কাজী জহিরুল ইসলাম
মূলত আমরা সকলেই প্রকৃতির অনুবাদক। আমাদের বোধ এবং চিন্তা মৌলিক। সেই বোধকে, চিন্তাকে আমরা ভাষা দিয়ে অনুবাদ করি। কারো অনুবাদ বক্তৃতা হয়ে ওঠে, কারো অনুবাদ হয় সাহিত্য, কারোটা বা সঙ্গীত। যারা ছবি আঁকেন তারাও তাদের বোধকে ছবিতে অনুবাদ করেন। অনুবাদহীনতা হচ্ছে নীরবতা দিয়ে সিল করা একটি টেরিটোরি। অনুবাদের আশ্রয় আমাদের নিতেই হয়। আমাদের বোধগুলো প্রথম যে অক্ষর,শব্দ, বাক্যে অনূদিত হয় সেটি প্রাথমিক ভাষা। আমরা চাই আমাদের এই বোধ বা চিন্তাপ্রসূত শব্দেরা পৌঁছে যাক পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ যেহেতু এক ভাষায় কথা বলেন না, শব্দেরা তাই অন্য ভাষার মানুষের কাছে বোবা। আমাদের উচ্চারিত শব্দ পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে চায় ঠিকই কিন্তু তাকে কে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে ‘দূর দ্বীপবাসিনী’র কাছে? আমি যেমন স্বভাষী মানুষের জন্য আমার নিজস্ব বোধকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করি, ঠিক তেমনি আমার উচ্চারিত শব্দকে অন্য কোনো অনুবাদক ড্রাইভ করে নিয়ে যান অন্য ভাষার মানুষের ভূখণ্ডে। সেখান থেকে ভিন্ন অনুবাদক নিয়ে যান আরো দূরের, আরো ভিন্ন ভাষার কোনো মানুষের ভূখণ্ডে, এভাবেই আমাদের শব্দেরা সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে।
পৃথিবীর বড়ো বড়ো সৃজনশীল লেখকেরা বলেছেন সৃজনশীল সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতার, অনুবাদ হয় না। রবার্ট ফ্রস্ট তো ঘোষণাই করেছেন, অনুবাদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা হারিয়ে যায় সেটিই কবিতা। ভিন্নভাবে ফ্রস্ট উচ্চারিত হয়েছে জাপানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নোবেলবিজয়ী লেখক কাজুও ইশিগুরোর আশঙ্কায়। তিনি বলেছেন, আমি চাই আমার কথাগুলো যেন অনুবাদের পরেও বেঁচে থাকে। এই দুই মহান লেখকের বক্তব্য প্রায় এক হলেও অভিব্যক্তি ভিন্ন। ফ্রস্ট নেতিবাচকভাবে বলেছেন এবং অনুবাদ নিরুৎসাহিত করেছেন কিন্তু ইশিগুরো অনুবাদ নিরুৎসাহিত করেননি কিন্তু আশঙ্কা করেছেন অনুবাদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়ত তার বক্তব্য বিকৃত হয়ে যেতে পারে। তিনি অনুবাদকে উৎসাহিত করে বরং অনুবাদকদের কিছুটা সাবধান করে দিয়েছেন তারা যেন তার বক্তব্যের মৌলিকত্ব রক্ষায় যত্নবান হন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অনেকেই আমার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আলবেনিয়ান, সার্বিয়ান, রুশ এবং উড়িয়া ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে। যেহেতু আমি সেইসব ভাষা জানি না তাই কেমন অনুবাদ হয়েছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে পারবো না। কিছুটা ইংরেজি বুঝি বলে আমি যখন ইংরেজি অনুবাদগুলো পাঠ করি, তখন সেগুলো অন্য কারো লেখা মনে হয়, খুব অচেনা লাগে। এমনকি আমি নিজে অনুবাদ করেও দেখেছি, মূল বাংলা কবিতা থেকে অনূদিত ইংরেজি বেশ দূরে সরে যায়। তাহলে কি আমার উচ্চারণ ভিন্ন ভাষার মানুষের কাছে পৌঁছুবে না? ফ্রস্টের কাছেই আত্মসমর্পণ করবো?
অনেক সৃজনশীল কবি, কথাসাহিত্যিকের মতো আমি নিজেও একথা বিশ্বাস করি, অনুবাদ একটি নতুন সৃষ্টি এবং এর মধ্যেও সৃজনশীলতা আছে। একজন কবি হিসেবে আমি চাই আমার কবিতাটি যখন অন্য ভাষার একজন পাঠকের কাছে তার ভাষায় অনূদিত হয়ে পৌঁছায়, তখন তিনি যেন তার ভাষায় একটি মানোত্তীর্ণ কবিতা পড়েন। সঙ্গে এও চাই আমার কবিতার মূল বক্তব্যটি যেন তার বোধে ধাক্কা দেয়। এখন কথা হচ্ছে দুটি ভাষা জানলেই কি একজন অনুবাদক এই কাজটি করতে পারবেন? না, পারবেন না। কবিতার অনুবাদ যেহেতু ট্রান্সক্রিয়েশন [বা রি-ক্রিয়েশন], তাই এই কাজটি একজন অভিজ্ঞ [বা সফলও বলা যেতে পারে] কবির পক্ষেই সঠিকভাবে করা সম্ভব। অনেকেই তো বাংলা ভাষাটা ভালো করে জানেন। কিন্তু তারা কি বাংলায় ভালো কবিতা লিখতে পারেন? পারেন না। তো যিনি বাংলা ভাষায় ভালো কবিতা লিখতে পারেন না তিনি কী করে অন্য ভাষার কবিতাকে বাংলায় একটি সফল ও সার্থক কবিতা করে তুলবেন? ইংরেজ কবি জন ডান বলেছেন, ‘ফর গড সেক হোল্ড ইওর টাং এবং লেট মি লাভ’। যে কেউ এটিকে অনুবাদ করবেন, দোহাই লাগে তুমি চুপ করো এবং আমাকে ভালোবাসতে দাও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন অনুবাদ করেন তখন তিনি লেখেন, “দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর” তিনি কথাগুলো ৬ মাত্রার মাত্রবৃত্ত ছন্দে সাজিয়েছেন। এটিকে বাংলা ভাষায় একটি সফল কবিতা করে তুলেছেন। প্রকৃত কবি ছাড়া আর কে এটা করতে পারত?
নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠি যদি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুবাদ না করে কবীর চৌধুরী করতেন তাহলে কি অমন কালজয়ী একটি কবিতা হয়ে উঠত? এমন দৃষ্টান্ত খুব কম আছে একজন অকবি ভিন্ন ভাষার কবিতার সফল অনুবাদ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু না করে যদি বোদলেয়ার অনুবাদ করতেন কোনো এক অকবি বাঙালি তাহলে হয়ত বাংলা ভাষায় বোদলেয়ারকে নিয়ে এতো মাতামাতি হতো না।
আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে বাংলা ভাষার অনেক কবিই ইংরেজিটা জানেন, তারা ইংরেজি থেকে তরজমা করে সফল বাংলা কবিতা তৈরি করতে পারেন কিন্তু ক’জন ইংরেজি ভাষার কবি বাংলা জানেন যে তারা আমাদের কবিতা ইংরেজিতে ট্রান্সক্রিয়েট করবেন? সম্ভবত একজনও নেই। তাহলে আমাদের কবিতা ইংরেজি ভাষায় পৌঁছুবে কী করে? আমাদের কবিতা কী তাহলে নীরবতা দিয়ে সিল করা এক দ্বীপেই অন্তরীণ থাকবে?
দুটি উপায় আছে। প্রথমত আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছুতে হলে আমাদের কবিদের কোনো একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ভালো করে রপ্ত করতে হবে এবং সেই ভাষায় কবিতা লিখতে হবে। এই পরামর্শে অনেকেই ভ্রু কোঁচকাবেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্যর্থতার কথা তুলবেন। অকবির পক্ষে কবিতার ট্রান্সক্রিয়েশন যেমন সম্ভব নয় তেমনি ভিন্ন একটি ভাষা শিখে কবিতা লেখাও দুরূহ কাজ। দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে ফ্রস্টকে বুড়ো আঙুল দেখানো, মানে চুলোয় যাক কবিতার মিউজিক, অনুবাদের মধ্য দিয়ে যা থাকে তাতেই খুশি হতে হবে। শুধু বক্তব্যটা অবিকৃত থাকলেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
বাংলা ভাষায় প্রচুর মানহীন কবিতা যেমন লেখা হচ্ছে, পৃথিবীর সব ভাষাতেই তা হয়, আবার প্রচুর উচ্চমানসম্পন্ন কবিতাও লেখা হচ্ছে। আমাদের ভালো কবিদের দুর্ভাগ্য যে তাদের মাতৃভাষাটি কোনো আন্তর্জাতিক ভাষা নয়। যদি বাংলা ভাষা ইংরেজি বা ফরাসীর মতো মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা হত তাহলে প্রতি দশকেই একজন করে বাঙালি কবি নোবেল পুরস্কার পেতেন।
অনুবাদ বিষয়ক এই ছোট্ট রচনাটি শেষ করি ইংরেজ কবি জন ডানের একটি কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর বেশ কিছু অনুবাদককে নিয়োগ দিয়েছেন। আমাদের কিছু কিছু কাজ অনুবাদ করে আমাদের বয়স, ব্যাধি, যুদ্ধ এবং জাস্টিস।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২ মার্চ ২০২৩।