spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ : লোক লোকান্তর

লিখেছেন : নাজমুস সায়াদাত

আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ : লোক লোকান্তর

নাজমুস সায়াদাত

কবি আল মাহমুদ ইত্তেফাকে চাকুরী করার সময় মোহাম্মদ আখতার নামে একজন অসাধারণ কাব্যপ্রেমিক, তীর্যকভাষী, প্রগতিশীল লোকের সাথে পরিচিত হন। তিনি একদিন সহসাই কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, তার খাতায় বই করার মতো কয়টি কবিতা আছে। খাতাটি কবির ড্রয়ারেই ছিল। তিনি বের করে মোহাম্মদ আখতারের হাতে দিলে তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা পড়ে গেলেন। কবিতা ছিল একান্নটি। মোহাম্মদ আখতার আঙুলে পৃষ্ঠা ও ফর্মা হিসাব করলেন আর বললেন, চার ফর্মার একটি সুন্দর বই হবে। কী নাম দেবেন এই বইয়ের? কবি চিন্তাভাবনাহীনভাবে বললেন, ‘লোক লোকান্তর’। মোহাম্মদ আখতার মুখ গম্ভীর করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বয়স তো মাত্র বাইশ পেরোচ্ছে। কাব্যগ্রন্থের এই দার্শনিক নাম? কবি হাসলেন। মোহাম্মদ আখতার বললেন, আজই বইটি প্রেসে চলে যাচ্ছে। আমরা আপনার বইটির জন্য একটি যৌথ ফান্ড সৃষ্টি করেছি। এতে কিছু সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চারুশিল্পী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম কপোতাক্ষ। আপনাকে কিছু রয়ালটিও দেওয়া হবে। তবে আপনাকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সাথে লেগে থেকে একটি প্রচ্ছদ বের করে আনতে হবে। আজ থেকে লেগে যান। কবি কাইয়ুম চৌধুরীর কাছ থেকে এক রঙা এক অসাধারণ প্রচ্ছদ আদায় করতে পেরেছিলেন। তিনি কবিকে বলেছিলে, প্রচ্ছদটি এক রঙা হলেও ছাপা হলে মনে হবে কয়েক রঙে ছাপা হয়েছে। আমি আপনাদের খরচ কমানোর জন্য এ আয়োজন করেছি।

কবি আল মাহমুদের প্রথম বই ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশের পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি তার আত্মজৈবনিক স্মৃতিগদ্য ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ গ্রন্থে লিখেছেন:

‘লোক লোকান্তর’ বেরিয়ে গেল। মোহাম্মদ আখতার বাংলা একাডেমিতে বইটির প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করেন। এতে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে বইটির ওপর আলোচনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সেবাব্রত চৌধুরী আরো কয়েকজন সদয় আলোচক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমানসহ বিপুল কাব্যপ্রেমিকরা। সম্ভবত কবি শামসুর রাহমান সেখানে ছিলেন না। কিংবা ছিলেন। আমি এখন আর তা স্মরণ করতে পারছি না। তবে সেটাই বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশনা উৎসব। 

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মোহাম্মদ আখতার কবিতার এতটা আত্মীয় ছিলেন তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে শহীদ হয়ে যান। আজ তার স্মৃতি সবাই ভুলে গেছে; কিন্তু আমি কী করে ভুলি? তিনি ছিলেন কবিদের উপকারী বন্ধু। এ কথা নিশ্চয় আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ শাজাহান সে সময়কার এসব উদীয়মান কবি ও বুদ্ধিজীবীরা কখনো ভুলেননি।  

পরবর্তীতে মুহাম্মদ মহিউদ্দিন সম্পাদিত ‘প্রথম বই প্রকাশের গল্প’ গ্রন্থে আল মাহমুদ ‘লোক লোকান্তর আমার প্রথম কাব্য সহবাসের ফসল’ শিরোনামের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন:

‘লোক লোকান্তর’ আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। যতদূর মনে পড়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। অনেক দিন আগের কথা। বয়সের কারণে সব মনেও করতে পারছি না। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যে সূদুর প্রসারী একটা প্রভাব পড়েছিল বলে ধারণা করি। সাহিত্য নিয়ে একটা জীবন খরচ করার পর আমার এ অনুধাবন হয়তো বাড়াবাড়ি কিছু নয়।

‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয়েছিল কপোতাক্ষ নামের একটি যৌথ প্রকাশনী সংস্থার তত্ত¡াবধানে। লেখক, শিল্পী ও শুভানুধ্যায়ীরা সাধ্য অনুযায়ী চাঁদা তুলে বইটির প্রাথমিক পুঁজির যোগান দিয়েছিল। হয়তো সেটাই ছিল ঢাকায় যৌথ উদ্যোগে লেখকদের চাঁদায় প্রকাশিত প্রথম বই। অনেক বড় আশা নিয়ে কপোতাক্ষ পথচলা শুরু করেছিল। কিন্তু মানুষের আবেগ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আর মানুষ বিচরণশীল প্রাণী। এক স্থানে স্থির থাকতে পারে না, তাদের মতভেদ হয়। অনেক আকাঙ্খা নিয়ে কপোতাক্ষ পথচলা শুরু করলেও পরে সংস্থাটি আর সামনে এগুতে পারেনি। 

‘লোক লোকান্তর’ বেরুবার পর প্রকাশনাটির অধিকর্তারা যেন ভাষা হারিয়ে ফেললেন। কী করবেন, কী করবেন না ঠিক করতে পারছিলেন না। প্রকাশনা সংস্থার পরিচালনা পরিষদে কোন নির্ধারিত ব্যক্তি না থাকায় ‘কপোতাক্ষ’ হাল ছাড়া নৌকার মতো এক সময় ভাসতে থাকলো। তা অবশ্য আলোচনার বিষয় নয়। আমার মতো এক যৎসামান্য কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ সেখান থেকে বেরিয়েছিল, তা স্মরণে এনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছি না। 

বইটির প্রকাশনা উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে সম্ভবত বাংলাদেশের সাহিত্যের অনেক গুণী ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। কপোতাক্ষের পক্ষে আমার অনুজবন্ধু কবি আসাদ চৌধুরী আয়োজনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মনে পড়ছে। আরো সম্ভবত যুক্ত ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, কাইয়ূম চৌধুরী, হাশেম খান, শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ। সে সব নিয়ে আসাদ বোধ হয় লিখেছেও প্রথম আলোতে। কবিতার সহযাত্রী আর বন্ধু হিসেবে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কবি আসাদ চৌধুরীকে সব সময় পাশে পেয়েছি।

‘লোক লোকান্তর’ বেরুবার পর কিছুটা হলেও সমসাময়িক কালের ভেতর আমার কবিতার প্রভাব পড়েছিল। খুব সস্তায় চার ফর্মার একটি বই বাজারে ছাড়া হয়েছিল। তাও আবার আল মাহমুদ নামের এক তরুণ কবির। কাইয়ূম চৌধুরী লোক লোকান্তরের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। এক রঙের কাজ হলেও চার রঙের একটা প্রচ্ছন্ন ভাব খেলা করছিল তার ভেতরে। সেই স্মৃতি এতকাল পরে জিজ্ঞেস করায় আমি অনেকটা আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। দুচোখ বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। বইটি বেরুবার পর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যেন একটা নতুন সময়ের সূচনা হলো। আজ এ সব মনে পড়লে অবিশ্বাস্য লাগে। ভীষণ রোমাঞ্চিত হতে হয়। লোক লোকান্তর কাব্যগ্রন্থ আমার কাছে ছিল পরম পাওয়া। কারণ, ওই সময়ে কোন লেখকের বই বের করা আজকের মতো সহজ ছিল না। 

লেখকরা যৌথভাবে কাজ করলে বিশাল ইমারত গড়ে তুলতে পারেন। কিন্তু তাদের এক করবে কে? আর তারা এক হবেনই বা কেন? হয়তো বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা একই আছেন। ঐক্যবদ্ধ আছেন। সত্যি তাই? আমি জীবনের গোধূলী বেলায় বেডরুমের এক কোণে শুয়ে তা কীভাবে বলবো! ষাটের দশকের সে সময়টাতে, তুলনামূলকভাবে আর কোন গ্রন্থ তখন এতটা আলোচিত হয়েছিল কিনা, মনে পড়ছে না। লোক লোকান্তর আমার প্রথম কাব্য সহবাসের ফসল। প্রথম সন্তান। প্রথম ভালোবাসার কথা কেউ কি ভুলতে পারে? 

[ শ্রুতিলেখক : আবিদ আজম ]  

‘আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই নিয়ে গল্প’ শিরোনামে ‘আসাদ চৌধুরী’ এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন :

শুধু লোক লোকান্তরই নয়, আল মাহমুদকে নিয়ে আরও গল্প করতে হবে, বুঝতে পারছি। তখনও তাঁকে চোখে দেখিনি, শুধু তাঁর কবিতার প্রেমে পড়েছি। কিন্তু আক্ষেপ ঘুচলো ১৯৬২’র দিকে রফিক আজাদের কল্যাণে। নতুন প্রেরণাদাতা সায়ীদ ভাই তো ছিলেন। রফিক আজাদ প্রথম থেকেই ভেতরে ভেতরে দারুণ সংগঠক। প্রথমে বেরুলো বক্তব্য, সায়ীদ ভাইয়ের (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) পৃষ্ঠপোষকতায়, পরে ‘সাক্ষর’। প্রশান্ত ঘোষাল, ইমরুল চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, রণজিৎ পাল চৌধুরী খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। পালের গোদার দায়িত্ব পালন করেছিলেন রফিক আজাদই—সে আরেক বৃত্তান্ত। প্রশান্ত ঘোষাল তিনজন কবিকে আমাদের আদর্শস্থানীয় বলে ঘোষণা করলেন সাক্ষর-এর এক লেখায়। আর এই কবিত্রয় হলেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ আর শহীদ কাদরী। আল মাহমুদের কোনো বই তখনো বেরোয়নি। প্রশান্ত একটি লেখায় প্রমাণ করলেন তিনি কতো বড় সমালোচক। এবারও রফিক আজাদের তৎপরতা। টাঙ্গালের আরেক কৃতীপুরুষ ছাপাখানার ব্যাপারে সত্যি তালেবর ব্যক্তি ছিলেন মুহম্মদ আখতার। তারই নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন একত্রিত হলাম শিল্পী হাশেম খান, শাহজাহান সাহেব, আমার সহপাঠী হেলাল, কথাশিল্পী শহীদুর রহমান, ইত্তেফাকের সাংবাদিক শাহাবুদ্দীন সাহেব আরও কয়েকজন মিলে (মাসে দশ টাকা করে দিয়ে) একটি তহবিল গঠন করে আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ বের করা হলো। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘কপোতাক্ষ’। ‘লোক লোকান্তর’ কাইয়ুম চৌধুরীর দক্ষিণ হাতের পরশে চমৎকার একরঙা প্রচ্ছদে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে বেরুলো। প্রায় রাতারাতি আল মাহমুদ তরুণদের কাছে দারুণ প্রিয় হয়ে উঠলেন। মুহম্মদ আখতারের উস্কানির ফলে সিদ্ধান্ত হলো, বইটির প্রকাশনা উৎসব করতে হবে। পেছনে নাটের গুরু রফিক আজাদ তো ছিলেনই আমার দায়িত্ব ছিল অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ বা ধন্যবাদ জাতীয় কিছু দেবার। কিন্তু মুশকিলটা বেধে গেল অন্য জায়গায়। যে প্রেসে বইটি ছাপা হয়েছিল, শ’দুয়েক টাকা না পেলে তারা কিছুতেই বইয়ের একটি কপিও দেবে না। খবরটা পেলাম দুপুরের দিকে। এদিকে সব আয়োজন সম্পন্ন। বাংলা একাডেমির মূল ভবনের তিনতলায় একটি মিলনায়তন ছিল, অনুষ্ঠানের সভাপতি সৈয়দ আলী আহসান, প্রধান অতিথি ইত্তেফাকের তারকা সাংবাদিক সিরাজ ভাই (সিরাজুদ্দীন হোসেন), সায়ীদ ভাইও কিছু বলতে রাজি হয়েছেন। অথচ বই কোথায়? উদ্যোক্তাদের আরও ভয় ছিল, অনুষ্ঠান শেষে অভ্যাগতদের যে চা-টা দেওয়া হবে, সেই খরচটাই বা কে দেবেন? না, আল মাহমুদের পরিবারটি খানদানি হলে কী হবে, সে সময় আর্থিক অবস্থাটাও সে রকম ছিলো না। আর আমাদের মধ্যে যারা উদ্যোগী তাদের পকেটের অবস্থাটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। হটাৎ করে মনে পড়ে গেল মধুদার কথা। মধুর ক্যান্টিনের মধুদা, শ্রী মধুসূদন দে। মাস কয়েক আগে পূজার সময় তিনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলেন, এই সুযোগটা এখন নেওয়া যায়। মধুদা বাকিতে সিঙ্গাড়া, সন্দেশ আর চা দিতে রাজি হলেন। কিন্তু নগদ অতোগুলো টাকা? ক্যান্টিনের ক্যাশে তখন শ’খানেক টাকাও জমা পড়েনি। বললেন, ঘণ্টা দুয়েক পরে দেবেন। দুই ঘণ্টা পার করে দেওয়ার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলেও মনে হচ্ছিল, বেশ দীর্ঘ সময়। জানি না, কার হাত দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, অনুষ্ঠানের সামান্য আগে কিছু কপি ঠিকই চলে আসে। যাকে বলে হাতে চাঁদ। সে সময় আল মাহমুদ পাজামার ওপর একটা প্রিন্স কোট চাপাতেন, ছিপছিপা শরীর, গলার বোতামটাও আটকাতেন। আমার ছোট বোন মাহেরু রোকেয়া হলের মাতবর মার্কা ছাত্রী। ওকে বলে দিয়েছিলাম আসার জন্য। সে দলবল নিয়েই এসেছিল। আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফুলহাতা টি-শার্ট দিয়েছিলেন আমার এক মার্কিন ছাত্র—সেটা গায়ে চাপিয়ে আমিও সাধ্যমতো স্মার্ট হয়ে হাজির হলাম। ওই পুরো অনুষ্ঠানের সংবাদটি ফটো সমেত ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। এরপর তো আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগদান করি সে বছরেরই শেষ মাসে, ডিসেম্বরে। লোক লোকান্তর আমি আক্ষরিক অর্থে হাতে করে বিক্রি করেছি—উপহারও দিয়েছি। একটি কবিতা আল মাহমুদ ডাক্তার চণ্ডীপদ চক্রবর্তীকে (আমার চণ্ডীদাকে) উৎসর্গ করেছিলেন। আল মাহমুদ যখন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন, আমি চণ্ডীদাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে হৈহৈ করে উঠলেন, ‘করেন। নিশ্চয়ই করা হবে।’ অর্থাৎ সংবর্ধনা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন আল মাহমুদের মামা, একই বাড়ির আজিজুর রহমান মোল্লা এম এন এ টিকিউএ। আর মহাকুমার (এখন জেলা) এসডিও ছিলেন আবুল হাসনাত মোফাজ্জল করিম কবি মোফাজ্জল করিম। তিতাস সাহিত্য পরিষদ (এ সম্পর্কে মুহম্মদ মুসার একটি ধারাবাহিক লেখা বেরিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি সাপ্তাহিকে) গঠিত হওয়ার সময় মোল্লা সাহেব দু’শ টাকা দিয়েছিলেন, সে সময় অনেক টাকা। আমি তিতাস সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, আর চণ্ডীদা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জামিলা খালার বাসার সামনে ফুলবাগিচা ছিল, এখন নেই, সেখানে বৈশাখের এক অপরাহ্ণে তিতাস সাহিত্য পরিষদ গঠিত হয়। আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ায় তরুণ কবিদের চঞ্চলতা এবং আনন্দকে মূল্য দিতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। প্রথমত টাকা কোথায়। ডাক্তার ফরিদুল হুদা (ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, পরে জিয়াউর রহমান সাহেবের মন্ত্রিসভার সদস্য, মওলানা ভাসানীর অন্ধভক্ত), প্রফেসর  আবদুল মোমেন, অধ্যাপক বজেন্দ্র কুমার দাস, অধ্যাপক একে লুৎফর রহমান (জাহাঙ্গীর) সবাই ভরসা দিলেন, না, অনুষ্ঠান হতেই হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্লাবের উৎসাহী সদস্য আমি। আমার অনুরোধে সেদিনের জন্য কার্ড রুম থেকে সরিয়ে ফেলা হলো। স্টেজটাকে সুন্দর করে সাজালেন সাহিত্য পরিষদের কর্মীরা। ঘাপলা এবারও। বিশিষ্ট সৈনিক (ও পরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক) অ্যাডভোকেট আলী আজম পিতৃবন্ধু। তিনি ডেকে বললেন, ‘মোল্লা সাহেব সভাপতিত্ব করলে ছেলেরা গন্ডগোল করবে। আপনি তাড়াতাড়ি অন্য ব্যবস্থা করুন। আল মাহমুদকে আমরা প্রথম সংবর্ধনা দিচ্ছি, কোনো রকমের উচ্ছৃঙ্খলতা ঘটুক আমরা চাই না। আমার মাথায় বাজ পড়লো যেন। করিম ভাই (আবুল হাসনাত মোফাজ্জল করিম) ঢাকা হলের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ইংরেজি বিভাগের স্মার্ট ছাত্র—তখনো জানতাম না তিনি কবিতে লেখেন। সমস্যার কথা বলতেই বললেন, ‘ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।’ বলা ভালো, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তখন দানা বাঁধছে, ছয় দফাকে ঘিরে দেশ একটি গনুঅভ্যুত্থানের দিকে এগোচ্ছে। মোল্লা সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘এসডিও সাহেবকে দিয়েই অনুষ্ঠানটা চালিয়ে দেন। এতে আমাদের পরিবারের সম্মান আরও বাড়বে।’ আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি, অত্যন্ত অমায়িক এই মানুষটি, আমাকে অভিভূত করে দিলেন। তারই ছেলে হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মুহাম্মদ মুসা, সে সময় মাত্র শিক্ষকতায় ঢুকেছেন, নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলে, তিতাস সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক, খুবই চাপের মধ্যে ছিলেন। হটাৎ কারেন্ট চলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হ্যাজাকের ব্যবস্থা ছিল বলে বোধহয় চণ্ডীদার বাসা থেকে তালপাখা আনিয়েছিলেন, সভাপতি মোফাজ্জল করিম (প্রখ্যাত কবি, কলামিস্ট, বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) পাখার বাতাস খাচ্ছেন। শরীফ, আল মাহমুদের বড় ছেলে, বাবার কোলে ঘুমুচ্ছে, আল মাহমুদ ছেলেকে বাতাস করছেন এই ফটোটা আমার বন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্ব প্রাণতোষ চৌধুরী কেন তুলেছিলেন তিনিই জানেন, আর এই ছবিটিই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন—সাদা-কালো আলোকচিত্র। অনেক কথা জমে আছে আল মাহমুদকে ঘিরে। ঢাকায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, দুই দফা চট্টগ্রামে, একাত্তরের কলকাতায়, গনকণ্ঠ’র সেই উত্তাল সময়ে, শিল্পকলা একাডেমিতে…নিউইয়র্কে, বাংলা একাডেমির ছোট্ট কক্ষে সোনালী কাবিনের যুগ, মায়াবী পর্দার যুগ, বিরামপুরের যুগ সময় কতো দ্রুত ফুরোয়।

আল মাহমুদের লোক লোকান্তর কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ হয় নভেম্বর ১৯৭৩। প্রকাশক: কাদির খান, নওরোজ কিতাবিস্তান বাংলাবাজার ঢাকা। মুদ্রণ এন হক মডার্ন টাইপ ফাউন্ডার্স প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিমিটেড ২৪৪ নবাবপুর রোড ঢাকা। প্রচ্ছদ নওয়াজেস আহমদ। কালাম মাহমুদ। এই বইয়ের কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৫৬-১৯৬৪ কবি এই বইটি তার আব্বা-আম্মাকে উৎসর্গ করেছিলেন। 

লোক লোকান্তর কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর শিরোনাম : বিষয়ী দর্পনে আমি, প্রতœ, তিমির তীর্থে, প্রতিকৃতি, রাত, তৃষ্ণায় ঋতুতে, অন্ধকারে একদিন, প্রবোধ, সিম্ফনি, সমুদ্র-নিষাদ, আমরা পারি না, স্বীকারোক্তি, অরণ্যে ক্লান্তির দিন, অরণ্যে অসুখী, তার স্মৃতি, বৃষ্টির অভাবে, অধ্যয়ন, নগ্ন পটভূমিকা, তিতাস, মায়াবৃক্ষ, অহোরাত্র, ড্রেজার, বালেশ্বরে, ব্রে, কঠিন সংসারে, লোক-লোকান্তর, এমন তৃপ্তির, আশ্রয়, রাস্তা, ফেরার সঙ্গী, লোকালয়, নুহের প্রার্থনা, পিপাসার মুখ, কাক ও কোকিল, নেশার সুরভি যেন, নিজের দিকে, করতলে, অবুঝের সমীকরণ, ভেদাভেদ, অকথ্য অলীক, শিল্পের ফলক, কাক, এমন আশার, রক্তিম প্রস্তাব, দুরুহ আভাস, আমি, চারজনের প্রেম, নৌকায়, শোকের লোবান, রুপোর রেকাবী, রক্ষসোপচার এবং স্মরণ। 

আল মাহমুদ গবেষক গাউসুর রহমান ‘আল মাহমুদের কবিতার বিষয়-আশয়’ গ্রন্থে লিখেছেন: 

আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর এলিয়টের প্রেরণায় উজ্জীবিত। লোক লোকান্তর কাব্যে ইয়েটসের দূরাগত আবছা প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিরিশের উত্তরাধিকার বহন করা এই মৌলিক কবি নাগরিক যন্ত্রণাকে যুগযন্ত্রণা হিসেবেই কবিতায় বরণ করে নিয়েছেন। জলসূত্রহীন মরু থেকে মুক্তি পেতেই ছুটে যান তিনি শৈশব-কৈশোর-প্রথম তারুণ্যের স্মৃতি উত্তাপিত তিতাস নদীর কাছে এবং এর অব্যবহিত পর শ্যামল নিসর্গে:

জীবিকাবিজয়ী দেহে কোন এক ঘরে দাঁড়াবো রে আজ

কাকের ধূর্ততা নিয়ে ফিরেছি তো এখানে ওখানে

খুঁজেছি জলার কণা থরথর ধুলোর তুফানে

এখন বুঝেছি মানে— এও এক নারকী সমাজ;

জলসত্র নেই কারো এই শেষে মেনে নিলো মন,

ধুলোকে এড়িয়ে আর কারো ঘরে যাবো না এখন। 

[ আল মাহমুদ, তৃষ্ণার ঋতুতে, লোক লোকান্তর ]

আল মাহমুদের মানস-প্রতিবেশে তিতাস আর গ্রামীণ নিসর্গ। কিন্তু মননপ্রক্রিয়ায় তিনি আধুনিক ও নগরচালিত। তাই তাঁর নগর-নরক থেকে তিতাস খুব দূরে নয়। এ বিবেচনায় তিনি লোকঐতিহ্যের ব্যবহার করতে গিয়ে স্বপ্ন ও ধ্যানের সংকেতময় অবস্থানে অবস্থান করছেন। এই সংকেতময়তা তাঁর দুর্দান্ত আধুনিকতারই প্রত্যক্ষ ফল। বোদলেয়র ও এলিয়েটের প্রেরণা নিয়েও বাংলা কবিতায় তিনি ইয়েটসীয় জীবননান্দ ধারার সার্থক প্রতিভূ। গোলাম মুরশিদ আল মাহমুদ সম্পর্কে তাই মন্তব্য করেন : 

আল মাহমুদের ভাষা একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব। যে মগ্নচৈতন্য থেকে ভোরের সহজ আলোর মতো তাঁর অনুভূতি ঝরে পড়ে, তারই উপযোগী ভাষা তাঁর আয়ত্তাধীন। আলো-আঁধারির ভাষায়, আভাসে ইঙ্গিতে তিনি তাঁর হৃদয়ের কথা আধখানা ব্যক্ত করেন, বাকি আধখানা পূরণ করে নিতে হয় পাঠককে। পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচনকে আধুনিক কোনো কবি সম্ভবত এমন নিপুন ও শৈল্পিক ভঙ্গিতে ব্যবহার করেন নি। পল্লীর উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা ও চিত্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কাব্যের ভাষাক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করেছেন। জসীম উদ্দীন যেখানে লোকসাহিত্যের উপাদানের উপর তাঁর কুটির তৈরি করেন, আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান ব্যবহার করেন। কেননা আল মাহমুদ অত্যন্ত সংবেদনশীল, সচেতন ও বিদগ্ধ শিল্পী। তাঁর উপলব্ধির গাঢ়তা জসীম উদ্দীনের তুলনায় অতলস্পর্শী। তদুপরি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দের এই ত্রিবিধ চলনেই বর্তমান কবির স্বচ্ছন্দ বিহার। অনেকের কাছেই তা ঈর্ষার বস্তু হতে পারে। 

[ গোলাম মুরশিদ, পূর্ববাংলার সাহিত্য : কবিতা, দেশ, ১০ জুলাই, ১৯৭১ ] 

লোক লোকান্তর কাব্য সম্পর্কে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত গোলাম মুরশিদের মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। লোকজ অভিজ্ঞতার অনুবৃত্তি আল মাহমুদের স্বপ্নকে শাসন করতে পারেনি। উল্টো লোকজ অভিজ্ঞতাকে আত্তীকৃত করেছেন আল মাহমুদ তাঁর কবিতায়। লোকজ অভিজ্ঞান আল মাহমুদের কবিতার আবহকে তুমুল নাগরিক অভিজ্ঞতার মধ্যেও স্বপ্ন ও সৌন্দর্যে স্মৃতির সৌরভ ছড়িয়েছে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই লোক লোকান্তর প্রকাশিত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে মন্তব্য করেন: 

… তাঁর নিচু কণ্ঠস্বরে তিনি তাঁর অনুভবের কথা, তাঁর পারিপার্শ্বিক কম্পমান অগ্রসরমান জীবনের কথা বলে গেছেন।… এক সুস্থ-স্বচ্ছ আত্মকেন্দ্রিক জগতের অধিবাসী এই কবি সযতœ ও পরিচ্ছন্ন ছন্দ ও ভাষার অধিকারী। 

[ আবদুল মান্নান সৈয়দ, সমকাল, কবিতাসংখ্যা, ১৩৭১-৭২ ]

আল মাহমুদের আত্মপরতা ও তাঁর অন্তর্গত রোমান্টিকতার কারণেই। কারণ রোমান্টিকতা থেকে ঝকঝকে আধুনিক কবিরও মুক্তি নেই। কল্পনা ও সৌন্দর্যচেতনার কারণেই রোমান্টিকতাও আধুনিক কবিকেও কম-বেশি বশ করে নেয়। নাগরিক যন্ত্রণার বিকল্প হিসেবেই আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় পল্লী জীবনের রোমান্টিক চিত্র উপস্থাপন করেছেন।…  

বর্তমানে ‘লোক লোকান্তর’ কবিতাটি উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্ত অন্যতম একটি কবিতা হিসেবে শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে। 

আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি

বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;

মাথার ওপরে নীচে বনচারী বাতাসের তালে

দোলে বন্য পানলতা, সুগন্ধি পরাগে মাখামাখি

হয়ে আছে ঠোঁট তার। আর দু’টি চোখের কোটরে

কাটা সুপারির রঙ, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল

যেন তার তন্ত্রে তন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল

চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের উপরে।

তাকাতে পারি না আমি রুপে তার যেন এত ভয়

যখনই উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,

মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি

সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়

লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি

আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়। 

[ লোক লোকান্তর-আল মাহমুদ, পৃষ্ঠা-৩৫]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ