spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি আল মাহমুদের দিনযাপন

লিখেছেন : মুহম্মদ মতিউল্লাহ

কবি আল মাহমুদের দিনযাপন

মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

আল মাহমুদের ‘দিনযাপন’ প্রকৃতপক্ষে একজন কবির দিনযাপন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও দ্রষ্টব্য ‘দিনযাপন’ আত্মকথন গ্রন্থটিকে ধারণ করে আছে, কিন্তু তার ভরকেন্দ্রে আছে এক কবির দৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ যেমন নানাসূত্রে জীবনের ছিন্ন এবং একইসঙ্গে অবিচ্ছিন্ন জীবনপ্রণালীর রকমারি খণ্ডচিত্র। আল মাহমুদের ‘দিনযাপন’ আত্মজৈবনিক গদ্যগ্রন্থটিও কখনো শিল্পের কাছে আত্মনিবেদিত, কখনো মানুষের কাছে। দরবেশের অধ্যাত্মপ্রণিপাতের পাশে রক্তমাংসের গৃহীমানুষের অনিদ্র মর্ত্য-মানসতা পাশপাশি বিচরণ করছে এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়। কখনো প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ করে রেখেছে, কখনও নারী। কখনও প্রকৃতির সঙ্গে সহবাস, কখনও মানুষের অবিরাম আকাঙক্ষার পাশে। কিন্তু সবদিক থেকে বোঝা যায় একজন কবির দিনযাপনের যথার্থতা। বর্ষার অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিধারা যদি তার কোনো কোনো দুপুর সন্ধ্যাকে অলৌকিকতায় বাজিয়ে তুলেছে, কখনও চেনা অচেনা নারী তাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিচ্ছে দিবসযামিনী। উঁকি দিচ্ছে বাল্যের প্রেমিকার মুখ, কখনো চিরচেনা স্ত্রী তাঁর চোখের সামনে হয়ে উঠছেন অপার রহস্যময়ী শিল্পের অধরা মাধুরী।

একদিন ঝড়ো সন্ধ্যায় জানালার গরাদ ধরে আলুলায়িত কেশে তাঁর স্ত্রীকে বৃষ্টির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কবির মনে হয়েছে কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের একমাত্র প্রার্থনা-বৃষ্টির প্রার্থনা—তারই এক মূর্তিময়ী রূপ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, ওই অলৌকিক রমণী। যাকে এতকাল ধরে দেখে আসছেন কবি, এক সন্ধ্যায় তাঁকে মনে হল রহস্যময়ী সেই অচেনা রমণী কেশ বিশৃঙ্খলায় যার বৃষ্টির প্রতিচ্ছায়া—যা গোটা বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করে আছে। লক্ষ লক্ষ কিষাণ-কিষাণীর বৃষ্টির আকাঙক্ষা যিনি ধারণ করে আছেন দুহাতের দুষ্পাঠ্য কররেখায়। ‘এই যে চিরচেনার মাঝেও দুর্জ্ঞেয় একটা রহস্যসৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীশরীর, আমি কবিতায় সেই বিষয়েরই উপমা খুঁজে বেড়াই’। আমাদের মনে পড়ে যায় এই নারীকে উদ্দেশ্য করেই আল মাহমুদ তাঁর ভাষার রহস্যে ভর করে একদা লিখেছিলেন—

‘যখন জীবনে শুধু অর্থহীন লাল হরতন

একেএকে জমা হলো, বলো একি অসম্ভব বোঝা

মুক্ত হয়ে হাঁটবার বন্ধ হলো সব পথ খোঁজা এদিকে তুমিও এলে ঈশকার বিবি মতন।

তুমিই এনেছো ডেকে এতসব বারোয়ারী পাপ আমার মগজ যেন একাকার একতাল ছাই দু’চোখে ধুলোর ধাঁধা, ভাবি আজ কোথায় দাঁড়াই কেমন বিষাক্ত লাগে, যেন দুটি লিকলিকে সাপ নিজেদের গর্ত ভেবে ঢুকে গেছে আমার নাভীতে বিষাক্ত ছোবল তার দিনরাত বাসনার ভিতে অবিরাম ঠুকে ঠুকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এলিয়ে।’  (‘ব্রে’ নাদিরাকেঃ ‘লোক লোকান্তর’)

কবির কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে খুঁজতে খুঁজতে কবিজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আল মাহমুদ সারা নিসর্গ মণ্ডলকে করেছেন এলোমেলো। তারপর এক সময় মনেও হয়েছে তাঁর ‘নদীর সাথে নারীর তুলনা অর্থহীন।’ মনে হয়েছে ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর।’ কিন্তু নারীসৌন্দর্যের অমিত বিভাবনা তাঁর কাব্যের সব পর্বেরই এক শীলিত ঐশ্বর্য। যে সৌন্দর্য আমাদের কখনোই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর মনে হয়নি। ‘সোনালি কাবিন’ ‘কালের কলস’ ‘লোক লোকান্তর’ ‘প্রহরান্তরে পাশ ফেরা’– কাব্যগ্রন্থে প্রেমস্নিগ্ধ নারীর শরীরী বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে—

১.

যে নারী দিয়েছে খুলে নীবিবন্ধ লেহনে পেষণে আমি কি দেখেছি তার পরিপূর্ণ পিঠের নগ্নতা? হয়তো জংঘার পাশে ছিল তার খয়েরি জরুল লেহন লীলায় মত্ত যা আমার লেলিহান জিহ্বাও জানে না।’

   (আমি আর আসবো না বলে: সোনালি কাবিন)

২.

‘সামান্য চৌকাঠ শুধু তুচ্ছ করে এসো এই ঘরে বাসনার স্থিরমুদ্রা স্পর্শ যদি করে নাভিমূল কী হবে শরীর ঢেকে, জানালার পাট বন্ধ করে?’ (বধির টঙ্কার লোক লোকান্তর)

৩.

‘তাদের খোঁপা আর বেণী থেকে ছড়িয়ে পড়ছে নিসিন্দা নিংড়ানো কেশ তেলের গন্ধ তাদের বুণীতে, মাতৃত্বের ঈষৎ হেলানো গৌরব। তারা একযোগে এক কুটির বাসিনীকে আহ্বান করে আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো।’

একটি ঘর তার ঝাঁপ খুলে দিচ্ছে।

‘ঐ তো সে মেঘনার লাফিয়ে ওঠা কালো রুই। গোধূলিতে ঘর ফিরতি রাখালদের হাঁকডাকের মতো খুশিতে উপচানো। পড়ন্ত বেলায় লুকিয়ে পড়া সহস্র শালিক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর মতো দেহ তার। চোখ যেন রাজা মহীপালের দীঘি। আর বুক দুটি মিথুনরত কবুতর। তার নাভিরন্ত্রের ভেতর একটি ভরত পাখির মতো আমি অনন্তে হারিয়ে গেলাম।’

  (অস্পষ্ট স্টেশনঃ আরব্য রজনীর রাজহাঁস)

নিসর্গমণ্ডলীকে ওলটপালট করেই প্রকৃতপক্ষে আল মাহমুদ নারীর উপমা খোঁজেন। তাঁর নারীর নাবিরন্ধ্রে মুখ ঢাকে ‘ভরতপাখি’। মেঘনার প্রাণবন্ত রুই মাছের লাফিয়ে ওঠার ভেতর জেগে থাকে মৎস্যকন্যাসদৃশ রমণীর উচ্ছ্বলতা,—মহীপালের দিঘির গভীরতা আর অতীত আশ্রয়ী ধূসরতায় ভরে যায় দুচোখ। আবহমান লোকজ বাংলার প্রেক্ষাপটে নিহিত প্রাকৃত সৌন্দর্যের রূপায়ণে আল মাহমুদের নারীরা হয়ে ওঠে অসামান্য। নারীর সৌন্দর্যের এই অনুসন্ধান যে কবির একটি সচেতন প্রয়াস এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। লোকজ বাংলার এই রূপের সন্ধান আমরা আল মাহমুদের আগে দেখেছিাম জসীমউদ্দিনের কাব্যজগতে। অবশ্য তা আল মাহমুদের মতো যথার্থতা অর্জন করতে পারেনি। আল মাহমুদ খুব সচেতনভাবে নারীরসৌন্দর্যের সন্ধান করেছিলেন বঙ্গদেশীয় প্রাকৃত নারীর রূপের মধ্যে। বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন থেকে আধুনিক কবিতা পর্যন্ত রূপসী নারীদের যে অঙ্গসৌষ্ঠব, সেখানে আর্যকন্যাদেরই গুরুত্ব। তাঁর স্বাতন্ত্র্য এখানেই, তিনি নিম্নবর্গীয় বাঙালি রমণীর সৌন্দর্যকেই আঁকতে চেয়েছেন, যার সুস্থিত শ্যামশ্রী প্রকাশ আমরা চকিত দেখেছি রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’তে। আল মাহমুদের কাব্য ভাবনায় ‘আর্যীকৃত শ্বেতপুত্র রমণীদের রূপ নয়—তিনি কবিতায় আনতে চেয়েছেন সেইসব কাজল কালো রাত্রিবরণ লাবণ্যবতীদের কথা, যারা বাংলার গ্রামাঞ্চলে জেলে মাঝি কামার কুমোর পটুয়া প্রভৃতি বাংলার প্রাচীন বৃত্তিতে নিযুক্ত গৃহস্থের ঘর আলো করে আছে।’ আল মাহমুদ অহংকারী ভাষায় জানিয়েছেন ‘আমার কবিতায় এ কাজটি সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছি। নারীর কথা আমি আজ পর্যন্ত যত কবিতায় বলেছি কালো মেয়ের কথাই বলেছি। আমাদের কাঙালিনী বাঙালিনী যুবতীরা যে মহৎ শ্যামশোভা ধারণ করেন তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির রমণীর মধ্যে আমি পাইনি।’ তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশের আগে এক চিঠিতে এ-গ্রন্থের প্রচ্ছদের ফরমাশ জানিয়ে শিল্পীবন্ধু হাশেম খানকে কথাগুলি লিখেছিলেন তিনি।

পরবর্তীকালে নিজের বিশ্বাসের জগৎকে পালটে ফেলেন আল মাহমুদ। নারীর উত্তুঙ্গ সৌন্দর্যের এই খেলা এক সময় অবসিত হতে চাইলো কি! মনে হয়েছে তাঁর ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর।’ তখন নদীর সঙ্গে নারীর তুলনা মনে হয় অর্থহীন। কাব্যসমগ্র প্রকাশের প্রাক্কালে আল মাহমুদ বলেছিলেন কবিকেও কোথাও না কোথাও পৌঁছাতে হয়। একদিন ফিরে আসতে হয় পৃথিবীর মায়াবী পর্দা ছেড়ে। কত ভালোবাসার হাত অবশেষে শিথিল হয়ে পড়ে… নিঃসঙ্গ কবির মনে প্রশ্ন জাগে সে তবে কোথায় যাবে? একটা পর্বে এসে আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন।

    ‘দিনযাপন’-এর তৃতীয় অধ্যায়ে তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন কবি। বিশ্বজগতের, সৃজন রহস্যের ঘোরটোপে কবি যখন ‘দ্বিধার-সমুদ্রে কম্পমান’, এবং মানবজাতির প্রগতির ধারাবাহিক বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাস অধ্যয়নর মধ্যে মানুষের দারিদ্র্যের অসাম্যের প্রতিকারসূত্র খুঁজেছেন এমন একটি সময়ে, একটি র‍্যাডিক্যাল পত্রিকা সম্পাদনার অপরাধে কারাবাসকালে (১৯৭৫) অনেকটা আকস্মিকভাবেই তাঁর হাতে এল ‘পবিত্র কোরান’।

যে গ্রন্থের নিবিড় অধ্যয়নে তাঁর বিশ্বাসের জগতে আসে পরিবর্তন। এই উপলব্ধির কথা প্রসঙ্গেই কাব্যসমগ্রের ভূমিকায় লিখেছিলেন আল মাহমুদ ‘মানবরচিত কোনো নীতিমালা বা সমাজব্যবস্থায় মানুষের কাম্য সুখ, আত্মার শান্তি বা স্বাধীনতা কোনোটাই সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। হলে কবির স্বপ্ন, দার্শনিকের অনুসন্ধিৎসা বা সমাজবিজ্ঞানীর বিপ্লবচিন্তা পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য নামিয়ে আনতে পারত। পারেনি যে এতে কবি বা বিজ্ঞানীর কোনো হাত নেই। এতে যাঁর হাত তিনি কবি দার্শনিক বা বিজ্ঞানীর প্রতি করুণাধারা প্রবাহিত করলেও পক্ষপাত দেখিয়েছেন অন্যধরনের মানব শিক্ষকগণেক প্রতি।’ ‘দিনযাপন’-এ কোরান পাঠের সেই উপলব্ধির কথাই জানিয়েছেন কবি। পেয়েছেন বিশ্বপ্রকৃতি ও সৌরজগতের গতিময় শৃঙ্খলার অদৃশ্য অঙ্গুলি সংকেত। শুধু তাই নয়, কবি বিস্ময়বোধ করেছেন, ‘আমার মতো কবির বিভ্রান্ত হয়ে পৃথিবীর উপত্যকায় ঘুরে বেড়ানোর জ্বালাময় জীবনকথাও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সে গ্রন্থে।’

ঈশ্বর বিশ্বাসী যে কবি আত্মার শান্তি, প্রাণের আরামের সন্ধানে সবের মধ্যেই দেখেন ঐশ্বরিক করুণা, মৃত্যু চিন্তা তাঁকে যে ভাবিয়ে তুলবে তাতে আর সন্দেহ কি! নিজের কবিতা পাঠকালেই মৃত্যুর হিমশীতল অনুভূতি নিজেকে বিপন্ন করে তুলছে —এমনতর ঘটনার বর্ণনায় তাঁর দিনযাপন কখনো হয়ে উঠছে বিষণ্ণ ধূসর! আধ্যাত্মিকতায় গৈরিক। আর সরলতায় রহস্যময়। সংবেদনশীল পাঠকের মনে পড়ে যাবে ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ কাব্যগ্রন্থের ‘শ্রাবণ’ কবিতাটি, যেখানে মৃত্যুর রকমারি উপমায় উৎকীর্ণ পঙ্ক্তিমালা অসংখ্য মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে কবিকে; কিংবা ‘একচক্ষু হরিণ’-এর ‘কবর’ কবিতাটির যেখানে কথা। প্রাচীন এক ভগ্নস্তূপের মাঝে কবরের মন্ত্রিত নিস্তব্ধতার পাশে স্বপ্নের নারীকে প্রথম ছোঁয়ার সাহসের ভেতর জমা ছিল অনন্ত ভয় আর শিহরন। যেখানে ঘুঘু পাখি ডাকে ভাঙা কবরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জারুলের ডালে। কবরের ভেতরে দৃষ্টি মেলে দেখেছেন কবি, ‘তোমার ক্ষুব্ধ চোখের মতো অসংখ্য ভাঁট ফুল ফুটে আছে।’

     অষ্টম পরিচ্ছেদে আল মাহমুদ নিজের কিছু আত্মমগ্ন কবিতার পাঠ প্রতিক্রিয়া শোনাতে চেয়েছেন। কবির কণ্ঠে তখন বিষণ্ণতার সুর। চট্টগ্রামের ‘মেজবান কবিরা’ টেপরেকর্ডারে ধরে রাখতে চান কবির কিছু নিচুস্বরের কবিতা। তিনি রাজি হলেন ঠিকই। কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে ক্রমশ বিষাদ ঘনিয়ে এল তাঁর কণ্ঠস্বরের রকমারি অন্ত্যমিলে। তাঁর মগ্নপাঠের মাঝেই হঠাৎ ‘সিজদারত দরবেশের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে’ উঠলেন কবি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে এল মৃত্যুর রকমারি উপমাখচিত ‘শ্রাবণ’ কবিতাটি। ‘শিরোনাম উচ্চারণের সাথে সাথে আজ পর্যন্ত আমি যত প্রিয়জনের চাক্ষুস মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি, সে সব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল।’ হয়তো তখন কবির আর একবার মনে হয়েছে জাগতিক সব সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত ক্লান্তিকর। কবিকেও শেষপর্যন্ত ফিরে যেতে হয় পৃথিবীর মায়াবী পর্দা ছেড়ে এবং সমস্ত ভালোবাসার হাত একদিন শিথিল হয়ে ঝরে যাবে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ক্রন্দনভারাতুর কবি ঘুমিয়ে পড়ে পৌঁছে যান এক স্বপ্নের জনপদে। আটচালা একঘরের কেয়ারটেকার বিষণ্ণ যুবতীকে কবি জানালেন ‘এই বাড়িটাতে একদা আমি জন্মেছিলাম। ওই-যে সজনে গাছটা, এর গায়ে এখনো আমার নাম লেখা আছে। ওই দ্যাখো, আমার নামের বানান থেকে এখনো ঝরছে হলুদ কষ। আমাকে কি এ অঙিনায়, ঘরের আসবাবপত্রের কাছে একটু যেতে দেবে?’ প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে ‘প্রকৃতি’ নামের সেই তরুণী জানায় ‘যারা একবার এখান থেকে যায় তারা যেন ফিরে না আসে। কারণ যারা ফেরে তার তো স্বপ্ন দেখে না। যাদের স্বপ্নের মৃত্যু হয় তারা কি আর কবি থাকে?’ স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারে ভয়ে নিজেকে মৃত ঘোষণা করবে না কবি। ঘুম ভেঙে তাই তিনি আবার নতুন জীবন এবং আনন্দ খুঁজতে চান। সেইসব তরুণ কবিদের সঙ্গে সমুদ্র দেখতে উঠে যান যেখানে ‘প্রকৃতি’ নামের সেই বিষণ্ণ মেয়েটি তরঙ্গ হয়ে নাচবে। হয়তো তখনি আমরা তাঁর কবিতার পাঠকেরা কিছুটা বুঝতে পারি আমরা তাঁর দৈব নির্ভরতা আসলে কবিতার রহস্যময়তার অনুসন্ধানের অন্য নাম। তাঁকে বলতে শুনি ‘শুধু কবিতার জন্য, রহস্যময় কবিতার জন্য আমি যেন চিরকাল দৈবে বিশ্বাস রেখে বাঁচতে পারি।’

  বিস্ময় ও দৈবের এই দেশ ছেড়ে বেরুলে এ গ্রন্থের আর একটি ভূমিতে পাঠক পৌঁছে যাবেন। রকমারি সমাজিকতাস্পৃষ্ট কবির পরিপার্শ্ব, যেখানে রয়েছে তাঁর জীবনযাপনের নিত্য সহচরেরা। তাঁর নগরজীবন, কবিবন্ধু, সামাজিক মানুষেরা। কবি আল মাহমুদের অলৌকিক এক হাত ছুঁয়ে আছে স্বর্গলগ্ন (কিংবা স্বর্গভ্রষ্ট) মানব-মানবীর শিথিল উড়ালের অলীক রাজ্যে। আর একটি লৌকিক হাত ছুঁয়ে আছে তাঁর বাংলাদেশ, বঙ্গদেশ; তাঁর ঢাকা শহর আর অগ্রজ অনুজ কবিবন্ধুদের রকমারি অনুষঙ্গ। তাঁর সমসাময়িক কবি সংগীতশিল্পীদের নিয়ে যেমন তিনি মত প্রকাশ করেছেন, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন তেমনি কিছু চেনা অচেনা মানুষের ছবি এঁকেছেন—যে মানুষেরা অনেক সময় হয়ে উঠতে পারে ঔপন্যাসিক চরিত্র। ঢাকা শহরকে আমরা একভাবে চিনেছিলাম প্রতিভা বসু-র ‘জীবনের জলছবি’ থেকে। বুদ্ধদেব বসু-র পুরানো পল্টনের ছবিও আমাদের চেনা হয়ে আছে। আল মাহমুদ সেই ঢাকা শহরকে দেখেছেন তার নাগরিক জীবনের নানা সুবিধা-অসুবিধা আর অতীতচারণায়। নাগরিকজীবনের অসুবিধের কথা জানিয়ে আল মাহমুদ লিখেছেন ‘দেশলাইয়ের বাক্সের মতো যে ফ্ল্যাটে আমি থাকি তাতে ছেলেমেয়ে বউ কাছের মানুষ মিলে মোট ১২ জন। কারও কোনো নিজস্ব ঘর নেই। সকলেই যৌথ অবস্থায় একধরনের আড়ালি ও সাবধানতার মধ্যে দিনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।’…ঢাকার অতীত ঐতিহ্য আর বর্তমান ব্যস্ত নাগরিকতার ভেতর দোয়েলের ডাক, ‘মুয়াজ্জিনের’ ভোরের আজান আল মাহমুদকে একাকি পুলকিত করে। ‘…আমি যখন ঢাকায় আসি তখন পর্যন্ত মোগলদের এককালের এই প্রাদেশিক রাজধানী এর অতীত অভ্যাসগুলির সবটুকুই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কেতাদুরস্ত ছিমছাম গোলামির কাছে বিসর্জন দেয়নি। তখনও ভিস্তিওয়ালারা চামড়ার মশক কাঁধে নিয়ে শীতের সকালে বাড়ি বাড়ি পানি ফেরি করত আর রাস্তাঘাট তাদের সিক্ত পায়ের ছাপে ভিজা থাকত।’…কিন্তু কালের দৌরাত্ম্যে ঢাকার সে ঐতিহ্য মুছে গেলেও এখনো মলিন হয়নি ‘দিগন্তভেদী ভোরের আজানের মহিমা’ এবং ভোরের দোয়েলের শিস (পাঠকের মনে পড়বে নিশ্চয় বরিশালবাদী জীবনানন্দের কলমে রূপসী বাংলার ছবি, ‘চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি’)। কিন্তু কবির সবসময় মনে হয় ‘আমি ছাড়া আর কোনো নগরবাসীর কাছে এই মধুর পাখির ডাক বুঝি ঠিকমতো পৌঁছুচ্ছে না।’

চট্টগ্রামের তরুণ কবিদের আহ্বানে কবিতার অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামকে চোখে জলে ভিজিয়ে এসেছেন বিষণ্ণ-করুণ মৃত্যুভাবনাতাড়িত কবি। কবিতার অনুষ্ঠানে সেইভাবেই এক আন্তরিক আহ্বানে কবি চলে আসেন কুমিল্লা শহরে। সে শহরেরও অতীত ঐতিহ্য কবিকে আকর্ষণ করে। কবির মনে পড়ে এই শহর একদিন আশ্রয় দিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুকে, সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে। প্রাচীন সেই কুমিল্লা শীলভদ্রের জন্মস্থান, বৌদ্ধ পণ্ডিত দার্শনিক শ্রমণদের মহাবিহার, এবং চর্যার কবিদের আশ্রয়স্থল। ‘কত চারণকবি এখানেই তাদের চর্যাকাব্যের শ্রেষ্ঠ পদগুলি রচনা করে এক রহস্যময় সন্ধ্যাভাষার সুষমায় জনগণের অন্তরে প্রবেশ করে অমর বলে গণ্য হয়েছেন’। সেখানে কবির জন্য অপেক্ষা করেছিল আরও এক বিস্ময়। কবি নজরুল ইসলামের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহরের কাছে একটি গ্রাম গোপন অকথিত যন্ত্রণার ইতিহাস বহন করে। নজরুলের প্রথমা পত্নী নার্গিস আসার খানম— বিয়ের রাত্রেই নজরুল যাকে ত্যাগ করে চিরকালের জন্য চলে আসেন। অনেক ব্যথাগীতি নজরুল পরবর্তী জীবনে তাঁকে কেন্দ্র করে রচনা করেছেন। কুমিল্লা শহর থেকে দূরে দৌলতপুরে ‘সেই প্রাচীন নোনাধরা বাড়িটার সামনে’ এসে দাঁড়ালেন কবি, যেখানে জন্মেছিলেন ‘কবি নজরুলের প্রথম নারী নার্গিস’। সেখানে কবির সঙ্গে, পরিচয় হয় এমন এক বৃদ্ধার সঙ্গে বাসর রাতে যিনি ‘ষোড়শী অবগুণ্ঠিতা নার্গিস আসারকে নজরুলের পালঙ্কে তুলে দিয়ে এসেছিলেন।’ সেই রাত্রেই, নজরুল জীবনবৃত্তান্তের পাঠকেরা জানেন, গোপন ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে নজরুল ‘অন্ধকারের নৌকায়’ নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেন। আর ফেরেননি। কবিকে বলেছিলেন সেই সদ্য পরিচিতা বৃদ্ধা, সম্পর্কে যিনি নার্গিসের ভ্রাতৃবধূ, ‘আপনিই বলুন, ষোলো বছরের এক যুবতীকে যদি তার সদ্য বিবাহিত স্বামী চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যায় তবে তার দীর্ঘশ্বাসে কি পাথরও বিদীর্ণ হয় না?’ নিরুত্তর কবির সেদিন শুধুই মনে হয়েছিল ‘প্রকৃতি এখানে এমন বিষণ্ণ যে, না এলেই বুঝি ভালো হত।’

ঠিক এমনি নাটকীয় মুহূর্তের সামনে আরও একবার অন্তত মুখোমুখি হবেন আল মাহমুদ, এক শোকসভায় কবি জসীমউদ্দিনকে দেখে। নজরুল সমকালীন কবি শাহাদাৎ হোসেনের মৃত্যু পরবর্তী শোকসন্তপ্ত স্মরণ সভায় আল মাহমুদ লক্ষ করেন ‘কবি জসীমউদ্দিনের নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্র তার শোকার্ত দীর্ঘ অবয়ব এসে মাইকের সামনে দাঁড়াল।’ এরপর জসীমউদ্দিনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন আল মাহমুদ। বাইরে থেকে তাঁকে মনে হত ‘অমিশুক অহংকারী’। কিন্তু তাঁর ভেতরে আল মাহমুদ দেখেছিলেন ‘শেষ জীবনের নৈঃসঙ্গের অসহনীয় যাতনা।’ এটা বুঝতেন বলেই জসীমউদ্দিন তাঁর প্রতি খুব প্রীত ছিলেন। পরবর্তী জীবনে সব মেলামেশা ছাপিয়ে তিনি সেই শোকসভায় এক কবির জন্য আর এক কবির অকপট বিলাপের চিত্রটি ভুলতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই মনে হত আল মাহমুদের ‘তিনি যেন সবসময় কারও বিরহে বালকের মতোই কাঁদছেন’।

সমকালীন তরুণ কবিরা জসীমউদ্দিন সম্পর্কে খুব উৎসাহী ছিলেন না। বরং তরুণ কবিদের এক ধরনের নিরাসক্তি কাজ করেছিল জসীমউদ্দিন বিষয়ে। আল মাহমুদ জসীমউদ্দিনকে বুঝতে চেয়েছিলেন অন্যভাবে। জসীমউদ্দিনের কবিতার ‘আঙ্গিক গঠনরীতির সারল্য’ কে লক্ষ করার চেয়ে আল মাহমুদ মনে মনে মূল্য দিতেন ‘তার আকস্মিক আবির্ভাবের গৌরব’কে, ‘স্ব-সমাজের সহজ প্রকাশভঙ্গির মাধুর্য’ কে। মনে মনে জসীমউদ্দিনের কাব্য ভুবনের সঙ্গে নিজে একধরনের সামীপ্য অনুভব করতেন। আল মাহমুদের চোখে জসীমউদ্দিনের কাব্যের

বিষয়বস্তু ‘গ্রাম্য শস্য নারী, নৌকা, চর ও দিগন্তের ব্যাপকতায় ভাসমান কর্মঠ মানুষ এবং তাদের অনার্যবাকভঙ্গি’। আল মাহমুদ খুব অপরিহার্যরূপে এগুলিকে তারও কাব্যের বিষয়বস্তু রূপে জেনেছিলেন। তাঁর কবিতায় আমরা সেই গ্রাজীবনের শিকড় অভিলাষী চৈতন্যকে অন্য আলোয় প্রত্যক্ষ করি নিবিড়ভাবে। জসীমউদ্দিনের কাব্যভাষার সরলতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে ‘প্রকৃত কবিহৃদয়’-এর সন্ধান পেয়েছিলেন, আল মাহমুদের ভাষায় সেই কবিহৃদয়টি একজন পূর্ববঙ্গীয় কিষাণের কবিহৃদয়, ‘যার আগে সেই দুষ্প্রবেশ্য অঞ্চল থেকে কোনো কবি-প্রতিনিধির দু’শতাব্দীর মধ্যেও প্রবেশ ঘটেনি, নিজেকেও আল মাহমুদ সেই দুষ্প্রবেশ্য অঞ্চলের উত্তরাধিকারী হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। জসীমউদ্দিনের বিষয় যে গ্রাম উদার নৈসর্গিক পরিবেশ তা তার নিজের জন্য, এমনকি যারা ওই চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির পাশে ‘কোনো নদীর পাড়সংলগ্ন গ্রাম অথবা নতুন জেগে ওঠা চরের মাটিতে জন্মেছেন’ তাদের জন্য অপরিহার্য ভেবেছেন কবি। এই ভাবনার মধ্যে তাঁর এক সরল সততার প্রকাশ দেখি আমরা। জসীমউদ্দিনের যে কাব্যভুবন, সরল আঙ্গিক-সৃষ্ট, আলমাহমুদ এই সরলতাকে আপন মৌলিকত্বে করেছেন রহস্যময়, দিগন্ত প্রসারী, কিষাণের হৃদয়ের চেয়ে সেখানে অনেক বেশি বাগ্ময় চিরকালীন আধুনিক জীবনজিজ্ঞাসু ! আধুনিকতা যাঁর কাছে ঐতিহ্য অনুসারী এক ক্রমপর্যায়। এক অবিরল প্রবহমানতা। সরল, কিন্তু রহস্যময় সহজতায় ভরা। জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আল মাহমুদের পার্থক্য এখানেই।

আল মাহমুদের ‘দিনযাপন’ আত্মকথনধর্মী গদ্য গ্রন্থটি আপন অভিজ্ঞতার মহিমায় উজ্জ্বল। আশ্চর্যসুন্দর নিজস্বতায় তাঁর গদ্যভাষা আমাদের মুগ্ধ করে। নানা পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এ গ্রন্থ কবি আল মাহমুদের কাব্যভাবনার যেমন প্রকাশ, তেমনি তাঁর সামাজিক মানুষ হিসেবে দিনযাপনের অভিজ্ঞতায় সহজ ছন্দময়। মৃত্যু ভাবনায় এ গদ্য যেমন বিষণ্ণ, কবির ধর্মদর্শন দেশজ সংস্কৃতি লোকাচারের বিবিধ বিন্যাসে তেমনি এক রহস্যলীন অলৌকিক আভিজাত্য ছোঁয়া। সব মিলিয়ে এ গ্রন্থ আমাদের আকৃষ্ট করে। ২০০৬ এপ্রিলে এ গ্রন্থের ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ‘প্রতিভাস’ আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে থাকলেন অসাধারণ মুদ্রণ পারিপাট্যের জন্যও।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ