মুসা আল হাফিজ
মানুষ নিজেকে জীবনের প্রবল স্রোতের উপর জায়মান ঢেউ বিশেষের মতো প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু সেই স্রোতের উৎস কোথায়? জীবনের স্বচ্ছন্দ গতির ভেতরেই সত্তার গহীন থেকে উৎসারিত ভাবনার তোলপাড়ে ক্রমাগত হতবিহ্বল হয়। সে ভাবে স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি অসম্ভব। কিন্তু কে রহস্যময় মানুষ ও বৈচিত্র্যময় বিশ্ব জগতের স্রষ্টা? আকাশের নীলিমা, চন্দ্রের সুষমা, সূর্যের রশ্মিধারা, সমুদ্রের ঊর্মিমালা, কোটি কোটি নক্ষত্র আর গ্রহ উপগ্রহের অভিনব দৃশ্য,- উপন্যাসের মতো সুসজ্জিত ও ধারাবাহিকভাবে বিন্যসিত। কে লিখেছেন এ উপন্যাসটি? তার সঠিক পরিচয় কি? মানুষের সাথে তার কি কোন সম্পর্ক থাকতে পারে? কেমন হবে সেই সম্পর্ক?
সে দেখে মানুষের মৃত্যু। পিতার কবর হয়তো সে নিজেই খনন করেছিল। তার পরিচিতদের অনেকেই দেখতে দেখতে মৃত্যুবরণ করল। তার মনে প্রশ্ন জাগে মৃত্যুর পরে কি হয়? মৃত্যুর সাথে সাথেই কি মানবজীবন শেষ?
সে জীবনকে ভোগ করে? সে আনন্দিত হয় এবং আরামের উপকরণসমূহ ব্যবহার করে, যা সে সৃষ্টি করেনি। সে পানি, বাতাস ও মাটি থেকে উপকৃত হয়। মাটি তার জন্য যদি শস্য উৎপাদন না করতো তার পক্ষে আদৌ কি বেঁচে থাকা সম্ভব হতো? সে জানে এগুলো কোন মানুষের তৈরী নয়। সে দেখে বিশ্বপ্রকৃতির গোটা ব্যবস্থাপনাই এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, এখানে কোন বিচ্যুতি ও বিরতির অবকাশ নেই। সে লক্ষ্য করে এক সমৃদ্ধ গতি, পরিবর্তন ও আবর্তন। কোনো জিনিসই এক অবস্থায় টিকে থাকছে না। সৃষ্টির সাথে লয়, ভাঙ্গার সাথে গড়া, উত্থানের সাথে পতন হাত ধরাধরি করে চলছে। ক্ষীণ ও খর্বকায় হচ্ছে শক্তিশালী, শক্তিশালী হচ্ছে ধ্বংস। যৌবন পৌঁছে যাচ্ছে বার্ধক্যে, কখনো শীত কখনো বসন্ত, কখনো শুষ্কতা কখনো সজীবতা । একটি ক্ষুদ্র বীজ যা চোখেই পড়তো না, সে হয়ে যাচ্ছে মহীরুহ। সে ছায়া দেয়, ফল দেয়। আবার একদিন শুকিয়ে মাটিতে একাকার হয়ে যায়। রাত্রি-দিনের সময়সীমা নিশ্চিদ্র নিয়মের অধীনে ক্রিয়াশীল। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, পুঞ্জিভূত মেঘমালাকে বিস্তীর্ণ করে দিচ্ছে। এই যে আবর্তন ও গতিক্রম, সবকিছুই যেন একটা অর্থ প্রকাশ করে চলেছে। একটি জলদমন্ত্র যেন সৃষ্টির সর্বত্রই ঘোষণা করে চলেছে– এগুলো ফলাফল নয় কোনো দুর্ঘটনার। এগুলোর সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন। আছেন সচেতন ও সজ্ঞান পরিচালক।
সৃষ্টিজগতের নানা উপকরণ ব্যবহারের জন্য দৈহিক ও মানসিক শক্তি, যা মানুষের অধিত, জীবনযাপন করার জন্য ভালো ও মন্দের চেতনা, যা তার অধীত, সে জানে এগুলো কেউ না কেউ দিয়ে থাকবেন। যিনি দিলেন তার উদ্দেশ্য কি? তিনি কি এর হিসাব নেবেন? তার কাছে কি দাঁড়াতে হবে?
সে জানে মানুষ হিসেবে তার জন্য নৈতিক জীবনের দরকার। কিন্তু নৈতিক চেতনার ঠিক বিপরীত প্রবণতা তার ভেতরে সক্রিয়।অতএব উভয়ের মধ্যখান দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা কি হওয়া উচিত? সে সমাজে দশজনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে জীবন যাপন করে। এদের সাথে যার যার অবস্থান অনুযায়ী কীভাবে ব্যবহার করবে? কিভাবে বিভিন্ন দল, সম্প্রদায়, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? স্বীয় প্রকৃতি ও নিয়তির বন্ধনে বন্দী হতে সে কি একান্তভাবে বাধ্য? কিংবা সে কি নিজ ইচ্ছার অধীনে স্বেচ্ছাচারী, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে? যা না করার ইচ্ছা, তা নাও করতে পারে?
এসব প্রশ্নের উত্তর সে অনুসন্ধান করে। মেধা বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে, এসব বিষয়ে চিন্তা চর্চা করে। নানা ধারণা জন্ম নেয় তার মনে। ধারণা সমূহের উপর সে কখনো সিদ্ধান্তে যায় , কখনো যেতে পারে না। সে তার ধারণা ও সিদ্ধান্তকে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। সমাজ সেটাকে হজম করে কিংবা করে না। সমাজে এভাবে বিচিত্র ধারণা সমূহ নিজেকে সত্য হিসেবে দাবি করে। মানুষের চিন্তাসমূহ প্রবাহিত হয় বিচিত্র খাতে। বাড়ে জিজ্ঞাসা ও সংশয়, বাড়ে যুক্তি ও ফ্যালাসি, বাড়ে আস্থা ও অনাস্থা।
বিজ্ঞান এসব জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে দাঁড়ায় না। এগুলো অবস্তুগত। বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বস্তুগত। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির রূপরেখা জ্ঞাত হয় এবং তাকে কাজে লাগানোর উপকরণ আয়ত্তে আনে। এর উন্নতির ফলে মানুষ অর্জন করে নানা শক্তি। নিজের ও প্রকৃতিনিচয়ের যা কিছু নিরীক্ষাযোগ্য, তাকে বুঝার ও ব্যবহারের অধিকতরো সক্ষমতা। সেগুলোকে সে ব্যবহার করতে চায় প্রাত্যহিক জীবনে। জীবনে এর প্রয়োগ যখন নিশ্চিত হয় তখন আমরা বলি সভ্যতার উৎকর্ষ হচ্ছে। কিন্তু এই জিনিসটি সামগ্রিক ও মৌলিকভাবে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আবার ধ্বংস অবধারিত করবে, তাও নির্বিচারে বলা যায় না। ব্যবহারকারী তাকে যে কাজে ব্যবহার করবে, সে কেবল এর আনুগত্য করবে।
বৈজ্ঞানিক উপকরণ সামনে আসার পর তারা বরং প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্ম দিয়ে চলে। যার উত্তর দিতে হবে কোনো এক জীবনদর্শনকে এবং বৈজ্ঞানিক মনও কামনা করে জীবন-দর্শনের কাছে আত্মনিবেদিত হতে। বিজ্ঞান বস্তুকে মানুষের হাত পর্যন্ত পৌঁছা নিশ্চিত করে। এরপর কি সব শেষ? একটি বৈজ্ঞানিক মনও প্রশ্ন করবে, একে সে কিভাবে প্রয়োগ করবে ? কি উদ্দেশ্যে, কি প্রকারে ব্যবহার করবে? ব্যবহারের নানা পন্থার মধ্যে কোনটি সে গ্রহণ করবে? বর্জন করবে কোনটি? এতে তারও অন্যের কি লাভ রয়েছে?
গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে সে যদি বস্তুগত লাভালাভকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে খুব সম্ভবত সে বস্তুতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে এবং প্রকৃতিতে বাঁচার সংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যোগ্যতমের টিকে থাকার দর্শনে “ঈমান” এনে আশপাশের সমস্ত সৃষ্টবস্তুকে পায়ে দলে সবার উপর নিজের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। ফলে বস্তুগত উন্নতিকে চরম লক্ষ্য হিসেবে ধরে জীবনকে দিন দিন জটিল ও দুর্বিষহ করে ছাড়বে। সে সমাজের প্রত্যেকজনকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখবে এবং কল্পিত শত্রুকে পরাজিত করে নিজেকে প্রমাণ করতে আরও শিশুসুলভ ক্ষিপ্রতা, আরও বৈচিত্র এবং আরও উন্নতির নেশায় নিজেকে বরবাদ করে দেবে। বিজ্ঞান তার হাতে যতই বস্তুগত উপকরণ তুলে দিক, সে তাকে নিয়ে আরো অস্থির হয়ে ওঠে। তার জীবনের অষ্টপ্রহরে লক্ষ্যপূরণের ব্যর্থতা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকাতে থাকবে।
কেউ যদি জীবন দর্শনের এই বালখিল্যের স্রোতে নিজেকে সঁপে দিতে না চায়, তাহলে সে জানতে চাইবে বস্তুশক্তি ব্যবহারের নৈতিক সীমা, মানুষে মানুষে সম্পর্কের কাঠামো, জগত ব্যবস্থায় তার অবস্থান ইত্যাদি।
এসব বিষয় না জানা পর্যন্ত বস্তুশক্তির ব্যবহারের আদর্শ সে বুঝতে পারে না। তার মনে বহু প্রশ্ন তোলপাড় সৃষ্টি করে। সে দেখে, আজকের দুনিয়ার মগ্নচৈতন্যের দার্শনিকদের থেকে নিয়ে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের প্রায় সবাই একই বাস্তবতায় আবর্তিত। তারা জীবনের মৌলিক অর্থের মীমাংসা খুঁজেছেন। মীমাংসায় উপনীত হবার দাবী করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু কারো মীমাংসা অন্যদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। তীক্ষ্ণ অনুমানের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়তো ব্যক্তি দার্শনিক ও তাঁর অনুরাগীদের স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য শক্তিশালী অনুমানের বিপরীতে সে যখন দাঁড়িয়েছে তখন রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। অবশ্য অনুমাননির্ভর দর্শন মাঠে আসার আগে, এর চেয়ে কোনো ভালো মানবসৃষ্ট প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়নি। মানুষ তখন আরও দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু বাহনে চড়ে বিশ্ববীক্ষার সমুদ্র পার হতে চাইতো। গ্রিকদের কথাই ধরুন। দার্শনিকদের এগিয়ে আসার পূর্বে তাদের চেতনালোকে রাজত্ব করতো হোমারের কল্পকবিতা।
মানবদেহে বৈচিত্র্যময় শক্তির সম্মেলন। মানুষ কথা বলে, কাজ করে, চিন্তা করে। এর পিছনে যে শক্তি আছে সেটা প্রয়োগের ক্ষমতা গবেষণার মাধ্যমে বৃদ্ধিও করা যায় কিন্তু এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা অজান্তেই মনের গহীনে নড়ে ওঠে, সেটা হচ্ছে, এসব শক্তি কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের শিক্ষা কি হতে পারে? স্নেহ-মমতা আবেগ-উচ্ছ্বাস, ক্রোধ-ঘৃণা এগুলো মানুষের সত্ত্বায় সার্বক্ষণিকভাবে ক্রিয়াশীল। কিন্তু এগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত পথ কী ? এগুলো কখন, কোথায় সে প্রয়োগ করবে? তার চেতনালোকে যেসব হৃদয়াবেগ ও উদ্দেশ্যরাজি সক্রিয়, এগুলোর অনুসরণই কি তার দৈব। এগুলোর অনুসরণ কি একেবারে নীতিশূন্য ও লাগামহীন? সে তার ব্যক্তিত্বের গভীরতর উপলব্ধিতে দ্বন্দ্বমুখর ইচ্ছাসমূহের তাড়না লক্ষ্য করে। সে কি সব ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেবে? যা তার পক্ষে অসম্ভব।
তার বেঁচে থাকার জন্য এই বিশ্বের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিশ্বের জন্য মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। তাহলে এই নাট্যাভিনয়ের উদ্দেশ্য কি? যেখানে মানুষকে তার নিজের ভূমিকায় নিরন্তর অভিনয় করে যেতে হয়? এইসব জিজ্ঞাসার জবাব এমন সব দার্শনিকের হাতে তুলে দেয়া যায় না, যারা নিজস্ব প্রকৃতি ও স্থান-কালের ভিত্তিতে সমাধান দাঁড় করান। যারা মানবজাতির অতীতের অভিজ্ঞতা অনেকটাই ভুলে যান। বর্তমান সম্পর্কে নিজস্ব রুচি ও ঝোকপ্রবণতার কারণে খণ্ডিত মীমাংসা উপস্থাপন করেন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কতিপয় ধারণা ছাড়া সত্যিকারের জ্ঞান বলতে তাদের কিছুই নেই। তারা তাদের জীবনের বিস্তর সময় গবেষণাগারে কোন এক ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে এমনভাবে অতিবাহিত করেন যে, সন্তোষজনক কোন সমাধান পাচ্ছেন না। তারা সমাধানের দিকে যেভাবে আগান, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে মানুষের জীবননদী মুহূর্তে মুহূর্তে ধেয়ে চলছে সামনের দিকে। আর প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের সামনে খুলে দিচ্ছে নতুন নতুন সুযোগ ও অভিজ্ঞতার দুয়ার। অথচ বিয়োগান্তক সত্য হচ্ছে যে, মুহূর্তগুলো বয়ে যাচ্ছে, আর ফিরে আসছে না। তারা তো তাদেরকে ঘিরে নিয়তির এই নিরবিচ্ছিন্ন ক্রীড়া-কৌতুকের সামনেই অসহায়। কোন দার্শনিক কি এমন যে, সময়ের রহস্যকে পাঠ করবেন বলে সময় তার জন্য অপেক্ষা করেছে?
যেসব দার্শনিক মানবজাতিকে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যাবার মন্ত্র শুনান এবং বলেন যে, থিসিস, এন্টিথিসিস, সিনথিসিসের ধারায় ভুল করবে, সংশোধন করবে, আবার ভুল করবে, আবার সংশোধন করবে, তারা আসলে মানবজাতির মৌলিক জিজ্ঞাসার কোন জবাবই উপস্থাপন করেন না। তারা এক অন্তহীন শূন্যতার ভিতর মানবজীবনের উদ্দেশ্যহীন আবর্তন ছাড়া আর কিছুই নির্দেশ করেন না। এ জাতীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের মাধ্যমে কোথাও কোন জনগোষ্ঠী শুদ্ধ ও বুদ্ধ হয়েছে এবং ব্যক্তি তার জীবনযাত্রার বাঁকে বাঁকে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার সমাধান পেতে সমর্থ হয়েছে, এমন কোন নজির লক্ষ্য করা যায় না।
বস্তুবাদী দার্শনিকরা জীবনকে পূর্ণাঙ্গ রূপ ছাড়া আর বাকি সব পন্থায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত সমূহ মানুষের মৌল প্রকৃতির বিপরীত দিক থেকে এসেছে। ফলত মানবীয় সীমানা থেকে প্রতিটি সিদ্ধান্তই উত্থিত প্রশ্নের সম্মুখে লা জওয়াব দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলেন, মানুষের প্রকৃতি মূলত নিষ্ঠুর। তখন অন্য প্রকৃতির বাস্তব সক্রিয়তাকে তারা ভুলে যান। প্রেম ও মমতা কি মানুষের মৌলিক প্রবণতায় নেই? তারা বলেন হৃদয় মানুষের জন্য অসহনীয় বোঝা। কিন্তু হৃদয়ই তো মানুষের জীবনকে উদযাপনের প্রধান অবলম্বন। তারা একে কীভাবে পারেন উপেক্ষা করতে? তারা বলেন, মানবজীবন গোলকের মতো কষ্ট থেকে ক্লান্তিতে এবং ক্লান্তি থেকে কষ্টে আবর্তিত ক্রীড়াবিশেষ। কিন্তু জীবনের সুখ, স্বচ্ছন্দ্য ,প্রীতি, ভালো লাগা, ভালোবাসা ইত্যাদি না থাকলে কী নিয়ে বাঁচতে পারতো মানুষ, মানুষের সমাজ ও সভ্যতা? তারা বলেন অনমনীয় অস্বীকারের দৃঢ় ভিত্তির উপরই মানববসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু বিশ্বাস, আস্থা, নির্ভরতা ও স্বীকৃতি কি মানব জীবন ও সমাজের প্রধান সংগঠক নয়?
এইসব দার্শনিক নেতির কাছে সমর্পিত হয়েছেন। তারা বলেছেন– ‘জীবন শীলা ও আবর্তে পরিপূর্ণ সমুদ্রের মত। মানুষ সতর্কতার সঙ্গে একে পরিহার করে। যদিও সে জানে সব প্রচেষ্টার শেষে জাহাজডুবি সুনিশ্চিত।’ যে বিষয় সম্পর্কে তারা অন্ধ সে বিষয়কে তারা মিথ্যে বলেছেন। তারা বলেছেন- ‘আমরা এখানে সুখী না হলে, চিরদিনই অসুখী রবো’। ‘আমরা এ জীবন হারালে, সবই হারালাম। এটাই প্রথম ও শেষ’। ‘যা কিছু উপভোগ করবে এগুলোই তোমার।’ একটি জন্তুর জন্য কি চাই? মানুষকে এর চেয়ে বেশি দিতে আগ্রহী নন বস্তুবাদী দার্শনিকরা।
মানুষের জন্য তাই একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়ায়। সেটা হচ্ছে, জীবনকে সামগ্রিকভাবে বুঝবার চেষ্টা পরিত্যাগ করা। কেননা সে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাসমূহের উপর নির্ভর করে নিজস্ব চেষ্টার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ গণ্ডির বাইরে যেতে পারেনি এবং প্রতিবারই তার সিদ্ধান্ত জীবনের একটি ভগ্নাংশ নিয়ে আবর্তিত হয়েছে মাত্র। সমগ্রের উপলব্ধি মানুষের যুক্তির পদ্ধতিগত প্রয়োগক্ষমতার বাইরে থেকে গেছে। সে তার জীবনের জন্য পথ এবং পদ্ধতিকে কখনো সম্পূর্ণ এবং জীবন্ত রূপরেখায় প্রত্যক্ষ করেনি।
এর ফলে মানুষের জন্য দুটি পথ খোলা থাকে। একটি হচ্ছে, জীবনের লাগামটাকে প্রবৃত্তির হাতে তুলে দেয়া এবং আত্মবিস্মৃতির শূন্যগর্ভে হারিয়ে যাওয়া। অপরটি হচ্ছে জীবনবিমুখ হয়ে নিজের সত্তা থেকে পলায়নের চেষ্টা। অর্থাৎ এমন এক অন্ধউপত্যকায় সমাহিত হওয়া, যা বর্ণ, গন্ধ এবং সবধরনের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত। উভয়পক্ষের যে কোনটাই মানুষের জন্য অবলম্বন করা সম্ভব। এ জন্য কয়েক কদম অগ্রসর হলেই এর তিক্ত ফলাফল ব্যক্তির মানস, রুচি ও চরিত্র থেকে শুরু করে সমাজশৃঙ্খলা ও মানবসমষ্টির জীবনের অঙ্গনে ভূমিকম্পের মতো প্রকাশ পেতে শুরু করে। মানুষের জীবন তখন উদ্দেশ্যহীন এবং এর ফলে অর্থহীন পরিক্রমায় উপনীত হয়। বিভিন্ন প্রতিকূল শক্তির সাথে মানসিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জীবনের ঘানি টানাই হয়ে ওঠে তার দিনরাত্রির সাধনা।
সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অহরহ পরিবর্তিত হতে চায়। সে বদলায় সুখের উপকরণ, পছন্দ ও অপছন্দ এবং সে তার অতৃপ্তি ঘুচাতে আরো নতুন কিছু প্রত্যাশা করতে থাকে। এভাবে জীবনের কঠিন সংগ্রামে শক্তি জোগাবার ও নির্দেশনা দেবার উচ্চতর পৃষ্ঠপোষকতার অস্বীকৃতির ফলে তার যাপিত দিবসটি বিস্তর ভোগবিলাস ও অর্থকড়ির মধ্যেও পথের পৃষ্ঠায় অস্বস্তিকর কিছু বিক্ষিপ্ত পদচিহ্ন ছাড়া কিছুই স্থাপন করে না। এটা সেই বিভ্রান্তির ফল, ভুল গন্তব্যের কারণে যা অনিবার্য দাঁড়িয়েছে।
এ কারণে মানবজাতিকে তার সর্ববিধ উপকরণসহ অপেক্ষা করতে হয় সর্বশক্তিমানের আওয়াজ শোনার জন্য। যিনি মানবজাতি ও বিশ্বভুবনের স্রষ্টা। মানুষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যার কাছে সুস্পষ্ট এবং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কি কি বিষয়ের মুখোমুখি মানুষ হতে পারে, সবকিছুই তিনি অবগত। অতএব তার জন্যে এটা অযৌক্তিক ঠেকে যে, তিনি সর্বজ্ঞ হয়েও মানুষের মৌলিক জিজ্ঞাসার জবাব দেবেন না এবং মানুষ সৃষ্টি করেই ক্ষান্তি দিবেন, সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের জীবনযাত্রাকে কল্যাণময় করার জন্যে প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা নির্দেশ করবেন না। বিধিব্যবস্থা তিনি অবশ্যই নির্দেশ করেছেন এবং সেটার নাম ওহী।