইসলাম, আদনান সৈয়দ, মনিজা রহমান, রওশন হাসান, লুবনা কাইজার, সোনিয়া কাদের,আলমগীর বাবুল, শাহ আলম দুলাল, মনজুর কাদের, শামস চৌধুরী রুশো, খালেদ সরফুদ্দীন, স্বপ্ন কুমার, এজাজ আহমেদ, আলম সিদ্দিকী এদের সঙ্গে।

এ ছাড়া অন্যান্য স্টেটস থেকে আগত : আশরাফ আহমেদ, হুমায়ুন কবির, নূপুর কান্তি দাশ, arius sagit ছিলেন এ মেলার অন্যতম স্মৃতি।

মজার বিষয় এই যে, এদের অধিকাংশই ছিলেন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। তাদের লেখার সঙ্গে পরিচয়ও ছিলো সে সুবাদে। তাই কাউকেই দূরের মনে হয়নি। এখনো মনে হয় না।

যেমন খুব কাছের মনে হয় কবি ভায়লা সালিনা লিজা’র এই সব অন্তর্গত উচ্চারণ।

তার কণ্ঠে যেন বেজে চলে, আমার কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি।  চিরায়ত সুর। আমিই যেন লিজা হয়ে, বেজে চলি, এই সব কবিতায়।

কবি ভায়লা সালিনা লিজা’র কবিতা:

পুরুষটি পুণ্যবলে আরোহন করে পৃথিবীর শীর্ষ চুড়োয় দাঁড়িয়ে থেকে বলে ‘চারু’ শোন, আজ রাতে আমার তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। কেমন হয় যদি আমরা দু’জনে কিছুক্ষণ কাটাই তোমার চিলেকোঠায়?

চারু আচানক চমকে উঠে! ফিসফিসিয়ে বলে, আনন্দ আমার যে নিজের কোন চিলেকোঠা নেই।

আনন্দ উঠে দাঁড়ায়; আলতো হেসে বলে- ‘আহ দুর্ভাগ্য আমার!’

২.

কত মানুষ এই শহরে হরেক রকম মানুষ। সাদা কালো লাল বেগুনী নানান রঙের; অথচ তুমি নামের একটা মানুষ নেই বলে আমার একলা ভীষণ লাগে। আমার সবাই আছে, সবকিছু আছে, শুধু একটা তুমি নেই কাছে। আমার সবচে, প্রিয় সবচে আপন তুমিই নেই বলে গোটা শহরটাকে একলা পাখি মনে হয়।

পাখি তোমার একলা পাখি অন্য দেশে, অন্য কোথাও অতিথি পাখি হয়ে আছে আর তুমি? কতগুলো দিন একলা থেকে থেকে ক্লান্ত তোমার মন খামোখাই করে কেমন কেমন।

খরখরে কাগজে প্রিয়তমা নামে বিলি কেটে ডেকে গিয়ে বলো, আসি আসি করে আসো না, এসো ফিরে এসো ঘরে; খাঁচাছাড়া পরাণ পাখি ফিরে এসো আমার ঘরে।।

১১/১৬/২০১৬

৩.

তুমি আমি রূপকথার ভিতরে

কতদিন কত রাত কাটিয়েছি

শুধু জীবন অক্লান্ত ছিলো সে সময়ে

বনের গভীর পথে- জোছনায় মুগ্ধ হয়ে যখনই

আমি তোমাকে ডেকেছি

কাছে এসে বলে যেতে-

‘এইতো আমি, এই দেখো আমি আছি তোমার কাছে’।

……

ইসমত শিল্পী

……

কবি জয় গোস্বামী’র একটি ডকুমেন্টারি দেখছিলাম। তাতে ইন্টার্ভিউ গ্রহীতাকে তিনি তার নিজের কবিতার কথা প্রসঙ্গে বলতে-বলতে এক পর্যায়ে জানাচ্ছেন, বর্তমান কবি ও কবিতা কতদূর অগ্রসর হয়েছে। কীভাবে। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

তিনি বললেন, অনেক মেয়েরা কবিতা লিখছে এ সময়ে। এবং তাদের অংশগ্রহণ ব্যাপক ও বিপুল, এটিও উল্লেখ করলেন। এবং তারা ভালো লিখছেন।

…..

এটি ছিলো ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা। যা সাম্প্রতিককালে আমি ফেসবুক কেন্দ্রিক কবি ও কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের মেয়েরাও সাহিত্যচর্চা তথা লেখালেখির জগতে এগিয়ে আসছে, বিপুল বেগে। বিপুল শক্তি নিয়ে। যা অতীতে দেখা যায়নি।

এদের মধ্যে অনেকেই, মানে বেশীর ভাগ কবি-ই ভালো লিখছেন। শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের অন্যতম একজন হলেন : কবি ইসমত শিল্পী (Ismat Shilpi)।

বর্তমান কালের এই কবি’রা প্রত্যেকেই নিজেদের আঙ্গিক ও উপস্থাপনের কৌশল বেছে নিয়েছেন। এবং বলাই বাহুল্য, সেটি গদ্য ছন্দ। হ্যাঁ, গদ্য কে বাহন করেই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। কেউ-কেউ যে অন্যান্য ছন্দে লিখছেন না বা চেষ্টা করছেন না, এমনটি নয়। কারো-কারো রচনায় অন্যান্য প্রচলিত ছন্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সংখ্যা সীমিত।

কবি ইসমত শিল্পী সহ সাম্প্রতিক অন্যান্য সকল কবিদের কাছে আমার একটি-ই দাবী, আপনারা যদি ছন্দ সমৃদ্ধ হয়ে আপনাদের কবিতায় এগিয়ে যান, তবে বাংলা কবিতায় আপনাদের স্থান আরো দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হবে, এতে সন্দেহ নেই।

কবি ইসমত শিল্পী’ র কবিতা :

..…

অতনু,

ঝরে পড়া মানেই তো পড়ে থাকা নয়। আবার পড়ে থাকা মানেই ঝরা যাওয়া- তা নয়। সবকিছু নিয়েই যেমন জীবনের বসবাস, তেমনি সবকিছু দেখতে দেখতেই আমাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পথচলা।এভাবে চলতে চলতেই কোথাও না কোথাও হঠাৎ থেমে যায় অদেখা নজর, অজানা অধির মন নিরবে খুঁজে দেখতে চায় ভুল শব্দাবলীর পদ্যভূমি। কিন্তু জীবন তো কবিতা নয়, জীবন তো গদ্য- তা আমার থেকে আর কে বেশি বুঝেছে এমন !—– তাই তো বারবার গদ্যে ফিরে আসতে হয়, বারবার সকালকে ভেঙ্গে দুপুর করতে হয়, দুপুরকে নিরবে ভেঙ্গে বিকেল, আবার রাত; সন্ধ্যা কিংবা গোধূলী, সব কোথায় যেনো মিলিয়ে গেছে সময়ের রুটিন থেকে। আহ্ ! কী বেদনা, কী যে কষ্ট, কী যে ঝরে পড়ার ব্যথা, কী যে পড়ে থাকার যন্ত্রণা, এসব কেউ কি বুঝবে এমন করে ? না কি সবকিছু বোঝাবার মত বল ?

হয়ত নিজেকেও বুঝতে দিতে মন চাইনা আর; বিশাল এক ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে নিজের এই পথচলা। তার যতটুকু দেখা যায়- সেটুকুই আনন্দ, আর যা কিছু নিজস্ব এবং নিজেই বোঝার, তার সবটুকু যন্ত্রণার বৃহৎ এক পাহাড়। সে আমায় এক মূহুর্তও একা হতে দেয় না, দেবে-না—তা আমি খুব বুঝি।

অতনু, এই যে ফিরে আসা, ফিরে থাকা- তার সবটুকু ইচ্ছের বাইরের, শুধুই জীবনের জন্যে, সম্ভ্রমের জন্যে। এই জীবন খুব বুঝেছে, সম্ভ্রম শুধু নিজের; তাকে নিজেই আগলে রাখতে হয়। সবার বেলাই এমন নয়, সবার কেউ কেউ বাঁচাবার আছে। আমার জন্যে হয়ত শুধুমাত্র ‘আমি’।—- ভাল কাটুক সারাবেলা, সারাটি জীবন।

১ নভেম্বর, ২০১৬।

২.

জানিস অতনু ?

কিছু জিনিস খুব নিরবে খুব বেশি ক্ষয়ে যায়, কেউ তার নমুনা দেখেনা, বোঝেও না। তার নড়াচড়া বা পরিবর্তন শুধু ভেতর-ই বোঝে, একান্ত নিরবে। এই যে, বিশ্বাস শব্দটি যেমন খুব বেশি অপরিপক্ক মনে হয় এখন। একেবারেই বানিয়ে তোলা জিনিস এটা, মূর্তির মতন; এ যেনো কেমন এক ধরনের বৈশ্বিক শান্তনা। কোত্থাও এর কোন ছিটে ফোটা আসলে নেই আর। চারপাশ কেমন যেনো সাজানো ভাবধারাতে গড়িয়ে চলছে, ছুটে চলছে, বিশ্বাস থেকে মোটেই না। এ তো সেই কবে থেকেই বুঝি তবুও চলছি তো- এই সাজানো দোকান পাট, ঘরদোরের মতই। কিন্তু ভেতরটা খুব যেনো ফাঁকা, খুব বড় গর্ত হয়ে যাচ্ছে খুব অজান্তে হলেও। অসংখ্য অবিশ্বাসের ছিদ্র এক হয়ে যক্ষার মত ফাঁকা এক ফুসফুসের আশ্রয়ে যেনো নিশ্বাস নিতে হয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন টিকে থাকে জীবন ? কতদিন বয়তে পারবে নিঃশ্বাস ?

অতনু,

ঈশ্বরকে বাধ্য করেছিল কে, বলতে পারিস ? কী এমন যন্ত্রণায় সে ফেলে দিয়েছিল আমায় এই জগতের মাঝে ? যার দায় তাঁর একেবারেই নেই !  এই যে উত্তার এক হাওয়ায় চলছে মানুষ, মানুষের দৌড় ; সে যদি জানতোই সব, তাহলে এই ব্যতিক্রম রক্ত দিয়ে কেন বানালো আমায় ?

জগতে ব্যতিক্রমের কোন দাম নেই অতনু, তা বোঝার মন নেই বলেই খুব অকেজো শব্দ এটা। ব্যকিত্রমকে বিশ্বাস করেনা কেউ। সবই খুব গতানুগতিক, বিশ্বাসটাও খুক-ই গতানুততিক। যখন নিজের চেতনায় দেখি, সবখানেই বিশ্বাসের অভাব, সব-ই অবিশ্বাসে ভরা। তখন অবেচেতনে খুঁজতে থাকি বিশ্বাসের কোন ছিন্ন টুকরা পড়ে আছে কিনা। আমার অবচেতন খুঁজতে খুঁজতে যত টুকরো বিশ্বাস পেয়েছি, তা জোড়া দিতে দিতে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসা। এই পথ চলা, বিশ্বাস জোড়া দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, তাতে ভেতরের নির্যাস দিতে হয়। সেই নির্যাস দিতে দিতে উপুড় করে দিয়ে ফেলেছি কবেই হয়ত।তাই আর কোন নির্যাস পাই না খুঁজে। কী দিয়ে জোড়াবো আর হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসগুলোকে ? কোনো মন্ত্র কী জানা আছে তোর, অতনু ?

অন্ধ-বিশ্বাসে পাঠ করার মত মন্ত্র ? যাতে এই চেতন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা যায় ? আর অবচেতন মনকে জাগিয়ে রাখা যায় ! এগুলো ছাড়া জীবন চলবে কী করে- আর !

(২০/৯/১৬)

৩.

আমি কষ্ট পেলাম বলে, আমায় ইমোশনাল বলে ক্ষত করলে আরো।

তুমি যখন অহংকারে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে মার্জিত মাটি কাঁপিয়ে দুপদাপ চলে গেলে,

তখন সেটা কি ছিল ?

আবেগ, নাকি অসভ্যতা –!

আমি আমার কষ্টগুলোকেও বিনয়ী হতে শিখিয়েছি।

…..

১ সত্যিকারের তুই চাই

২. একদিন জল হব

৩. পায়ের কাছে নদী

কবি ইসমত শিল্পী’র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। 

…..

হাবীবাহ নাসরীন

……

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালের কবিদের মধ্যে একমাত্র কবি হাবীবাহ নাসরীনকেই দেখা যাচ্ছে, ছন্দ নির্ভর কবিতা লিখতে। এটি আশার কথা। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। আবার ঠিকও হতে পারে। তবে, কবি হাবীবাহ নাসরীন যে ছন্দে স্বতঃস্ফূর্ত, এটি তার কবিতা পড়লেই বোঝা যায়।

কবি হাবীবাহ নাসরীন (Habibah Nasrin) পেশায় সম্ভবত সাংবাদিক। এবং বয়সে তরুণী। তার অনুসন্ধিৎসু একটি মন আছে। এবং হৃদয় সংবেদী চোখ আছে আর আছে মানবতাবাদী কলম। এই নিয়ে তার কাব্যসংসার।

এই সংসারে তার একটি কন্যাসন্তানও আমরা দেখেছি, তার নাম “কবিতা”। গত বইমেলায় যা পৃথিবী আলোকিত করেছে “কবিতা আমার মেয়ে” নামে। এবং যতদূর জানা যায়, ব্যাপক পাঠক প্রিয়তাও পেয়েছে।

ইদানীং তার ছোট-ছোট আঙ্গিকের ছন্দবদ্ধ কবিতাগুলোয় প্রেম ও জীবনের গভীর উচ্চারণ মিলেমিশে আমাদের সচকিত করে তুলছে।

কবি হাবীবাহ নাসরীন এর কবিতা:

যে কথা হৃদয় বলে

যে কথা হৃদয় বলে, আমি তার কতটুকু বুঝি

যে কথা কলম জানে, আমি তার কতটুকু জানি

নিগূঢ় কালির ভাঁজে কত সুর, কত কানাকানি

যে নাম হৃদয় জপে, আমি তাকে কতটুকু খুঁজি।

হৃদয় কোথায় থাকে, বের করো, কেটেকুটে দেখি

এত কথা, হাহাকার কোথায় কী করে জমা রাখে

কী মায়ায় অবিরাম নিজেই নিজেকে ঘিরে থাকে

এত কাছে থাকি তবু মুখ তুলে দেখবে না সে কি।

আমিও পুড়েছি কত, দহনই তো জীবনের পুঁজি

লাল নীল অক্ষরে অহরহ লিখে যাই যাকে

এ বুকের বাম পাশে চুপচাপ সে-ই শুয়ে থাকে

যে কথা হৃদয় বলে, আমি তার কতটুকু বুঝি।

(‘কবিতা আমার মেয়ে’ থেকে নেয়া)

২.

বয়স কত হলো,

সতের না ষোল?

একটি গোলাপ চাও কি পেতে, একটি দেবো কাঁটা

একটি চিঠি লিখছি তোমায় শুভ্র, সাদামাটা।

একটি দেবো কলম তোমায়, একটুখানি কালি

ছন্দ দেবো, কাব্য দেবো, হাস্নাহেনার ডালি।

তুমি শুধু অল্প করে গল্প লিখে দিও

জন্মদিনে হৃদয়ভরা শুভেচ্ছা নাও প্রিয়…।

০১.১০.২০১৬

৩.

খা‌দিজা তুই যা ঘুমিয়ে

চাই না বিচার, বিচারহী‌নের এমন করুণ ক্ষ‌ণে

‌কে পে‌য়ে‌ছে বিচার ব‌লো, শুধাও জ‌নে জনে

তনু গেল, রিশা গেল, আফসানা আর মিতু

আমরা শুধু দে‌খেই যা‌বো, আমরা ভীষণ ভীতু।

বল‌তে গে‌লেই নি‌ষেধ শু‌নি, চতু‌র্দি‌কে মানা

‌কে খোয়া‌তে চায় গো ব‌লো সাধের প্রাণখানা?

মা চায় না বুক খা‌লি হোক, বাবাও ভ‌য়ে কাঁ‌পে

আমরা তবু খুন হ‌য়ে যাই তনুর অ‌ভিশা‌পে!

খা‌দিজা তুই যা ঘু‌মি‌য়ে, নরপশুরা থাকুক

মা‌য়ের আঁচল খা‌লি করার নকশা নতুন আঁকুক!

০৫-১০-২০১৬

….

কবি হাবীবাহ নাসরীন এর কবিতার সংসার যে দিনে-দিনে আরো সমৃদ্ধ হবে, তা, তার কবিতাপ্রেমই বলে দেয়।

এ জগতে তার নিরন্তর সাফল্য কামনা করছি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ