spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাকবিতা গুচ্ছ : জাকির আবু জাফর

কবিতা গুচ্ছ : জাকির আবু জাফর

গুছিয়ে নেবার গল্প 

বাবার হুকুম ছিলো– সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নেবে 

ভোর হলে চোখ থেকে ঘুমগুলো গুছিয়ে নিতাম

স্বপ্নগুলো গুছিয়ে রাত রেখে দিতাম মশারীর ভাঁজে 

রাতের সমস্ত দাগ ঝেড়ে বিছিয়ে দিতাম দিনের তরিকা

মক্তব-শিক্ষক বলতেন চুলগুলো গুছিয়ে নাও

চুল গোছগাছ করে গুছিয়ে নিতাম মুখও

কেননা উস্তাদ মুখে দেবেন খোদার কালাম

এত কণ্ঠ, ডানে বাঁয়ে, এত যে শব্দের ধ্বনি 

শিক্ষক একাই ধ্বনিগুলো গুছিয়ে নিতেন 

বলতেন মনটি গুছিয়ে রেখো বুকের ভেতর 

কেননা মনই বেসামাল হয় আজীবন 

কৈশোরের সকালগুলো আজো জ্বলে স্মৃতির জেহেনে

উঠোনের রোদগুলো গুছিয়ে নিতাম নাস্তার টেবিলে 

মা বলতেন–টেবিলের ছায়াগুলো ঝেড়ে 

                           রোদগুলো রেখে দাও 

আমরা ছায়া ঝেড়ে রেখে দিতাম টেবিলের তলে

নাস্তায় রোদের ঝোল ঢেলে জুড়িয়ে নিতাম ঝাল

শরীর গুছিয়ে নিতে গোগ্রাসে গিলতাম 

দর্পিত দুপুর চারিদিক থেকে ছায়াগুলো গুছিয়ে 

                                  রেখে দিতো গাছের নীচে 

গাছও গুছিয়ে নিতো ছায়ার শরীর 

ভাবি আলো তীর্যক হলেই কেনো ছায়া ছোট হয়ে যায় 

পাখির ফিরতি সুর মিশে বাঁশবন থেকে নামতো সন্ধ্যা 

সন্ধ্যার মৌনতা গুছিয়ে রাখতাম বইয়ের ভাঁজে

গভীর হলেও মশারিতেই থেকে যেতো রাত

কেবল জীবন গুছিয়ে নেবার তৃষ্ণায় জাবর কেটেছি বইয়ের পাতায়

সবাই জীবন গুছিয়ে নেবার কথাই বলে

জীবন গোছাতে গোছাতে দেখি- 

মৃত্যুই গুছিয়ে রাখে মানুষ !

চোখতলা

ব্যাংক যোগে নয় বিকাশ করে দাও তোমার নগদ দৃষ্টি 

ক্যাশ করে দেখি–

কী হৃদয় সেলাই করা তোমার দৃষ্টির ইজারে

ভ্রু উল্টিয়ে দেখে নেবো তোমার চোখতলা

কীভাবে ঝরাও তোমার দৃষ্টির শিশির 

চোখতলায় দাঁড়াতেই দেখি–

অকারণ কুয়াশায় ভিজে থাকার দাগ

অশ্রুতে ধুয়ে থাকা দৃষ্টির কেয়ারি

মনছেদা দৃষ্টির খোঁচায় যখন হৃদয় ক্ষত

আমি করতেই পারি চোখের মামলা

দৃষ্টি-বাণিজ্যকে হৃদয়-শিল্প করার পক্ষে আমি নই

আমি চাই মনের রাজস্বধারী হৃদয়ের দীর্ঘস্থায়ী চেক

দৃষ্টি-খেলাপী হবার ইচ্ছেও রাখি না আমি 

রাজি নই দৃষ্টি-হামলায় জিম্মি হতেও

আমি চাই দৃষ্টি-মাচায় হৃদয়-লতার লকলকে ডগা

যার তরুণ পাতায় লেখা হবে চোখের গল্পটি 

বিষাদ আগুনে পোড়া দৃষ্টির ছাই 

        কুড়িয়ে নেবো বুকের কাছে 

ছাইগুলো সুরমা করে সাজিয়ে দেবো চোখের দোকান 

দেখো শেষ তর্কেও দৃষ্টিই থাকে বিক্রির শীর্ষে

প্রেমের দৃষ্টিতে নাকি থাকে ক্রসফায়ার 

কে হয় খুনের শিকার! 

মন নাকি দৃষ্টির পাখি! 

যে ই হোক দাউদাউ জ্বলতেই থাকে দৃষ্টির আগুন 

চোখ তো হৃদয় শাসিত ক্যামেরা

তোমার দৃষ্টির ছবি তুললেই দেখি- 

                  তোলা হয় মনের ছবি 

আর মন সে তো গোপন লীলার ময়ূরী 

চোখ দেখে দেখে চোখাতুর আমি 

দৃষ্টি-জালে ছেঁকে তুলি মন-জলের মাছ

পৃথিবীর উঠোন থেকে জগতের চোখ দেখে ভাবি–

আহা আমারই আছে কোটি কোটি দৃষ্টিঋণ

এ দুটি চোখের কৃতজ্ঞতায় নতমুখে লিখি-

                                         দৃষ্টির মসনবি

কেননা চোখের দাম চোখ ছাড়া বুঝবে না কেউ!

নতুন তরিকা

কেউ কিছু আঁকতে দিলে ফুলই আঁকতাম আমি 

ফুল আঁকতে আঁকতে অকস্মাৎ একদিন 

                          এঁকে ফেলি ফুলের গন্ধ

সেই থেকে শুরু আমার আঁকার নতুন তরিকা 

তারপর–

রোদ আঁকতে এঁকে ফেলি রোদের উষ্ণতা 

ছায়া আঁকতে এঁকে যাই ছায়ার শীতল 

দৃশ্য আঁকতে এঁকে ফেলি দৃশ্যের আড়াল এবং

সন্ধ্যা আঁকতে আঁকতে এঁকে রাখি সন্ধ্যার মৌনতা

এভাবেই বৃক্ষ আঁকলে আঁকা হয় বৃক্ষের ধ্যান

কারো চোখ আঁকতে দৃষ্টি এঁকে ফেলি 

অশ্রু আঁকতে এঁকে ফেলি অশ্রুর নুন

হাসি আঁকতে আঁকি হাসির খোশ

এমন করেই এক ফোটা জল আঁকতে  

এঁকে রাখি সমুদ্রের ঘ্রাণ

ইচ্ছেগুলো আঁকতে আঁকতে এঁকে ফেলি ইচ্ছের ছায়া

মন এঁকে দেখি আঁকা হয় মনের চুপিসার

এভাবে খোয়াব আঁকতে আঁকতে 

এঁকে ফেলি  খোয়াবনামা 

পিঁপড়ের সারি আঁকতে আঁকি পিঁপড়ের পায়ের আওয়াজ

বাঘের গর্জন আঁকতে এঁকে ফেলি বীরত্বের ধ্বনি 

যখন সাহস আঁকি সত্যের উত্তাপ আঁকি 

ভীরুতা আঁকতেই দেখি আঁকা হয় কাপুরষ 

এভাবে সমাজ আঁকতে আঁকতে আঁকি সমাজের অন্ধত্ব 

মানুষের মুখ আঁকতে হঠাৎ আঁকা হয় নেকড়ের মুখ

চাতুর্য আঁকতে এঁকে ফেলি শেয়ালের ধূর্ততা

সহসা বন্ধুত্ব এঁকে দেখি স্বার্থের জাল

খ্যাতি আঁকতে আঁকতে এঁকে ফেলি জেলাস আগুন

অতঃপর–  

জীবন আঁকতে আঁকতে এঁকে ফেলি এক স্বপ্নের ঘোড়া 

মানুষের কাছে যে ঘোড়াটি অধরা চিরদিন!

ভাঁজ করার কৌশল 

জামা ভাঁজ করার কৌশল এঁকে মা বললেন–

এমন করেই ভাঁজ করে নিতে হয় জীবনের দুঃখগুলো

ভাঁজের চাতুর্য শিখতে শিখতে আমি শিখে গেলাম 

কীভাবে একাই ভাঁজ করে নিতে হয় পথের বন্ধুর

আমি সুখ ভাঁজ করার নিদান খুলে বরাবরই অপলক

মা আমার দৃষ্টি ভাঁজ করে রেখে দিলেন কৈশোরের তাকে 

বললেন– যখন ইচ্ছে খুলে দেখিস নিষ্পাপ এই চোখের নদী 

সহসাই নদীগুলো ভাঁজ করে রেখে দিলাম বুকের ভেতর

তারপর ঢেউয়ের পৃষ্ঠাগুলো সেলাই করে দেখি- 

কীভাবে এক মলাটে বন্দি– জলের অভিধান 

জল থেকে চরাচর আমার মুহূর্মুহু পাঠের আয়াত

ঘাসের অক্ষর থেকে পাতার নকশা

সবুজ শরবত থেকে ভোমরের চুম্বন 

পাঁপড়ির ঠোঁট ও বৃক্ষের ধ্যান

এসব দরবেশী মাকাম আমার নিত্যতায় চোখা

ফসলের ছায়া ছেঁকে ভাঁজ করি ধানের কম্পন 

আমার রোদ ও ছায়ার ফাঁকে থৈথৈ বৃষ্টির ঘ্রাণ 

মৌমাছির গুঞ্জন ভাঁজ করে পাঠ করি মৌচাকের লিপি

রাতগ্রন্থ পাঠ করে জেনে গেছি অঘুমো চোখের বিধি 

জেনে গেছি শিউলির শ্বাস থেকে মুদ্রিত গন্ধের হরফ

জোছনায় টুপটাপ শিশিরের কেরাত শুনে ভাঁজ করি ভোরের নিশ্বাস 

আমার আমিকে ভাঁজ করার কায়দা এখন দুর্দান্ত 

যখন সবাই ভাঁজ করে ক্ষমতার উত্তাপ 

সকলেই ভাঁজ করে খ্যাতির তৃষ্ণা 

হৃদয় কাটার ছোরাটি শাণিয়ে সবাই যখন সন্তর্পণ

আমি একাকীই ভাঁজ করি মানুষের মানচিত্র 

পরতে পরতে আস্ত জীবনটি ঘেঁটে দেখি 

সুখের নেশায় কেবল দুঃখই ভাঁজ করে মানুষ!

চিরতমা বাংলাদেশ

আমিও গাঁয়ের শিরা থেকে বেড়ে ওঠা 

                      লকলকে লতার ফাগুন 

রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়ার উদাত্ত হৃদয় এবং

ঢিবির নিতম্ব থেকে ঝিঁঝিঁর রাগ– সংগীত 

আমার নিকুঞ্জে জ্বলে পলাশের ঘোরলাগা রঙ

বনানীর বুকে বুকে তাপহীন শিমুল আগুন

ডুমুর ডালের তলায় সবুজ জলে আমি বৃক্ষের মুখ

আমার বুকের ভেতর ঘাসের সংসার 

শরীর জুড়ে করঞ্জার নিকুঞ্জ 

চোখের সারাটা জুড়ে শর্ষের পতাকা এবং

হাতের রেখায় ধেয়ে চলা নদীর উজান

আমি বসন্তের ঝোল ঢালি গ্রীষ্মের পেয়ালায় 

বৃষ্টির হৃদয় থেকে শীতল স্বভাব তুলে ভরে দেই 

শিউলি ও ছাতিমের বুক  

কুমারী বাতাস ঢালি ঢাকার জনজটে

দুর্বাঘাস থেকে শিশিরের নকশা তুলে গুঁজে রাখি

রাজপথের সিনার ভেতর 

মতিঝিলে রুয়ে দেই এক টুকরো ধানের সবুজ 

কাঁঠাল তলার করে নেই ধূসর দোয়েল চত্বর 

বাতাবী নেবুর ছায়ায় ভিজিয়ে দেই শাহবাগ মোড়

কবিতার আড্ডা থেকে দীর্ঘ শ্বাস তুলে বুকে রাখি

পাতার সুবাস

ফসলের দীর্ঘ দীর্ঘ মাঠ আমার বাংলা অভিধান 

মটর দানার দেহে আমার শব্দের পেলব

সূর্যমুখি পাঁপড়ির খাঁজ আমার বর্ণমালার অ আ

মটরশুঁটির ক্ষেত আমার ভাষার বিতান

শিশিরের ফোটাগুলো মুক্তোময় শব্দ আমার 

কুয়াশার ঘোর ঘোর রহস্য কাহিনী 

সমগ্র সবুজ আমার প্রেমের উপাখ্যান 

পৃথিবীর বুকে বুকে চোখ তুলে দেখো আমি এক 

অনস্বর চিরতমা বাংলাদেশ!

আমিও বৃষ্টির পাঠক 

বৃষ্টির অক্ষর থেকে শব্দ তুললেই শুনি হৃদয় ঝরার ধ্বনি 

শুনি শূন্যতার শরীর বেয়ে নামা জলের সংগীত 

মেঘের হৃদয় যখন প্রাচীন বাঁশির অনলবর্ষী 

সন্ধ্যা নয় শুধু মধ্যরাতও তখন মহামগ্ন ধ্যানের আসর 

হৃদয়ের তাসবিহ্ যখন বৃষ্টির শ্বাস

অনায়াসে তাকে লিখি জলের ঠোঁটে 

কে শোনে ঝরঝরন্ত জলের উচ্চারণ 

পাঠের কৌশল দেখে নড়ে ওঠে আমার ঠোঁট

আমার হৃদয় তখন বর্ষণধারী বৃষ্টিবিদ্যালয়

ভেবে বেশ লাগে – আমিও বৃষ্টির পাঠক এক

আমিও হৃদয়ে লিখি বুনোবৃষ্টির নাম

 কে যেনো আদেশ করেন– মূর্ছনায় তন্ময় হও

আমি হই,

সারাটা শরীর ছেঁকে তন্ময় আনি হৃদয়ের কাছে 

সন্তর্পণে হৃদয়টি গুঁজে রাখি বৃষ্টিবীণায়

তারপর হৃদয়তারে বেজে ওঠা সুর 

সারারাত খেলে নির্জন কুহরে

খুব সহজেই নির্জনতার হয়ে উঠি আমি 

আবার বলেন– শোনো এই বৃষ্টিতেই ঝরে  আত্নার কেরাত

জানোনা প্রতিটি ফোঁটার শরীরে লেখা উদগমের আদেশ 

মেঘের হৃদয় থেকে আমার হৃদয় খুব দীর্ঘ পথ  নয়

 মন-কুন্জে তাই জমে বর্ষণের চিরন্তন উদাস

কে আছো, এমন উদাসী নির্জনে নিজেকে 

ভেজায় সহসা

 উচ্ছল উদ্যম আর উল্লাসের ঝরঝরে উৎসবে

হৃদয় বিছিয়ে বসে একাকীত্বের পাশে

মেঘের হৃদয়গুলো ঝরে পৃথিবীর হৃদয়ের কাছে 

আর হৃদয় মানেই অনন্তের তসবিহ্ রাখার সিন্দুক 

দেখি পৃথিবীর নদীগুলো বৃষ্টির প্রাচীন গুদাম

সারাটা জমিন যেনো একান্ত বিছানা

পাহাড়গুলো সমর্পিত শিথান

পাঠের আনন্দ এঁকে মন আমার অনন্তের স্মারক

পরিচিতি

জাকির আবু জাফর। বাড়ি–ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায়। লেখাপড়া–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  লোকপ্রশাসনে অনার্স- মাস্টার্স। লেখালেখি – কিশোরকাল থেকেই। দেশের বিশিষ্ট কবিদের একজন তিনি। দেশের সীমানার বাইরেও রয়েছে তার বিপুল পরিচিতি। তিনি উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, এবং জনপ্রিয় গীতিকার। তিনি কলামিস্ট,  নিবন্ধকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি সমান পাঠকপ্রিয়। শিশু সাহিত্যে কিশোর কবিতায় যেমন রয়েছে তার বিশেষ অবদান। তেমনই কিশোর গদ্যেও তিনি অনন্য। বড়দের ছোটদের সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি। গীতিকার হিসেবে তিনি সমাদৃত ও প্রশংসিত। কবিতা, কিশোর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথাসহ এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা– ৫৪ টি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ