নোমান প্রধান
শরীর তার মাটিরঙা। বঙ্গদেশের মাটির মতই তার উর্বরতা। কোলের শিশুটিকে যেভাবে জড়িয়ে রেখেছে, তাতেই পষ্টই বোঝা যাচ্ছে কেমন মমতাময়ী সে; পলিজমা মাটির মতন। তার চোখের গহীনে লুকানো অবারিত জল। বঙ্গের বুকেও তো জমা আছে অফুরান জল তবে সেই জল নারীর অশ্রুর মত নোনা নয়। নিশ্চয় নোনা জল ফেলনা নয়, তবে এই মূহুর্তে জল সামলে নেয়া খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন কিছুটা সামলে নিয়ে দাঁড়ানো আর দাঁড়িয়ে কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া। নয়তো অবিরাম গর্জনে, প্রতিটা আঘাতে নদী যেভাবে সামনে এগিয়ে আসছে তাতে কি হয় কিছুই বলা যায় না। কিচ্ছু না। ব্যথার বিষে নীল যে, সে নিজেকে সামলে চলবে এমনটাও তো কেউ আশা করবে না। সান্দ্র যৌবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া বয়সী নারীটিকে উন্মত্ত নদীর পাড় থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য তার বাহু ধরে জোর চাপ দেয় তারই কোন নিকটাত্মীয়া বৃদ্ধা। শত ভাঁজে কুকড়ে যাওয়া ত্বকে ঢাকা নুব্জ্য শরীরে তেমন জোর নেই যে তিনি বাচ্চাসহ মহিলাটিকে বসা থেকে টেনে তুলে ফেলবেন। তবুও তিনি চেষ্টা করেন মেয়েটাকে তার করনীয় স্মরণ করিয়ে দিতে। শিঘ্রী সরে যেতে হবে কালযমুনার তীর থেকে। বিগত তিন চাঁদ ধরে যমুনা তার পাড় ভাঙছে। ক্রোধের উন্মত্ততায় নেই কোন থামার লক্ষণ। কে জানে ভাটির লোকেরা অজান্তেই তার পাঁকা ধানে মই দিয়েছে কিনা! ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে যেমন ভেঙ্গেছে জন্ম থেকেই, আক্রোশে। কত গ্রাম, কত গঞ্জ, কত পথ, কত জনপদ যে সে গিলে খেয়েছে তার হিসাব কেউ রাখে নাই। সেই হিসাব রাখার মত না। রাক্ষুসীর গর্জন বলে দিচ্ছে সে আরো খাবে, আরো আরো ভাঙবে। গৃহহারার মাতমে মাতমে সারা বাংলা সারা হলেই যেন তার সুখ। অথবা এমনো হতে পারে, তার বুকে এমন কোন ব্যথা দিয়েছে কেউ যার দরুন আমৃত্যু ধ্বংসের ক্রোধ জমেছে তার বুকে!
‘ভাঙন আমার সব নিয়া গেলো জ্যাঠি, আমার সব গেলো’! ঠাঁইহাঁরা জননীকে সরিয়ে নেবার জন্য জোর করতে কোলের শিশুকে আকড়ে বিলাপ করে প্রতিবাদ জানায় সে। সে নিজেও যেন নদীর বুকে বিলীন হয়ে ঘর হারানোর ব্যথা ভুলতে চায়।
অবস্থা বেগতিগ দেখে, লোকের জটলা থেকে আরেক বৃদ্ধা এগিয়ে আসে। বৃদ্ধার শরীরে একখন্ড বস্ত্র। চোখে পাড় ভাঙ্গতে থাকা নদীর মতন প্রাচীন ক্রোধ। বিলাপ করতে থাকা নারীর পাশে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, ‘মাগী তর ঘর গেসে আর আমারার বেবাগ আছে। না? রঙ্গ রাইখা উঠ অহন। আবুইদ্দা ডরাইতাসে লো। উঠ’। বৃদ্ধার ঝাঁঝালো কন্ঠে কাজ হয়। কোলের শিশুকে আকড়ে ধরে উঠে দাড়ায় সে। অশ্রু মুছে বৃদ্ধাদের সাথের পিছিয়ে আসে বেশ কয়েক পা। মানুষের জটলার সম্মুখেই দাড়ায় সে। জটলায় দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষের চোখে মুখে সব হারানোর ব্যাথা। আচমকা নয়, এই ব্যাথা তাদের চেহারায় বসতি গড়েছে দিনের পর দিনের অবারিত নির্মমতায়। নদী নিতে নিতে নিয়ে নিয়েছে তাদের নিজের বলে যা কিছু দেখে তারা স্বস্তি পেতো। যেই ঘরে তারা সাঁঝের পর ফিরতে চাইতো, যেই উঠান থেকে তারা বেড়িয়ে পরতো জীবিকার সন্ধানে, যেই দাওয়া তাদের কোলাহলে মুখরিত হতো লাগামহীন শব্দে, যেই পীঠে রোজ ভোরে তাদের শিশুরা গুনগুন করে গাইতো প্রবল পরাক্রম স্রষ্টার নাম, যেই বাজার থেকে তারা জোগাড় করতো রোজগেরে প্রয়োজন, যেই পথ ছিলো তাদের চিরোচেনা বন্ধুর মত, শত আহ্লাদ গিলে নিয়েছে করাল গ্রাসে। হারাতে হারাতে আজ তাদের শিকড়, পূর্বপুরুষের শেষ নিশান কবর গুলোও নিশ্চিহ্ন। মায়ের মত গ্রামের শেষ প্রান্তের শেষ ঘরটাও কাল যমুনার ভোগে গেছে আজ প্রভাতে। নতুন সূর্য্যের আলো মাখা নতুন দিনটায় আজ তাদের নতুন পরিচয়- ঠিকানাহীন সর্বহারা!
ঝপ্যাৎ করে মস্ত একটা শব্দ হলো। শিশুরা চমকালেও যুবাদের চোয়াল আরো শক্ত হলো। প্রবীনদের বুক চিরে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। শিশুকোলে নারীটি যেখানে বসা ছিলো, সেই জায়গার মাটিটুকু ধ্বসে বিলীন হলো। ঝপ্যাৎ শব্দে তরুনী মহলেই কেবল কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা যায়। যদিও এই শব্দ তাদের অতি চেনা তবুও সব কিছুই যেন তাদের কাছে ভয়াল মনে হয়। মানুষের জটলাটা পুরো বেলা নদীর দিকে চেয়ে রইলো। সব যেখানে দাফন হয়েছে সেই নদীর চঞ্চল রূপালী বুকে রোদ আর ঢেউয়ের নাচন ছাড়া আর সব কিছুই যেন বিস্মৃত হয়ে রইলো। কয়েকটা শিশু কেঁদে উঠলো থেকে থেকে, মায়েরা বুক অনাবৃত করে দিতেই সেখানে মুখ গুজে সুস্থির হলো তারা। আর বাকি সবাই নদীর দিকে তাকিয়ে। অনেকক্ষণ পর এক বৃদ্ধ মাঝি বিলাপ করে উঠে।
‘আহা রে গাঙ’! এটুকু বলে তার মুখে আর রা জুটে না। অনেক বিলাপের পর আজ তাদের শব্দেরা ক্লান্ত। এই নদীর বুক থেকে সে জাল ভরে মাছ তুলে এনেছে সে অগুনিত দিন। নদীর কাছ থেকে লুট করে আনা মাছের বিনিময়ে তার ঘর হয়েছে, বউ এনেছে, সন্তানের মুখে তুলে দিয়েছে গ্রাস। ষাট বছরের জীবনে পঞ্চাশোর্ধ বছরের বেশী সময় ধরে জলের বুক থেকে তিলে তিলে আহরণ করে আনা সম্পদের বিপরীতে মাত্র মাসখানেকে সব লেনাদেনা চুকিয়ে দিলো নদী!
‘সব তো শেষ! এর পরে কি’? পুরোটা বেলা লোকটার মাথায় ঘুরছিলো এই কথাটা, কোন সদ্যুত্তরে আছে শুন্যতা। দুইটা জোয়ান বউ ছাড়াও তিন সন্তান আর বৃদ্ধ বাবার দায়িত্ব যে তারই কাঁধে!
‘আমরা কি এই দরিয়ায় ভাইসা যামু’? অকূল দরিয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই যেন চোখে পড়ে না কুমারীদের। কুমারীদের মাঝে সবচেয়ে উঠতি যে, সপ্তা দুয়েক আগে এক আমাবশ্যার মাঝরাতে সে আর তার মা-বাবা-ভাই সবাই যখন ঘুমের ঘোরে, তখন হানা দেয় যমুনা। মায়ের সাথে রসুই ঘরে ঘুমাচ্ছিলো সে। কারো চিৎকার শুনে জেগে উঠে মা-মেয়ে। ঢেউয়ের প্রবল শব্দ শুনে ঠাহর পায় না স্বপ্ন নাকি বাস্তব। যতক্ষণে হুশ ফেরে ততক্ষণে তার বাবা আর ভাইয়ের ঘরটা বিলীন হয়েছে। গাঢ় অন্ধকারে অন্ধ হয়ে বসে শুনছিলো কেবল ঢেউ আর মানুষের আহাজারি মিশ্রিত অচেনা অসহ্যকর শব্দ। কারা যেনো আলো জ্বেলে টেনে হিচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেলো মা আর মেয়েকে। যখন সকাল হলো, আলো ফুটলো তখন আর দেখার মত কিছুই রইলো না ভাঙন ছাড়া।
আরো কয়েকজন কথা বললো। শ্রান্ত কন্ঠ, হতাশ কন্ঠ, ব্যাথিত কন্ঠ, অসহায় কন্ঠ, মুমুর্ষ কন্ঠ; অপারগ শব্দের হাট বসেছে যেনো। পুরনো কথা, হারানোর ব্যাথা ছাড়া আর কোন ভাবের অনুবাদ যেনো ভুলে গেছে সকলে। একই আবর্তে ঘুরতে থাকা শব্দেরা যেনো মনটাকে দুমড়ে দেয়। ভাবনা হয় অসাড়। বলা ও শোনার জন্য যেনো বিলাপই রয়ে গেছে শেষ সম্বল হয়ে। আচমকা একটা ব্যাতিক্রম কন্ঠ শোনা গেলো। সবাই শুনলো কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলো না।
‘গাঙ্গের কাম গাঙ্গ করছে, আমাগো কাম আমাগো করতে হইবো’। বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার তরুন কিন্তু তেজী কন্ঠটা বলতে থাকে, ‘চাচারা, ভাইয়েরা, খালারা, বইনেরা। আমাগো গেরাম আর নাই। ঘর নাই, জিরাত নাই। কিন্তু পেটে যহন ভূখ লাগবো, আসমান যখন ভাইঙ্গা পড়বো তহন কি শইল্যে এই সব মানবো? যা হওয়ার হইসে, এহন আগে ভাবেন সবাই’। অনুরোধ রেখে কথা শেষ করে তেজী কন্ঠ।
‘কি করবা মিয়া? গাঙ থেইকা বেবাক তুইলা আনমু নাহি’? কি করবে ঠিক দিশা পায় না দুই জোয়ান বউওয়ালা লোকটা। তার আবার তিন সন্তান আর বৃদ্ধ পিতাকে নিয়েও তার চিন্তা।
‘আগাইয়া যামু। পুবের জঙ্গল যদ্দুর পারি সাফ করমু। আবার ঘর বানামু। সীমানা গাড়মু। গেরাম হইবো আবার। হাত হাত লাগাইলে আষাঢ়ের আগে সবার ঘর উইঠা যাইবো। অন্তত মাথার উপরে একটা ছনের চালা তো হইবোই বেবাকের লাইগা’। দিশা দেখায় তেজী কন্ঠ।
মানুষের জটলাটা নড়ে উঠে। কথা গুলো যেনো এবার তারা বুঝতে পারে। তারা দরিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে পুবের দিকে তাকায়। রেখার মত দেখা যায় জঙলটা। নদীর জিভটাও ওইদিকে তাক করা নাই।
‘চলো বেবাকে’। বলে তেজী কন্ঠ পা বাড়ায়। তাকে অনুসরন করে আরো অনেক জোড়া পা। আশা যেন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তারা হাজির হয় বিরান জঙলে।
জঙলের শুরুতে ফাঁকা জায়গা দেখে মহিলারা এক দিকে সরে উনুন বানায়। যার পুটলিতে যা ছিলো তাই দিয়ে চলে সম্মিলিত আহারের ব্যবস্থা। শিশুরা একদিকে সরে সদ্য আবিষ্কৃত খেলায় মেতে উঠে। বৃদ্ধরা খুঁজে বের করে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান আর তরুন-যুবারা বাহুর শক্তি এক করে আঘাত করে জঙ্গলের প্রান্তে। নতুন করে ঠিকানা গড়ার আশায় আসে উৎসবের আবেশ। যেই মানুষগুলোর চোখে ছিলো সর্বহারার বিষ, সেই চোখে এখন রাঙা স্বপ্ন। ধারালো কুঠার ছিটকে আঘাত করতে থাকে জোয়ানদের প্রেরণায়। এক এক করে গাছ উপরে পড়তে থাকে। মানুষের কামনার সামনে কোন বাধাই তৈরী করতে পারে না বৃক্ষরাজি। ক্রমাগত ধারাল কুঠারের আঘাতে মুখ থুবড়ে জমিনে গড়ায় প্রাচীন বৃক্ষের দল। তার সাথে জমিনে আছড়ে পড়ে অগণিত পাখির বাসা, পাখির ছানা আর ডিম। যেখানটায় মানুষের ভিড় সেই জায়গাটা ভরে উঠে স্থপতি পাখিদের নির্মান কাঠামোর সামগ্রীতে। ছন, ঘাস আর গাছের চিকন ডালগুলোতে সয়লাব হয় জঙ্গলের প্রান্ত। মানব শিশুরা খেলনার মত কুড়িয়ে নেয়া পাখির সেই ছানাদের যারা উড়তে শেখেনি।
আসমান ভারী হয়ে উঠে পাখিদের কিচির মিচির আর্তনাদে। কেউ ঘরহারা, কেউ সন্তানহারা, কেউ ঠিকানাহারা, কেউ হারায় পরিবার। তাদের আর্তনাদের কিচির মিচিরে মহা ধরিত্রীর কোথাও কেউ চমকায় না। কোন দ্রোহ জন্মে না। নিশ্চুপ প্রকৃতি জানে, কারো নীড় না ভাঙলে যেন গড়ে কারো ঘর। শুধু তারা কাঁদে, যারা সবটুকু গড়েছিলো নিজের প্রচেষ্টাতে।