শাদমান শাহিদ
কবি মহিবুর রহিমের কাব্যজগতে একযুগেরও অধিক সময় ধরে আমার বিচরণ। সে জগতের প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রের হাত ধরে দীর্ঘদিন আমি ঘুরেছি। দেখেছি সে-জগতের বিচিত্রতা। কবিতা, ছড়া, কিশোর কবিতা এবং গবেষণা মিলিয়ে তিনি এ পর্যন্ত বারটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এরমধ্যে আটটি কবিতার গ্রন্থ, দুটি ছড়া ও কিশোর কবিতা, এবং দু’টি লোক-সাহিত্য গবেষণা।
আটটি কাব্যগ্রন্থ হলো অতিরিক্ত চোখ (২০০২), হে অন্ধ তামস (২০০৩), অনাবাদি কবিতা (২০০৭), দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র (২০১০), মিলেনিয়াম শব্দজট (২০১৪), হৃদয়ে আমার কোনো মন্দা নাই (২০১৮), সবুজ শ্যামল মন (২০১৮), হাওর বাংলা (২০২১) ইত্যাদি।
কবি মহিবুর রহিম নব্বইয়ের শুরু থেকে কাব্যচর্চা করে এলেও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অতিরিক্ত চোখ’ প্রকাশিত ২০০২ সালে। প্রকাশক সত্তরের প্রখ্যাত কবি আবিদ আজাদ। প্রকাশনা সংস্থা ‘শিল্পতরু’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরিচিত মহলে তিনি বেশ প্রশংসিত হন। কবি আল মাহমুদ বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে যে কজন কবির কবিতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মহিবুর রহিম তাদের একজন। কবিতা লেখার জন্যে কবিদের যে স্বতন্ত্র অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন হয় মহিবুর রহিমের তা রয়েছে। এজন্যে তার কবিতা পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে। বিশেষ করে তার শব্দ ব্যবহারের প্রতি নিষ্ঠা, কল্পনা ও নিজস্ব পদবিন্যাস আমাকে আনন্দিত করেছে। আমার বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যে একদিন সে নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিতে পারবে।”
এর পরের বছরই ‘ঘোড়াউত্রা’ থেকে প্রকাশিত হয় ‘হে অন্ধ তামস’। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো বলতে গেলে ‘অতিরিক্ত চোখ’ কাব্যগ্রন্থেরই এক্সটেনশান। এ দুটো গ্রন্থ মিলিয়ে কবি মহিবুর রহিমের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন পরিপূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে। দেখা যায় তিনি ত্রিশ দশকীয় আধুনিকতার যে অব্যাহত প্রভাব; তার থেকে সচেতন প্রচেষ্টায় বেরিয়ে যেতে চান। তার তাগাদাও আছে এই কবির মনে।
‘আগুনের দাগ দগদগে বাম হাতে/সারা শরীরে ছড়ানো সর্বনাশ/ তোমার অভাবে মত্ত সংঘাতে/এরচে ভালো নিরন্ধ্র কারাবাস।/অবিশ্বাসে চোখ দু’টো করে লাল/বস্তুর ভেতর খুঁজেছি নিগূঢ় অর্থ/ কষাঘাতে কাটে রুগ্ন কালাকাল/দুঃখ এবং দুরাশায় ভরে মর্ত।’
এবং কবি আরও লেখেন–
‘তোমাকে নিয়ে নিরীক্ষা প্রবণ সারারাত/একটি নতুন লাইন লিখে কাটাকাটি… তবুও তোমার সংস্কার চেয়ে সারারাত/একটি নতুন লাইন লিখে উচ্ছাসি’
ইত্যাদি। কবিতায় পরিবর্তন প্রত্যাশা কতটা প্রবল হলে তিনি লেখেন ‘কবিতা ক্ষতের মলম’। একদিকে যেমন তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি পরম বিশ্বাসী মানুষ, অন্যদিকে রয়েছে জন্ম শেকড়রের প্রতি প্রবল টান। এই দুই বিষয়কে অবলম্বন করে তিনি গড়ে তুলেছেন ভিন্ন পাটাতন। আর এসবই প্রতিফলিত হয়েছে উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থদুটির প্রতিটি কবিতায়। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে গিয়ে উচ্চারণ করেন,
‘একদিন আমার জন্মকাল যখন শিরায় পেলাম রক্তের প্রবল ভ্রমণ
একদিন যখন বুকে পেলাম হৃদয় বলে জীবনের গভীর তরঙ্গ ধ্বনি
চোখে পেলাম দ্রষ্টব্যের আশ্চর্য দ্যুতির অপটিক
দেখলাম ফুলের রক্তাভা পাতার ক্লোরোফিল’
(প্রশংসা তোমার, অতিরিক্ত চোখ)
ঠিক তেমনিভাবে মহানবী (স) এর গুণকীর্তন করতে গিয়ে তিনি বলেন,
‘আজ যদি থাকতেন রসুল (স.)
এই সুদূর জলবিধৌত বাংলাদেশ থেকে
আমি তাঁর কাছে ছুটে যেতাম
(আজ যদি থাকতেন রসুল স., অতিরিক্ত চোখ)
অথবা
‘আমার নবীজি (স.) হেরা গুহার আলোকপ্রভা আর বুননের কর্মস্পৃহা নিয়ে বেরিয়ে এলেন/ রেশমের গুটি ভেঙে তিনি পৃথিবী বুননের এক ঐশী সুতা বের করে শুধু বললেন/ বিশ্বাস করো। নবীজির উচ্চারণে শ্বাসরুদ্ধকর শয়তান চামচিকে হয়ে উড়ে গেলো/ আর মক্কার দাম্ভিকেরা নিজেদের ধারালো অস্ত্রের ঝিলিকে দেখলো তাদেরই কর্তিত মুন্ডু। (নবীজি স./হে অন্ধ তামস)
মুসলিম বিশ্বে নবী-রাসুলদের পর যেকজন মনীষী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তাঁদের অন্যতম একজন আল্লামা ইকবাল। মুসলিম বিশ্বের পথপ্রদর্শক হিসেবে মহাকবি ইকবাল যে দর্শন বাতলে গেছেন, তা কবি মহিবুর রহিমের মনকেও ছুঁয়ে গেছে। সে সত্য স্বীকার করে মহিবুর রহিম বলেন,
‘হিমালয় ভেদ করে উর্ধ্বে উঠা তিনি এক বিরাট বিবেক
আরব ইউরোপ চীন আফ্রিকার একত্র রচনা…”
কবি মহিবুর রহিমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গুণ হলো তাঁর রয়েছে অসম্ভব এক কল্পনাশক্তি। তার কিছু কিছু কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায়, কবিতাগুলো যেনো লক্ষ-কোটি মাইল দূরে কেনো এক অজ্ঞাত জগত থেকে নাযিল হয়েছে। এদের আয়ু যেনো কোটি কোটি বছর ধরে। তিনি দীর্ঘ জীবনে দেখেছেন পৃথিবীর হাজারো উত্থান-পতনের কাহিনি। আর তারই বর্ণনা করেছেন ‘দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতা। যেমন–
‘সন্ধ্যার রহস্যময় রঙ ছড়িয়ে পড়েছে নিস্তরঙ্গ নদীর শরীরে
আর রহস্যের আড়ালে ঢলে পড়েছে কালান্তক সূর্য
যেন এক বসন্তযুগ গায়ে পরে শুয়ে আছে নদী
যেন বুকে তার টারশিয়ারি যুগ অতিক্রান্তের গান।’
(নদী, দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র)
অথবা
অঘ্রানের শেষে মাঠে মাঠে ধান কাটা শেষ হয়ে গেলে
গভীর এক শূন্যতা পড়ে থাকে নীরব প্রহরে
তখন কুয়াশা দীর্ণ রাতে
রহস্যের ইন্দ্রজাল হাতে জ্বলে ওঠে চন্দ্রিমার আলো
এই শূন্যতার ভিতর খেলা করে কোন এক অশরীরী সাদা আর কালো
সাদা থেকে ছুটে আসে শত শত পদাতিক ঘোড়া
কালোর পাহাড় ভেঙে ছোটে এরা দিগ্বিদিক।
(অঘ্রানের শেষে, দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র)
কবি মহিবুর রহিমের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায়। চাকরি সুবাদে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছেন। সে হিসেবেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি ও মানুষের সাথে তার একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আর তারই প্রভাব পড়েছে ‘তিতাসের নিরবধি ঢেউ’ কবিতায়। তার উচ্চারণ,
প্রতিদিন ভোর এসে চুমু খায় পূর্বদিগন্তের এই নদীবিধৌত ভূমিতে
ঝলমলিয়ে ওঠে রোদ মেদির হাওরে বা তিতাসের তীরে
আর কী আশ্চর্য সুর লুকিয়ে রয়েছে এই স্রোতস্বিনী নদীর হৃদয়ে!
ফকির আফতাব উদ্দিনের বাঁশি ও বেহালায়
কিংবা আলাউদ্দিন খাঁর সুর সাধনায়
মৃরজা হোসেন আলি, মনমোহন দত্তের কণ্ঠে উপচে ওঠে সেই সুর
বহু সাধকের হৃদয় গভীরে শালদা, বিজনা, হাওড়া
এবং তিতাসের নিরবধি ঢেউ প্রেরণার দরদি সুর ভণে।
(তিতাসের নিরবধি ঢেউ, দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র)
দেশের অনেক বরেণ্য কবি ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে তিনি সঙ্গ দিয়েছেন। দেশ-সমাজ-সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তুমুল আলোচনা করেছেন, তর্ক-বিতর্ক করেছেন, কখনও নিজে ক্ষেপেছেন, কখনও তাদেরকে ক্ষ্যাপিয়ে তুলেছেন, কালের নিয়মে আজ তারা অনুপস্থিত। হয়তো কবরে তাঁরা ভালো আছেন, ভালো নেই কেবল সঙ্গীহারা কবি মহিবুর রহিম। অফিস শেষে সন্ধ্যার দিকে কবি মহিবুর রহিমের সাথে হাঁটতে বেরুলে দেখি, তিনি প্রায়ই একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যান। যেখানে বাস করে দীর্ঘদিনের সঙ্গী কবি ও বুদ্ধিজীবীগণ। তাঁদের কথা স্মরণ করে আফসোস করেন তার হারিয়ে যাওয়া সময়ের জন্যে।
কবি আল মাহমুদ মহিবুর রহিমের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন, তাই ‘বাংলা সাহিত্যে একদিন সে নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিতে পারবে’ বলে যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, আমার মতে কবি মহিবুর রহিম সে স্থানটা দখল করেছেন তাঁর ‘হাওর বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে। এগ্রন্থেও কবিতাগুলো একান্তই তার নিজের। এখানে অন্যকেউ প্রবেশ করার সুযোগ পায়নি। এখানে এসে তিনি কাউকে সে সুযোগ দেননি। তিনি যখন বলেন,
‘আমার মা জননী প্রতি জ্যোস্নারাতে উঠোনে সযত্নে দুঃখ বুনতেন
রাতের তারারা তাতে ছিটিয়ে দিতো উৎকর্ষ রাসায়নিক
এভাবে আজীবন লাফিয়ে উঠেছে তার দুঃখ সংসারের শস্যবীজ’
অথবা
‘সেই দেশে যেতে যেতে রূপকথা হয়ে যায় প্রতীক্ষার প্রহর
সতের হাওর আর তের নদী কল্পনার ডানা মেলে উড়ে
পাল তোলা নাও নেই, যান্ত্রিক ট্রলারের অক্লান্ত আওয়াজে
মেঘের ভেলার মতো থোকা থোকা গ্রাম ভেসে চলে’
এই দৃশ্যকল্প একান্তই তার নিজের। এখানে এসে তিনি জীবনানন্দ দাশ এবং আল মাহমুদ দু’জন থেকেই আলাদা হয়ে গেছেন।
সর্বদা হু হু করে মন
বিশ্ব যেন মরুর মতন
উহ! কী জ্বলন্ত জ্বালা
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।
বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের নষ্টামি আর তান্ডবলীলা দেখে হতাশায় কাতর হয়েছিলেন, ভোরের পাখি খ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। তারপর কাতর হয়েছিলেন আরো অসংখ্য মহত্তম কবি-সাহিত্যিক। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দানব এতোটুকু নড়েচড়ে বসেনি। সে নানাপ্রকার ফাঁদ পেতে শিকার করেই যাচ্ছে একের পর এক দেশ, জনপদ, জাতি। বিশেষ কিরে মুসলিম বিশ্ব যেনো তাদের হাতের পুতুল। যখন ইচ্ছে তার হাতটা ভেঙে দিচ্ছে, গলাটা মুচড়ে দিচ্ছে। কারো কিচ্ছু বলার সাহস নেই। কেউ কিচ্ছু বলছে না। মাঝেমধ্যে নাম মাত্র প্রতিবাদ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিচ্ছু হচ্ছে না। এ অবস্থায় কবি কিছু না বলে পারেন না,
নিঃশব্দ শিশির হয়ে কতো মৃত্যু জমেছে এই বুকে
জীঘাংসার অভিঘাতে ছিন্নভিন্ন নীল বর্ণ শোক
সময়ও উদ্বিগ্ন আজ উপর্যুপরি মৃত্যুর ভারে
শোনো সেই মাতম ও মর্সিয়া, পৃথিবীর অবিচ্ছিন্ন কান্না।
(কারবালা, মিলেনিয়াম শব্দজট)
অথবা
মৃত্যু সন্ধিক্ষণ চাঁদের গ্রীবায় ঝুলে
একবাটি বিবমিষা পান করে
বড়ো থিতু হয়ে যুগ চলে ফিউজ বাল্বের চোখে
কে এখন হারানো রোদের সুর খোঁজে?
(মৃত্যুপুরাণ, মিলেনিয়াম শব্দজট)
(অসমাপ্ত)
‘অসুখ’ কবিতা ও সমসাময়িক কাল
কবি মহিবুর রহিম নব্বই দশকের একজন প্রতিভাবান কবি। এর মানে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে। এমনটাই আমাদের সাহিত্য বিবেচনার পরিচিত ধারা। অথচ তিনি দেশের আলোচিত কবিদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত! এরও বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। দু’য়েকটি ব্যতিক্রম বাদে এদেশে সম্ভাবনাময় কবিরা সাংস্কৃতিক রাজনীতির শিকারই হয়েছেন বেশি। মহিবুর রহিমও হয়তো তার থেকে ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আমার আজকের আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমি কবির প্রথম দিকের কয়েকটি কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। যেগুলো তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অতিরিক্ত চোখ’ এ অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটির রচনাকাল সম্ভবত ১৯৮৮ সাল হবে। সে সময়েই তার লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। কবিতাটি হচ্ছে ‘অসুখ-১’। দুটি কবিতা একই নামে হওয়ায় এমন নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। প্রকৃত নামকরণ ‘অসুখ’ ধরে নেয়া যেতে পারে। গত কয়েকদিন ধরেই কবিতাটি পড়ছিলাম। একটি সিরিয়াস কবিতার নিবিষ্ট পাঠ অনেক সময় কবিতাটির শৈল্পিক কাঠামোয় প্রবেশে সহায়তা করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সমসাময়িক ঘটনাবলী, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষত কাশ্মীর পরিস্থিতি, আসামের তথাকথিত ‘এনআরসি’র নামে ১৯ লক্ষ নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করে দেয়ার পায়তারা, রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হয়ে আছে, সেই সাথে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান সমস্যা, এমন কি চীনের উইঘুর নির্যাতন, এসব ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে গোটা এশিয়ায় একটি অসহনীয় উদ্বেগ সচেতন মানুষমাত্রকেই কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক গতিধারা শুধু উদ্বেগজনক পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেনি, সমূহ সর্বনাশের বাঁশি বাজিয়ে চলেছে অনবরত। তার সাথে আছে একরোখা আগ্রাসী বিশ্ব রাজনীতি। সেটি পরমাণু যুদ্ধেরও হুমকি সৃষ্টি করে রেখেছে।
দু’শ বছরের পরাধীনতা থেকে সুদীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকারী ভারতবর্ষের মানুষজন এখনো স্বাধীনতার সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ পুরো অঞ্চলের মানুষ এখন অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অস্থিরতায় হাসফাস করছে। যা পরাধীনতার সময়কাল থেকেও দুঃসহ। এই পরিস্থিতিতে আমি যখন আমার প্রিয় কিছু গান শুনি ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।’ কিংবা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার, ওহে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুশিয়ার।’ আমার বুক কেবল ভার হয়ে আসে। মনে হয় এত রক্তক্ষয় এত ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা কী তাহলে ব্যর্থ? এমন একটি আশঙ্কা অজান্তেই মনে এসে লাগে।
সে রকম এক বাস্তবতায় কবি মহিবুর রহিমের ‘অসুখ’ কবিতাটির পাঠ আমাকে এ কবিতার নবমূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করে। প্রিয় পাঠক আলোচনার সুবিধার্থে কবিতাটির ম‚লপাঠ নিচে তুলে দিলাম–
অসুখ/ ম হি বু র র হি ম
সারারাত ঘুম নেই কি একটা শব্দে আমার ঘুম আসে না
চোখের পাঁপড়িগুলো ভিজে ওঠে ব্যথা করে চোখ,
ব্যথাটা চোখের থেকে নিচে নামে কখনো থামে না।
স্থানান্তর হয় শুধু চোখ থেকে কাঁধে বুকে এই নির্দয় অসুখ–
নিয়ত ঘুরতে থাকে। কখনো পায়ের দিকে নেমে যায়,
তারপর আবার চোখেতে। ব্যথাটা অস্পষ্ট দেখাও যায় না
দেখানো যায় না শুধু একটা নির্দয় শব্দ শোনা যায়
প্রশ্ন করে কোথায়? এর উত্তর আমিও জানি না!
সমস্ত দিকেই এর উত্থান ধারণা আমাকে চিন্তিত করে
আমার চিন্তার জাল দ্রবীভ‚ত হলে আবার ব্যথাটা বাড়ে
এবং চোখের মাঝে নিশ্চল, নির্মম তারপর জল হয়ে ঝরে;
সারারাত ঘুম নেই ঘুমোতে পারি না এই এক ব্যর্থ সংহারে।
মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে দেখি হিমালয় ছুঁয়ে সারা এশিয়ায়
ব্যথাটা ছড়িয়ে আছে মৃত লাশে, ব্যর্থ স্বাধীনতা, মিথ্যা সান্তনায়!
সনেট কাঠামোর এ কবিতাটির রচনাকাল ১৯৮৮ হলে ইতোমধ্যে তিন দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। কবিতাটি নেয়া হয়েছে কবি রবিউল আলম নবীর টাইমলাইন থেকে। আজ থেকে চার বছর পূর্বে নিজের টাইমলাইনে কবিতাটি পোস্ট দিয়ে রবিউল আলম নবী লিখেছন– ‘যে কবিতা পড়ে কবি মহিবুর রহিমের প্রেমে পড়েছিলাম।’ আমার কাছেও কবিতাটির নিবিষ্ট পাঠ নতুন করে কবি ও কবিতার প্রতি অন্যরকম এক আগ্রহের জন্ম দিল। এ কবিতায় এক নিভৃতমনা দ্রষ্টা কবিকে যেন আবিষ্কার করলাম। কবিতাটির রূপকল্প ব্যক্তি চৈতন্য থেকে সামগ্রিক চৈতন্যে বিশেষত সারা এশিয়ায় মৃত লাশে, ব্যর্থ স্বাধীনতা, মিথ্যা সান্ত¡নায় ছড়িয়ে পড়া এক দুর্দমনীয় অসুখের ইঙ্গিত সত্যি কবির দূরদর্শীতাকে পাঠকের মনে উপস্থাপন করে। কবিতাটির অসাধারণ গঠন কাঠামো, বিষয়ের অনন্যতা, উপস্থাপনের অভিনবত্ব সবই একজন শক্তিমান কবিকে চিনিয়ে দেয়। কোন দলদাস বা গ্রুপবাজ কবি না হয়ে নীরবে নিভৃতে কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন কবি মহিবুর রহিম। কবির প্রথম পর্যায়ের এই কবিতাটি সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।