spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারসাক্ষাৎকার : রফিক উল ইসলাম

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাক্ষাৎকার : রফিক উল ইসলাম

১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?

উত্তর : আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থটির নাম— ‘জলের মতো সুখে আছি’

প্রকাশকাল : ১৯৮৫। 

একদম শুরুর দিকে, অর্থাৎ সেই আট-এর দশকে, আমার মনে হচ্ছিল যে, একটা বই এবার বের করা দরকার। আমার এক বন্ধু, তার নাম তপন গায়েন, দশ বছর জেলে ছিল নকশাল আন্দোলনের সময়ে। ওকে এত অত্যাচার করেছিল পুলিশ, ভাবতেই পারবে না। ওর নখের ভেতরে ছুঁচ ঢোকানো হয়েছিল, আর এতভাবে বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে পেটানো হয়েছিল, সে ক্রমশ অন্ধ হয়ে আসছিল। সে আমায় উৎসাহ দিয়ে বলল, ‘তোমার বই বের করতে তো কোনও অসুবিধা নেই। সে তখন সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তার সঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের ভীষণ যোগাযোগ ছিল। তাঁরা খুব ভালবাসতেনও ওকে। যতদূর মনে পড়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘সপ্তাহ’ বলে একটি পত্রিকা করতেন। ‘সপ্তাহ পাবলিকেশন’ ছিল। তপন সাহস দিল: ‘আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বলব। আর তোমার কবিতাগুলো দাও আমাকে। আমি অমিতাভদার একটা মতামত লিখিয়ে নেব।’ মজার বিষয়, কিছুদিন পরই তপন সত্যিসত্যিই কবি অমিতাভদার মতামত লিখিয়ে আনল, আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেও রাজি করিয়ে ফেলল ‘সপ্তাহ পাবলিকেশন’ থেকে আমার বই প্রকাশের বিষয়ে। আমি তো অবাক!

ভালো কথা, বই তো বের হবে, কিন্তু প্রচ্ছদ কে করবেন? আমার পছন্দের শিল্পী ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। আমাদের এখানকার একজন মাস্টারমশাই, তাঁর নাম শিশির দাস, তাঁর সঙ্গে পূর্ণেন্দু পত্রীর পূর্ব-ঘনিষ্টতা ছিল। তিনি একদিন সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছে, ‘প্রতিক্ষণ’ অফিসে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর, তিনি ডাকলেন তাঁর ঘরে।

কাজ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন:’তোমার নতুন বই, প্রথম বই বের হবে?

আমি বললাম: ‘হ্যাঁ, পূর্ণেন্দুদা…’

— কিন্তু আমি তো মলাট করতে পারব না, অতো সময় নেই আমার…

হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়, অত্যন্ত দুর্বল, একটা ন্যালাভোলা ছেলে হঠাৎ খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমার ভেতর যেন সেইরকমের একটি শক্তি কোথা থেকে আমদানি হয়ে এসেছিল।

বললাম: ‘ পূর্ণেন্দুদা, আপনার করে দেওয়া প্রচ্ছদ ছাড়া আমার বই বের হবে না। আপনি যদি বলেন, দুবছর পর আমার বই এর প্রচ্ছদ করে দেবেন, তাহলে দুবছর পরেই আমার বই বের হবে…।’

উনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বললেন:’সামনের সপ্তাহে এসো।’

তো, ফলে, শেষ পর্যন্ত পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদ দিয়ে, কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর ভূমিকা দিয়ে প্রকাশিত হল আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ : ‘জলের মতো সুখে আছি’। এই সমস্ত ঘটনাবলী দিয়ে স্পষ্টতই বোঝা যাবে আমার প্রথম বইপ্রকাশের সেই সময়কালীন আবেগ, উৎকণ্ঠা আর মানসিক টানাপোড়েনের বিষয়গুলি।

২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

উত্তর: সাহিত্য-শিল্পের বিষয়টি তো ঠিক পারিবারিক সম্পত্তির মতন বিষয় নয়। ফলে, এখানে উত্তরাধিকার শব্দটি ওইভাবে প্রযোজ্য নয়। বরং বলা যায়, আমি একটি প্রবাহের উত্তরাধিকারী, যে প্রবাহধারায় সেই চর্যাপদের কাল থকে অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলা কাব্যধারা অগ্রসরমান হয়ে চলেছে।

৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

উত্তর: আমার কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ১৩ টি। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (‘প্রতিভাস’ / কলকাতা) এবং ‘কবিতাসংগ্রহ’ (‘কথাপ্রকাশ’ / বাংলাদেশ)। একটি ইংরেজি কবিতার বই  : The Magic Bridge এবং একটি ছোটদের কবিতাগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে: ‘হাওয়ার কানে মেঘের দুল’

আমার সম্পাদিত ও গবেষণামূলক গ্রন্থগুলি সব মিলিয়ে ২১ টি। 

নিজের কাজকে উল্লেখযোগ্য তকমা দেওয়া কেমন যেন অস্বস্তিকর। তবুও বলি, আমাদের বাংলার ষাট দশকের অন্যতম প্রধান কবি সামসুল হক এর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর চিরবিদায়ের প্রায় কুড়ি বছর পর। 

দুই বাংলার পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের কবিদের নিয়ে দুটি খণ্ডের দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আমার সম্পাদনায়।

শেষে বলি, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার অনেকগুলি গবেষণাগ্রন্থ আছে, যেগুলি প্রায় বারো বছরের পরিশ্রমের ফসল। একটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করি এখানে। গ্রন্থটির নাম: ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথাবার্তা সংগ্রহ’। রয়াল সাইজের বইটি ৬০০ পৃষ্ঠার, সম্পূর্ণ আর্ট পেপারে ছাপা, দাম ১২০০ টাকা। বইটিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারাজীবন ধরে পশ্চিমবঙ্গ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, গোলটেবিল বা টেলিভিশনে কথাবার্তা বলেছেন, সবগুলিকেই অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছি আমি, সম্পাদনাসহ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের অজস্র দুষ্প্রাপ্য ছবিও মুদ্রিত আছে গ্রন্থটিতে। বাংলাদেশে বইটি ৩০০০ টাকায় বিক্রি হয় জেনেছি। বইটির ভূমিকা লিখছেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিছুটা উল্লেখ করি এখানে, তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায়ে এই গ্রন্থটি সম্পর্কে আমার মায়াময় অনুভূতি আর আবেগের পরিসরটি ঠিক কোন স্তরের। সুনীল লিখছেন: ‘… এর মধ্যেই আমার জীবন ও রচনা বিষয়ে রফিক তিন খানা বই লিখে ফেলেছে, এবার সে হাত দিয়েছে আর এক বিস্ময়কর, বৃহৎ কাজে। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছরের লেখক জীবনে বিভিন্ন মানুষের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছি এবং প্রকাশের পর জমিয়ে রাখার কথা কল্পনাও করিনি। কিন্তু রফিক সেসব উদ্ধার করার কাজে নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনেক অধুনালুপ্ত ছোটো পত্রিকা, যেসব পত্রিকার নামও অনেকে জানেনা এখন, রফিক কী করে যেন সেইসব পত্রিকা থেকেও সাক্ষাৎকার উদ্ধার করেছে। এই বিপুল পরিশ্রমের জন্য রফিককে অবশ্যই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়, যদিও আমি জানিনা যে এইসব সাক্ষাৎকারের কোনো মূল্য আছে কি না। তবে ‘অর্ধেক জীবন’ নামে আমি যে স্মৃতিকথা লিখেছি, যার পরের অংশ লেখার জন্য অনেক শুভার্থী মাঝে মাঝে আমাকে অনুরোধ জানান, আমি আর তা লিখতে রাজি নই, কিন্তু এই সাক্ষাৎকার থেকে তার অনেক উপাদান পাওয়া যেতে পারে। রফিকের এই শ্রম ও নিষ্ঠার মূল্য কতখানি তা পাঠকরাই নির্ধারণ করবেন। আমি শুধু মনে মনে মাঝে মাঝে বলি, আমার চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘজীবন যাপন করো, রফিক!’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় / ১৭. ০৭. ২০১২)।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, আমার বেশিরভাগ গ্রন্থেরই প্রকাশক ‘প্রতিভাস’ (কলকাতা)।

৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।

উত্তর: আমার সাম্প্রতিক কবিতাগ্রন্থটির নাম ‘নবীনগরের রাখাল’। এর ঠিক আগে আমার যে কবিতাগ্রন্থ ‘অবসরের পর সেলফি’, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ (সিগনেট প্রেস) থেকে। এই কবিতাবইটি নিয়েই কিছু ভাবনার কথা বলি।

‘অবসরের পর সেলফি’ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলার কথা এটুকুই যে: সেলফি শুধুমাত্র নিজস্ব অবয়বেরই প্রতিচ্ছবি নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গগুলিও! কিন্তু অন্তর্গত অনুষঙ্গগুলি? সেগুলির ছবি? সেসবই তো খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা আর অক্ষরে অক্ষরে এঁকে রাখার চেষ্টা করে যাওয়া। যেখানে নিভৃতিই একমাত্র পরিত্রাতা। যে-জীবন যাপন করি আমরা, তার পরতের পর পরত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বহুজন্মের আলো আমাকে পথ দেখায়। একক ভেঙে ভেঙে বহুত্বে ছড়িয়ে পড়ার যে ক্ষরণ ও যন্ত্রণা, সেসব যেন এই যাত্রাপথের ধারাবাহিক সিম্ফনি! জীবনের সব ভার দুহাতে সরাতে সরাতে নিজেকে ক্রমশ শূন্য করে তোলা, তারপর মুক্ত ডানায় উড়ে বেড়ানো বর্তমান আর দূরবর্তী ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলির ওপর! নিয়ত মৃত্যু আর নবজন্মের ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই একজন কবি বা শিল্পীর উন্মেষ সাধিত হয়। যেন এক অলীক ভিক্ষাপাত্র সম্বল করেই অচেনা সব দরোজায় কড়া নাড়া, যদি কিছু সঞ্চিত হয় তাতে। সেই সঙ্গে যুক্ত রাখা এক গভীর বিশ্বাস: কিছুটা অন্তত অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তিনিও শান্তি পাবেন না। কে তিনি?

কে তিনি?

তিনি কি সেই যিশু, যাঁর জন্মের অপেক্ষায় আস্তাবলের সব ঘাসবিচালি, অশ্বক্ষুর-সংলগ্ন সবটুকু অসমতল ভূমিকে মাতা মেরির কোল-এ রূপান্তরিত করে দিতে চেয়েছি? নাকি তিনিই রামকৃষ্ণদেব? ঠাকুরঘরের প্রার্থনা-সংগীত আর ধূপের ধোঁয়া সরিয়ে, আমাদের ধীবরপাড়া দুপায়ে মাড়িয়ে তিনি আজও হেঁটে চলেছেন পাঁকাল মাছের সাধনার অভিমুখে! চোখ খুলে শুধু একটু দেখতে চাওয়া তাঁকে। এটুকুই তো। কিংবা তিনি কি বুভুক্ষার ঈশ্বর? যাঁর সৃষ্ট ক্ষুধাজর্জর পৃথিবীতে মুহম্মদ-জন্মের বিরিয়ানি আর যিশুজন্মের কেক সবকিছুই একাকার হয়ে যায়। কিংবা তিনি কি সেই পিপাসার ঈশ্বর? কারবালার প্রান্তর থেকে যে তৃষ্ণা জাগরিত হয়ে আছড়ে পড়ে আমাদের ভূমির ওপর, সেই তৃষ্ণায় আমার জল-ভরা বুক পেতে পরখ করে দেখি, আমাকে পুরোপুরি শুষে নিতে পারে কি না! এটুকুই চাওয়া…!! 

কিন্তু তিনি যে-ই হোন, তিনি নিরপেক্ষ নন। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তো আসবেই। জন্ম থেকে জন্মান্তরে যেতে যেতে এই নিরপেক্ষতার আঙ্গিকটিকে ঘিরে অজস্র জিজ্ঞাসার চিহ্ন ভিড় করে সেলফির চতুষ্পার্শ্বে! খচাখচ দু-চারটি ধরেও রাখি অন্তর্গত ক্যামেরায়। নইলে যুগ যুগ ধরে মানুষকে সতর্ক করার জন্যে এত এত নবীগণ পৃথিবীতে এলেও, ইবলিশের কুমন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করতে পারলেন না মানুষকে! ঈশ্বর কি সত্যিই চেয়েছেন বিপথগামী ইবলিশকে বেশ কিছুটা অন্তত অকেজো করে দিতে? ভাবব না? ভেবেই তো চলেছি আজও…। ভেবেই তো চলেছি অজস্র অদৃশ্য প্রাচীরগুলি নিয়েও। যেসব প্রাচীর মানুষের সঙ্গে মানুষের, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের, সত্যের সঙ্গে যাপনের অবিরত বিরোধ বাঁধিয়ে চলেছে!

বইটি থেকে কিছু পংক্তি উদ্ধৃত করি এখানে:

ক.

“অতঃপর গোটা আস্তাবল জুড়ে মাতা মেরির কোল। তীক্ষ্ণ অশ্বখুর,

অসংলগ্ন ভূমি মাতা মেরির কোল। যাবতীয় খড়বিচালি

হিমঘর নৈঃশব্দ্য মাতা মেরির কোল। প্রভু, এবার তো নিশ্চিন্তে

জন্মান। আপনি না জন্মালে ২৬ ডিসেম্বর আসে কেমন করে!”

                        (২৬ ডিসেম্বর) 

খ.

“সামনেই রামকৃষ্ণ উৎসব। আমরা দশম শ্রেণি

গামছা বিক্রি করব। বাবার একঘরে হয়ে থাকা এসো,

যত মত এসো, তত পথ এসো, নির্জন তাঁতঘরে

আলপনা হয়ে ওঠো।”

                       (নির্জন তাঁতঘরে)

গ.

“ঈশ্বর বিবাহিত কি না এই বিতর্কে

বাড়তি দু-মুঠো অন্ন জোটে না। খিদের পৃথিবীতে 

বিরিয়ানি যা,

কেকও ঠিক তাই।

ঠিক তাই-ই…”

                      (নবিদিবস)

ঘ.

“কেন খোঁজো! এত গ্রহ নক্ষত্র, এত এত আলোকবর্ষের

এই পৃথিবী সামান্য তো নয়। কোথাও-না-কোথাও আমি আছি

কেয়ামত পর্যন্ত পাহারা দিয়ে দিয়ে তোমাকে ঠিক

এগিয়ে নিয়ে যেতে।”

                      (কেয়ামত পর্যন্ত) 

ঙ.

“কারবালার প্রান্তর থেকে যে বাতাস

ছুটে আসে লোকালয়ের দিকে, তার অন্তরে

পিপাসার আত্মা লেগে থাকে। সেই পিপাসায়

আমি তো সামান্য বারি, আমাকে খুন করতে পারো

এমন ছুরি তোমাদের হাতে নেই।”

                        (ওহে, তোমরা)

৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?

উত্তর: একজন কবি বা লেখককে কোনও দশকের ছোট্ট গণ্ডির ভেতর আবদ্ধ করা যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, সব কবি-লেখকই সব দশকের। যিশুখৃষ্টের জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে জন্মানো সফোক্লিস যেসব নাটক রচনা করেছিলেন, সেসব নাটক তো আমরা এখনও মন দিয়ে পড়ি বা দেখি। ফলে, ব্যাপক অর্থে, সফোক্লিস কি এই সাম্প্রতিক কালের কেউ নন? একটু ভাবতে হবে বৈকি। তবে আর একটি বিষয় আছে, যেটি এখানে বলবার। সাহিত্য-সম্পর্কিত আলোচনা কিংবা বিচার বিশ্লেষণের সুবিধার জন্যে কবি-লেখকদের লেখালেখির উত্থানকালকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার মধ্যে ধরা হয়। যেমন আমরা সাধারণত বলে থাকি, কবি জীবনানন্দ দাশ তিরিশের কবি অর্থাৎ তিরিশের দশকের কবি। যার অর্থ, জীবনানন্দ দাশের লেখালেখির উত্থানকাল তিরিশের দশক। সেইভাবে ধরলে আমাকে আশির কবি অর্থাৎ আশির দশকের কবি হিসাবে ধরা হয়। কেননা আমার লেখালেখির উত্থান কাল আশির দশক। প্রসঙ্গক্রমে মনে রাখতে হবে, আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থটির প্রকাশকালও আশির দশক (১৯৮৫)।

৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।

উত্তর: আমাদের সময়কাল অদ্ভুত  এক স্তব্ধতার সময়কাল। কেননা ষাট দশকের হাংরি কিংবা শ্রুতি আন্দোলনের কোনও অস্থিরতা তখন আর নেই। সত্তরের সময়কালীন মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা তখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ফলে গূঢ় আত্মজৈবনিক হয়ে উঠতে চাইলো আমাদের অন্তর্গত ভাবনা চিন্তাগুলি। ভাষাকে মোচড় দিয়ে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলা যায় কি না, সেসব দিকে ধাবিত হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আমাদের রচনাগুলি হয়ে উঠতে চাইল ‘মুক্ত জানালায়’ (open window) সমর্পিত এবং শেষ পর্যন্ত সমাপ্তিহীন, অর্থাৎ শেষ হয়েও যাদের ‘শেষ’ বলে সত্যিই কিছু থাকলো না কিংবা রাখা হল না। আমাদের স্বরে ভর করলো গাঢ়তা, এবং বহুবর্ণ হীরকের দ্যুতি। এই গাঢ়তাকে নানাভাবে চর্চাবিন্দুতে রেখে কবিরা তাঁদের নিজস্ব পথ অনুসন্ধান করতে থাকলেন। অনেক ক্ষেত্রে মুখের ভাষার সরলতার ভেতরেই প্রতিফলিত হল মহাজাগতিক ছায়া এবং অনন্ত। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের স্ফূলিঙ্গও নতুনভাবে বিকশিত হল কবিদের রচনায়। সব মিলিয়ে, এরকমই ছিল আমাদের দশকটি, আমাদের সমকাল, আমরা যারা একসঙ্গেই পথ চলা শুরু করেছিলুম ওই সম-দশকের আঙিনায়। 

৭. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?

উত্তর: অনেকেই তো। কতজনের কথা বলতে পারি এখানে? কারুর কারুর নাম উচ্চারণ করতে গেলেই তো অন্যমনস্কতার কারণে কেউ কেউ বাদ পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে বিষয়টি ভীষণই দুঃখজনক হবে আমার কাছে। তাই আলাদাভাবে কারুর নাম উচ্চারণ করলুম না এখানে। কিন্তু একটু সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, দুই বাংলায় অজস্র কবি ভীষণই উল্লেখযোগ্য কবিতা রচনা করে চলেছেন। এমনও হয়, অনেক সময়ে তরুণ কিংবা তরুণতর কবিদের কবিতা পড়তে পড়তেও ভেতরে ভেতরে খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি, শুধুমাত্র অনুরাগ কেন, শ্রদ্ধাবোধও জাগে। বিস্মিত, স্তব্ধ হয়ে থাকি বেশ কিছুদিন। সব মিলিয়ে বাংলা কবিতার যে ধারা সাম্প্রতিক কালে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তার উৎকর্ষতা অতুলনীয়, এটুকুই আমার পরম বিশ্বাস।

৮. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।

উত্তর: আমি তো থাকি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ডায়মন্ড হারবার শহরের নিকটস্থ বসন্তপুর গ্রামে।

চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত। পরিপূর্ণ বেকার। লেখালেখিই অবলম্বন। 

পরিবারে বাবা, আমার সহধর্মিণী, কন্যা, নাতি-নাতনি, ভাইয়েরা, তাদের স্ত্রী-কন্যারা আছে।

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ