spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

লিখেছেন : খালিদ সাইফ

দোররা

খালিদ সাইফ

কোনো বাধা না পেয়ে সাদা গরুটা এগিয়ে গেল সবুজ চারা ধানগাছের দিকে। যাবেই না বা কেন! ধানগাছগুলো যেমন তরতাজা আর স্বাস্থ্যবান — দেখলেই যে-কোনো গরু-ছাগলের জিভে পানি চলে আসবে। হাফেজ ছমিরুদ্দিনের গরুটা সুযোগ পেয়ে ধানগাছ সাবাড় করা শুরু করল। গরুটি চরাতে এনেছিল হাফেজ সাহেবের দশ বছরের ছেলে কলিমুল্লাহ। গরু ছেড়ে দিয়ে সে পাশের আমগাছের নিচে বসে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মার্বেল খেলায় মেতে ওঠে। খেলার উত্তেজনা ও আনন্দে কলিমুল্লাহ পুরোপুরি ভুলে যায় গরুর কথা। গরু কাজে লাগায় এই সুযোগ। অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি শেষ করে ফেলে চারা ধানের একটি বড় অংশ।

সেই সময়ই কোথা থেকে যেন ছুটে আসে চারার মালিক রিয়াজুল। গরুর কাণ্ডকারখানা দেখে মাথা চাপড়াতে থাকে। অবোলা প্রাণীর মালিককে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে থাকে অশ্লীল সব গালাগাল। না এর শাস্তি গরুর মালিককে পেতেই হবে।

রিয়াজুল কৌশলে এগিয়ে যায় গরুর দিকে; যেন গরু উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে। খপ করে ধরে ফেলে গলার দড়ি। এ সাফল্যে রাগ কিছুটা শান্ত হয় । সোজা এগিয়ে চলে খোয়াড়ের দিকে। গরুর দড়ি ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে গজরাতে থাকে।

এই সময় চৈতন্যোদয় ঘটে কলিমুল্লাহর। দৌড়াতে দৌড়াতে সে ছুটে আসে রিয়াজুলের কাছে। ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দেয় ।

কোথায় লি যাচ্ছেন আমার গরুডা? ভাঙ্গা কণ্ঠে সে জানতে চায়।

খেকিয়ে উঠে রিয়াজুল। অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে থাকে কলিমুল্লাহকে। গালি শুনে আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে ছেলেটি। হঠাৎ সে নাছোড়বান্দার মতো গিয়ে জাপটে ধরে গরুর গলার দড়ি। থেমে পড়ে গরু। কলিমুল্লাহর আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে রিয়াজুল। নাক-মুখ খিঁচিয়ে উঠে তার। চিৎকার করে গরুর দড়ি ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু ভয় পেয়ে আরও জোরে গরুর দড়ি টেনে ধরে কলিমুল্লাহ ।

বাধা পেয়ে মাথা বলকাতে থাকে রিয়াজুলের। চেঁচিয়ে উঠে সে, গরু দিয়া তোর বাপের ধান খাওয়াইছিস হারামির বাচ্চা। আমার চারা ধানডা তুই শ্যাষ করি দিছিস। তুই শাস্তি পাবিই পাবি ।

তখনও দড়ি ছেড়ে দেয় নি কলিমুল্লাহ। গরু নিয়ে দুজনের টানা-হেঁচড়ানি চলতে থাকে। কলিমুল্লাহর সাথে যারা একটু আগে মার্বেল খেলছিল সেই ছেলেরা এসে দাঁড়ায় কাণ্ড দেখার জন্য। তখনই ঘটনা পুরো রূপ নিয়ে বিস্ফোরিত হয়। রিয়াজুল এগিয়ে এসে কয়েকটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কলিমুল্লাহর গালে। ঘটনার এই আকস্মিকতায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে ছেলেটি। গরুর দড়িও ছেড়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে ।

দর্শক নির্বাক। তারা শুধু সাক্ষী হয় ঘটনার ।

হাফেজ ছমিরুদ্দিন ছেলের কাছ থেকে সব শোনে। নিজের গরু ধান খেয়েছে এটা নিঃসন্দেহে তারই অপরাধ। কিন্তু এজন্য ছেলেকে শাস্তি দেওয়া হবে এটা মানতে পারে না। প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। হাফেজ গিন্নি এতক্ষণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামাচ্ছিল। স্বামীকে বেরুতে দেখে সেও পেছনে পেছনে আসে। বাড়ির সদর দরজায় এসে মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, খামোখা ঝগড়া-ঝাটি কইরেন না — আপনার দোহায় লাগে ।

রওনা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রিয়াজুলকে ধরে ফেলে ছমিরুদ্দিন। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে রিয়াজুলকে বলে, গরু খোয়াড়ে দেন কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু আমার ছাওয়ালডাক মারছেন ক্যা ?

লোহা ঝালাইয়ের মতো জ্বলে ওঠে রিয়াজুল। উহ্ আদর করতে হবি উনার ছাওয়ালকে। আমার চারা ধানগুনি গরু দিয়া খাওয়ায়ে শেষ করছে আর আমি আদর করব উনার ছাওয়ালরে ! কি আমার জমিদারের ব্যাটা। মারিছি ঠিক করিছি।

একথা শুনে রাগে আদিম অন্ধকারে ঢুকে যায় হাফেজ ছমিরুদ্দিন। দ্রুত চলে যায় রিয়াজুলের পাশে। খপ করে বাম হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রিয়াজুলের দাড়ি। তারপর দ্রুত গতিতে প্রচণ্ড শক্তির সাথে দুগালে বসিয়ে দেয় দুই চড়।

মারের আঘাতে চোখে অমাবশ্যার আকাশের তারা দেখতে থাকে রিয়াজুল। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে তার কয়েক মুহূর্ত লেগে যায়। কি বলবে কিছুক্ষণ বুঝে উঠতে পারে না। হাফেজ সাহেব যে গায়ে হাত তুলবে এটা ছিল তার কাছে অকল্পনীয় ।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে বলে ওঠে সে, তুই আমারে মারলু! আমার দাড়ির বেইজ্জতি করলু। এজন্য তোক কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব দিতে হবি। তোক আমি ছাড়তাম না। গরু তোক খোয়াড় থাকিই লি আসতে হবি। সাথে যোগ করে অশ্লীল গালি।

ছমিরুদ্দিন বলে, যাও লিয়ে যাও খোয়াড়। খোয়াড় থাকিই আমি ছাড়া অ্যানবো গরু ।

মার খেয়ে রিয়াজুল প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করে না। বদলে জোরে জোরে অভিশাপ দেওয়া শুরু করে, আমাক মারের শাস্তি তোক পাতেই হবি। হারুন মণ্ডলের কাচে আমি বিচার দিব। আল্লাহ যে হাত দি আমাক মারচে ওই হাত তুমি খসায়ে ফেল। যে হাত ও আমার উপর তুলছে ওই হাত তুমি অবশ করি দিও। ওর হাত তুমি ভ্যাঙি গুঁড়া করি দিও মাবুদ।

সারা রাস্তায় বদদোয়া দিতে দিতে রিয়াজুল গিয়ে উপস্থিত হয় লোকমান হাকিমের খোঁয়াড়ে। গরুটা খোয়াড়ে দিয়ে যে টাকা পায় সেটা নিয়ে সোজা চলে যায় হারুন মণ্ডলের বাড়ি। যাওয়ার পথে দেখা হয় ইন্তাজ,রবিউল, কাশেম ও আবুবকরের সাথে। সবার কাছে সে বয়ান করে ছমিরুদ্দিনের হাত তোলার কাহিনি। গরুর চারা খাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনা অত্যন্ত আবেগ মিশিয়ে বর্ণনা করে যায়। শেষে যুক্ত করে, নবীজির সুন্নত হিসেবে দাড়ি রাখিচি ভাই, আমার অপমানও না হয় ম্যানি লেওয়া গেল, কিন্তু নবীজির সুন্নতের অসম্মান তো আমার নবীজির অসম্মান! এইডা আমি হতে দিব ল্যা। আল্লাহপাকের কোরআনের হাফেজ হয়া ও আমার নবীজিরে অপমান করে এ আমি ম্যানব ল্যা। এর  শাস্তি  হতেই হবি ।

প্রত্যেক শ্রোতাই নবীজির বিষয়ে আসাতে অত্যন্ত মর্মাহত হলো। প্রত্যেকের কথাই এরকম ছিল যে, নবীজির সুন্নতের সাথে যে বেয়াদপি করে সে আবার কিসের হাফেজ, কিসের মুসলমান ।

রিয়াজুল যখন হারুন মণ্ডলের বাড়ি পৌঁছল তখন আসরের আজান হয়ে গেছে। মণ্ডলের সাথে তার দেখা হলো না। সেই দুপুর বেলাতে মণ্ডল রাজাপুরের হাটে চলে গেছে। তার দেখা হলো মণ্ডলের ছোট ভাই ইয়াকুবের সাথে। তাকে জানালো নিজের কাহিনি। নবীজির অপমানের কথা শুনে ইয়াকুবও জিহাদি জোশে ফুলে উঠল। রিয়াজুলকে সে আস্বস্ত করে, বিচারের ব্যাপারে সব ধরনের সাহায্য করবে। তবুও সতর্কতার জন্য বলল, যেহেতু তুমি বাদি তাই আগামীকাল বাদ ফজর অ্যাসি নিজেই বড় ভাইকে ঘটনাটা কও, সেডিই সবচায়া ভালো হবি নি।

ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসে রিয়াজুল ।

পরের ঘটনাগুলো এমনিতেই ঘটতে থাকে। কারখানায় উৎপাদনের মতো উৎপাদিত হতে থাকে গুজব। ছমিরুদ্দিনের দাড়ি ধরে চড় মারার কাহিনি মানুষের মুখে রূপান্তরিত হতে হতে কোরআন-হাদিস অবমাননায় গিয়ে ঠেকে। কোথাও কোথাও অসতর্ক বর্ণনাকারীরা এও বলতে থাকে যে হাফেজ ছমিরুদ্দিন নবীজির হাদিস পুড়িয়েছেন। বর্ণনার কল্যাণে রাতারাতি বদলে যায় দৃশ্যপট। ঘটনার পুরো প্রবাহ চলে যায় ছমিরুদ্দিনের বিপক্ষে। যদিও দু-চারজন মানুষ হাফেজের  সাথে ছিল, কিন্তু জনগণের মনের ক্ষোভ বুঝতে পেরে তারাও রণেভঙ্গ দেয়। পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে বেচারা। এ সময়ের কয়েকটি দিন তার কাছে হাজার বছরের মতো দীর্ঘ মনে হতে থাকে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের প্রভাব সারা শরীরের উপরে পড়া শুরু করে। এই কয়দিনে তার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে ।

নানা গুজবের খবর ছমিরুদ্দিনের কানে আসে। একদল জিহাদি লোক নাকি তৈরি হয়েছে, শপথ নিয়েছে তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। হাফেজ বেচারা লুকিয়ে লুকিয়ে এলাকার মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে আলেম-উলামা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে যায়। প্রকৃত ঘটনা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে। অনেকে তাকে সমর্থন করে, সহানুভূতি জানায়; কিন্তু অধিকাংশ যে বিরুদ্ধে — এটা সে বুঝতে পারে।

হঠাৎ সে সিদ্ধান্ত নেয়, পালিয়ে যাবে গ্রাম ছেড়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ছমিরুদ্দিন আবিষ্কার করে, গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার জন্য যে সাহস দরকার, সেটা তার নেই। অবশেষে সে আল্লাহ হাতে ছেড়ে দেয় নিজের ভাগ্য।

এই ঘোর দুর্দিনে ছমিরুদ্দিন কি করবে ভেবে পায় না। অবশেষে মন স্থির করে, এটাই হলো উপযুক্ত সময় — সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করার। হঠাৎ করেই ইবাদত-বন্দেগির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। রাতের বেলা যখন ঘুম আসে না, তখন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় মাবুদের সামনে। সিজদায় গিয়ে চোখের পানিতে বইয়ে দেয় পদ্মা-যমুনা। অবাক ব্যাপার হলো, এই সমর্পণের মধ্যে ফিরে পায় সে হারানো মানসিক শক্তি।

অবশেষে বিচার বসে। হারুন মণ্ডলের খানকায় এসে জড়ো হয় সারা গ্রামের মানুষ। দীর্ঘক্ষণ ধরে নানা প্রশ্নোত্তর ও অনুসন্ধান চলে। ছমিরুদ্দিন ও  রিয়াজুলকে নানাভাবে জেরা করা হয়।

চৌধুরীবাড়ির মেজকর্তা এমদাদ শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন ছমিরুদ্দিনকে গিয়ে রিয়াজুলের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।

মওলানা ইন্নাস আলি রেগে গিয়ে হাফেজ ছমিরুদ্দিনকে অনেক গালমন্দ করলেন নবীজির সুন্নতকে অবমাননা করার জন্য।

অনুসন্ধানের সময় অবশ্য ছমিরুদ্দিন বলে, নবীজির সুন্নতকে  অবমাননার কথা তার বিন্দুমাত্র মনে আসে নি। নবীজির আদর্শ তার জীবনের চেয়েও মূল্যবান। সে আসলে রাগের মাথায় রিয়াজুলকে শাস্তি দিতে গিয়ে এই ভুল করে বসে।

অবমাননার কথা বিচারের জমায়েতে  অস্বীকার করতে গেলে কয়েকজন লোক তেড়ে আসে ছমিরুদ্দিনকে মারতে। অবশ্য মুরব্বিদের হাতের ইশারায় তারা বসে পড়ে।

অনেকক্ষণ পর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কিন্তু ব্যক্তিত্বের সাথে হারুন মণ্ডল বলে উঠল, যাও ছমিরুদ্দিন, যাইয়া মাপ চাও রিয়াজুলের   কাছে।

আদেশের সাথে সাথে বিধ্বস্তভাবে ও অনিচ্ছার সাথে ছমিরুদ্দিন এগিয়ে যায় রিয়াজুলের দিকে। সামনে বসে জড়িয়ে ধরে রিয়াজুলের পা। হাফেজ সাহেবের এই নতিস্বীকারে হঠাৎ রিয়াজুলের সারা শরীরে বিজয়ের এক পুলক বয়ে যায়! কেমন যেন এক অচেনা পৌরুষ জেগে উঠে তার মধ্যে। হিংস্র পশুর মতো চিৎকার করে উঠে সেই পৌরুষ। চিৎকারের প্রভাবে রিয়াজুল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। অসুরিক শক্তি নিয়ে সেই পৌরুষ অন্ধের মতো জাপটে ধরল হাফেজ ছমিরুদ্দিনের দাড়ি। শুধু তাই নয়, মুহূর্তের মধ্যে সে অপর হাত দিয়ে হাফেজ সাহেবের দুই গালে বসিয়ে দিল কয়েকটা চড়। আকস্মিক এই ঘটনায় নির্বাক হয়ে গেল জনতা। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য, হঠাৎ গর্জে উঠল জমায়েত। এই একটি কাজই যথেষ্ট ছিল বিচারসভার রিয়াজুলের বিপক্ষে যাওয়ার জন্য।

রাগে লাল হয়ে গেল হারুন মণ্ডলের সারা মুখ। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, বিচার যদি তুই-ই করবু রিয়াজুল, তাহলে আমরা এখানে কি ছিঁড়ার জন্য হাজির আছি?

জনতার মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, সালারে ঘরের মটকায় পা বাঁধি পিটাও। সালার সাহস কত!

জনতার মধ্যে প্রচণ্ড গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। চৌধুরীবাড়ির মেজকর্তা এমদাদ আবার দাঁড়ালেন। একটি কাশি দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে চলনবিলের মাঝখানের মতো নীরবতা নেমে এলো জমায়েতে।

তিনি বললেন, আমাদের বিচার অমান্য করেছে রিয়াজুল। শাস্তি এখন তাকেও পেতে হবে। দুজনকেই ইসলামি আইন মোতাবেক কুড়িটা করে দোররা মারা হোক।

রায় ঘোষণা করে এমদাদ বসে পড়লেন। আবার গুঞ্জন জনতার মধ্যে। কেউ কেউ আপত্তি জানাতে চাইল রায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু বোঝা গেল ঝুঁকি নিতে চাইছে না কেউই।

শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়ালেন মোমেন বিশ্বাস। সবার দিকে তাকিয়ে তিনি বক্তব্য পেশ করার জন্য অনুমতি চাইলেন। জনতা অনুমতি দিলে তিনি কথা শুরু করলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি হাফেজ ছমিরুদ্দিনকে চিনি। আপনারা হয়ত অনেকেই তাক আমার চায়া বেশি জানেন। আমি সবসময় তারে একজন পরহেজগার মানুষ হিসেবে দেখিচি। গরুর ফসল খাওয়া লি রাগ করি রিয়াজুলকে মারছে এটা নিঃসন্দেহে অপরাধ করচে। সে দাড়ি ধরচে এডাও ঠিক করে নাই। আসলে রাগের মাথায় সে এ কাজটা করছে। …

এ পর্যন্ত বলতেই জনতার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। কেউ কেউ তার কথার প্রতিবাদ করতে চাইল। মোমেন বিশ্বাস হাত তুলে তাদের থামালেন।

জোর গলায়, উচ্চস্বরে আবার বলতে শুরু করেন; তার কণ্ঠস্বরে ছিল আত্মবিশ্বাসের এক গভীর সুর, যেটার মেজাজি ভঙ্গি শুনে জনগণ নীরব হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, নানা ঘটনা আমাদের মধ্যে ঘটে, সবকিছুকে শ্রদ্ধার জিনিসের সাথ গুলায়ে ফেলা ঠিক না। এতে আমাদের কাজগুলো জটিল হয়া যায়। নবীজির অসম্মানকে এই বিচারের সাথে জড়ায়ে ফ্যালায়া একে অনেক কঠিন করা হয়চে। এতে সবচায়া বড় অবিচার করা হয়চে হাফেজ ছমিরুদ্দিনের প্রতি আর সবচায়া বড় লাভ হইচে রিয়াজুলের। জনগণের সমর্থন পায়চে সে। নবীজির অসম্মানের কথা শুনলে কার মাথা ঠান্ডা থাকে। আমারও মাথায় রক্ত উঠি যায়। আবার ভাবি, আমার আবেগকে কেউ যেন পুঁজি না করে, কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে।

এ পর্যন্ত বলা হতেই শ্রোতাদের মধ্য হতে একজন দাঁড়িয়ে কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু হারুন মণ্ডল তাকে থামিয়ে দেন, থামো মিয়া, একজনকে শ্যাষ করতে দাও। সারাদিন সবার এক বিচার নিয়া পড়ি থাকলে চলবি না নি।

 কথা শেষ করে তিনি মোমেন বিশ্বাসের দিকে তাকান, তুমি শেষ করো।

মোমেন বিশ্বাস বলেন, আমার কতাও প্রায় শেষ। আমি যেটা কতে চাচ্চি তা হলি, এই দোররা-টোররা মারার দরকার নাই। দু’জনকেই জরিমানা করি ছাড়ি দেওয়া হোক। দোররা-টোররা মারলে পেপার-পত্রিকা-টেলিভিশনে চলি যাবি নি। নানা কথা কবি নি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা। দরকার নাই এসব জটিলতার মধ্যে যাওয়ার। আমার কথা শেষ।

বসে পড়ে মোমেন বিশ্বাস। তার বসে পড়ার সাথে সাথেই গর্জে উঠেন মওলানা ইন্নাস আলি, না, বিচার-সালিশ আমরা ইসলামি আইন মোতাবেকই করিব। পত্র-পত্রিকা, পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী ও টেলিভিশন যে যাই বলুক, দোররা মারাই এই বিচারের উপযুক্ত ফয়সালা।

মওলানার কথা শেষ হলে জনগণের মধ্যে আবার গুঞ্জন ওঠে। অনুচ্চ গলায় জনগণ তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দেয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গলার আওয়াজ।

বিচারের মধ্যে স্পষ্ট মতপার্থক্য দেখা দেয়। এই মতানৈক্য জনগণ ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছায় নেতৃস্থানীয় বিচারকদের মধ্যেও। একদল দোররার বিরুদ্ধে, আরেক দল দোররার পক্ষে।

দোররা নিয়ে যখন এই মতপার্থক্য বিচারসভায় চলছে, তখনই কর্কটক্রান্তি রেখার মতো তীব্র বিরোধের একটি রেখা সবার অলক্ষ্যে গ্রামের মানুষকে দুটি দলে বিভক্ত করে ফেলে। কতদিন যে এই বিভাজন রেখা মানুষের সুস্থ সম্পর্ককে নষ্ট করতে থাকবে তা কেউ জানে না।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ