spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধমানবতাবাদী এবং উন্মূল দেশপ্রেমিক কবির প্রতিকৃতি : কবি আবদুল হাই শিকদার

লিখেছেন হাসান আলীম

মানবতাবাদী এবং উন্মূল দেশপ্রেমিক কবির প্রতিকৃতি : কবি আবদুল হাই শিকদার

হাসান আলীম

এক.

আবদুল হাই শিকদার (১/১/১৯৫৭) কাল অতিক্রমকারী সতত বহমান এক শক্তিশালী প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক, সাহসী ও দ্রোহী কবি। তিনি কেবলমাত্র আশির দশকের অন্যতম কবি নন বরং তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। মানবতা,দেশপ্রেম, আদর্শবোধ, প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী মৃত্তিকা সংলগ্ন আকাশ বিসারী এক শক্তি মন্ত কবি। দেশমৃত্তিকা -শোণিত-শিক্ত এক কবি, লোরকা, পাবলো নেরুদার মতো,কখনও কখনও নজরুলের মতো আজন্ম বিদ্রোহী এক প্রেমিক কবি-যিনি দেশকে ভালোবাসেন প্রাণাধিক, মানুষকে ভালোবাসেন প্রাণান্ত।

কবি পরিচয়ে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক সব্যসাচী লেখক।

কবিতা, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, জীবনী,ভ্রমণ কথা,গল্প, স্মৃতিকথা,সম্পাদনা –প্রভৃতি রচনায় তিনি উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এ পর্যন্ত শতাধিক গ্রন্থ তার প্রকাশ পেয়েছে –যার মধ্যে কবিতা গ্রন্থ ২২টি,শিশু কিশোর তোষ গ্রন্হ ২৩ টি,প্রবন্ধ গ্রন্থ ২০টি,নজরুল বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ ১৩টি,ভ্রমণ কথা ৮টি,জীবনী ৪টি,

সম্পাদনা করেছেন ১৫ টি গ্রন্থ। এ ছাড়াও গল্প গ্রন্থ, চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রন্থ ও স্মৃতিকথা বের হয়েছে একটি করে। তার আরও অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধ, প্রতিবেদন, ফিচার, কলাম প্রকাশ পেয়েছে শতাধিক।

বাংলা একাডেমি সহ দেশ বিদেশের প্রায় ৫০ প্রতিষ্ঠান থেকে পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন– তিনি আমার কাব্য -সতীর্থ, একান্ত বন্ধু -স্বজন।

দুই. সম্প্রতি ‘ডাক টিকেট’ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠন তার ওপর একক কবিতা পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা একাডেমির পরিচালক কবি রহিমা আক্তার কল্পনা সহ আমি এবং আরও অনেকে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমি ছিলাম প্রধান আলোচক।

অনুষ্ঠানটি ছিলো একক কবিতা পাঠ ও আলোচনার।তাই আমি তার পঠিত কবিতা এবং তার অন্যান্য কবিতা সম্পর্কে কিছু মূল্যায়ন মূলক বক্তব্য প্রদান করে ছিলাম। সেই আলোচনার কিয়দংশ উল্লেখ করার কসরত করছি। আবদুল হাই শিকদার ছাত্রজীবন থেকে, কিশোর কাল থেকে লিখছেন কিন্তু তার সাড়ম্বর প্রকাশ ঘটেছিলো একবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আশি লক্ষ ভোর’ বের হয়েছিল ১৯৮৭সনে। কিন্তু কবিতা প্রকাশ হয়েছিল আশির প্রারম্ভ এবং তার পূর্ব কাল থেকেই। আশির দশক জ্যোতি জোসনার কবিকণ্ঠ‘ শিরনামে আশির দশকের দশজন অন্যতম কবিদের নিয়ে আমার একটি সমালোচনামূলক গ্রন্থ বের হয় জুলাই ২০০৩-এ। এই গ্রন্থে আবদুল হাই শিকদারের ওপর আবদুল হাই শিকদার : মানুষ মৃত্তিকার কবি শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি। আশির দশকের কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দিন আহমদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, শাহাদাৎ বুলবুল,আবদুল হাই শিকদার, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার,মজিদ মাহমুদ, আসাদ বিন হাফিজ, মোশাররফ হোসেন খান সহ আরও কেউ কেউ লিখেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ তার দরোজার পর দরোজাগ্রন্থে আশির দশকের কয়েক জন কবির ওপর প্রবন্ধ লিখেন।নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দিন আহমদ চতুর্দশ শতাব্দীর কবিতাগ্রন্থে আশির দশকের আঠাশ জন কবির তালিকা সহ তাদের কারো কারো কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘একবিংশকবিতা পত্রে লেখেন আশির দশকের কবিতা ঐতিহ্য সূত্র নব নির্মিতি। আবদুল হাই শিকদার সম্পাদিত আশির দশক নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনে লিখেন–’কবিতা আশির দশক : একটি পর্যালোচনা ‘।

আসাদ বিন হাফিজ’ মাসিক কলম’ পত্রিকায় লেখেন এক গুচ্ছ বিদ্রোহী শব্দমালা’নামে আশির দশকের প্রতিনিধিত্বকারী কবিদের ওপর মূল্যবান প্রবন্ধ। কবি মজিদ মাহমুদ রচিত আশির দশক : কবি কবিতা শীর্ষক গ্রন্থটি কলমিলতা প্রকাশন থেকে বের হয় ১৯৯১ সনের একুশে বইমেলায়। এ গ্রন্থে তেরো জন কবির সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এরা হলেন –খোন্দকার আশরাফ হোসেন (৪/১/১৯৫০),আশরাফ আল দীন(২/৫/১৯৫৪),আবদুল হাই শিকদার (১/১/১৯৫৭) হাসান আলীম (১৩/৩/১৯৫৭),কামাল মাহমুদ (৫/৭/১৯৫৭), মোশাররফ হোসেন খান (২৪/৮/১৯৫৭), সোলায়মান আহসান (৭/৭/১৯৫৭), মুকুল চৌধুরী (২২/৮/১৯৫৮),তমিজ উদ্দিন লোদী (১/১/১৯৫৯),ফরিদ কবির (২২/১/১৯৫৯), রেজাউদ্দিন স্টালিন (২২/১১/১৯৬১),বুলবুল সরওয়ার (২৭/১২/১৯৬২) ও খসরু পারভেজ (২৫/১২/১৯৬৩)।

উল্লেখ্য, দশ বছরের কবিতা অংশে একান্নজন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। মজিদ মাহমুদের এ বইটি প্রকাশের আগে অবশ্য সেই সময়ের নামকরা সাহিত্য পত্রিকা মাসিক কলম-এ, পত্রিকার সম্পাদক কবি মতিউর রহমান মল্লিক যত্নের সাথে মজিদ মাহমুদের নেয়া এ সব কবিদের সাক্ষাৎকার ধারাবাহিক ভাবে ছাপিয়েছেন।

তিন. ২০০৯ সনের বই মেলায় ‘আশির দশক : নির্বাচিত কবিতাশীর্ষক গ্রন্থটি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এতে ‘আশির কবিতাশীর্ষক পটভূমি নিবন্ধ লিখেছেন কবি আল মাহমুদ তিনি তার দীর্ঘ নিবন্ধে বলেন –

. আশির কবিরা চিরন্তন বিষয় ‘প্রেম’নিয়েই কেবল পড়ে থাকেনি বরং দেশমাতৃকার কথা ও আপন বিশ্বাসের বাণীও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উত্থাপন করেছে।’

সবার সম্পর্কে আলাদাভাবে মন্তব্য না করেও বলা যায়, আশির এ সব কবি ইতোমধ্যে তাদের দশক অতিক্রম করে এসেছেন এবং টিকে আছেন। ‘

কবি এবং প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ এ গ্রন্থের বেশ বড়ো ভূমিকা লিখেছেন–কাব্যকথা কমল সুগন্ধি পরিপূরশিরোনামে।

তিনি আশির দশকের কবিদের সম্পর্কে বেশ মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যে কয়েক পঙক্তি

.’আট. আশির দশকের কবিদের হাতেই উত্তরাধুনিকতার বীজ বপিত হয়েছিল।

নব্বই দশকে তা স্ফারিত, বিকশিত ও বিবর্তিত হয়।

২.নয়. চল্লিশের দশকে একদিকে সাম্যবাদী-সমাজতন্ত্রের ধারা প্রবাহমান ছিল, অন্যদিকে ধর্মবিশ্বাসী একটি গোষ্ঠীর জাগৃতিও ঘটেছিল। কয়েক দশক পরে আশির দশকে এরকম বিশ্বাসী একটি কবিদল উত্থিত হলো।এঁরা বাংলাদেশের কবিতার নতুন একটি স্বর যোজনা করেছেন।

৩.এগারো. এই সময়ের কোনো কোনো কবির রচনায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদির প্রয়োগ দেখা যায়।

‘আমি এ গ্রন্থে ‘হৃত্ কমলের টানে ‘ শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখি। আশির দশকের সাতান্ন জন কবির দশটি করে কবিতা নিয়ে এটি সম্পাদনা করি। টাঙ্গাইলের নিমকাল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে কবি শরীফ শাহরিয়ার সম্পাদিত আশির দশকের কবি কবিতা ‘শীর্ষক একটি চমৎকার সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারী ২০১০ সনে।

একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন তিনি। এ গ্রন্থে একানব্বই জন কবির পাঁচ টি করে কবিতা স্থান  পেয়েছে।

আমাদের আজকের কবি আবদুল হাই শিকদারের কবিতা এ সব সম্পাদনা গ্রন্থে বেশ সম্মানের সাথে স্থান পেয়েছে। 

চার..

কবি আবদুল হাই শিকদার ছন্দ সচেতন কবি। তিনি বাংলার প্রধান তিন ছন্দে কবিতা লিখেছেন। তবে এর মধ্যে তিনি অক্ষর বৃত্ত মুক্তক ছন্দ এবং গদ্য কবিতায় বেশ স্বচ্ছন্দ লাভ করেন। মন্দাক্রান্তা ছন্দ এবং রুবাই ফর্মে তার উল্লেখ যোগ্য কাজ রয়েছে।’ মানব বিজয় কাব্য’ তার রুবাইয়াত। রুবাইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন। মানবতা, মানবপ্রেম তার মূল বিষয় শুরু নারী প্রেম বা প্লেটোনিক ভালোবাসাই তার অন্যতম বিষয় নয়। পঙক্তিতে মাত্রা সংখ্যা নিয়েও তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

যেমন–

তুমি তো ধ্যানী মুনি

আমিই বিজ্ঞান

দুজনে একা একা কিছুটা ম্রিয়মাণ

তার,চে এসো গাই কোরাসে প্রিয় গান।

এখানে পঙক্তিতে অসমতা এবং অন্তমিলেও ভিন্নতা এনেছেন। চার পঙক্তির রুবাইয়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ পঙক্তির অন্তমিলে সাম্য কিন্তু তৃতীয় পঙক্তিতে সে মিল থাকে না। শিকদার এক্ষেত্রে বেশ কিছু রুবাইয়ে অন্তমিলের ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন এবং কোথাও আবার অন্তমিল দেন নি, তবে ছন্দের মাত্রা ঠিক রেখেছেন –স্বরবৃত্ত বা মাত্রা বৃত্ত উভয় ছন্দের ক্ষেত্রে।

চার. .

শিকদার ছন্দে পাকা। তিনি সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা রচনা করেছেন।

সাতটি অবকাশ তাদের হাতে ছিলো

তারা তো দশজন একলা লোক ছিলো

তাদের জামাজুতো কবিতা বই খাতা

হিসাবি নড়ানড়ি রোদের দিকে ছাতা

(সাতটি অবকাশ/রেলিঙ ধরা নদী)

এক্ষেত্রে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক কবিতা রচনা করেছেন এমনকি গানও লিখেছেন।

উদ্ধৃতি–১.হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি

জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।

প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি,

আকাশ -পানে চাই কী জানি কারে দেখি।

(প্রভাত -উতসব/প্রভাত সংগীত )

২.খাঁচার পাখি ছিল

সোনার খাঁচাটিতে

বনের পাখি ছিল বনে।

একদা কী করিয়া

মিলন হল দোঁহে

কী ছিল বিধাতার মনে।

(দুই পাখি /সোনার তরী)

আমি শুধু শিকদারের ব্যাতিক্রমি বিষয়ের কিছুটা উল্লেখ করলাম।

স্বরবৃত্ত, মাত্রা বৃত্ত, অক্ষর বৃত্ত বা তার গদ্য কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা দীর্ঘ করতে চাই না। তিনি তো

ছন্দে ঋদ্ধ। তাই সে বিষয়ে আর বেশি বলতে চাই না।

.

আবদুল হাই শিকদার তার কবিতার বিশালায়তন জুড়ে কিছু নতুন কাজ করেছেন। আমাদের আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্য এমন কাজ দু একজন করেছেন কিছু কিছু। আর তা হল pleasure of Vulgarity বা কুৎসিত -সুন্দরের রস। পাবলো নেরুদার কবিতায় ভালগারিজম পাওয়া যায়। কিন্তু কুৎসিত চিত্রকল্পের মাধ্যমে যে সার

বা Climax তৈরি করে চরম সত্যের আবাহন করা যায় তা আমাদের সাহিত্যে প্রচুর নয়। কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতায় একটি অসাধারণ ভয়ঙ্কর এবং কুৎসিত চিত্রকল্পের সৃষ্টি করেছেন। সেটি হল–

‘আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী'(বিদ্রোহী/অগ্নি-বীণা) অথবা আমি যদি বলি–

‘মুত্রে ভেজা যোনির ভেতর পুরুষাঙ্গের বীর্যপাত,

এমন গান্দা আধার থেকেই তোমার আমার সূত্রপাত।

(ব্যজস্তুতি/একটি চেয়ারের গল্প) আবদুল হাই শিকদার প্রচুর কবিতায় কুৎসিত –সুন্দর চিত্রকল্পের মাধ্যমে দারুণ রস সৃষ্টি করেছেন। এমন সাহসী, প্রতিবাদী চিত্রকল্প আমাদের সাহিত্যে মেলা ভার।এখানে তিনি তার একটি কাব্য ভাষা, Poetic diction নির্মান করেছেন -যা তাকে চোখ বুঁজে চিনিয়ে দেয়।কিছু উদ্ধৃতি–

১.আপেল গাছের তলায় পাশের নদীটা নুনু বার করে হাসে উরুর ভিতরে ছিলো ঘনকালো মেঘ।(শীত/আশি লক্ষ ভোর)

২.সরিয়ে নিওনা এই জলজ বাতাস সংসারে

নক্ষত্রের কেবিনেটে আদরে লুকিয়ে রাখা কালোকোট

দুর্দান্ত আঘাতে ভাঙ্গা ফজলি আমের পোয়াতি ডাল।

(সান্দ্রস্বরিত/আশি লক্ষ ভোর )

৩.মানুষ দেখলে সে ডেকে ওঠে পায়রার মতো

মানুষ দেখলে সে নড়ে ওঠে ঘাটে বাধা নৌকার মতো।

(জাজিম প্রাপ্তি/আশি লক্ষ ভোর )

৪.আমাকে শিঙ্গি মাছের বিষ দিয়ে

সে অন্য পুরুষের সুগন্ধি আতরের মতো

বুকের পশমে হাত রাখে।(রাজধানী/আশি লক্ষ ভোর )

৫.বলিলাম হে,কবিতা এই অসময়ে

নারীর উরুর ভিতর খুঁজিতেছ কি?

বলিল বিষন্ন বদন,সব গেছে এই মিয়াদের

আছে শুধু উরুর জোনাকি।(ক্যামব্রীজ,৯৫/এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো

পাঁচ. .

আবদুল হাই শিকদার কেবল নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য বিভূষণা কবি নন বরং দেশমাতৃকার উন্মূল প্রেমে উচ্চকিত সাহসী বখতিয়ার। বিজয় করেছেন মাতৃভূমির মৃত্তিকা, শোনিত-সৌরভে -শিক্ত-শিশিরাদ্রের মন-মনসুরিয়াতে।

তার কবিতার বিশালায়তন-বিশালাক্ষী, ভুবন –বোধিত-আকাশ-বিসারী।

ভুরি ভুরি কবিতার ভুরি ভুরি পঙক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া যায় কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু তুলে ধরছি –

১.কেটেছে নয়টি মাস উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে

মাথার রক্ত ঘাড় বেয়ে বেয়ে ভিজিয়েছি তপ্তজমি

তারপর গৃহে ফেরা –শ্রান্ত ক্লান্ত দেখি

ক্যারাভান ভুল পথে,সম্মুখে শুধু ধু ধু ফোরাতের তীর

টলমলে জল নয় বল্লম হাতে নিয়ে অপেক্ষা অধীর।

(আরেক হোসেন/আশি লক্ষ ভোর )

২.আমার বুকের মধ্যে তখন সিরজদৌলার মতো হৃদপিণ্ড।

আমার দু,চোখের মধ্যে তখন লোরকার সেই চোখ।

আর আমি সিরাজ সিকদারের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

আমার মনে আছে আমি ইব্রাহিমের প্রভুর কথা ভেবেছিলাম।

ইউনুসের ত্রাণকর্তার কথাও স্মরণে আসেনি তা নয়।

ইউসুফ! ইউসুফ! অন্ধ কূপের ভিতর

তোমার প্রতিপালকের জন্য কি আমার চোখে পানি এসেছিলো?

মনে নেই —

মোহাম্মদের হাবীব আমার কিছুই মনে নেই।

কারণ ওরা আমার কলমের বিরুদ্ধে কণ্ঠার ওপর ধরে রেখেছিলো উদ্ধত বল্লম।

—আমি শুধু আমার চেতনাকে সর্বশেষ বারের মতো একাগ্র রেখে

ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম প্রিয়তম স্বদেশের পরতে পরতে। (এইবদ্ধভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো /এই বদ্ধ ভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো )

৩.স্মরণ কর আগ্রাসী আবরাহার শেষ সময়গুলো

তার জন্য তোমার প্রতিপালক আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে

কঙ্কর নিক্ষেপকারী পক্ষী প্রেরণ করেন।

অতঃপর হস্তি বাহিনীকে তিনি ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন।

মুসার পিছনে ধাবমান ফেরাউনের পরিণতির কথা ভাবো,

কারণ সে ছিলো সুস্পষ্ট সীমা লঙ্ঘনকারী,

আর আবুলাহাব —তার প্রতি পতিত তোমার প্রভুর ঘৃণা

তার দুই হাতের প্রতি লানত।(লানত/ঐ)

৪.স্বাধীনতার দাঁত বসাতে

আসছে দানব তেড়ে

সেই দানবকে তোয়াজ করে

দেশদ্রোহী নেড়ে।

দানব এবং দেশদ্রোহীর

ভৈরবী সঙ্গীত

বাংলাদেশের বুকের ওপর

আনছে ডেকে শীত। (ডাক/ঐ)

৫.গগন আন্ধার করি লোডশেডিং নামিয়াছে

আমাদের মাথার ভিতরে

কিছুই দেখি না আর ভালো

ভালো কিছু সহেনা নয়নে…..

………………………………….

……………………………

ঘরে সাপ বাইরে সাপ

শহর বন্দরময় সাপ

চোখে মুখে শব্দে শব্দে সাপ বিছানায়

সাপের শাসনে কান্দে লক্ষীন্দরের মায়

হায় সাপ, কোথায় রাখিব সন্তাপ

কাহাকে ডাকিব ভাই

পূন্য পাইব কোথা সব বুক ভরা শুধু সাপ।

(লোডশেডিং নামিয়াছে /লোডশেডিং নামিয়াছে)

৬.পলাশীর প্রান্তরের আফিমখোর মীরজাফর না তুই?

মহাভারতের সেই শকুনী?

তুই -ই তো রামায়ণের বিভীষণ।

শাহনামার জোহহাক।

অডিসির সাইরেন দ্বীপের বাসিন্দা।

চন্দরগুপ্তের দরবারে আসীন জটিল কুটিল চানক্য।

তোকে আমি ঠিকই চিনেছিরে শালা!

(ট্রান্সপারেন্ট কাব্য /কে সিরাজদৌলা কে মীরজাফর)

পাঁচ. .

আবদুল হাই শিকদার মানবতাবাদী কবি–মানুষ, মানুষের জন্য দেশ,ধর্ম,দর্শন, ভালোবাসা তার কবিতায় ভূবন -নিমগ্ন -আকাশ-নিষণ্ন। তার দেশপ্রেম, মানবপ্রেম থেকে বিশ্বমানবিকতা সৃষ্টি হয়েছে। তার এ উত্তরণ মূলত তার দেশপ্রেম সন্নিহিত ধর্মবিশ্বাস ও আত্মোতসর্যনের জন্য হয়েছে। তার এ ক্রম-উত্তরণ লক্ষ্য করা যায় তার বিভিন্ন কবিতার উজ্জ্বল স্বাক্ষরের চমক-নির্ঝরণে।

১.বলা হলো,হে আমার সম্প্রদায়

মরোর জঙ্গলে যে বাহু গুলিবিদ্ধ হলো সে বাহু কার?

ভূসর্গ চৌচির করে যার আর্তনাদ লাদাখের বরফে হারিয়ে যায়

সে আর্তনাদ কার? ফিলিস্তিনের প্রতি ধূলিকণায় কার রক্ত

বসনিয়ার পথে পথে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লাশগুলো কার?

সেব্রেনিকায় যে বালিকারা ধর্ষিত হয়েছে, সে কার কন্যা সে কার জননী, (আর কোন বসনিয়া নয়)

২.ইমাম তুমি তাকালে সামনে জালিমের জিন্দান

ভেঙে খান খান নমরুদ আর ফেরাউন ভূপাতিত

ইমাম তুমি দুহাত বাড়ালে ওমনি ফুটলো গোলাপ

বারুদে বারুদে জাগালে দারুণ জীবনের অঙ্কুর

ইনসানিয়াত তোমার গর্বে পৃথিবীর পথে পথে

ফেরি করে আজ নতুন শরাব স্বপ্নের কলরব।(ইমাম)

৩.মুহম্মদ আপনি এমন কেন

আমার উপকূল জুড়ে আপনার বেলাভূমি

তায়েফের বনে একজন রক্তাক্ত মানুষের

দুর্লভ উচ্চারণ থেকে

আমার দূরত্বকে আমি বাড়াতে পারিনি কোনোদিন

আমার পরমায়ু সমূহ সীমাবদ্ধতায় মুহম্মদ

কেবলমাত্র আপনার নামের বাতিঘর

প্রলুব্ধ মক্ষিকার মতো আমার গহন রক্তে ও ঘামে

উন্মাতাল আলোর নাচনে আমাকে অস্থির করে শুধু

এই অস্থিরতার বাইরে আমি কোথায় যাবো

আপনার অধিকৃত ভূভাগ থেকে বেরুবো কেমন করে?

(জ্যোতিষ্ক মেঘের বাতিঘর)

৪.প্রভু, আমাদের ইবাদতগুলিকে তুমি বেহেশতের লোভ

থেকে মুক্তি দাও।

আমাদের গভীর ও নিবিড়তাকে দোজখের ভয় থেকে মুক্তি দাও।

আর এই লোভী ও ভীতদের মধ্যে সঞ্চার কর বদরের বৈভব।

তারপর আমাদের প্রতিটি ইবাদত হয়ে উঠুক এক একটি যুদ্ধ ঘোষণা।

এই যুদ্ধ অন্যায় ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে

এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে,

এই যুদ্ধ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে

এই যুদ্ধ অমানবিকতার বিরুদ্ধে,

বাতিল হয়ে যাওয়া গলিত পুঁজের বিরুদ্ধে।

আমাদের প্রতিটি কালেমা এখন এক কোটি শ্লোগান।

আমাদের প্রতিটি নামাজ এখন এক কোটি মানববন্ধন।

আমাদের প্রতিটি রোজা এখন এক কোটি অনশন ধর্মঘট।

আমাদের জেকেরগুলো এখন এক কোটি গনগনে মিছিল।

আর জাকাতগুলো মৃত্তিকার উপর খাড়া করে রাখে

ঝাঁঝালো ব্যানার।

আর আমাদের হজ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম

প্রতিবাদ সমাবেশ।

(ইবাদতগুলি প্রার্থনাগুলি/তারউজিয়াল গ্রামে বৃষ্টি নামলো)

৫.আমার পিছনে ওহুদের রক্তাক্ত ময়দান

সামনে রহমাতুল্লিল আলামীনের একান্ত ভুবন

দুই চোখ দিয়ে তখন ফোয়ারার মতো গলগল করে

বেরিয়ে আসছে পানি

কিন্তু চোখের পানির আর কতটুকু সাধ্য

হৃদয়ের জলোচ্ছ্বাসকে পরিপূর্ণ ভাবে জাহির করে

ফলে বৃক্ষের মতো

বৃক্ষের ঝরা পাতার মতো

রিয়াদুল জান্নাতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয় —

আর টাইটানিকের মতো

গভীর অনির্বচনীয়তায় তলিয়ে যায় আমার সকল সত্তা

আমার অহংকার (হেজাজপঞ্জি/তারউজিয়াল গ্রামে বৃষ্টি নামলো)

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিশালী কবি যেমন প্রতিবাদী,বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী

তেমনি নিগুঢ় নিবেদিত স্রষ্টা প্রেমিক কবি।তিনি মূলধারার বিশ্বাসী কবিদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, অন্যতম বিশ্বাসী –বিপ্লবী –মরমি কবি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ