spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্য'একবিংশ' সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে কি আমরা ভুলেই গেলাম?

স্মরণ : খোন্দকার আশরাফ হোসেন। লিখেছেন : ড. ইসরাইল খান

‘একবিংশ’ সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে কি আমরা ভুলেই গেলাম?

ড. ইসরাইল খান 

    ‘কবিতা ত্রৈমাসিক’ পরিচয় দিয়ে ‘একবিংশ ‘ প্রকাশিত হয়েছিলো আশির দশকের কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সম্পাদনায় নব্বই দশকের শুরুতে।

     তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। অতিরিক্ত পড়াশোনা করে এসেছিলেন বিলেত থেকে। কাব্যক্ষেত্রে একটু বিলম্বে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন বলে তাঁর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করত বলে মনে হয়েছে।  তিনি সত্তর দশকের কবি, নাকি আশির দশকের ! –এই ছিলো তাঁর মনঃকষ্টের কারণ। 

     মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলে তিনি হয় তো ভেবেছিলেন, আগে জীবিকার জন্য ভালো একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়া দরকার। পাশাপাশি লিখতে হলে ভালো পড়াশোনারও প্রয়োজন ! তাই  সত্তর দশকের অনেকটা সময় জুড়ে তাঁকে  একাডেমিক কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে হয়েছে । 

    খোন্দকার আশরাফ হোসেন জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ির জয়নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪৯ সালের জুন মাসে। তাঁর পিতার নাম নূর মোহাম্মদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগ থেকে  স্নাতক (১৯৭০) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (১৯৭১) নিয়ে তিনি পেশাগত বিদ্য়ায় পারদর্শী হওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। 

     সেখান থেকে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে যথাক্রমে  ডিপ্লোমা ইন টিচিং এবং ভাষাতত্ত্বে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায় থিতু হয়েছিলেন। তারপর তিনি কাব্যচর্চায় সিরিয়াসলি মনযোগী হন। তখন থেকেই তাঁকে আমরা চিনি এবং জানি।  কিছুটা ব্যক্তিগত আন্তরিক সম্পর্কও আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে কিংবা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনেও আমরা বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যিক আলোচনায় সময় কাটিয়েছি। তাঁর কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন কোথায় কিভাবে কিছু পাওয়া যাবে, সেসব  শলাপরামর্শও চলেছে আমাদের মধ্যে । বলা প্রয়োজন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন খুবই নিরহঙ্কার সাধাসিধে আটপৌরে মানুষ হিসেবে চলাফেরা করতেন। কিন্তু তাঁর মূল পেশা অধ্যাপনা, সাহিত্যচর্চা বা কাব্যিক চিন্তা-পরিকল্পনায় তিনি ছিলেন দৃঢচিত্ত কঠিন আত্মপ্রত্যয়ী ও  স্বতন্ত্র ধারার মানুষ, একজন ডেডিকেটেড পত্রিকা-সম্পাদক।

     ‘একবিংশ শতাব্দী’ সুদূর থাকতেই তিনি ঐ নামে একটি কবিতার কাগজ প্রকাশের চিন্তা তিনি করেছিলেন! এই চিন্তা যে খুব মৌলিক ছিলো না,  তা না বললেও চলে। কারণ শুধুই কবিতা ও কবিতা বিষয়ক আলোচনা সমালোচনার কাগজ বাংলা সাময়িক সাহিত্যের ইতিহাসে আগেও প্রকাশিত হয়েছে। সেসব তো মাথায় ছিলোই। তদুপরি কবিতা নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভিন্নতর বক্তব্যও ছিলো। নিজের  পত্রিকা না হলে মতবাদ প্রচার করা যায় না। সেই চিন্তা  থেকেই তিনি ‘একবিংশ’ প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর একটা বক্তব্য ছিলো– দশকওয়ারী  কবিদের বিভক্ত করার দরকা কী? কবি তো কবিই। যিনি কবি, তিনি সবসময়ের জন্যেই  কবি। কবির মৃত্যু হয় না। এবং কবির আবেদন কখনো শেষ হয় না। 

     একবিংশ কাগজের সম্পাদকীয় গুলোয় তিনি কাব্যান্দোলন ও কবিদের  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং  কবি ও কবিতার প্রতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন । তাঁর সম্পাদকীয় নিবন্ধগুলোতে রয়েছে অসংখ্য যুগোপযোগী সাহিত্যজগৎ নিয়ে ভাবনা ও চিন্তা। এগুলো বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহৃত হবে।  কারণ প্রচলিত ধারার চিন্তার বাইরে কারা আরও কী কী ভেবেছিলেন, তা ইতিহাসের ভাষ্য লেখার সময় জরুরি বিবেচিত হবে বৈকি ! 

   ডিসেম্বর ১৯৯০ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘অপকবিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে’  শীর্ষক সম্পাদকীয় বক্তব্যে  তিনি ঘোষণা করেন —

     ‘গত নয় বছর বাংলাদেশে স্বৈরকবি অপকবিদের সামাজিক দাপট আমরা ঘৃণার সাথে লক্ষ্য করেছি। গণমাধ্যম গুলোকে গ্রাস করেছিলো স্বৈরশাসকের দোসর কবি-সাহিত্যিক নামধারী কিছু সুবিধাবাদী লোক।  পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে, রেডিওতে, তাদের শকুন-ছায়া ক্রমাগত বিস্তৃত হতে হতে এক সময় ঢেকে ফেলেছিলো সমস্ত আকাশ। কবিতাকে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গভবনের গালিচামোড়া দরবার হলে। কবিতার লাশ ঠুকরে খেয়েছে টিভি-টাওয়ারে বসে থাকা গৃধিনী-শকুন। অপকবিতা এবার অপসারিত হোক, এ আমাদের  দাবি। “

      আর একটা সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিলো- ‘ কবিতা-বিরোধীরা ধ্বংস  হোক ‘– শিরোনামে। 

         ‘ কবিতার শত্রু শুধু অপকবিরা নয়, সাহিত্যের অন্য মাধ্যমেও কবিতা-বৈরীরা লুকিয়ে আছে।….কেননা কবিদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি তাদের ঈর্ষার বস্তু। ‘

      ‘ জাতীয় কবিতা পরিষদ ‘ সম্পর্কে লেখা হয় :

      ‘স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে কবিদের একাত্মতা ঘোষণা করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম হিসাবেই মূলত ‘ জাতীয় কবিতা পরিষদ’ পরিকল্পিত হয়েছিলো। সময়ের দাবি মেটানোর দিকেই এর লক্ষ্য প্রায় পুরোপুরি নিয়োজিত থাকায় কবিতার বা শিল্পের বৃহত্তর দাবির দিকে নজর দেয়া সম্ভবপর হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে  আমাদের আশা, জাতীয়  কবিতা পরিষদকে ঢেলে সাজানো হবে এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহকে স্পষ্টভাবে সনাক্ত করা হবে। ‘

     একবিংশ’র বিভিন্ন সংখ্যায় ব্রিটিশ,মার্কিন, আফ্রিকান ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রধান কবির কবিতা ও কবিতা বিষয়ক রচনার অনুবাদ করে প্রকাশ করে বাংলাদেশের সাহিত্যে বিদেশি ভাষার রাজনীতি সচেতন, রোমান্টিক ধারার আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক কবিদের বা বিশ্বসাহিত্যের চর্চা করা হয়েছে। 

       এতে আমাদের সাহিত্যসমাজ সমৃদ্ধ হয়েছে। অনিয়মিত ভাবে একবিংশ প্রায় বিশ বছর ধরে বেরিয়েছিল। এ র সাধনা ছিলো বিশ শতকের প্রারম্ভ থেকে একুশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত ব্রিটেন আমেরিকা ও বিভিন্ন দেশের কবিতার পালাবদলগুলো, বিভিন্ন কাব্যান্দোলন ও বিশ্বের প্রধান কবিদের সম্বন্ধে আলোচনা করা ও প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশ করা। 

      সেই সাথে রয়েছে সমকালীন উৎকৃষ্ট কবিতার অনুবাদ, লিটলম্যাগাজিন বিষয়ক সমীক্ষা ও কাব্যবিষয়ক বিখ্যাত প্রবন্ধাবলীর বাংলা ভাষায় রূপান্তর । 

    এই সময়টা ছিলো আবার স্বাধীনতা পরবর্তী সৃজনশীলতার কাল। জাতীয় জীবনে দুঃসময় দেখা দিলে তখন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাজ  বেড়ে যায়। ক্রান্তিকালের নানান সামাজিক রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনাশের প্রচেষ্টারত শকুনিদের প্রতিহত করার জন্য তখন শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন লেখক  কবি সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সুদিন উদ্ধার করে আনতে হয় ।

 খোন্দকার আশরাফ হোসেন এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ  তিন রমণীর ক্বাসিদা প্রকশিত হয়েছিলো ১৯৮৪ সালে। পার্থ তোমার তীব্র তীর (১৯৮৬), জীবনের সমান চুমুক (১৯৮৯), সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর (১৯৯১), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৫) প্রভৃতি তাঁর অপরাপর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। 

   তাঁর গদ্য-গ্রন্থ : বাংলাদেশের কবিতা : অন্তরঙ্গ অবলোকন (১৯৯৫)। অনুবাদ : সফোক্লিসের রাজা ইদিপাস (১৯৮৭), ইউরিপিডিসের মিডিআ (১৯৮৭), পাউল সেলানের কবিতা (১৯৯৭), সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের উপাদান (১৯৮৯), ফোক টেলস ফরম বাংলাদেশ (১৯৮৫), ফোক পোয়েমস ফরম বাংলাদেশ ( ১৯৮৫) প্রভৃতি। বাংলা একাডেমি বা অন্য কোনো মানসম্মত সাহিত্যপুরস্কার তিনি লাভ করার আগেই আকষ্মিকভাবে ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ! তাঁর সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কেবল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলাওল পুরস্কার (১৯৮৭)। 

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কিছু না কিছু কাজ দীর্ঘদিন পরেও আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই খুঁজে বের করতে হবে বলে আমার মনে হয়েছে। 

তাঁর সাহিত্যকর্ম দীর্ঘজীবী না-হলেও, একবিংশ’র ঐতিহাসিক তাৎপর্য স্বীকৃত হবে বলে আশা করা যায়।

 ৩০ মে ২০২১

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ