খোরশেদ মুকুল
যান্ত্রিক যুগে ন্যানোটেকনোলজির ছোঁয়া আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারিশমায় মানুষ যেখানে অনুকাব্যের সন্ধান করছে সেখানে মহাকাব্যের চিন্তা করা নিশ্চয় সাহসের ব্যাপার। ফররুখ আহমদের পর যে যাত্রায় দীর্ঘদিন কোনো বড় কবি পদচিহ্ন রাখার সাহস করেননি সেখানে আল মাহমুদের যাত্রা নিশ্চয় সাহস আর প্রশংসার দাবিদার- “এ বুক/ দারুণ সাহসে বুঝি করে ধুকপুক”, “ অতিক্রম করি ক্ষুদ্র কাব্যের নিয়ম/ মহাকাব্য রচিবার পরম উদ্যম” কিংবা “ বাধাবন্ধ মানি নাকো মানি না পাহারা”। আল মাহমুদের প্রিয়কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাকাব্য না লেখার যে কৈয়ফিয়ত দিয়েছেন “ আমি নাব্য মহাকাব্য সংরচনে ছিল মনে/ হঠাৎ কখন তোমার কাঁকন কিঙ্কণিতে/ কল্পনাটি গেল ফাটি হাজার গীতে/ মহাকাব্য সেই অভাব্য দুর্ঘটনায়/ পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে কণায় কণায়” সেটাকে মহাকবির দুর্বল যুক্তি হিসেবেই আখ্যায়িত করেন ‘সোনালী কাবিন’র কবি। শাশ্বত কাহিনি অবলম্বনে বহমান প্রাচীন বাংলা ভাষা, আধুনিক উপমা- চিত্রকল্প-অন্ত্যমিল আর প্রচলিত পয়ার ছন্দে রচিত সাহিত্যিক মহাকাব্য “এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না”। মাইকেল মদুসূদন দত্তের মেঘনাদবদ কাব্য, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃত্রসংহার, নবীন চন্দ্র সেনের রৈবতক, কুরুক্ষেত্র আর প্রভাস, কায়কোবাদের মহাশ্মশান, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘স্পেনবিজয় কাব্য’র মত কাহিনি নির্বাচনে তিনি ঐতিহ্যিক হলেও ঘটনা বর্ণনায় তিনি অনন্য। গাম্ভীর্যতা পরিহার করে নদীর স্বচ্ছ ঢেউয়ের মত বহমান এই মহাকাব্য। পুঁথির মত সুর তোলে। ছলাৎ ছলাৎ করে বলে গেছেন আদি মানবের কাহিনিকাব্য। মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যে বিচারে বাংলা সাহিত্যে টিকে থাকা হাতেগোনা কয়েকটা মহাকব্যের মধ্যে এটিও স্থান করে নেবে পাঠকের হৃদয়ে। পরিসর বিবেচনায় অনেকে এটাকে Epicling- ছোটো মাপের মহাকাব্য বলারও চেষ্টা করেছেন। তবে সার্বিক বিবেচনায় শেষ বয়সে আল মাহমুদের অন্যন্য এক সৃষ্টি “এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না”।
পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনার মাধ্যমে কবি মানবজাতির যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। বিশেষ করে ইভের মাধ্যমে নারীর সৌন্দর্য আর খাসলত, তাকে মাতৃরূপে সৃষ্টি- “মায়ের অমৃত রস দিলেন বিধাতা” এবং নারী-পুরুষের আকর্ষণের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তা বেহেশত থেকে দুনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে আদম-হাওয়ার কাহিনি বর্ণনায় তিনি অনেকটা বাইবেলীয় বয়ান অনুসরণ করেছেন বলেই মনে হয়। হাওয়াকে ‘ইভ’ বলে সম্বোধন করা, নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার জন্য ইবলিশ সাপ সেজে ইভকেই ফুঁসলিয়েছেন মর্মে বর্ণনা– “ সাপ কথা বলে শুনি মনুষ্য ভাষায়”, ইভের কারণেই আদমের পথভ্রষ্টতা– “ তবু ফল খাইয়েছে আমার সই” প্রভৃতি সেমিটিক বলেই মনে হয়। যদিও তিনি নারী হিসেবে ইভের যথেষ্ট প্রশংসাও করেছেন– “ কেউ তো পারেনি দিতে, কেউ পারে না”, “জগৎব্যাপী নারীর বিজয়” কিংবা “ এই নারী ছড়ায় জ্যোতি অতি মনোরোম” এবং আদমের দায় স্বীকারও দেখিয়েছেন- “তবু দোষ নিতে হবে আমার এই কাঁধে”। কিন্তু ঘটনা তো উল্টো ছিল। সবকিছু আদমের মাধ্যমেই হয় আর ইভ তাঁর অনুগত স্ত্রী হিসেবে তা মেনে চলে কিংবা মেনে নেয়। এই হিসেবে তাঁর নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলে ইভের দোষও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে মূল ঘটনা কিংবা ইবলিশের সাথে মূল শত্রুতা আদমের মাধ্যমেই হয়। আদমের বিজয় ইবলিশ সহ্য করতে পারেনি- “ শয়তান দিশেহারা আদমের জয়ে”। কারণ সে ইবাদত বন্দেগি করতে করতে সে ফেরেশতার মর্যাদা পেলেও জাত হিসেবে সে জিন। আর জিন তৈরি আগুন দিয়ে। আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে- “মাটির আদম খাড়া তার পুরো ভাগে”। মাটির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার মাধ্যমে কবি মূলত মাটির তৈরি মানুষেরই মহিমা গেয়েছেন নানাভাবে–
১। মাটি থেকে উথলায় মাটির সুমতি
২। মাটিকে দিলেন খাঁটি অবাক বিস্ময়
মাটি যেন মাটি নয় কাঞ্চনের বাটি
৩। মাটির পাহাড় নয় মায়ার পাহাড়
৪। মাটির ভেতর থেকে লাবণ্যের ঘাম
৫। আমার সম্মুখে এই মাটির মহিমা
৬। আমার বিপক্ষে মাটি করে বাজিমাত
৭। শয়তানের সাথে যুদ্ধ, তোমার কিরিচে
ধার দিতে হবে, যাও- মাটির উপরে
৮। মাটির সরসে লাল গোলাপ ফোটায়
৯। সৌন্দর্যের সব সংজ্ঞা লুটোয় মাটিতে
১০। মৃত্তিকার মহিমা যেন সোনার বাটিতে
১১। যাদের গড়ন হলো মাটিতে অমর
তাদেরি বিজয় গায় মাটির অধর
১২। মাটিকে দেখলে কাঁপে ভয়ে শয়তান
১৩। এ তো শুধু বালু নয়, শুধু এরি নাম মাটি
মাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তবু এতো খাঁটি
আল্লাহ অসীম ও অন্যন্য। তাঁর শেষও নাই, শুরুও ছিল না, “তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি”। তাঁর সৃষ্টি জগতের ক্ষুদ্র প্রতিফলন “এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না”। তাই নামের সাথে যথার্থ যৌক্তিকতা পাওয়া যায় এই মহাকব্যে। তবে কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর, কেয়ামত হয়ে যাওয়ার পর কিংবা শেষ বিচারের পর নতুন কোনো জগতের ইঙ্গিত দেয় কবি, সেটা কি জান্নাতের কথা নয়!। আল্লাহ মালুম। তবে মহাকাব্যটি আট স্বর্গে শেষ করা কি কাকতালীয় নাকি মুমিনের শেষ ঠিকানা জান্নাত বুঝাতে কবির এমন বিন্যাস। প্রশ্নগুলো থেকেই যায়!
প্রথম অধ্যায়ে কবি মহাকব্যের নিয়মানুযায়ী প্রার্থনা দিয়েই শুরু করেন। আল্লাহ ও রাসুল সা. এর প্রশংসা করে তিনি নিজের অক্ষমতা কাটিয়ে, গ্লানি মুছে কবির বিজয় ঘোষণা করেন। কারণ মহাকাব্য লেখার যে সাহস তা কবির আছে- “ দুয়ারে ভাঙিয়া আসে জোয়ারের ধ্বনি/ সাগরে ভাসাই মহাকাব্য তরণী”। এই মহাকাব্য লেখার যে তাড়া ও তাগিদ তা তিনি বর্ণনা করেন, “ দু’কানে শুনতে পাই অপার্থিব ধ্বনি”। শুরুই করেন তিনি হামদ ও নাতের মাধ্যমে–
প্রথমে সিজিদায় যাই আল্লাহর সম্মুখে
কাব্য রচনার ভাষা সৃজিলেন বুকে।
……………………………………
এইখানে লিখ তবে রসুলের নাম
রসুলের নামে বলি সালাম সালাম।
এরপরেই তিনি মূল কাহিনি বর্ণনায় যান– “এবার তো যেতে হবে কাহিনীর মাঝে”। চারপাশে নানা কাহিনির ছড়াছড়ি হলেও কবির কাছে সবকিছু পুরোনো লাগে- ভূতের নাচন যেন শেওড়ার গাছে”। তাই তিনি গল্প খুঁজতে খুঁজতে থিতু হন শাশ্বত কাহিনি– “মাটির আদম খাড়া তার পুরো ভাগে”।
গল্পের শুরুতে এক মাটির মানুষ
আদম তাঁহার নাম সবল পুরুষ।
আল্লাহর জিকিরে তাঁর কাঁপে তনুমন
কাঁপছে প্রভৃতি, কাঁপে জনসাধারণ।
এখানে গল্পের শুরু বলে কবি থামেননি করেছেন আদমের প্রশংসাও। সাথে করেছেন ফেরেশতা ও আদম সন্তানের আল্লাহভীতির স্তুতি– ‘কাঁপে জনসাধারণ’। আল্লাহ আদমের দেহে রুহ দেয়ার পর সবাইকে সিজদা করতে বললে, ইবলিশ তার অহংকারী বৈশিষ্ট্যের কারণে তা করেনি। আগুনের তৈরি বলে অহংকার করে। তাই সে অভিশপ্ত বলে বিবেচিত হয়। আর আদমের শির আরও উঁচু হয়। মাটির কাছে আগুনের এই হার ইবলিশ মানতে পারছিল না- “দুর্গন্ধ কর্দমে কেন হাত নষ্ট হয়”। হিংসায় জ্বলছিল।
শয়তান দিশেহারা আদমের জয়ে
আগুনের শিখা যেন লাফায় সভয়ে
কেবলি সে খোঁজে কোথা আদমের খুঁত
যেমন পেতনি নাচে শেওড়ার ভূত।
আদম যখন জান্নাতে ঘুমাচ্ছিলেন তখন আল্লাহ সৃষ্টি করলেন হাওয়াকে- “পাশেই শায়িতা আছে ঈভের শরীর/ আরমোড়া ভাঙে যেন সুন্দরের নীড়”। জান্নাতে তাদের সাথে ইবলিশের পরিচয় হয়। সে শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে আদম-ঈভকে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ানোর জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। কবির বর্ণনায় ইভের কথায় এসেছে। যেটা আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি। শয়তান সাপ সেজে ঈভের সাথে যে কথোপথন, তা কবির ভাষায়–
ঈভ চমকে ওঠে একি কাণ্ড হায়
সাপ কথা বলে শুনি মনুষ্য ভাষায়
সাপের বক্তব্যে আছে কী যে মর্মবাণী
আগে তো শুনিনি আমি কিছু তো না জানি।
এভাবে ঈভ আদমেক অনুরোধ করে ফল খেতে- “হঠাৎ ফলের গায়ে একটি কামড়”, তারপর উভয়ের সামনে আল্লাহর শাস্তি উন্মুক্ত হয়- “ নীরবে ঝরিয়া যায় বুকের বসন” অথবা “কেবলই উন্মুক্ত হয় আমার শরম”। কিন্তু এতেও ইবলিশ পরাজিত হয়- “ইবলিশ চমকে ওঠে হায়রে প্রলয়!/ অকস্মাৎ আমার শিরে একি পরাজয়”। সাথে সাথেই তাঁরা নগ্নদেহ ঢেকে নেয় জান্নাতি গাছপালায়। এরপরে তাঁরা তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করে দেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান- “শয়তানের সাথে যুদ্ধ, তোমার কিরিচে/ ধার দিতে হবে, যাও- মাটির উপরে”। আর আল্লাহর নির্দেশ আর যাতে অমান্য না করে সে আদেশ দেন- “আমার নিষেধ ভঙ্গেরই সাজা”। কিন্তু ইবলিশ আর ষড়যন্ত্র বন্ধ করেনি। থেমে যায়নি দ্বন্দ্ব।
কেউ যেন না বলে খেলা শেষ হয়ে গেলো
এ কেবল শুরু মাত্র, ওগো আঁখি মেলো।
হে সুন্দরি চোখ মেলে দেখ এ জগৎ
এর নাম রণক্ষেত্র বহু মতামত।
কাহিনি বর্ণনায় পরম্পরা কিছুক্ষেত্রে ছন্দপতন দেখা গেলেও তালের কারণে উতরে গেছে সকল সীমাবদ্ধতা। যেনো দখিণা হাওয়া পাঠকের মনে একের পর এক দোলা দিচ্ছে। সেই মাতাল হাওয়ায় ঘুরে আসে জান্নাত থেকে দুনিয়ায়। এই বিস্তৃতি সত্যিই মুগ্ধকর। তবে সর্বত্র তিনি মাটি তথা মানুষের যে মহিমা ঘোষনা করেছেন তাতে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় “ আশরাফুল মাখলুকাত”র কথা। “এ তো শুধু বালু নয় শুধু এরি নাম মাটি/ মাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি তবু এতো খাঁটি”।
আলোচনাটি আদ্যোপান্ত পাঠ করে আনন্দ পেয়েছি