মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
আধুনিক বাংলা কবিতা তার ঊষালগ্ন থেকে যে দু’জন ধাত্রীর হাতে প্রতিপালিত হয়ে উঠছিল আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) তাঁদের একজন— অরুণকুমার সরকার একসময় এরকমই মন্তব্য করেছিলেন। বস্তুত আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৯৪০-এ প্রকাশিত হয় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-র প্রথম সংকলন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ তার পরের ঘটনা। দুই সম্পাদকের পৃথক পৃথক ভূমিকায় সেদিন চিহ্নিত হয়েছিল আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান প্রধান প্রবণতাগুলি। আইয়ুব তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলাকবিতাকে একটি তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন সেদিন; যদিও অন্যতম সম্পাদক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সূত্রগুলিকে ধরে ধরে উত্তর দেওয়ার মতোই লিখেছিলেন দ্বিতীয় আর এক ভূমিকা। নিজে কবিতা না লিখলেও রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আবু সয়ীদ আইয়ুব নামটি।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত হয়ে এক নতুন দিনের সাহিত্য তখন অল্পে অল্পে বিকশিত হচ্ছে একদল তরুণের হাতে। সেকালের ‘কল্লোল’ হয়তো সূচনালগ্নের আধুনিকতার এক পাঁচমিশেলি উদাহরণ। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু-র সম্পাদনায় শুধুই কবিতার জন্য, ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশিত হল তিরিশের দশকের এক নতুন কাব্যপ্রবর্তনায়, সেদিন নতুন কাব্য ভাবনার অন্তহীন উদ্ভাসন নিয়ে গড়ে উঠল কবিতা ভবনের আড্ডা। বুদ্ধিবৃত্তির বিচিত্র বিন্যাস ঘটিয়ে, মনন-মেধার পারস্পরিক বিনিময় ঘটাতে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে রচিত হচ্ছে ‘পরিচয়’-এর আড্ডা। ঠিক তখনই আবু সয়ীদ আইয়ুব কলকাতায় গড়ে তুলতে চাইছেন এক বুদ্ধিজীবী দার্শনিক সমাজ, যেখানে চলবে নিত্য নতুন দার্শনিক আলোচনা, শানিত মেধার ভাববিনিময়। চাইছেন তা বাঙালি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। জন্মসূত্রে বাঙালি নন তিনি। বাংলা নয় তাঁর মাতৃভাষা। অথচ বাংলা ভাষাতেই লিখছেন তাঁর যাবতীয় চিন্তাশীল দার্শনিক প্রবন্ধ। তাঁর বাংলা শব্দ প্রয়োগ এতটাই বিশুদ্ধ, নজরুল ইসলাম কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলী-র মতো আরবি ফারসি যোগযুক্ত বাংলা নয় (অবশ্য এই দুই ভাষাশিল্পী যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সার্থকভাবে তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বিষয়ের দাবিতে)। তৎসম শব্দ সমৃদ্ধ শব্দ প্রয়োগ তাঁর। কখনও তাঁর শব্দ চয়ন আধুনিক কথ্যরীতির। বলেছিলেন আইয়ুব, যদি কলকাতায় বাস না করে বাস করতেন লখনউ শহরে, তা হলে হয়তো হয়ে উঠতেন উর্দু সাহিত্যের সমালোচক লেখক। কিন্তু কলকাতার মতো ‘প্রান্তিক শহরে’ বসে তা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার লেখকও হতে চাইলেন না। কলকাতায় বসবাসের সূত্রে, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের, দার্শনিকদের সঙ্গে যোগযুক্ততার ফলে হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের এক সার্থক গদ্যশিল্পী। আর রবীন্দ্রনাথই তাঁর প্রধান আকর্ষণবিন্দু। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘পান্থজনের সখা’, ‘পথের শেষ কোথায়’ ‘ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক’ সমালোচনা গ্রন্থগুলি তার প্রমাণ। মাতৃভাষাকে পাশে রেখে অর্জিত যে-কোনো ভাষার একটিকে পছন্দ করে নিয়ে, সেই ভাষার লেখক হয়ে ওঠার এই যে ইতিবৃত্ত আবু সয়ীদ আইয়ুব-কে ঘিরে, সাহিত্যের ইতিহাসে এ-ঘটনা খুব বেশি নেই।
রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ার আকর্ষণে যে বাংলাভাষা প্রেম, সে ছিল তাঁর বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম পর্ব। বাংলাভাষা শিক্ষার দ্বিতীয় পর্বের গল্প আবু সয়ীদ আইয়ুব নিজেই জানিয়েছেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই.এসসি পড়তে এসে, আইয়ুব লক্ষ করেন নতুন সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা খুব ভালো এগোচ্ছে না, বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে ভাষার ব্যবধানে। ‘আমি ইংরেজি বলে যাই সহজেই, তারা কিন্তু সহজে ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারছে না। কাজেই তারা বাংলাই বলতো, তবে ইংরেজি মিশিয়ে। কলেজের ছেলেরা যতখানি ইংরেজি মেশায় তার চেয়ে একটু বেশি পরিমাণে–আমার কাছে তাদের বক্তব্যটি বোধগম্য করার জন্য। এই অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে পড়ে আমি স্থির করলাম যে আমাকে কথোপকথনের উপযুক্ত বাংলা শিখতে হবে।’
আইয়ুবের পাঠ্যবিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান। অথচ বরাবর তাঁর মনে হয়েছে ‘দর্শনই হবে আমার অধ্যয়ণ-অধ্যাপনার বিষয়।’ এম.এসসি পর্যন্ত এগিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে প্রবেশ করলেন দর্শন বিভাগে এবং দর্শনশাস্ত্রে পাশ করেই পেয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেধাবৃত্তি। গবেষণার বিষয়বস্তুও নিজেই বেছে নেন, স্বাধীনভাবে– ‘Content of Error in Preception and thought’ কিন্তু তাঁর অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণন বিষয়টি নিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতে পারেন না, বরং সেমিনারে তাঁর প্রবন্ধ শুনে রাধাকৃষ্ণন মন্তব্য করেন “Ayyub, why do you going for so much logic chopping and hair splitting analysis?” দর্শনের বিষয় নিয়ে একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসার পরিমণ্ডল তৈরি করতে চেয়েছিলেন কলকাতা শহরে। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ-‘আমার স্বাস্থ্য ভঙ্গুর, স্মরণশক্তি ক্ষীণ। এই সব বাধা ডিঙিয়ে পাশ্চাত্যের দার্শনিক মহলে সাড়া জাগাবার মতন প্রবন্ধ লিখতে পারব সে ভরসা আমার ছিল না। আরও কম পরিশ্রম করে এদেশের দার্শনিক মহলে সাড়া জাগাতে পারতাম হয়তো। কিন্তু এদেশে সেরকম দার্শনিক মহল কোথায়?’ তবু পরবর্তী জীবনে তিনি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁর দার্শনিকবন্ধুদের। অধ্যাপক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য, কালিদাস ভট্টাচার্য, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, হুমায়ুন কবির, মানবেন্দ্রনাথ রায়, অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়-দের কথা তিনি স্মরণ করেছেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। চল্লিশ-পঞ্চশের দশকে অনেক বন্ধুকে তিনি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিরিশের দশকে তাঁর শুরুর জীবনে দার্শনিক ভাবনায় তিনি ছিলেন একা। চল্লিশের দশকে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৭-এ তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয়। আইয়ুব লিখেছেন, ‘এই বিরাট ব্যক্তির গভীর ছায়া পড়েছে আমার রাজনীতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনায়। তাঁর একটি বাণী আমার মনে সাড়া জাগাল, ‘A Philosophical revolution must Preced Political and social revolution-in this country.’ যদিও এম. এন. রায়ের একান্তিক ‘জড়বাদী দার্শনিক বিপ্লব’ ভাবনাতে তার মন সম্পূর্ণ সায় দেয়নি। কেননা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ‘অনেকান্তবাদ দ্বারা সংঘটিত’। এবং এ কারণেই রাবীন্দ্রিক ঈশ্বরভাবনার, উপলব্ধির অনেকান্তিকতা এবং ‘বিভিন্ন অন্তের মধ্যে যে টানাপোড়েন’- তা আইয়ুবের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় ঐশ্বর্য হয়ে ওঠে।
পদার্থবিদ্যার পাঠ ছেড়ে, দার্শনিকসমাজ গড়ে তোলার ইচ্ছা ত্যাগ করে, অতঃপর আইয়ুব চাইলেন বাংলা ভাষার লেখক হয়ে উঠতে। তিনি লিখেছেন ‘আমি লক্ষ করলাম যে এদেশে, অন্ততপক্ষে বাংলাভাষার দেশে, সংস্কৃতি উদ্যানের সবচেয়ে জীবন্ত ফলন্ত বৃক্ষ হচ্ছে সাহিত্য এবং তৎসংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনা। তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উচ্চাভিলাষ জাগলো আমার মনে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘তিরিশের দশকের ‘পরিচয়’ এবং যাট ও সত্তরের ‘দেশ’ আমাকে লেখক করে তুললো। আমার লেখকজীবনের শেষ প্রান্ত থেকে এই দুই অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন এবং সুহৃদ সম্পাদকদ্বয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং শ্রীসাগরময় ঘোষকে সহৃদয় কৃতজ্ঞ নমস্কার জানাই।’
🌹আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘বুদ্ধি বিভ্রাট এবং অপরোক্ষানুভূতি’ ছাপা হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’-এ। সে প্রবন্ধের ভাষার আইয়ুব নিজেই বলেছেন ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় সচেতন প্রভাব লক্ষ্যণীয়।’ কিন্তু সে প্রভাব অচিরেই এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন সচেতনভাবে। প্রবন্ধটি সুধীন্দ্রনাথের বাড়িতে রেখে এসে আইয়ুব অপেক্ষায় থাকেন এবং পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হলে লেখকসূচিতে তাঁর নাম না দেখে হতাশ হলেন। কিন্তু তারও তিন মাস পর যখন বেরোল পরবর্তী সংখ্যা ‘লীডিং আর্টিল্-‘ এর সম্মান পেয়ে, প্রথমেই ছাপা হল লেখাটি। সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইয়ুবের অধিকাংশ সময় কথাবার্তা চলত ইংরেজিতে। সুধীন্দ্রনাথ জানান, ‘your article was so excellent that I wanted to make it the leading article, I hope you didn’t mind the delay, সুধীন্দ্রনাথ আরও জানান, ‘Pramatha Choudhuri spoke very highly of your article and asked his friend Atul Gupta to read it’, রবীন্দ্রনাথও সুধীন্দ্রনাথের কাছে আইয়ুবের প্রবন্ধের প্রশংসা করেন। ‘পরিচয়’এ প্রকাশিত আইয়ুবের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘সুন্দর ও বাস্তব’। রবীন্দ্রনন্দনতত্ত্ব বিষয়ক এই প্রবন্ধে আইয়ুব প্রথম রবীন্দ্রচর্চা শুরু করেন। আরও একটি তথ্যও পাঠককে জানানো যায় ‘imagery’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘চিত্রকল্প’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন আইয়ুব এই প্রবন্ধে। বাংলায় ‘চিত্রকল্প’ পরিভাষাটির ব্যবহার আইয়ুবেরই অবদান।
🌹🌹আইয়ুব সারাজীবন ধরেই যা কিছু লিখেছেন তার অধিকাংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। প্রসঙ্গত তিনি নানাভাবে আধুনিক বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা কবিতার বিন্যাসটিকেও লক্ষ করেছেন। তাঁর আধুনিক কাব্য সমালোচনায় আধুনিকতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে। পদার্থবিদ্যার পাঠ ছেড়ে, দার্শনিকসমাজ গড়ে তোলার ইচ্ছা ত্যাগ করে, অতঃপর আইয়ুব চাইলেন বাংলা ভাষার লেখক হয়ে উঠতে। তিনি লিখেছেন ‘আমি লক্ষ করলাম যে এদেশে, অন্ততপক্ষে বাংলাভাষার দেশে, সংস্কৃতি উদ্যানের সবচেয়ে জীবন্ত ফলন্ত বৃক্ষ হচ্ছে সাহিত্য এবং তৎসংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনা। তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উচ্চাভিলাষ জাগলো আমার মনে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘তিরিশের দশকের ‘পরিচয়’ এবং যাট ও সত্তরের ‘দেশ’ আমাকে লেখক করে তুললো। আমার লেখকজীবনের শেষ প্রান্ত থেকে এই দুই অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন এবং সুহৃদ সম্পাদকদ্বয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং শ্রীসাগরময় ঘোষকে সহৃদয় কৃতজ্ঞ নমস্কার জানাই।’
আইয়ুব সারাজীবন ধরেই যা কিছু লিখেছেন তার অধিকাংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। প্রসঙ্গত তিনি নানাভাবে আধুনিক বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা কবিতার বিন্যাসটিকেও লক্ষ করেছেন। তাঁর আধুনিক কাব্য সমালোচনায় আধুনিকতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে ‘অমঙ্গল চেতনা’। এই আলোচনাসূত্রে কবিতা সমালোচনার অর্জিত একটি নিজস্ব বোধও তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন। কাব্যরচনা আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে নিছক শব্দ নিয়ে খেলা নয়। তিনি বলেন, ‘কাব্যরচনা নিছক শব্দের আলিম্পন-একথা আজ সাহিত্যের অভিজাত মহল থেকে শোনা গেলেও আমার কাছে অশ্রদ্ধেয় ঠেকে।’ তাঁর কাব্যভাবনায় কবিকে হতে হবে ‘সত্যদ্রষ্টা’। সংস্কৃত অর্থেও কবি। কোলরিজের মতো করে আইয়ুবও বলতে চান ‘No man was ever yet a great poet without being at the sametime a profound philosopher’. কবিতা এবং নারী সম্পর্কে শেষপর্যন্ত ‘আমি ভাববাদী’ স্বীকার করেও কাব্যদেহের প্রতি মনোনিবেশ গুণকে তিনি অস্বীকার করেননি বলেই তাঁর মনে হয়েছে ‘কবিতার ভাষা স্বচ্ছ কাচের মতো মোটেই নয়, নিজের অনবদ্য ধ্বনিটিকে ফুটিয়ে তোলা তার কাজ।’ আঙ্গিকের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ ছাড়াও আধুনিক সাহিত্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। সেটি অমঙ্গল চেতনার আধিক্য। আইয়ুবের অভিযোগ ‘আনন্দ- আগ্রহ-শ্রদ্ধা বিস্ময়’-এসবের পরিবর্তে ‘বোরডম বিরক্তি বিবমিষা’র আধিক্য, আধুনিক সাহিত্যকে উৎপীড়িত করেছে। সাহিত্যে আঙ্গিকসর্বস্বতার চেয়ে বিষয় তাঁর কাছে তাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আকাঙক্ষা করেছেন মহৎ সাহিত্যে থাকবে এক শুভ ও কল্যাণবোধ। আত্মপক্ষ সমর্থনে আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকেই উদ্ধৃত করেন।’ কেবলমাত্র ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা জগতের যে পরিচয় পাইতেছি তাহা জগৎপরিচয়ের সামান্য একাংশ মাত্র- সেই পরিচয়কে আমরা ভাবুকদিগের, কবিদিগের, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদিগের চিত্তের ভিতর দিয়া কালে কালে নবতররূপে গভীরতর রূপে সম্পূর্ণ করিয়া লইতেছি। কোন গীতিকাব্য রচয়িতার কোন কাব্য ভালো, কোনটা মাঝারি তাহাই খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখানো সমালোচকের কাজ নহে। তাহার সমস্ত কাব্যের ভিতর দিয়া বিশ্ব কোন বাণীরূপে আপনাকে প্রকাশ করিতেছে তাহাই বুঝিবার যোগ্য।’
এক অন্তহীন কল্যাণবোধের রাবীন্দ্রিক ভাবুকতা আইয়ুবেরও অন্বিষ্ট। জড়জগতে মানবমন নিরপেক্ষ সত্য শুভ সুন্দরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন আইয়ুব। শিল্পমূল্য থাকা সত্ত্বেও তাই আইয়ুবের দৃষ্টিতে বোদলেয়র উঁচু দরের কবি নন। আইয়ুব মনে করতেন কবির উপলব্ধি যদি ‘শ্রেয়োনীতির’ উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, কিংবা সে উপলব্ধি যদি ‘অসত্য’ বলে প্রতিভাত হয়- তা হলে যতই আঙ্গিক সিদ্ধ হন কবি, তাঁর হৃদয়-উপলব্ধি পাঠকের কাছে পৌঁছোতে তিনি ব্যর্থ হবেন। আইয়ুব ব্যাখ্যা করে বলেন, এই ‘অসত্য’ কব্যিক অর্থে অসত্য অর্থাৎ ‘not founded on the facts of experience’
আইয়ুব প্রতিষ্ঠিত কাব্যতত্ত্বে আঙ্গিক সিদ্ধিই কবির সাফল্যের নিয়ামক শক্তি নয়। শিল্পকুশলতাই শুধু কবিকে ‘মহৎ কবি’ করতে পারে না। মহৎ কবির আরও অতিরিক্ত কিছু গুণ থাকবে। কিন্তু কী সেই গুণ? আইয়ুব হয়তো এক নন্দিত অসহায়তায় বলেন ‘কী সে গুণ তা বলা খুব সহজ নয়, তবু অনুভব করি শিল্পকর্মের উৎকর্ষ আবশ্যক হলেও যথেষ্ট নয়।’ ‘শিল্পবাহিত অভিজ্ঞতা কতখানি মহান’, আইয়ুবের মতে, তার উপর নির্ভর করবে কবির মহত্ত্ব। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে আইয়ুব রবীন্দ্রনাথ কিংবা টি. এস এলিয়ট কিংবা রিচার্ডস্- কে উদ্ধৃত করেন। রিচার্ডস যিনি কবিতা থেকে বিশ্বাস অবিশ্বাস সত্য মিথ্যা ইত্যাদির কথাএকেবারেই খারিজ করে দেন, তিনিও বলেন ‘শিল্পরচনা কখনো ব্যর্থ হয় কমিউনিকেশনের ব্যর্থতার দরুন, কখনো এই কারণে যে যা কমিউনিকেট করা হয়েছে তার কোনো মূল্য নেই।’ আইয়ুবের কাব্যতত্ত্বে এই ‘মূল্য’ অবশ্যই শ্রেয়োনীতি নির্ভর, শুভ ও কল্যাণবোধের দ্যোতক। নাস্তিক আইয়ুবের কাব্যসমালোচনার এই সূত্র ধরেই হয়তো অরুণকুমার সরকার মন্তব্য করেছিলেন ‘আইয়ুব ধর্মে ঈশ্বরে আস্থা রাখেন না, কিন্তু মনে হচ্ছে ধর্ম এবং ঈশ্বরের কাজটা তিনি কবিকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছেন।’
আবু সয়ীদ আইয়ুবের হাত ধরেই পাঠক রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শিখলেন নতুনভাবে। এতকাল তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন উপনিষদের আলোয়; কিন্তু আইয়ুবই একজন আধুনিক দার্শনিকের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত করলেন আধুনিক বাঙালির কাছে। তাঁর সমকালে এক পাঠিকা আইয়ুবকে বলেছিলেন,’ আপনি রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন আমাদের, সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।’ আর আইয়ুব নিজে বলেছেন, ‘আমার চোখ তো আমি অনেকটাই পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের কাছে।’ রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু-র ছিল অনেক সংশয়, ফলত অনাগ্রহ। আইয়ুব শেষ পর্বের রবীন্দ্রনাথ থেকেই তুলে আনলেন অনেক গোপন সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনাকে আইয়ুব তাঁর ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা ‘পান্থজনের সখা’ কিংবা ‘পথের শেষ কোথায়’ গ্রন্থে একটি সুসংহত তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছেন সেই প্রথম। শেষ পর্বের রবীন্দ্রনাথের অনেক দার্শনিক রহস্য তিনিই উদ্ধার করলেন পাঠকের সামনে। একসময় মোহিতলাল মজুমদার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন ‘এই দীর্ঘকালেও রবীন্দ্র সাহিত্যের একটি সুসংহত অলোচনা কাহারো পক্ষে সম্ভব হইল না; এ পর্যন্ত যাহা কিছু হইয়াছে তাহাতে কোনো সাহিত্যিক আদর্শের সন্ধান নাই, তাহা ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছ্বাস-সমালোচনা নয়, সুখালোচনা মাত্র।’ আইয়ুবের চোখ দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যকে প্রত্যক্ষ করে বাঙালি পাঠকের এই আক্ষেপ নিশ্চয় অনেকটা মিটেছে সন্দেহ নেই। শেষ পর্বের রবীন্দ্রকবিতার প্রতি অনেক অভিযোগ-বিশেষত ভাষার স্পষ্টতা, সোজাসুজি বক্তব্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আইয়ুব উত্তর খুঁজেছেন। তিনি আরও দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে অমঙ্গল চেতনা রবীন্দ্রকাব্যের বিভিন্নস্তরে সংকুচিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে, যা তাঁর আগে তেমনভাবে কেউ দেখাতে পারেননি। অবশ্য আমরা বুদ্ধদেব বসুর কথা ভুলে যাচ্ছি না। কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ, বিশ্ববীক্ষা পরিবর্তিত হয়ে, পরিণত হয়েছে কীভাবে, এবং তাঁর ‘রোমান্টিক উদ্বেলতা’ এবং ঈশ্বর প্রেমের প্রশান্তি একই সঙ্গে কীভাবে সর্বমানবিকতা বোধের পাশাপাশি ট্রাজেডির পথ রচনা করেছে-আইয়ুব তাকেই তুলে ধরেন ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। আর এখানেই তিনি একটি নতুন চেতনার রূপারোপ পাঠকের সামনে আনেন-যার নাম ‘ট্র্যাজিক চেতনা’। রবীন্দ্র কবিতা ও গানের পূর্বাপরতা থেকে তিনি উদ্ধার করেছেন এক রাবীন্দ্রিক ট্রাজিক ভাবনা। এই শব্দযুগ্মটি আরিস্টটলের ট্রাজেডি-র বোধ থেকে আলাদা যা আইয়ুবই প্রথম প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রনাথের ট্রাজিক চেতনার আলোচনায়। তাঁর ‘পান্থজনের সখা’ গ্রন্থে ঘুরে ফিরে বহুবার এসেছে শব্দযুগ্মটি।
শৈশবে একটি উর্দু মাসিকপত্রের পাতায় প্রথম তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-র কবিতাগুলি পড়েন, তখন তাঁর বয়স তেরো বছর। ‘মনে প্রাণে ঈশ্বর বিশ্বাসী, পরকালের ভয়ে পুণ্যকর্মে যত্নশীল, পাপবোধে ঈষৎ পীড়িত।’ উর্দু সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ বাড়িয়েছিলেন তাঁর এক বউদি।–আইয়ুবের জীবনে ‘প্রথম রোমান্স’ সেই বউদির সঙ্গে ছিল তাঁর ‘গভীর প্রেমছোঁয়া বন্ধুত্ব’। আইয়ুব লিখেছেন, ‘তিনি যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম এলেন তখন আমার বয়স নয়, তাঁর তেরো।’ দুই প্রায় সমবয়সী বন্ধুর মধ্যে চলে তাঁদের মতো করে গভীর সাহিত্য আলোচনা। এখানে পাঠকের অবশ্যই মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বউদি কাদম্বরী দেবীর প্রেম ছোঁয়া বন্ধুত্বের ঘটনাগুলি। শৈশবের সেই সাহিত্যপ্রীতি ও রবীন্দ্রপ্রীতি পরবর্তী জীবনে তাঁকে রবীন্দ্রসাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক ও সমালোচক হয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তী জীবনে পরিণত মন নিয়ে পড়েছেন ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’। বার্ট্রান্ড রাসেল পড়ে ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে হয়ে ওঠেন নির্মোহ, এবং পরিণত জীবনের নাস্তিকতা শেষ পর্যন্ত ‘বাল্যকালের পরম আশ্রয়দাতা পরম কল্যাণময় অনন্তশক্তিধর বিশ্ববিধান কর্তাকে’ খুঁজে পেল না। ব্যক্তিস্বরূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে প্রবল অনাগ্রহী হয়েও ঈশ্বরপ্রেমে রঞ্জিত ‘গীতাঞ্জলি’ তাঁর মনে শেষজীবন অবধি গভীর দাগ কাটল কেন। আইয়ুব ‘গীতাঞ্জলি বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত সমস্যা’ প্রবন্ধে এর উত্তর দিয়েছেন: ‘গীতাঞ্জলি-তে তো ঈশ্বরবিষয়ক কোনো মত বা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হচ্ছে না; ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে একজন কবির, এক বা একাধিক অনুভূতিমাত্র ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই কবি এবং পাঠকের মধ্যে মতবিশ্বাসের পার্থক্য যত গভীর ও মৌলিক হোক, অনুভূতির প্রকাশ যদি সুন্দর হয়ে থাকে তবে যে কোনো সহৃদয় পাঠকের মন তাতে সাড়া দিতে পারবে না কেন?’
তিরিশ চল্লিশের দশকে ‘কবিতাভবন’ যেমন ছিল কবি-শিল্পীদের একটি আড্ডার কেন্দ্র, তেমনি আবু সয়ীদ আইয়ুব গৌরী আইয়ুবের ৫ পার্ল রোডের বাড়ি। দেশ বিদেশের কবি শিল্পী দার্শনিক রাজনীতিক ঐতিহাসিকদের যাতায়াত ছিল সে-বাড়িতে। বসত নানা ধরনের দার্শনিক আলোচনাসভা। হুমায়ুন কবির, এম. এন. রায়, জয়প্রকাশ নারায়ণ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অম্লান দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, আর্থার কোয়েশলার, এডওয়ার্ড শিল্স, এলেন রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, কে না যেতেন। শয্যাশায়ী আইয়ুব, অসুস্থ গৌরী দেবী। তবু এরই মধ্যে মনন মেধার নন্দিত বিনিময়। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর পর কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘বুদ্ধদেব বসু মারা গিয়েছেন। তাই কলকাতার প্রতি আমার আর কোনো আকর্ষণ নেই।’ তারপর নিজের ভুল সামলে বলেছিলেন, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব যতদিন আছেন, ততদিন কলকাতা আসতেই হবে।’ ৫ পার্ল রোডে মাসে দুই রবিবার বসত অলোচনাসভা। সে আলোচনায় অধিকাংশ সময়ে থাকতেন আইয়ুব নিজে, অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়, কখনও জ্যোতির্ময় দত্ত, মীনাক্ষী দত্ত। রুচিরা শ্যাম কিংবা স্বপন মজুমদাররা এসে কখনো-কখনো আইয়ুবের লেখার ডিকটেশন নিতেন। চল্লিশের দশকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-রাজেশ্বরী দত্ত, আইয়ুব, এম. এন. রায় প্রমুখের আড্ডার একটি বর্ণনায় শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: ‘সেই সন্ধ্যাগুলি ছিল পারস্পরিক প্রীতিতে সরস, মৌলিক চিন্তার সমাবেশে দ্যুতিময়, আলোচ্য বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে সুসমৃদ্ধ, সুসন্নদ্ধ মতপার্থক্যের প্রকাশে প্রাণবন্ত।’ মানবেন্দ্র রায়ের ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ছিল প্রবল উচ্চকিত, সুধীন্দ্রনাথ কখনও কৌতুকময়। কিন্তু ‘আইয়ুব সর্বদাই বিনম্র, অনুত্তেজিত, সুবিন্যস্ত, নিজের যুক্তিতে দৃঢ় এবং স্পষ্ট অথচ অপরের বক্তব্য বুঝতে আগ্রহী এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’ শিবনারায়ণ রায় আরও জানাচ্ছেন, ‘আইয়ুব সুরায় বীতরাগ, খাদ্যে নিস্পৃহ, কিন্তু আলোচনায় উজ্জ্বল।’
শারীরিক কষ্টকে উপেক্ষা করেই আইয়ুব প্রায় দশ বছর অম্লান দত্তের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংরেজি কাগজ ‘কোয়েস্ট'(‘Quest’) ইংল্যান্ডে স্টিফেন স্পেন্সারের সম্পাদনায় যেমন প্রকাশিত হত ‘এনকাউন্টার’ তেমনি ভারতে আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘কোয়েস্ট’। দেশ-বিদেশের বহু মনীষী কাগজটিতে লিখতেন। কাগজটি ছিল ‘Congress for cultural Freedom’-এর ভারতীয় শাখার মুখপত্র। প্রচ্ছদের শিরোনামের পাশে প্রতিটি সংখ্যায় লেখা থাকত ‘An Adventure of Ideas’ ১৯৫৮-থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আইয়ুব সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এখান থেকে তিনি মাসে ৫০০ টাকা বেতন পেতেন। হঠাৎ রটে যায় ‘কোয়েস্ট’ কাগজটি CI-এর টাকায় চলে। বাধ্য হয়ে আইয়ুব এবং অম্লান দত্ত কাগজটি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন।
শঙ্খ ঘোষ তাঁকে বলেছিলেন ‘ধর্মহীন এক ধার্মিক’। সারাজীবন শারীরিক অসুস্থতার বিরুদ্ধে, জড়শক্তির বিরুদ্ধে, আর্থিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে এক নিরুপম শিল্পের জগৎ, আধ্যাত্মিকতার জগৎ—এক ঈশ্বরহীন আধ্যাত্মিকতা, এক রাবীন্দ্রিক প্রাতিস্বিকতা আত্মস্থ করে বেঁচে থেকেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁকে সহায়তা ও বন্ধুত্ব দিয়েছেন তাঁর যোগ্য সঙ্গিনী গৌরী আইয়ুব। দু’জনের বয়সের ব্যবধান প্রায় ২৫ বছর। পরিচয়ের শুরু থেকেই আইয়ুব অসুস্থ। তাঁর অসুস্থতা যা দুরারোগ্য। তিনটি শক্তিক্ষয়ী অসুস্থতা একই সঙ্গে তাঁকে প্রায় মুমূর্ষু করে রেখেছে। এতটাই মুমূর্ষু যে ‘দিনে একবারের বেশি বিছানা ছেড়ে উঠতেই তার ভালো লাগতো না।’ তবু তাঁকেই বিয়ে করেন গৌরী দত্ত। অনেক সামাজিক প্রতিকূলতা, তাঁর দর্শনের অধ্যাপক পিতা ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের প্রবল আপত্তি-কোনো কিছুই তাঁর সিদ্ধান্তের বদল ঘটাতে পারেনি। ১৯৫৬ সালের জুনে তাঁদের বিবাহ হয় ৫ পার্ল রোডের বাড়িতে। গৌরী দেবীর পিতা ধীরেন্দ্রমোহন দত্ত ছিলেন ‘গগনচুম্বী মহীরুহের মতো।’ দর্শনের অধ্যাপক আইয়ুবের মধ্যেও তেমনি গগনাবৃত মহীরুহের বিস্তার। কিন্তু ‘গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় আয়তাকার উন্নতনাসা এই বুদ্ধিজীবী মানুষটির সর্বাঙ্গে কাব্যময় একটি দূরাগত মরণের ছায়া।’ গৌরী দত্তের সুহৃদ অমিতাভ চৌধুরী এভাবেই আইয়ুব ও গৌরীর পিতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেদিন একটি তুলনামূলক প্রতিচ্ছায়ায়। এমনতর অসুস্থ আইয়ুবকে গৌরী দেবীর জীবনসঙ্গী করার দুর্মর বাসনার মধ্যে জ্যোতির্ময় দত্ত দেখেছিলেন ‘মধুবনীর রাধিকার’ দূরাগত স্বপ্নধ্বনি, ‘কৃষ্ণকামনাই যার বিধাতা।’ আইয়ুবের প্রতি এমনই ভালোবাসার টানে গৌরী দত্ত নিজেকে যেন তাঁর প্রিয় সখি, চিন্তার বান্ধবী কিংবা যোগ্য সংস্কৃতিসাধিকা করে গড়ে তুলেছিলেন। অনারোগ্য অসুস্থতার কারণে শান্তিনিকেতন থেকে, পরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনা ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে আসেন আইয়ুব। সাংসারিক সমস্ত দায়িত্ব পড়ে গৌরী আইয়ুবের ওপর। আইয়ুবের প্রবন্ধের ডিকটেশন নেওয়া থেকে শুরু করে ৫ পার্ল রোডের আড্ডার বন্ধুদের আতিথেয়তা সবই সামলেছেন তিনি। নিজের অসুস্থতা প্রসঙ্গে খুব খেদের সঙ্গে লিখেছেন আইয়ুব ‘আমার মূলরোগ Parkinsonism সম্বন্ধে ফিজিওথেরাপিতে
বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তার আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন ওঁর রোগটা বড় beautiful! কী অর্থে beautiful? দেখবেন ওর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একে একে অকেজো হয়ে যাবে, কিন্তু মস্তিষ্কটা শেষ পর্যন্ত বেশ active থাকবে।’ এই দুরারোগ্য অসুস্থতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা—এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছিল যখন নিজেকে ‘জড় প্রকৃতির, শরীরের দাস’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। নাস্তিক আইয়ুব শেষ দিনের, মৃত্যুর অপেক্ষায়, ‘মাটির ডাকের অপেক্ষায়’ থেকেছেন। তবু এই অসুস্থতার মধ্যে, শারীরিক জড়ত্ব আর মস্তিষ্কের সক্রিয়তা নিয়ে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন তিনি। নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন এক আধ্যাত্মিকতায়, ধর্মহীন ধার্মিকের ব্রত পালনের ভেতর। আধ্যাত্মিকতার অর্থ বলতে আইয়ুব বলেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধনা বলতে বুঝিসাহিত্য সংগীত দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস জনসেবা ইত্যাদির সাধনা, পর্বতগুহায় নিশ্চল বসে তপস্যা নয়।’ দীর্ঘ রোগভোগের পর আবু সয়ীদ আইয়ুব ১৯৮২ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রয়াত হন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত অসীম একাগ্রতায় ধৈর্যে রবীন্দ্রকবিতায় গানে রাবীন্দ্রিক অনুধ্যানে সচল রেখেছিলেন নিজের চিন্তার জগৎকে। ধর্মহীন এক বিশুদ্ধ নৈতিকতাকে অবলম্বন করেই ছিল তাঁদের যৌথ জীবনযাপন।
রাবীন্দ্রিক ভাবলোকে সদাবিচরণশীল আইয়ুব চিন্তা ও চেতনায় এক সেকুলার দেশ সমাজব্যবস্থার স্বপ্নকে লালন করেছিলেন। মানুষের অন্তর্লোকের মধ্যে চেয়েছিলেন সর্বমানবিক এক চেতনার জাগরণ, যার মূলকথা ‘শ্রেয়োনীতির বোধ’। রবীন্দ্রনাথের ভক্তিবাদকে আইয়ুব গ্রহণ করেননি। অথচ ঈশ্বরবোধটুকু নিয়ে আধুনিক ভারতজিজ্ঞাসায় এক নতুন পথ রচনা করতে চেয়েছেন। সেকুলার মানবতাবাদী ভাবনার পথিকৃৎ হিসেবে মঙ্গলসাধক আবু সয়ীদ আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুবের নামটি ইতিহাসের অচেনা পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে, মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে যুক্ত যে ইতিহাস।